দেশের ডলার বাজারের অস্থিরতা এখন চরম স্থবিরতায় রূপ নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক, রপ্তানিকারক, মানি চেঞ্জার্স, খোলাবাজার সর্বত্রই চলছে স্থবিরতা। সংকট প্রকট আকার ধারণ করায় কেউ এখন ডলার ছাড়ছে না। ডলার ছেড়ে দিলে প্রয়োজনে আবার পাওয়া যাবে কিনা-এমন শঙ্কা অনেকেরই। তারা এখন ডলার ধরে রাখতে চাচ্ছে। যে কারণে বাজারে ডলারের লেনদেন কমে গেছে। এতে ডলারের সংকট সর্বত্রই আরও প্রকট হচ্ছে। আমদানির এলসি খোলা যাচ্ছে না। ফলে অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভের ক্ষয় রোধ করতে বা পতন ঠেকাতে ডলার বিক্রি কমিয়ে দিয়েছে। এতে বাজারে সংকট আরও বেড়েছে। ব্যাংকগুলো এখন আমদানির ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের জন্য চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাচ্ছে না। ফলে অনেক দায়দেনা স্থগিত রাখতে হচ্ছে। এতে সুদ যেমন বাড়ছে, তেমনি আরোপিত হচ্ছে দণ্ড সুদ। ফলে বিশ্ববাজারে দেশের দুর্নাম হচ্ছে। অতিরিক্ত নিরাপত্তার জন্য বিদেশি ব্যাংকগুলো এখন এলসি কমিশনের ওপর বাড়তি প্রিমিয়াম আরোপ করছে। এতে আমদানি খরচ আরও বেড়ে যাচ্ছে। আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ১০-১২ কোটি ডলার পর্যন্ত বিক্রি করত। এখন মাঝে মধ্যে বিক্রি করছে ৫-৭ কোটি ডলার। তারপরও রিজার্ভের ক্ষয় রোধ করা যাচ্ছে না। ২০২১ সালের আগস্টে গ্রস রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৮০৬ কোটি ডলারে উঠেছিল। এখন তা কমে ২ হাজার ৭৩৩ কোটি ডলারে নেমেছে। নিট রিজার্ভ আরও কমে ২ হাজার ১৫২ কোটি ডলার হয়েছে। যা দিয়ে তিন মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানির দায় মেটানো সম্ভব হবে।
ব্যাংকগুলোতে ডলারের সংকট প্রকট আকার ধারণ করায় রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের মাধ্যমে অর্জিত কোনো ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিক্রি করছে। ফলে রিজার্ভে কোনো ডলার যোগ হচ্ছে না। তবে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের ঋণের কিস্তির অর্থ পেলে সেগুলোই কেবল রিজার্ভে যোগ হচ্ছে। এসব খাতে ডলার পাওয়া যাচ্ছে চাহিদার তুলনায় অনেক কম। ফলে জরুরি প্রয়োজনে রিজার্ভ থেকেই চাহিদা মেটানো হচ্ছে।
রপ্তানির ডলার দিয়ে এখন রপ্তানিকারকদেরই চাহিদা মিটছে না। ফলে তারা ডলার ছাড়তে চাচ্ছেন না। ছাড়লে এলসি খোলার সময় ডলার না পাওয়ার অভিজ্ঞতাও অনেকের রয়েছে। এছাড়া মাস ঘুরলেই প্রতি ডলারে ১ টাকা বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এজন্য রপ্তানিকারকরাও ডলার ধরে রাখতে চাচ্ছেন। এ প্রেক্ষাপটে গত ৪ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক সার্কুলার জারি করে রপ্তানিকারকের প্রয়োজনে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে ডলার স্থানান্তরের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এতে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে ডলার স্থানান্তর আরও কমে গেছে। আগে রপ্তানিকারক নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী এক ব্যাংক থেকে ডলার অন্য ব্যাংকে স্থানান্তর করে এলসির দেনা শোধ করতে পারতেন। এখন সেটি করা যাচ্ছে না।
