প্রমত্তা পদ্মাকে বলা হয় দ্বিতীয় খরস্রোতা নদী। শুকনো মৌসুমে বিভিন্ন জায়গায় চর জেগে থাকলেও বর্ষা মৌসুমে রুদ্ররূপ ধারণ করে। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় নদীর গতিপথে আঁকাবাঁকা স্থানে ভাঙন হয় প্রবল।
বর্ষায় উজান থেকে তীব্র গতিতে নেমে আসা ঢল নদীর বাঁকে আছড়ে পড়ে। ফলে নদীর তলদেশ গভীরতা সৃষ্টি করে বাঁকসংলগ্ন তীরে তীব্র ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এভাবেই পদ্মার পাড় বিস্তৃত হয়।
এরসঙ্গে যোগ হয়েছে পদ্মা বহুমুখী সেতুর ৪১টি স্প্যানসহ ৪০টি পিলার। এগুলো স্থাপিত হওয়ায় আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে পদ্মা। এতে তীর ও চর ভাঙনের শঙ্কা তীব্রতর হচ্ছে।
এরই মধ্যে ১৭টি পিলার সংলগ্ন এলাকায় চর জেগে উঠায় ভাঙন বাম তীরে প্রসারিত হতে পারে। পাশাপাশি ঘটেছে নদীর মরফোলজিক্যাল (রূপগত) পরিবর্তন। এতে প্রকল্পের মধ্যবর্তী বিভিন্ন স্থানে নতুন করে নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে।
এসব স্থানে ভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে প্রকল্প এলাকাও ভাঙন কবলিত হয়ে পড়তে পারে। এরইমধ্যে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং ও টঙ্গীবাড়ী এবং শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার অসংখ্য গ্রাম। ঝুঁকিতে আছে এসব এলাকার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, হাসপাতালসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট সূত্র এবং লৌহজং-টঙ্গীবাড়ী ও জাজিরা উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা সরেজমিন ঘুরে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ভাঙন ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সাড়ে চারশ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু কোনো কার্যকর ফল আসছে না। ২০ কোটি টাকা খরচের পর প্রকল্পের মনিটরিং সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সভায় কাজের নকশা পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক দেওয়ান আইনুল হক। কারণ লৌহজং উপজেলার সামনে চ্যানেল তৈরি করা একটি চর হঠাৎ অপসারণ হয়ে মূল পদ্মায় মিশে গেছে।
সেখানে এখন ১২ থেকে ১৫ ফিট পানির গভীরতা। যে কারণে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ পদ্মার বাম তীরের প্রায় সাড়ে ৮ কিলোমিটার এলাকা চিহ্নিত করা হয়। এখন চর অপসারণ হওয়ায় ১৮ কিলোমিটার এলাকাকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। অন্যদিকে জাজিরা এলাকাকে ভাঙনমুক্ত রাখতে ১১শ৭৩ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব করেছে শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড।
এবার বর্ষা মৌসুমে ভয়াবহ চিত্র দেখা যেতে পারে পদ্মার বাম তীর অর্থাৎ মুন্সীগঞ্জের লৌহজং ও টঙ্গীবাড়ী উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। এর কারণ হিসাবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, সেতুর ১৭টি পিলারসংলগ্ন এলাকায় চর জেগে উঠায় ভাঙন বাম তীরে প্রসারিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। সরেজমিন দেখা গেছে, এই বর্ষায় বিলীন হয়ে যাবে-এমন আশঙ্কায় বাড়িঘর তালাবদ্ধ করে অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন। ভাঙনের তীব্রতা সম্পর্কে ক্ষতিগ্রস্তদের মন্তব্য, ‘এটা ভাঙন নয়, পদ্মা গিলে খাচ্ছে এলাকা।’ ইতোমধ্যে কয়েকটি ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
