নির্ধারিত মেয়াদে শেষ হয়নি কাজ। নানা কারণে দফায় দফায় বেড়েছে মেয়াদ। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পায় ব্যয়ও। এমন ১৫টি প্রকল্পের পেছনে মূল ব্যয়ের তুলনায় বাড়তি খরচ যাচ্ছে ৬০ হাজার ৬৫৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, যা মূল ব্যয়ের প্রায় দ্বিগুণ। অনুমোদনের সময় ব্যয় ধরা ছিল ৭৭ হাজার ৮৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা।
বাস্তবায়ন পর্যায়ে ডিজাইনে ত্রুটি, উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়নে জটিলতা, সঠিক সম্ভাব্যতা যাচাই না হওয়া, ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন ব্যয় বেশি, ঠিকাদারদের গাফিলতি, দরপত্র প্রক্রিয়ায় দেরিসহ নানা কারণে বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্প যদি সঠিকভাবে তৈরি হতো এবং সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা করা গেলে বাড়তি টাকা নাও লাগতে পারত। এটা একধরনের অপচয়। সেই সঙ্গে যে সময়ে যেসব সুফল পাওয়ার কথা, সেগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ ও জাতি। এর একটি কস্ট বেনিফিট অ্যানালাইসিস করা দরকার।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ঢালাওভাবে অপচয় বলা যাবে না। তবে এরকম বাড়তি খরচ কাম্য নয়। এমন হওয়া উচিতও নয়, তারপরও হচ্ছে। এগুলোর সঙ্গে অনেক লোক জড়িত। কাজেই কে কোথায় ফাঁকি দিচ্ছে, বোঝা মুশকিল। অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে বৈদেশিক পরামর্শক যুক্ত থাকে। কিংবা বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আনতে হয়। সেসব ক্ষেত্রে দেরি হলে সেটা বাস্তবতা। এছাড়া টাকার মান কমে যাওয়ায়ও কিছু প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে। পাশাপাশি বাস্তবায়ন দেরি হলে ব্যয় বাড়াটাই স্বাভাবিক। কেননা টাইম ইজ মানি। আমরা চেষ্টা করছি বলেই ধীর ধীরে এ অবস্থার উন্নতি হচ্ছে।
প্রকল্পগুলো হলো-পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রজেক্ট, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ এবং দোহাজারী-রামু-গুনদুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ। আরও আছে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণ, সিরাজগঞ্জ শিল্পপার্ক স্থাপন, চিটাগাং সিটি আউটার রিংরোড নির্মাণ এবং খুলনা শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প। এছাড়া রয়েছে বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মাণ (প্রথম পর্যায়)।
সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প-২: এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক ৪ লেনে উন্নীতকরণ। উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়কে দীর্ঘ সেতু নির্মাণ (এলবিসি)। জাতীয় উন্নয়ন প্রশাসন একাডেমি প্রতিষ্ঠা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিদ্যমান চত্বরে ১টি বহুতল অফিস ভবন নির্মাণ প্রকল্প।
বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শেষ হলে ভালোই হতো। কিন্তু সেটি না হওয়ায় যে পুরোটাই অপচয় হয়েছে, সেটিও বলা যায় না। কেননা বিআরটিসহ অনেক প্রকল্প সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা যায়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ার বাস্তব কারণ আছে। তবে প্রকল্প নেওয়ার সময় সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ঠিক মতো করা হলে এবং সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা থাকলে এত সমস্যা হতো না। অর্থাৎ গোড়ায় গলদ থাকলে বাস্তবায়ন পর্যায়ে এর প্রভাব পড়বেই।
সূত্র জানায়, পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি ২০০৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। সেসময় মূল অনুমোদিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়াসহ নানা জটিলতায় শুরুতেই হোঁচট খায় প্রকল্পটি।
পরবর্তী সময়ে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করে প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় ধরা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। সর্বশেষ মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে মূল বরাদ্দের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে ২২ হাজার ৪৪৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (পিপিপি) প্রকল্পটি ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। মূল অনুমোদিত ব্যয় ধরা হয় ৩২১৬ কোটি টাকা। কিন্তু সর্বশেষ মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয়েছে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। জমির দাম এবং পুনর্বাসন ব্যয়সহ নানা কারণে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯১৭ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যয় বেড়েছে ১৭০১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এছাড়া পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পটি ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে চায়না এক্সিম ব্যাংকের অর্থায়ন সংক্রান্ত জটিলতায় প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে যায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। বাড়তি খরচ যাচ্ছে ৪২৫৪ কোটি ৮ লাখ টাকা।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহুলেন টানেল নির্মাণ প্রকল্পটি ৮৪৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদন দেয় একনেক। কিন্তু চীনা এক্সিম ব্যাংকের ঋণ প্রক্রিয়া নানা জটিলতার কারণে বাস্তবায়ন পিছিয়ে যায়। সর্বশেষ ব্যয় বাড়িয়ে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে মেয়াদও বেড়েছে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ফলে এ প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় যাবে ২২৪৩ কোটি টাকা। দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে গুনদুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল।
সেসময় ব্যয় ধরা হয় ১৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে অর্থায়নের বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়ায় বাস্তবায়ন পিছিয়ে যায়। সেই সঙ্গে প্রথম পর্যায়ে সিঙ্গেল লাইন মিটার গেজ ট্র্যাক নির্মাণের কথা থাকলেও পরে মিটার গেজের পরিবর্তে ডুয়েল গেজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। ফলে প্রথম সংশোধনীতে ১৬ হাজার ১৮২ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে মোট খরচ ধরা হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত।
অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের আরও একটি প্রকল্প হলো সিরাজগঞ্জ বিসিক শিল্পপার্ক স্থাপন। এটি ১৯৯৯ সালের ১৭ জুন অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ বোর্ড সভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সিরাজগঞ্জে একটি শিল্পপার্ক স্থাপনের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত দেন। এরপর থেকেই শুরু হয় প্রকল্প প্রণয়নের কাজ। এর মাঝে চলে যায় প্রায় ২৩ বছর। দীর্ঘদিনেও কাজ শেষ না হওয়ায় খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। প্রকল্পটির মূল ব্যয় ছিল ৩৭৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা। কিন্তু সর্বশেষ সংশোধনীর মাধ্যমে করা হয় ৭১৯ কোটি ২১ লাখ টাকা। সম্প্রতি ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
‘খুলনা থেকে মোংলা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ’ প্রকল্পের মূল ব্যয় ছিল ১৭২১ কোটি ৩৯ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে আরও ৪৫৯ কোটি ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। এতে প্রকল্পটির ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৪২৬০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সে হিসাবে প্রথম প্রাক্কলিত ব্যয়ের তুলনায় বর্তমান ব্যয় বেড়েছে আড়াই গুণ। সর্বশেষ সংশোধনী অনুযায়ী প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত রয়েছে। সূত্র জানায়, ২০১১ সালে ‘চিটাগাং সিটি আউটার রিং রোড’ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার।
একে একে ১১টি বছর পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি কাজ। চতুর্থ দফায় ব্যয় বাড়ানোয় ৮৫৬ কোটি ২৮ লাখ ৬০ হাজার টাকার প্রকল্পের খরচ দাঁড়িয়েছে ২৬৭৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকায়। ফলে বাড়তি ব্যয় যাচ্ছে ১৮১৯ কোটি ৬৮ টাকা। বিআরটি গাজীপুর-এয়ারপোর্ট (গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট) প্রকল্প। দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ায় চার বছরের এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সময় লাগবে ১২ বছর। সর্বশেষ মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে।
এটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ২০৩৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪২৬৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। ফলে এ প্রকল্পে বাড়তি যাচ্ছে ২২২৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এদিকে পৌনে ৪ কিলোমিটার সড়ক ১৮ দশমিক ৩০ মিটার প্রশস্ত করতে সাড়ে ১১ বছর লাগছে। অথচ প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় ২ বছরে সম্পন্ন করার কথা। সেই সঙ্গে প্রায় ৯৯ কোটি টাকার ‘খুলনা শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পটির বাস্তবায়ন খরচ এখন ১৬০ কোটি ৩১ লাখ টাকা বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পটি শেষ করতে ২৫৯ কোটি ২১ লাখ টাকা লাগবে। ফলে বাড়তি খরচ যাবে ১৬০ কোটি ৩১ লাখ টাকা।