এখন ডেমোক্রেসির পরিবর্তে আওয়ামীক্রেসি চলছে উল্লেখ করে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের এমপি বলেছেন, সরকারি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে বেছে বেছে আওয়ামী লীগের লোক বসানো হচ্ছে। সাধারণ মানুষ মনে করছে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজ হচ্ছে সরকারি দলের দুর্নীতিবাজদের সার্টিফিকেট দেওয়া- যে তারা কোনো দুর্নীতি করেননি।
তিনি আরও বলেন, সব জায়গায় বিভাজন সৃষ্টি করা হচ্ছে, এটাই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী। ফলে গরিব আরও গরিব হচ্ছে, ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে লুটপাট চলছে। দেশের সাধারণ মানুষের খোঁজ রাখা হচ্ছে না। বর্তমান সরকার স্বাধীনতার পক্ষে হতে পারে, কিন্তু তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তি নয়।
শুক্রবার রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক স্মরণসভায় সভাপতির বক্তব্যে জিএম কাদের এসব কথা বলেন।
এর আগে সকালে কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এরশাদের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দ। এছাড়াও ঢাকাসহ সারা দেশে কুরআনখানি, দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে।
স্মরণসভায় জিএম কাদের আরও বলেন, এরশাদ সাহেবের দেশ পরিচালনার সময়কে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১০ নভেম্বর ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত সামরিক আইন জারির মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হয়েছে। ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে আইন সঙ্গতভাবে তিনি দেশ পরিচালনা করেছেন। প্রথম ভাগকে আদালত অবৈধ বলেছে কারণ সংবিধান সঙ্গতভাবে হয়নি। যদি জনগণের কল্যাণে কাজ হয়ে থাকে তাকে অবশ্যই বৈধ বলা যায়।
জি এম কাদের বলেন, ১৮৮৮ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিল। ১৯৯৬ সালে আবার বিএনপির বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী। আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন এখন চলছে। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে একটি নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে আরেকটি আন্দোলন হয়েছিল। সেই সময়ে ওয়ান ইলেভেন এসেছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৬ সালে বলেছিলেন, আমরা চিরস্থায়ীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চাই। এখন তারা সংবিধানের দোহাই দিয়ে নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চাচ্ছেন। ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন সংবিধান সম্মত ছিল না। পরবর্তীতে সংসদে এর বৈধতা দেওয়া হয়েছে। ২০০৮ সালে ওয়ান ইলেভেনের সময় অনির্দিষ্টকালের জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাও সংবিধান সম্মত ছিল না। আবারো নবম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। সংবিধান সবাই মেনে চলছি তা তো নয়।
বিরোধীদলীয় উপনেতা বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে নির্বাচন করতে হবে নির্বাচিত সরকারের অধীনে, আমরাও তাই চাই। নির্বাচিত সরকার যদি নির্বাচন কমিশনসহ সব কিছু প্রভাবিত করতে পারে তাহলে তাকে সমর্থন করা যায় না। সংবিধানে বলা হয়েছে গণতন্ত্রের কথা। জনগণ যদি মনে করে আমার ভোটে সরকার গঠন হয়েছে, তাকেই বলা যায় নির্বাচিত সরকার। নির্বাচন কমিশন যেন সরকারের প্রভাবের বাইরে থাকে। যদি আমার কথায় নির্বাচন কমিশন চলে, তাহলে আমি কী হেরে যাব- এমন সিদ্ধান্ত নেব? সরকার নির্বাচন কমিশনকে প্রভাবিত করতে পারলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, আওয়ামী লীগ নামে ও বেনামে সরকার হয়ে যাচ্ছে। তারা তাদের সরকারের জন্য কাজ করছে। তারা কাজ করছে তাদের সরকারের জন্য। কিছু মানুষ প্রশাসনে আছে, পুলিশে আছে, সরকারি বিভিন্ন বিভাগে আছে, তারা আগ বাড়িয়ে বলেন আমরা আওয়ামী পরিবার। আমরা ছাত্রলীগ-যুবলীগ করেছি। তারা আওয়ামী লীগের সভায় যায়, শ্লোগান দেয় এবং আওয়ামী লীগের ভাষায় কথা বলে। এরা হচ্ছে বেনামে আওয়ামী লীগ।
তিনি বলেন, এখন ডেমোক্রেসির পরিবর্তে আওয়ামীক্রেসি চলছে। যেখানে গভর্মেন্ট অব দ্যা আওয়ামী লীগ, গভর্মেন্ট বাই দ্যা আওয়ামী লীগ এবং গভর্মেন্ট ফর দ্যা আওয়ামী লীগ। এটা কখনোই ডেমোক্রেসি হতে পারে না। আমরা চাই নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। সেই সরকার নির্বাচিত হতে হবে। যে সরকার নিজেই নিজের ফলাফল ঘোষণা করতে পারে- তাকে নির্বাচিত সরকার বলা যায় না। বর্তমান আওয়ামীক্রেসি দেশের ইতিহাস বদলে দিচ্ছে, আগামী প্রজন্মের জন্য একটি ভয়াবহ দেশ রেখে যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। তরুণ সমাজ হতাশায় মাদকাসক্ত হয়ে গেছে।
জি এম কাদের বলেন, রাষ্ট্রপতির আহবানে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন। তখন যারা ক্ষমতায় ছিল তারা ব্যতীত দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলসহ সাধারণ মানুষ তাকে স্বাগত জানিয়েছিল। বর্তমান সরকারের প্রধান তখন বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। সাধারণ মানুষ এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ জনকল্যাণমূলক মনে করেছে। পল্লীবন্ধু আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বৈষম্যবিহীন একটি সমাজ গঠন করেছিলেন। আইন সবার জন্য সমান ছিল। রাষ্ট্রীয় সম্পদ বা সুযোগ সুবিধা সবার জন্য সমান ছিল।
তিনি বলেন, ১৯৯১ সালের পর থেকে দেশে সর্বত্র দলীয়করণ চলছে। দলের লোককে বেশি সুযোগ দেওয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি, চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্যে। টেন্ডারবাজি চলেছে, দলীয় লোকেরা ফুটপাত থেকে চাঁদা তুলছে। আওয়ামী লীগ কর্মীরা অন্ধ ভিক্ষুকের কাছ থেকেও চাঁদা তোলে। চাঁদার জন্য রাস্তাগুলো বিপণন কেন্দ্র করে ফেলেছে। কোটি কোটি টাকা চাঁদা তুলে আবার বণ্টন হয়, এরশাদ সাহেবের সময় এগুলো ছিল না।
জি এম কাদের বলেন, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে। পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের সঙ্গে বৈষম্য করতো। বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে দেশের মানুষ স্বৈরশাসন ও উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলো। একসময় মনে হলো বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে আমাদের নিজেদের একটি দেশ দরকার। ১৯৭১ সালে মুক্তির জন্যই স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল। আমরা কী বৈষম্য থেকে মুক্তি পেয়েছি? এখন আওয়ামী লীগ ও নন আওয়ামী লীগ বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ বা বাবা-চাচারা আওয়ামী লীগ না করলে চাকরি পাওয়া যায় না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ আর মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ভাগ করে বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। কোনো মানুষই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল না। আবার স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ সৃষ্টি করে বৈষম্য করা হচ্ছে। স্বাধীনতার বিপক্ষে কিছু লোক ছিল। তাদের সংখ্যা খুবই কম। অনেকে মারা গেছে, অনেকের ফাঁসি হয়েছে। আর যারা বেঁচে আছে তারা চলাফেরা করতে পারে না। তাহলে তরুণ সমাজের মাঝে স্বাধীনতার পক্ষ আর বিপক্ষ করা হচ্ছে কেন?
এ সময় জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি বলেছেন, এই মুহূর্তে জাতির জন্য পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। দুঃখের বিষয় তিনি আমাদের মাঝে নেই। জাতীয় পার্টি নয় বছর দেশ পরিচালনায় মাত্র ৮০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে অভূতপূর্ব উন্নয়ন করেছে। যা বর্তমান বাজেটের এক বছরের খরচের মাত্র ১০ ভাগ। জাতীয় পার্টির শাসনামলে কোনো দুনীতি হয়নি।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু এমপি বলেন, গোলাম মোহাম্মদ কাদের এমপির প্রতি দেশের মানুষের আস্থা আছে। দেশের মানুষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিপক্ষে জাতীয় পার্টিকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় দেখতে চায়। দুর্নীতি ও দুঃশাসনের কারণে ওই দুটি দলের ওপর সাধারণ মানুষ বিরক্ত।
কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, জাতীয় পার্টির পথচলা কখনোই সহজ ছিল না। কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে জাতীয় পার্টি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবে। পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের ওপর পার্টির সবার আস্থা আছে।
কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি বলেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এক দফা দাবি ঘোষণা করেছে। বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করবে না আর আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার অধীন ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। দেশের মানুষ আতংকিত হয়ে এদের হাত থেকে মুক্তি চায়।
কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি বলেন, পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করে ইতিহাস হয়ে আছেন। তিনি উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে মানুষের হৃদয়ে চিরঞ্জীব হয়ে আছেন। বাংলাদেশ থেকে পল্লীবন্ধুর নাম মুছে ফেলা যাবে না।