আইডব্লিউএম’র (ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং) সমীক্ষা প্রতিবেদনেও পদ্মা বহুমুখী সেতুর প্রভাবে নদীর ডান ও বাম তীর ভয়াবহ ভাঙনের তথ্য তুলে ধরা হয়। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, পদ্মা পলিবাহী শক্তিশালী নদী। এই নদীতে ৪১টি স্প্যানসহ ৪০টি পিলার স্থাপন করা হয়েছে। এরফলে নদীর তীর ও চর ভাঙন বেড়ে যেতে পারে। নদী ভাঙন ঠেকাতে উজান ও ভাটিতে নদী ড্রেজিংয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম রোববার বলেন, পদ্মা হচ্ছে সুইংয়িং রিভার (দোলায়মান নদী)। আমার রিপোর্টেও আছে। এই নদী ভাঙন কয়েক বছর এ পাড়ে কয়েক বছর থাকে ওই পাড়ে। আমার কাছে ৩০ বছরের স্যাটেলাইট ম্যাপ আছে। সেখানে দেখা যাবে কিভাবে দুই পাড়ে সুইং করেছে। এখন লৌহজংয়ে ভাঙবে আবার ওই পাড়ে ভাঙবে। সরকারকে এখন ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে ভাঙন হতেই থাকবে।
তিনি বলেন, ৪০টি পিলারের কারণে পদ্মায় একটি প্রভাব পড়তেই পারে। সরকার পদ্মা সেতু করেছে জনগণের সুবিধার জন্য। সুবিধা করতে গিয়ে অসুবিধা যাতে না হয় সেজন্যই তো ১৫০ মিটার স্প্যান দেওয়া হয়েছে। যমুনায় ছিল ১শ মিটার স্প্যান। সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে যাতে ক্ষতিটা কম হয়।
তিনি বলেন, নদী শাসন এমনভাবে করা হয়েছে যাতে ১শ বছরের আগে না ভাঙে। কারণ পদ্মা সেতু একটি স্বপ্নের নাম।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু এলাকায় আমাদের আড়াইশ মিটার জায়গা আছে। যখন প্রয়োজন হয় পিলার এলাকায় ড্রেজিং হয়, সেখানে ৫ থেকে ১০ হাজার সিএফটি বালি হয়। আমার একটি ড্রেজার বালি কাটলে ৫শ বাল্কহেড নিতে পারে। সেটা এখন বসে আছে। পুলিশকে বলে দেওয়া হয়েছে অবৈধ বালি উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চর হয় আবার চর এমনিতেই অপসারণ হয়। শিবচরে বিশাল একটি এলাকায় চর ছিল। সেটি আর এখন নেই। যেখানে বিমানবন্দর করার কথা শুনেছিলাম। এখন সেখানে চরের কোনো অস্তিত্বই নেই। পদ্মার চরিত্রই এটা। এখন নদীটা ওইদিকে (লৌহজংয়ের দিকে) যাচ্ছে। সেখানে ছোট নদী ছিল। সেটা মূল পদ্মায় মিশে গেছে।’
তিনি বলেন, ড. আইনুন নিশাদ স্যার বলেছেন পদ্মাকে শাসন করা খুবই কঠিন। এই নদীকে ছোট করা যাবে না। আমরা নদীকে ছোট করিনি। আমরাও চাই নদী পুরোটাই থাকুক।
জানতে চাইলে পাউবোর তত্ত্বাধায়ক প্রকৌশলী দেওয়ান আইনুল হক বলেন, পদ্মা সেতুর উজানে মূল পদ্মা নদীর তীর প্রতিরক্ষায় জন্য প্রতি মিটারে ১৮৭ ঘনমিটার ডাম্পিং ম্যাটেরিয়ালস ধরে তীর প্রতিরক্ষা কাজের ডিজাইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হয়।
পদ্মা সেতুর আড়াই কিলোমিটার ডাউনে পদ্মা নদীর একটি শাখা চ্যানেলে (পদ্মা নামে পরিচিত) অবস্থিত ছিল। সে অনুযায়ী প্রতি মিটারে অবস্থানভেদে সর্বোচ্চ ৪৫ ঘনমিটার ডাম্পিং ম্যাটেরিয়ালস ধরে ডিজাইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু বর্তমানে মূল পদ্মা নদী ও শাখা চ্যানেলটির মধ্যবর্তী অংশের চরটি নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় শাখা চ্যানেলটি মূল পদ্মায় রূপ নিয়েছে। ফলশ্রুতিতে, বর্তমান ডিজাইন অনুসারে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করলে কাজটি টেকসই না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নদীর মরফোলজিক্যাল পরিবর্তনজনিত কারণে পাউবো প্রকল্পের মধ্যবর্তী বিভিন্ন স্থানে নতুন করে নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। উক্ত স্থানগুলোতে ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে প্রকল্প এলাকাও ভাঙন কবলিত হয়ে পড়বে।
অপর আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অপরিকল্পিতভাবে বালি উত্তোলনের একটি প্রভাব পড়েছে জনবসতি এলাকায়। বিষয়টি আমি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একটি সভায় উত্থাপনও করেছি। সেতু কর্তৃপক্ষ নিজেরা মনিটরিং করার কথা জানিয়েছেন।
ভাঙনের তীব্রতা : অনুসন্ধানে জানা গেছে, পদ্মা নদীর ভাঙনে জাজিরা উপজেলার বড়কান্দি ও পালেরচর ইউনিয়নে প্রায় দুই শতাধিক পরিবারের বাড়িঘরসহ ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বড়কান্দি ইউনিয়নের রঞ্জন ছৈয়াল কান্দি, খলিফা কান্দি ও দুর্গারহাট গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি, ফসলি জমিসহ কিছু মসজিদ, মাদ্রাসা পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। পালেরচর ইউনিয়নের কাথুরিয়া মোহন ফকির কান্দি, ফরাজি কান্দি, দেওয়ান কান্দি, হুকুম আলী সরদার কান্দি, রাঢ়ি কান্দি এলাকায় ব্যাপক নদী ভাঙন ঠেকাতে ১১শ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া লৌহজংয়ের পার্শ্ববর্তী টঙ্গীবাড়ী উপজেলার প্রায় ২৪টি গ্রাম বিলীন হয়েছে। নিঃস্ব হয়েছে শত শত পরিবার। এখনো ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করেনি প্রশাসন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ রাসেদুজ্জামান বলেন, পদ্মায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের তালিকা করা হচ্ছে।
আরও জানা গেছে, উপজেলার হাসাইল-বানারী, পাঁচগাঁও, কামারখাড়া ও দিঘিরপাড় ইউনিয়নে প্রতিবছরই ভাঙন দেখা দেয়। ভাঙনের কবলে পড়ে এই চার ইউনিয়নে বিলীন হয়েছে ২৪টি গ্রাম।
গ্রামগুলো হলো-পাঁচন খোলা, বিধুয়াইল, বানারী, নোয়াদ্দা, নগর জোয়ার, বাঘের পাড়, বিদগাও, মান্দ্রা, আকিগাও, ষোলপড়ান, সাতক, মধ্য হাসাইল, ইসলামপুর পূর্ব হাসাইল, গারুগাওগ্রাম, চিত্রকরা, দশোত্তোর, বাঘবাড়ি, কান্দার বাড়ী, সরিষা বন, হাইয়ারপাড়, দিঘিরপাড় ও চৌষার।
আর এসব গ্রামে অবস্থিত হাসাইল কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, পূর্ব হাসাইল জামে মসজিদ, ইসলামপুর জামে মসজিদ, চৌষার জামে মসজিদ, গারুগাও জামে মসজিদ, হাইয়ারপাড় জামে মসজিদ, সরিষা বন জামে মসজিদ, পাঁচনখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও মন্দির পদ্মায় ডুবে গেছে। আর ভাঙনের আতঙ্কে রয়েছে-হাসইল বাজার, বানারী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, দাতারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দিঘিরপাড় বাজার, কামারখাড়া বাজার নদীর পাড়ের ৮শ পরিবার। শনিবার (১ এগ্রিল) পদ্মা নদীর পাড়ের দিঘিরপাড় গ্রামের বাসিন্দা শাহিন বেপারী জানান, প্রতিবছরই পদ্মায় গিলে খাচ্ছে শত শত পরিবারকে। বর্ষা মৌসুমে ভাঙন দেখা দিলে লোক দেখানে জিও ব্যাগ ফেলা হয়। কিন্তু কেউ এ ভাঙন রোধে স্থায়ী পদক্ষেপ নেয় না।