এলসির দেনা শোধ করে ব্যাংকগুলোর কাছে রেমিট্যান্স বাবদ প্রাপ্ত ডলারের কিছু অংশ নিজেদের কাছে থাকত। সেগুলো তারা অন্য ব্যাংকে বিক্রি করত। এখন যেসব ব্যাংকে রেমিট্যান্স বেশি আছে তারাই কেবল অন্য ব্যাংকে কিছু ডলার বিক্রি করতে পারছে। মাত্র ৭-৮টি ব্যাংকের অন্য ব্যাংকে ডলার বিক্রির সক্ষমতা রয়েছে। বাকিদের নেই। যাদের আছে তারাও বিক্রি কমিয়ে দিয়েছে। কেবল ওপেন পজিশন লিমিট বা ডলার রাখার নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করলে সেগুলো অন্য ব্যাংকে বিক্রি করছে। এছাড়া করছে না।
বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) বিধান অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত ডলার থাকলে তা আন্তঃব্যাংকে বিক্রি করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে প্রতি ডলারে গড় কেনা দামের চেয়ে ১ টাকা মুনাফা করতে পারবে। তবে কোনোক্রমেই ডলারের দাম সর্বোচ্চ ১১০ টাকার বেশি হবে না। বর্তমানে ব্যাংকগুলো ডলার কিনছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দরে। ১১০ টাকায় বিক্রি করলে তাদের মুনাফা থাকে ৫০ পয়সা। এর সঙ্গে পরিচালন খরচ যোগ করলে এতে মুনাফা থাকে না। এ কারণে আন্তঃব্যাংকের স্পট মার্কেটে ডলার বেচাকেনা একেবারেই কমে গেছে। তবে আগাম বা ফরোয়ার্ড বেচাকেনা কিছুটা হচ্ছে। এছাড়া সোয়াপ (এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের মেয়াদি ধার, যার বিপরীতে সুদ দিতে হয়) হচ্ছে। এতে ডলারের দাম বেশি পড়ছে। এসব খাতে প্রতি ডলার গড়ে ১১১ থেকে ১১৪ টাকা পর্যন্ত পড়ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আগাম কোনো ডলার বেচাকেনা হয়নি। এর আগে জানুয়ারিতে ৩ কোটি ৫ লাখ ডলার, ফেব্র“য়ারিতে ২ কোটি ৯০ লাখ ডলার, মার্চে ৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার, এপ্রিলে ৩ কোটি ৬৯ লাখ ডলার বিক্রি হয়েছে। মে মাসে কোনো বেচাকেনা হয়নি। জুনে ২০ লাখ ডলার ও জুলাইয়ে ৫০ লাখ ডলার বিক্রি হয়। চলতি বছরের জুন থেকে আগাম ডলার বেচাকেনা কিছুটা বেড়েছে। তবে তা আগের মতো নয়।
সোয়াপের আওতায় গত বছরের জানুয়ারিতে ছিল ৩২৯ কোটি ডলার, ফেব্র“য়ারিতে ৩৩২ কোটি ডলার, মার্চে ৩৪৮ কোটি ডলার, এপ্রিলে ৪০৭ কোটি ডলার, মেতে ৩৮১ কোটি ডলার, জুনে ৩৪০ কোটি ডলার, জুলাইয়ে ২২১ কোটি ডলার, আগস্টে ৩২৫ কোটি ডলার, সেপ্টেম্বরে ২৫৮ কোটি ডলার, অক্টোবরে ১৭৪ কোটি ডলার, নভেম্বরে ১৫৩ কোটি ডলার ও ডিসেম্বরে ১৮১ কোটি ডলার লেনদেন হয়। গত বছরের মতো এ বছরও এ খাতে লেনদেন কমেছে। গত জুন পর্যন্ত প্রায় অর্ধেক কমে গেছে।
এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে ডলার লেনদেন ২০১৭ সালে ছিল ১ হাজার ৮১০ কোটি ডলার। ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ১৮০ কোটি ডলার। ২০১৯ সালে তা কিছুটা কমে হয় ১ হাজার ৫৭০ কোটি ডলার। ২০২০ সালে তা দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৪৫০ কোটি ডলারে। করোনার কারণে ওই বছরে দেশে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে। এর বিপরীতে আমদানি ছিল কম। যে কারণে ডলারের ছড়াছড়ি ছিল বাজারে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনে রিজার্ভ বাড়িয়ে রেকর্ড উচ্চতায় তুলেছিল। তখন এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকে দীর্ঘমেয়াদি রীতিতে ডলারের লেনদেন করে ভারসাম্য রক্ষা করে।
২০২১ সালে করোনার ধকল কমলে আমদানি বাড়তে থাকে। এ সময় আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দামও বেড়ে যায়। তখন আমদানি ব্যয়ও বাড়ে। তখনো ডলারের প্রবাহ বেশি থাকায় এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে লেনদেন বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৩৭০ কোটি ডলারে। ২০২২ সালের ফেব্র“য়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে এপ্রিল থেকে ডলার সংকট প্রকট হতে থাকে। পরে তা ক্রমেই বেড়েছে। ফলে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে ডলার লেনদেনও কমে যায়। ওই বছরে তা কমে ৩ হাজার ৭০৫ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত তা আরও কমে ১ হাজার ৭২০ কোটি ডলারে নামে। গত আগস্ট থেকে এ ধরনের লেনদেন আরও কমেছে।
এদিকে টাকার মান ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে গত বছর রেকর্ড পরিমাণ ডলার বিক্রি করে। ওই বছরে ১ হাজার ২৯৪ কোটি ডলার বিক্রি করে। এর বিপরীতে কোনো ডলার বাজার থেকে কেনেনি। চলতি বছরের শুরু থেকে ডলার বিক্রি কমিয়েছে। তারপরও রিজার্ভ থেকে গত আগস্ট পর্যন্ত ৭৮৪ কোটি ১৭ লাখ ডলার বিক্রি করেছে। এর আগে ২০১৭ সালে ১২৩ কোটি ১০ লাখ ডলার, ২০১৮ সালে ২২৯ কোটি ২০ লাখ ডলার, ২০১৯ সালে ১৬২ কোটি ১০ লাখ ডলার বিক্রি করে। ২০২০ সালে বিক্রি করেছিল মাত্র ৬৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। ওই বছর বাজারে ডলারের প্রবাহ ছিল বেশি। যে কারণে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে পেরেছে। তবে সরকারি আমদানির দায় মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে কম দামে ডলার দিয়েছে। কারণ ওই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলারের দাম বাজার থেকে ৪-৫ টাকা কম ছিল। আইএমএফের চাপে এখন বাজারের সমান দরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ডলার বিক্রি করে। ২০২১ সালে ডলার বিক্রি করে ২৪৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
এদিকে ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ডলার বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়। জুনে তা প্রবল আকার ধারণ করে। সেপ্টেম্বরে গিয়ে তা আরও প্রকট হয়। ওই সময়ে ঘন ঘন ডলারের দাম এলোপাতাড়িভাবে বাড়ছিল। ওই বছরজুড়েই ছিল অস্থিরতা। গত বছরের শেষদিকে ডলারের দাম বাফেদার মাধ্যমে নির্ধারিত হতে শুরু করে। প্রতিমাসের শুরুর দিকে তারা ডলারের দাম বাড়াচ্ছিল। এতে বাজারে অস্থিরতা কমলেও ডলার সংকট প্রবল হচ্ছিল। বাফেদার নির্দেশনা ভঙ্গ করে বেশি দামে যেমন ডলার কিনেছে, তেমনি বিক্রিও করেছে। এতে ডলার কেনাবেচার সঙ্গে জড়িতরা শাস্তির মুখেও পড়েছে। সাম্প্রতিক তদন্তেও আরও কিছু ব্যাংক একই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে শাস্তির মুখে আছে।
ঘোষিত দরের চেয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রি ও ডলার মজুত করার খবর পেয়ে গত মাসে মানি চেঞ্জার্স ও খোলাবাজারে অভিযান পরিচালনা করে গোয়েন্দা সংস্থা। এতে বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়। কয়েকটি মানি চেঞ্জার্সের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এতে ডলার বাজারে নেমে আসে স্থবিরতা। কেউ এখন আর ডলার বিক্রি করছে না। মানি চেঞ্জার্সের বেশিরভাগই বন্ধ থাকছে। তাদের অভিযোগ, বেঁধে দেওয়া দামে ডলার মিলছে না। ফলে তারা ডলার কিনতেও পারছে না, বিক্রিও করছে না।