ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলসহ চার দফা দাবি জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় এ দাবি তুলে ধরেন সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম। ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সব প্রকার মানবাধিকারের চালিকা শক্তি’ শীর্ষক সভায় আয়োজন করে সম্পাদক পরিষদ।
দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে-১. স্বাধীন ও মুক্ত সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে যেসব আইন প্রক্রিয়াধীন আছে, সেই প্রক্রিয়া এখনই স্থগিত করা। আইনগুলোর মধ্যে যেসব ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতাকে ব্যাহত করতে পারে, সেগুলো আইন থেকে বাদ দেওয়া। ২. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে। আর যদি তা বাতিলে সরকারের কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে, তাহলে এমন একটি ধারা যুক্ত করতে হবে, যেখানে বলা থাকবে, এই আইন গণমাধ্যম, স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য প্রযোজ্য নয়। সাংবাদিকতার কারণে আজ পর্যন্ত যেসব মামলা করা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহার ও গ্রেফতার সাংবাদিকদের মুক্তি দিতে হবে। ৩. যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, সেটি সরকার উদ্যোগী হয়ে যেন একেবারেই মুছে ফেলে। ৪. সাংবাদিকতার সুরক্ষার জন্য আইন হতে পারে, যা সংবিধানের চেতনার মধ্যে রয়েছে।
সম্মানিত অতিথি হিসাবে সভায় বক্তব্য দেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করে এটিকে গণমাধ্যমবান্ধব করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। একই সঙ্গে সাইবার জগতের নিরাপত্তার বিধান করারও আহ্বান জানান।
সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। যতক্ষণ না এটি বন্ধ করতে পারছেন, সংশোধন না করতে পারছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে মামলা দায়ের করবেন। অভিযোগ এলেই গ্রেফতার করে চালান দিয়ে কারাগারে পাঠাতে পারবেন না। জামিন পাওয়ার অধিকার থাকতে হবে। সবাই বলেছেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পর্যালোচনা দরকার। অবশ্যই পর্যালোচনা দরকার এবং সংশোধন দরকার। এটি ঝুলিয়ে রাখা ঠিক নয়।’
তিনি বলেন, ‘সরকারকে বলব অবিলম্বে আইনমন্ত্রীর কথা বাস্তবায়নের জন্য পরামর্শ সাপেক্ষে কোথায় কোথায় সংশোধন করতে সেগুলো সংশোধন করে দিন। সাইবার জগতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কী ধরনের আদালত ও আইনকানুন দরকার, সেটিও ঠিক করে বলে দিন। সুতরাং সাইবার জগতের নিরাপত্তার বিধানও করেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধন সাপেক্ষে সংস্কার করে এটিকে গণমাধ্যমবান্ধব করেন।’
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক আরও বলেন, গণমাধ্যমে স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ব্যাপারে কোনো দরকষাকষি চলতে পারে না। আবার ডিজিটাল জগতের নিরাপত্তা বিধানের জন্যও কোনো রকমের দরকষাকষি চলতে পারে না। দুটোই থাকতে হবে। ডিজিটাল জগতের নিরাপত্তার বিধানও করতে হবে, গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতাও নিরাপদ করতে হবে। একই সঙ্গে বাকস্বাধীনতাও নিরাপদ করতে হবে। এই দুটো নিশ্চিত করার মধ্যে দিয়েই ভবিষ্যতে সাইবার জগতে ভূমিকা রাখতে হবে। গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমকে সাইবার জগতের সঙ্গে খাপ খাওয়া হবে।
দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ বলেন, সাংবাদিকদের অবস্থা এখন করুণ। তাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা হয়েছে; একটা আইন করে, আরেকটা সাংবাদিকদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে। আমাদের মধ্যে যে বিভাজন এটা দূর হবে কিনা সন্দেহ আছে। আমরা দেখেছি, অনেক ইস্যুতে সাংবাদিকদের একপক্ষ দাঁড়ায়, আরেকপক্ষ কিছুই বলে না।
নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় ভিন্নমত প্রকাশ করতে দেওয়া হবে না, দেবেও না। যে আইনের জন্য সবাইকে ভুগতে হচ্ছে, অনুনয় করে লাভ হবে না। সরকারের মন্ত্রী, এমপি পর্যায় থেকে বারবার বলা হয়েছে সংশোধন করা হবে, কিন্তু হয়নি। গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সঙ্গে নিয়ে জনগণকে সমন্বয় করে আন্দোলন করতে হবে।
প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, বাংলাদেশে মতপ্রকাশের যথেষ্ট স্বাধীনতা আছে। বুঝে নেন, ওইভাবে বলতে পারছি না। সংবিধানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে বলা আছে, কিন্তু কীভাবে ক্ষমতাসীনরা বিরক্ত হবেন না, সেটার ব্যাখ্যা পরিষ্কার করা নেই। যে কারও বিরুদ্ধে যে কোনো সময় ডিএসইতে মামলা হতে পারে।
ডেইলি স্টার সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনামের সভাপতিত্বে এবং সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্য দেন-ইত্তেফাক সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, সমকাল সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল, দেশ রূপান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোস্তফা মামুন প্রমুখ। সভায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানও উপস্থিত ছিলেন।