আরও জানা গেছে, হুমকির মুখে আছে লৌহজং সরকারি কলেজ, প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়, একটি চক্ষু হাসপাতাল, দুটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, লৌহজং উপজেলার সাবরেজিস্ট্রি অফিস, ভূমি অফিস, বেশ কয়েকটি মসজিদ, মাদ্রাসা, কয়েকটি বাজার, খেলার মাঠ ও ফসলি জমি। এ পর্যন্ত ভাঙনের কবলে পড়ে প্রায় ২০ হাজার পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছে। অর্ধশত স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে লৌহজংয়ের কলমা ইউনিয়ন, গাঁওদিয়া ইউনিয়ন, বেজগাঁও ইউনিয়ন, লৌহজং-তেউটিয়া ইউনিয়ন, খিদির পাড়া ইউনিয়ন, কনকসার ইউনিয়ন, কুমারভোগ ইউনিয়ন, হলদিয়া ইউনিয়ন ও মেদিনীমণ্ডল ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। বাকি এলাকা হুমকির মুখে রয়েছে। এবার বর্ষা মৌসুম শুরু হতেই আবার শুরু হয়েছে পদ্মার ভাঙন।
নিঃস্ব নড়িয়া এখন শান্ত : ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ভাঙনে নড়িয়া উপজেলায় নিঃস্ব হয়েছে শত শত পরিবার। সেই নড়িয়া এখন শান্ত। তীব্র ভাঙন আর সেখানে নেই। ১ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নের পর এখন নড়িয়া ভাঙনমুক্ত। তবে ভাঙনের চিত্র এখনো স্থানীয় বাসিন্দাদের তাড়িয়ে বেড়ায়।
এছাড়া নড়িয়া পৌর এলাকাসহ বাঁশতলা, কেদারপুর, সুরেশ্বর চন্ডিপুর, পাঁজগাও, চরআত্রা, নোয়াপাড়া, সাধুর বাজার, ওয়াপদা, মুলফতগঞ্জ বাজার ও চর নড়িয়াসহ আরও অনেক এলাকার বাড়িঘর, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নদীতে চলে যায়। মুলফতগঞ্জ ছিল একটি প্রাচীন বাজার।
এই বাজারসহ তিনটি বাজার বিলীন হয়ে গেছে। সেখানে তিনশরও বেশি দোকানপাট নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এছাড়া একটি কমিউনিটি ক্লিনিক, দুটি সরকারি বিদ্যালয় ভবন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তিন তলা ভবন, গাড়ির গ্যারেজ, মসজিদ, মন্দির, ব্রিজ, কালভার্ট, রাস্তা ও ফসলি জমিও নদীতে বিলীন। শুধু নড়িয়ার পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ ভাঙনের শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। ওই সময় ৮০টি পাকা ভবনসহ নদীর পেটে গেছে প্রায় সাতশ একার ফসলি জমি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে প্রায় আড়াই বর্গ কিলোমিটার এলাকা নদীতে চলে গেছে।
গতি নেই বাম তীর প্রকল্পে : পদ্মা বহুমুখী সেতুর ভাটিতে মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং ও টঙ্গীবাড়ী উপজেলাধীন বিভিন্ন স্থানে পদ্মা নদীর বাম তীর সংরক্ষণ শীর্ষক প্রকল্পের কাজ চলমান। কিন্তু এখানে কাজের বাস্তবায়ন হতাশাজনক। এক বছরে এই কাজের অগ্রগতি মাত্র ৯ দশমিক ৭১ ভাগ। তবে প্রকল্পের অগ্রবর্তী প্রতিবেদনে অর্থ বরাদ্দের চেয়ে কাজের পরিমাণ বেশি (৪ দশমিক ৫৯ ভাগ) দেখানো হয়েছে। অথচ অসময়ে ভাঙনের তীব্রতায় পদ্মার তীরবর্তী লৌহজং ও টঙ্গীবাড়ীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, ‘প্রকল্পের অনুমোদিত মেয়াদকাল ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৪৬ কোটি ১১ লাখ টাকা। অনুমোদিত ডিপিপি অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাকে সুরক্ষিত করতে প্রায় সাড়ে ৮ কিলোমিটার নদী তীর প্রতিরক্ষা কাজ, আধা কিলোমিটারেরও বেশি বিদ্যমান নদী তীর প্রতিরক্ষা কাজের পুনর্বাসন এবং এক কিলোমিটারেরও বেশি চর অপসারণের জন্য নদী ড্রেজিংয়ের (৫.৫১ লাখ ঘনমিটার মাটি) সংস্থান রাখা হয়েছে।
অপ্রতুল বরাদ্দ : ‘পদ্মা বহুমুখী সেতুর ভাটিতে মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং ও টঙ্গীবাড়ী উপজেলাধীন বিভিন্ন স্থানে পদ্মা নদীর বাম তীর সংরক্ষণ’ কাজের ধীরগতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় অংশ নেন কর্মকর্তারা। ২২ মার্চ এ বিষয়ে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন সেক্টর-৪ এর মহাপরিচালক মো. সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ওই সভায় প্রকল্পের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরেন প্রকল্পটির পরিচালক দেওয়ান আইনুল হক। ওই সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, প্রকল্পের অগ্রবর্তী প্রতিবেদনে চলমান কাজের বিলের পরিমাণ উল্লেখ করা হয় ৩৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
এছাড়া প্রকল্পের অনুকূলে ২০২১-২২ অর্থবছরে তিন কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। বরাদ্দের বিপরীতে কাজই হয়েছে ২ কোটি ৯৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার। ডিপিপি অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ৩১৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকার সংস্থান ছিল। এরপর মূল এডিপিতে ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করে অর্থবছরের শুরুতে প্রকল্পটি ‘সি’ ক্যাটাগরিভুক্ত করা হয়।
ফলে প্রকল্পের অর্থছাড় বন্ধ হয়ে যায়। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সম্মতিক্রমে ২০২২ সালের অক্টোবরে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ পুনর্বিন্যাস করা হয়। পরে আলোচ্য প্রকল্পের অনুকূলে ছাড়যোগ্য ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়। ফলে চলতি অর্থবছরের শুরুতে অর্থছাড় অনিশ্চিত হওয়ায় প্রকল্পের অগ্রগতি কম।
অগ্রবর্তী প্রতিবেদনে প্রকল্পের প্রায় ৬০ ভাগ জিও ব্যাগ ডাম্পিং কাজ সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছে। জিওব্যাগ ডাম্পিংয়ের মাধ্যমে প্রকল্প এলাকাকে ভাঙন হতে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে উল্লেখ করা হলেও বাস্তব অবস্থা ভিন্ন।
সরেজমিন জানা গেছে, পদ্মার ভাঙন বসতবাড়ির কাছাকাছি চলে আসায় লৌহজং-তেউটিয়া ইউনিয়নের বড় নওপাড়া গ্রামের মো. কুতুব মোল্লা, মো. হোসেন মোল্লা, মো. মামুন মোল্লা, মো. মানিক মিয়া ও মো. পারভেজসহ অনেকেই ঘরে তালা লাগিয়ে পরিবার নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। স্থানীয় ইউপি সদস্য সাগর খান বলেন, নদী ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়ে লোকজন ঢাকা, টঙ্গী ও গাজীপুরের কোনাবাড়িতে ভাড়ায় বসবাস করছেন।
এবার বর্ষার আগেই ভাঙন শুরু হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে লৌহজং উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বেপারি বলেন, বিশেষ করে পদ্মা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বালি উত্তোলনের ২ মাসের একটি চুক্তি ছিল। সেই চুক্তির মেয়াদ অতিক্রম হওয়ার পরও অপরিকল্পিতভাবে মাসের পর মাস বালি তোলা হচ্ছে।
এ কারণে বর্ষা শুরু হওয়ার আগে নদীর বাম তীরে এর প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন তিনি। জাকির হোসেন বেপারির অভিযোগ-চাঁদপুরের বালিখেকো ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানের পুরো সিন্ডিকেট পদ্মার এই প্রান্তে অবৈধভাবে বালি তুলে ব্যবসা করছে। এরা এখন গোটা লৌহজং উপজেলাকে নদী ভাঙনের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। চুক্তি লঙ্ঘন করে প্রতিদিন শত শত বাল্কহেড বোঝাই করে প্রশাসনের সামনে দিয়েই চলে যাচ্ছে। অথচ অবৈধ বালি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসন।
বালি উত্তোলনের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের নদীশাসন কাজের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন লি.র সঙ্গে অধিগ্রহণ করা সীমানায় বালি উত্তোলনের চুক্তি হয়। এতে দেখা গেছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বালি উত্তোলনের চুক্তির সত্যতা পাওয়া যায়। কিন্তু নির্ধারিত সময় অতিক্রমের পরও নির্বিঘ্নে চলছে বালি উত্তোলন।
তথ্যানুসন্ধানে পাওয়া নথিপত্রে দেখা গেছে, সিনোহাইড্রো করপোরেশনের পক্ষে বালি অপসারণ করছে সাব-ঠিকাদার খোকন কন্সট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লি.।
জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মইনুল ইসলাম খোকন বলেন, এখন কারা বালি তুলছে বা বাল্কহেড দিয়ে অপসারণ করছে তা আমি জানি না। আমি পদ্মায় এখন বালির বস্তা ডাম্পিং করছি।
তিনি বলেন, কিছু দিন আগে কোস্ট গার্ড অবৈধ বালি উত্তোলনের অভিযোগে অভিযান চালায়। এ সময় ড্রেজারসহ আটক করা হলে আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামে কাগজ জাল করার বিষয়টি জানতে পারি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঢাকা পওর বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী রনেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন, নকশা পরিবর্তন করা হলে চলমান কাজের ব্যয় কোনো কাজে আসবে না এমন নয়। নকশায় নীল দাগ খচিত স্থানগুলো অধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রকল্প এলাকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। না হলে প্রকল্পের সফলতা আসবে না।
তিনি বলেন, লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ভাঙন নিয়ে পত্র দিয়েছেন। সেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘লৌহজং উপজেলার স্থায়ী বাঁধবহির্ভূত ভাঙন কবলিত অংশগুলো বিদ্যমান ডিপিপি সংশোধন করে অন্তর্ভুক্ত করা না হলে এই উপজেলা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
এরপর পাউবোর কেন্দ্রীয় অঞ্চলের বিদায়ি প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি কারিগরি কমিটির সদস্যদের নিয়ে এলাকা পরিদর্শনে যান। ওই সময় লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল আউয়াল উপস্থিত ছিলেন।