জাতীয়

হাসপাতালে শয্যা সংকটে ফিরে যাচ্ছেন রোগীরা

রাজধানীর সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চাপ এত বাড়ছে যে, অন্য রোগীরা চিকিৎসা নিতে এসে ফেরত যাচ্ছেন। আবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরাও ঠিকমতো সেবা পাচ্ছেন না। সব মিলিয়ে এক নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে হাসপাতালগুলোতে। রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, রোগীর চিকিৎসায় চিকিৎসকদের অবহেলাও রয়েছে।

এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৪৯ জন রোগী। সরকারিভাবে এ সময়ের মধ্যে মৃত্যুর কোনো তথ্য না জানালেও কাছে তথ্য রয়েছে, চিকিৎসাধীন এক শিশু শুক্রবার মারা গেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছয় বছরের শিশু তাশফিন আহানাফের মৃত্যু হয়েছে।

তাশফিন আহানাফ আরটিভি অনলাইনের শিফট ইনচার্জ আবুল হাসানের ছেলে। আরটিভি অনলাইনের ডেপুটি চিফ নিউজ এডিটর বিপুল হাসান জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর শিশুটি ছয়দিন জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। শরীরে রক্তক্ষরণ হওয়ায় রক্তের প্লাটিলেট অনেক কমে যায়। এজন্য তিন ব্যাগ রক্ত দিতে হয় তাকে। পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় বৃহস্পতিবার তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। শুক্রবার দুপুরের পর শিশুটির মৃত্যু হয়।

হাসপাতালে একদিকে ডেঙ্গু রোগীর চাপ, অন্যদিকে সাধারণ রোগী। এক নাকাল অবস্থা। শুক্রবার দুপুরে রাজধানী শ্যামলীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে জরুরি বিভাগের সামনে রোগীর অভিভাবকরা শিশুদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে উৎকণ্ঠায় সময় পার করছিলেন। ২ মাস ১৭ দিন বয়সি শিশু আলিফের মুখে অক্সিজেন মাস্ক। নানির কোলে ছটফট করছিল শিশুটি। পেছনে দাঁড়িয়ে আঁচলে মুখ ঢেকে গুমড়ে কাঁদছেন শিশুটির মা। তীব্র শ্বাসকষ্টে ছটফট করছে শিশুটি। মুমূর্ষু শিশুটির বাবা মো. রাসেল স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।

মো. রাসেল এই প্রতিবেদককে বলেন, ছেলের নিউমোনিয়া হওয়ায় ১০ দিন আগে চাঁদপুর থেকে এই হাসপাতালে নিয়ে আসি। চিকিৎসকরা জানান, আইসিইউ সাপোর্টের প্রয়োজন। সেদিন শয্যা না থাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করি। খরচ মেটাতে না পারায় ফের এখানে আসছি। কিন্তু আজও আইসিইউ ফাঁকা নেই বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা। এখন কোথায় যাব সেটিও বুঝতে পারছি না। শুধু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রেই নয়, সাধারণ শয্যাও খালি নেই এই হাসপাতালে।

শিশু হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা জানান, ডেঙ্গু রোগীর চাপে শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে। ভর্তি হতে না পেরে অনেকেই ফিরে যাচ্ছে। শিশুদের আইসিইউ সাপোর্ট পিআইসিইউ ও এইচডিইউতেও শয্যা খালি নেই। বাধ্য হয়েই অন্য হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

চিকিৎসকরা আরও জানান, শুরুতে চারতলার ১১৪নং ওয়ার্ডের ১২টি বিছানায় ডেঙ্গু রোগীদের ভর্তি করা হয়। এতে করে ওই ওয়ার্ডে অন্য রোগীরা ভোগান্তিতে পড়েন। পরে নিচতলার দুই নম্বর ওয়ার্ডে ১৬টি বিছানা ডেঙ্গু কর্নার করা হয়। তাতেও জায়গা সংকুলান না হওয়ায় এখন পুরো ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। ৪২টি শয্যার সবগুলোতেই রোগী ভর্তি আছে। শয্যা সংকটে হাসপাতালের অন্যান্য ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে শিশু হাসপাতালের মতো একই চিত্র দেখা গেল রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও। শয্যা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন রোগীরা। হাসপাতালের ৩১৩ নম্বর শিশু ওয়ার্ডের ২৩ নম্বর বিছানায় ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি আছে আট বছর বয়সি দুই শিশু নাহিম ও সাজিদ। মোহাম্মাদপুর এলাকার বাসিন্দা সাজিদের মা সোনিয়া আক্তার বলেন, আট দিন আগে সাজিদের জ্বর আসে। বাড়িতেই প্যারাসিটামল ওষুধ খাওয়াচ্ছিলাম। সুস্থ হওয়ার পর ফের জ্বর আসে। এরপর তাকে নিয়ে শিশু হাসপাতালে যাই। শয্যা না পেয়ে এখানে আসি। বৃহস্পতিবার এখানে আসার পর ডেঙ্গু পজিটিভ হয়। শয্যা না পাওয়ায় অন্য রোগীর সঙ্গে ভাগাভাগি করে থাকতে হচ্ছে।

