অর্থনীতি

বিকল্প মুদ্রায় লেনদেনের জটিলতায় বাংলাদেশ

বিশ্ব বাণিজ্যে লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলারের আধিপত্য কমছে। বৈশ্বিক রিজার্ভের মধ্যে ডলারের অংশও কমে যাচ্ছে। ডলারের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় অনেক দেশেরই আমদানি ব্যয় ও বৈদেশিক দায় বেড়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে অনেক দেশ এখন বৈদেশিক বাণিজ্যে বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের চেষ্টা করছে। বাংলাদেশও বৈশ্বিক লেনদেনের কিছু ক্ষেত্রে বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে।

এর মধ্যে ভারতীয় মুদ্রা রুপিতে সে দেশের সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্য সীমিত আকারে শুরু হয়েছে। চীনা মুদ্রা ইউয়ানে এলসি খুলে সে দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করার বিষয়ে দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদন দিলেও এখন পর্যন্ত ওই মুদ্রায় কোনো এলসি খোলা হয়নি।

সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) এখন পর্যন্ত পাঁচটি দেশের মুদ্রাকে স্থিতিশীল মুদ্রা বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। এগুলো হচ্ছে-মার্কিন ডলার, যুক্তরাজ্যের মুদ্রা পাউন্ড, ইউরোপীয় অঞ্চলের মুদ্রা ইউরো, জাপানি মুদ্রা ইয়েন ও চীনা মুদ্রা ইউয়ান। এর মধ্যে মার্কিন ডলার, যুক্তরাজ্যের মুদ্রা পাউন্ড, ইউরোপীয় অঞ্চলের মুদ্রা ইউরোই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বেশি সচল। চীনা ও জাপানি মুদ্রা ওই দেশ ছাড়া অন্যত্র চলে না। যে কারণে এ দুটি মুদ্রা আইএমএফের স্বীকৃতির পর বৈশ্বিক বাণিজ্যে সচল হতে পারেনি।

২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চীনা মুদ্রায় এলসি খোলার অনুমোদন দিলেও এখন পর্যন্ত এ মুদ্রায় কোনো এলসি খোলা হয়নি। কারণ ইউয়ান চীন ছাড়া অন্য কোনো দেশে চলে না। ফলে চীনে ইউয়ানে রপ্তানি করে ওই মুদ্রা চীন ছাড়া অন্য কোনো দেশে ব্যবহারের সুযোগ নেই। যে কারণে রপ্তানিকারকরা চীনা মুদ্রায় এলসি খুলছেন না। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে রয়েছে বিশাল অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে চীন থেকে ১৪ হাজার কোটি ইউয়ান পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এর বিপরীতে রপ্তানি করা হয়েছে ৪০৬ কোটি ইউয়ান। ফলে চীন থেকে ওই মুদ্রায় আমদানি করার মতো যথেষ্ট ইউয়ান বাংলাদেশের হাতে নেই। তারপরও ইউয়ানে বাণিজ্য করতে হলে ডলার দিয়ে ইউয়ান কিনতে হবে। যা বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যয় আরও বাড়িয়ে দেবে।

একই অবস্থা হবে ভারতীয় মুদ্রা রুপিতেও। বাংলাদেশ ভারত থেকে বছরে প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি রুপির পণ্য আমদানি করে। এর বিপরীতে ভারতে রপ্তানি করে ১২ হাজার কোটি রুপি। ফলে আমদানি-রপ্তানির মধ্যে পাহাড়সম ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এত বিপুল অঙ্কের আমদানির দায় মেটানোর মতো রুপি বাংলাদেশের হাতে নেই। এ কারণে সিদ্ধান্ত হয়, আপাতত ভারতে যে পরিমাণ রপ্তানি হচ্ছে তা হবে রুপিতে। ওই রুপি দিয়ে ভারত থেকে পণ্য আমদানি করা হবে। এ হিসাবে দুই দেশের মধ্যে ১২ হাজার কোটি রুপির বাণিজ্য স্থানীয় মুদ্রায় হবে। এতেও সমস্যা হবে বাংলাদেশ থেকে যারা পর্যটক বা চিকিৎসার জন্য ভারতে যাচ্ছেন, তাদের অনেকে রুপি নিয়ে যান। তখন তারা রুপির সংকটে পড়বেন। বাধ্য হয়ে তারা ডলার নেবেন। এতে ডলারের ওপর চাপ বাড়বে।

এছাড়া যেসব রপ্তানিকারক ভারতে রপ্তানি করেন তারা রুপিতে মূল্য আনলে সেগুলো ভারতেই খরচ করতে হবে। অন্য কোথাও করা যাবে না। কিন্তু একজন রপ্তানিকারকের ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশে লেনদেন করতে হয়। রপ্তানির কাঁচামাল অনেক সময় ভারত থেকে না এনে অন্য দেশ থেকেও আমদানি করা হয়। এক্ষেত্রেও রপ্তানিকারক সমস্যায় পড়বেন। অন্য দেশ থেকে কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে তাকে ডলারে এলসি খুলতে হবে। তখন রুপি বিক্রি করে ডলার কিনতে হবে। এতে খরচ বাড়বে। এ কারণে রপ্তানিকারকরা রুপিতে পণ্যের মূল্য নিতে আগ্রহী হবেন না।

২০২০ সালে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলে সেদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করার বিষয়টি সমীক্ষা শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এটি এখনো শেষ হয়নি। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে দেশটির ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ফলে রাশিয়া এখন ডলারে লেনদেন করতে পারছে না। চীনা মুদ্রায় বেশিরভাগ লেনদেন হচ্ছে। বাংলাদেশ চীনা মুদ্রায় রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেন করতে গিয়েও সফল হয়নি। কারণ যথেষ্ট মুদ্রা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নেই।

এদিকে শিল্প খাতের উদ্যোক্তারা জানান, বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ায় আমদানিতে বিকল্প মুদ্রা ব্যবহার করলে সুবিধা পাওয়া যাবে। খরচ কমবে। বাংলাদেশ মোট আমদানির ৪০ শতাংশই করে ভারত ও চীন থেকে। কিন্তু রপ্তানি করে কম। এছাড়া গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে এ দুই মুদ্রার মানও টাকার চেয়ে বেশি কমেছে। টাকার মান কমেছে ২৬ শতাংশ, ভারতীয় মুদ্রা রুপির মান কমেছে ৩২ শতাংশ, চীনা মুদ্রার মান কমেছে ২৮ শতাংশ। এসব কারণে দেশের রপ্তানিকারকরা ডলারের বাইরে স্থানীয় মুদ্রায় এলসি খুলতে আগ্রহী হচ্ছেন না।

বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। ডলারের পরিবর্তে অন্য মুদ্রায় পণ্য আমদানি করলে ব্যয় কম হবে। এতে বৈদেশিক লেনদেনে সাশ্রয় হবে। এ কারণে ডলারের পরিবর্তে অন্য মুদ্রায় লেনদেনকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু ডলারের বিকল্প এখন কোনো মুদ্রা দাঁড়াতে পারেনি বলে সেটি সফলও হয়নি।

তবে ভূরাজনৈতিক কারণে এখন অনেক দেশই ডলারের বিকল্প মুদ্রা খুঁজছে। এক্ষেত্রে চীন অনেক দূর এগিয়েছে। তারা রাশিয়া, ইরান, ভারতের সঙ্গে বিকল্প মুদ্রায় লেনদেন করছে। নিজস্ব আমদানি-রপ্তানির বাইরে চীনা মুদ্রায় লেনদেন নিষ্পত্তি করছে।

ভারতের বৈদেশিক লেনদেনের প্রধান মুদ্রা ডলার। কিন্তু দেশটি জাপানের সঙ্গে দুই দেশের নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন সম্পন্ন করছে। এতে বছর শেষে যে লেনদেন বকেয়া থাকছে, পরের বছর তা সমন্বয় করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়াও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন করছে। এর মাধ্যমে ডলারের উত্তাপ থেকে তাদের অর্থনীতিকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

এদিকে ব্রিকস ব্যাংক নিজস্ব মুদ্রা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। এতে বর্তমানে ৮টি দেশ রয়েছে। আরও ১৯টি দেশ এতে যোগ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে।

বিশ্বে রিজার্ভ মুদ্রাব্যবস্থায় ২০০১ সালে যেখানে ডলারের অংশ ছিল ৭৩ শতাংশ, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর এই হার আরও কমে হয়েছে ৫৮ শতাংশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *