জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে প্রথমে শুরু হয় ছন্দপতন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের ১ বছর বা ৬ মাস আগে থেকে শুরু হয় এই ছন্দপতন। একটি নির্বাচনের পর টানা ৪ বছর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ার যে গতি থাকে নির্বাচনি বছরে বা নির্বাচনের ১ বছর বা ৬ মাস আগে থেকে এটি কমতে থাকে।
একপর্যায়ে রিজার্ভ বাড়ার গতি থেমে গিয়ে নিম্নমুখী হয়। কখনো বাড়লেও তা খুবই সামান্য। চূড়ান্ত হিসাবে নির্বাচনের ৬ মাস আগের পরিমাণে রিজার্ভ নির্বাচনি মাসে থাকে না। তা বেশ কমে যায়। নির্বাচনের পর আবার রিজার্ভ বাড়তে থাকে। সব মিলে নির্বাচনি বছরে রিজার্ভে চলে উত্থান-পতন।
অথচ নির্বাচনি বছরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে। ঋণ প্রবৃদ্ধির হারও কমে যায়। তারপরও রিজার্ভ কমাকে ভালো চোখে দেখছেন না দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে নির্বাচনের আগে দেশের রাজনীতিতে যে অনিশ্চয়তা দেখা দেয় তাতে করে অনেকে বিদেশে টাকা পাচার করে দেন। আমদানি-রপ্তানির আড়ালে বা হুন্ডির মাধ্যমে এসব টাকা পাচার হয়। যে কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়ে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে উত্থান-পতন হয়েছে। নির্বাচনের বছরের শুরুর দিকে রিজার্ভ বেড়ে রেকর্ড পরিমাণ উচ্চতা ছুঁয়েছে। কমপক্ষে ৬ মাস আগে থেকে কমতে শুরু করে। কোনো কোনো মাসে বাড়লেও পরিমাণে তা খুব কম। নির্বাচনি বা তার আগের মাসে রিজার্ভ কমে যায় বেশ। নির্বাচনের পর আবার বাড়তে শুরু করে। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। তবে এবার গত ২ বছর ৪ মাস ধরে রিজার্ভ কমছে। এবার রিজার্ভ কমার অন্যতম কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া ও বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব। এছাড়া দেশ থেকে নানা ভাবে টাকা পাচার হচ্ছে। এ কারণেও রিজার্ভ কমছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দুর্নীতির মাধ্যমে যেসব টাকা অর্জিত হয় সেগুলো নির্বাচনি বছরে একটি চক্র বিদেশে পাচার করে দেয়। কারণ নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল হলে একপক্ষ নানাভাবে নাজেহাল হবেন। এ আশঙ্কায় তারা টাকা বিদেশে পাচার করে সেখানে বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। যে কারণে নির্বাচনি বছরে আমদানি ব্যয় অস্বাভিকভাবে বেড়ে যায়। রপ্তানি আয়ের মূল্য দেশে না আসার প্রবণতা বাড়ে। একই কারণে কার্ব মার্কেটে ডলারের দামে বড় ধরনের ওঠানামা করে। এবারের নির্বাচনের আগে থেকে ডলার সংকটের কারণে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। টাকা পাচারের বাকি সবই হচ্ছে। ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই নির্বাচনের অনেক আগে থেকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। তবে এবারের রিজার্ভ কমার সঙ্গে বৈশ্বিক কারণের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নানা কারণ জড়িত। এর মধ্যে নির্বাচনের কারণে এক ধরনের অনিশ্চয়তাও দেখা দিয়েছে। এ কারণে অনেকেই টাকা পাচার করছেন। নির্বাচনের ২ বছর ৪ মাস আগে ২০২১ সালের আগস্টে দেশের রিজার্ভ বেড়ে রেকর্ড ৪ হাজার ৮০৬ কোটি ডলারে ওঠেছিল। এরপর থেকে তা কমছে। কমার গতি এখনও অব্যাহত রয়েছে। জুলাইয়ে রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৯৭৩ কোটি ডলার। আগস্টে তা কমে ২ হাজার ৯২৬ কোটি ডলারে নামে। সেপ্টেম্বরে আরও কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৬০৮ কোটি ডলারে। অক্টোবরে ২ হাজার ৬৪৮ কোটি ও নভেম্বরে ২ হাজার ৪৮৯ কোটি ডলারে নামে। আইএমএফ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণের কিস্তি ছাড় হওয়ায় সম্প্রতি রিজার্ভ কিছুটা বেড়ে ২ হাজার ৬০৫ কোটি ডলারে ওঠে। নির্বাচনের পর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা শোধ করলে রিজার্ভ আবার কমে যাবে।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদের একাদশ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময়ে রিজার্ভ সাশ্রয় ও আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ সংকোচন নীতি গ্রহণ করে। তারপরেও আমদানি ব্যয় কমেনি। বরং আরও বেড়েছে। শুধু সেপ্টেম্বরই আমদানি ব্যয় বেড়েছিল ২৪ শতাংশের বেশি। আমদানি ব্যয়সহ অন্যান্য খাতে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় বাড়ার কারণে রিজার্ভে গিয়ে চাপ পড়ে। ওই বছরের ৩০ জুন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৩১৭ কোটি ডলার। ২৯ আগস্ট তা কমে ৩ হাজার ২৮০ কোটিতে দাঁড়ায়। ৩১ অক্টোবর আরও কমে ৩ হাজার ২০৮ কোটিতে নেমে যায়। নভেম্বরে তা আরও কমে ৩ হাজার ১০৫ কোটি ডলারে নেমে যায়। ডিসেম্বরের শেষে তা বেড়ে ৩ হাজার ২০২ কোটি ডলারে ওঠে। নির্বাচনের পর জানুয়ারিতে রিজার্ভ কিছুটা কমে ফেব্রুয়ারি থেকে আবার বাড়তে শুরু করে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে সহনশীল রাজনৈতিক পরিবেশ না থাকলে অনিশ্চয়তা বাড়ে। ফলে অনেকের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দেয়। এ কারণে নির্বাচনি বছরে দেশ থেকে টাকা পাচার বাড়ে। ফলে রিজার্ভেও চাপ পড়ে। সুস্থ ও সহনশীল রাজনৈতিক চর্চা গড়ে উঠলে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা হলে এই প্রবণতা কমে আসবে।
প্রাপ্ত্য তথ্যে দেখা যায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদের দশম নির্বাচন। এর আগে পরে রিজার্ভে বেশ উঠানামা ছিল। ওই সময়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ছিল বেশ উত্তপ্ত। ওই নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের আগস্টে রিজার্ভ বেড়ে ১ হাজার ৬২৫ কোটি ডলারে ওঠে। সেপ্টেম্বরে আবার কমে ১ হাজার ৬১৫ কোটি ডলারে নেমে যায়। অক্টোবরে আবার বেড়ে ১ হাজার ৭৩৪ কোটি ডলারে ওঠে। নভেম্বরে আবার ১ হাজার ৭১০ কোটি ডলারে নেমে যায়। ডিসেম্বরে বেড়ে ১ হাজার ৮০৯ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এটি আবার বাড়তে থাকে । ওই মাস শেষে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৮১২ কোটি ডলারে। ওই বছরে নির্বাচন বেশিরভাগ বিরোধী দল বর্জন করেছিল। ফলে নির্বাচনি উত্তাপ ছিল না মাঠে। উলটো রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত ছিল। আমদানি-রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কার্যক্রম ছিল কম। ফলে রিজার্ভে খুব বেশি প্রভাব পড়েনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর শান্তিপূর্ণভাবে সংসদের নবম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে সব দল অংশ নেয়। রাজনৈতিক উত্তাপের পরিবর্তে ছিল নির্বাচনি উত্তাপ। ২০০৮ সালের জুনে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৬১৫ কোটি ডলার। জুলাইয়ে তা কমে ৫৮২ কোটি ডলার, আগস্টে সামান্য বেড়ে ৫৯৬ কোটি ডলারে ওঠে। সেপ্টেম্বরে তা আবার কমে ৫৮৬ কোটি ডলার নেমে যায়। অক্টোবরে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৫৫৫ কোটি ডলারে। নভেম্বরে আরও কমে ৫২৪ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। নির্বাচনের পর ওই মাসে রিজার্ভ কিছুটা বেড়ে ৫৭৯ কোটি ডলারে ওঠে। জানুয়ারিতে আবার কমে ৫৫৮ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ফেব্রুয়ারিতে আবার বেড়ে ৫৯৫ কোটি ডলার ওঠে।
২০০১ সালের ১ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হয় অষ্টম সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনের আগে-পরেও রিজার্ভে উত্থান-পতন হয়েছিল। ওই সময়ে ক্ষমতাসীন সরকার ক্ষমতা ছাড়ার আগে রিজার্ভ আগের ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে ৯৯ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নিলে রিজার্ভ আবার বাড়তে থাকে। ২০০১ সালের জুলাইয়ে রিজার্ভ ছিল ১১৪ কোটি ডলার। আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২৫ কোটি ডলারে। সেপ্টেম্বরে আবার কমে ১১৫ কোটি ডলারে নেমে যায়। অক্টোবরে আরও কমে ১০৮ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। নভেম্বর থেকে রিজার্ভ আবার বাড়তে থাকে। নভেম্বরে এর পরিমাণ বেড়ে ১১১ কোটি ডলার এবং ডিসেম্বরে তা আরও বেড়ে ১৩০ কোটি ডলারে দাঁড়ায়।