একই বিছানায় ভর্তি শিশু নাহিমের বোন জানান, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ভাইকে নিয়ে পাঁচ দিন আগে এখানে ভর্তি করাই। এখন শারীরিক পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। শয্যা ফাঁকা না থাকায় আরেক রোগী সাজিদকে তাদের সঙ্গে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসায় চিকিৎসকদের বেশ উদাসীনতা রয়েছে বলে অভিভাবকরা অভিযোগ করেন। শুক্রবার ৩১৩ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তির জন্য পাঁচজন রোগীকে অপেক্ষা করতে দেখা দেখা যায়। তাদের মধ্যে ৫ দিনের নবজাতক ও এক বছর তিন মাস বয়সি মুমূর্ষু শিশু ছিল। কিন্তু চিকিৎসক না থাকায় তাদের দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হয়।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান বলেন, শুরুর দিকে রোগী কম থাকলেও এখন শিশুদের দুটি ওয়ার্ডেই ডেঙ্গু আক্রান্তদের ভর্তি করা হচ্ছে। বড়দের জন্য ষষ্ঠতলায় দুটি ডেঙ্গু ওয়ার্ড করা হয়েছে। শয্যা সংকটে শিশুদের মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। যেভাবে রোগী বাড়ছে এমনটা চলতে থাকলে আরও বিছানা লাগবে। চিকিৎসক অনুপস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, দুপুরে শিফট পরিবর্তন হওয়ায় এমনটি হয়েছে।

এদিন মহাখালীর ডিএনসিসি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘুরে সেখানেও অনেক রোগীকে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিতে দেখা যায়। হাসপাতালটির ডি-ব্লকের তিনতলায় অন্তত ৩৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা নিতে দেখা যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক-নার্সরা জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ২১ জন ভর্তি হয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জানুয়ারিতে ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১২ জন, মার্চে ২ জন, মে’তে ১১ জন, জুনে ৩৮ জন এবং জুলাই মাসের শুক্রবার পর্যন্ত ৫১ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত এই হাসপাতালে ১৪৪ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।

হাসপাতালের পরিচালক কর্নেল ডা. একেএম জহিরুল হোসাইন খান বলেন, এখানে ২১ জন মেডিকেল অফিসার, ১৩ জন কনসালটেন্ট, ৩ জন সহযোগী অধ্যাপক ও ২ জন সহকারী পরিচালকসহ মোট ৩৯ জন চিকিৎসক ও ৫০ জন নার্স রোগীদের সেবা দিচ্ছেন। এর বাইরে কিছু সহায়ক জনবল রয়েছেন। সারা দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় ডিএনসিসি হাসপাতালের ৮০০টি শয্যা ডেঙ্গু চিকিৎসা ডেডিকেটেড করা হয়েছে। ঘোষণার পর চিকিৎসক-নার্সসহ প্রয়োজনীয় জনবল চাওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দুই মাসের জন্য ৩৬ জন চিকিৎসককে সংযুক্তি দিয়েছে। তারা এখনো যোগদান করেনি। এছাড়া নার্সিং অধিদপ্তর কোনো চিঠি দেয়নি। শুনছি বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। চিকিৎসক-নার্স দিলে রোগীদের সেবা দিতে সহজ হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ জ্বরসহ নানা উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছেন। কিন্তু ডেঙ্গুর ভিড়ে অন্য রোগীদের সহজে ঠাঁই মিলছে না। আবার হাসপাতালের অব্যবস্থাপনায় ভোগান্তিতে পড়ছেন রোগীরা। এমন প্রেক্ষাপটে রোগীদের মানসম্মত সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ বাড়বে। তাই ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য নির্দেশনা দিলেই হবে না। সেটি কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে। রোগীরা সেবা নিয়ে সুস্থ ও সন্তুষ্ট কিনা সেটিও দেখতে হবে। সবার আগে ডেঙ্গুজ্বরের বাহক এডিস মশা নিধনে সব দপ্তরের সমন্বিত উদ্যোগে মশা নিমূর্ল করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *