অর্থনীতি

ফাগুন হাওয়ায় গাঁদা ফুলে আগুন, গোলাপের দামে রেকর্ড

পয়লা ফাল্গুন ও বসন্তবরণ উৎসব বুধবার। এছাড়া এদিনই ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’।

একই দিনে দুই দিবস ঘিরে বাজারে বেড়েছে ফুলের চাহিদা।
ফুলের রাজ্যখ্যাত যশোরের গদখালীর পাইকারি বাজারে গাঁদা ও গোলাপ ফুলের বাজার জমজমাট হয়ে উঠেছে। চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় অন্যান্য ফুলের পাশাপাশি গাঁদা ফুলের দামও বাড়ছে হু হু করে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে এই ফুলের দাম বেড়েছে পাঁচ থেকে সাতগুন পর্যন্ত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এই ফুলের দাম আরও বাড়বে। বসন্ত উৎসবের দিনে বিশ্ব ভালবাসা দিবস হওয়ায় এদিন গোলাপের চাহিদাও থাকে সর্বোচ্চ।

ফুলচাষিরা বলছেন, রেকর্ড সর্বোচ্চ দামে এ বছর গোলাপ বিক্রি হয়েছে। তবে বৈরী আবহাওয়ায় কম ফুল উৎপাদন এবং চড়া বাজারে ইন্ডিয়ান গোলাপের আগমনে তাদের মনে লোকসানের আশঙ্কা।

সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) রেকর্ড সর্বোচ্চ দামে গদখালী বাজারে গাঁদা ফুল কেনা-বেচা হয়েছে। প্রতি হাজার গাঁদা ফুল ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে কেনা-বেচা হয়েছে। গত সপ্তাহে এ পরিমাণ ফুল ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। গাঁদা ফুলের এমন দামে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা ভীষণ খুশি।

একই দিনে গোলাপের রেকর্ড দাম থাকলেও গতদিনের তুলনায় দাম কিছুটা কমেছে। এদিন গোলাপ বিক্রি হয়েছে ২০-২৫ টাকা। অথচ একদিন আগে রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) গোলাপ বিক্রি হয়েছিল মানভেদে ২৫-৩০ টাকা পর্যন্ত। চায়না গোলাপের দাম ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।

এদিন প্রতিটি রজনীগন্ধা বিক্রি হয়েছে ১২ থেকে ১৫ টাকা, রঙিন গ্লাডিউলাস প্রতিটি বিক্রি হয়েছে (মানভেদে) ২০ থেকে ২৫ টাকা, জারবেরা বিক্রি হয়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা ও চন্দ্রমল্লিকা ৩ থেকে ৫ টাকা। ফুল বাঁধাইয়ের জন্য কামিনীর পাতা বিক্রি হয়েছে প্রতি আঁটি ৩০ টাকায়। জিপসির আঁটি বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকায়।

মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সকালে গদখালী ফুলের বাজারে গিয়ে দেখা যায়, কাকডাকা ভোর থেকেই কৃষকরা বড় বড় ঝুড়ি ও বস্তায় ভরে ভ্যানে করে গাঁদা ফুল নিয়ে এসেছেন মোকামে। যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের পাশের ফুলের আড়তে তারা গাঁদা বিক্রি করছেন। কেউ কেউ ভ্যানের ওপর থেকে নিজেরাই গাঁদা ফুল বিক্রি করছেন। একদিকে চলে ফুলের বেচাকেনা অন্যদিকে নারীরা সুঁই সুতো দিয়ে শুরু করেন মালা গাঁথার কাজ। তাদের গাথা মালা বিভিন্ন পরিবহনে করে ঢাকাসহ দেশের জেলায় জেলায় পাঠানো হয়। এদিন গাঁদা ফুলের ভালো দাম পেয়ে অধিকাংশ কৃষকের মুখে চওড়া হাসি ফুটেছে। কৃষকরা বলছেন, এবার গাঁদা ফুলের দাম আরও বাড়বে।

পানিসারা গ্রামের কৃষক আরিফ হোসেন বলেন, সাড়ে ছয় হাজার গাঁদা নিয়ে হাটে এসেছি। প্রতি হাজার ফুল বিক্রি হয়েছে ৬৫০ টাকা দরে। সপ্তাহখানেক আগে এই ফুল বিক্রি করেছি প্রতি হাজার ১৫০ টাকা দরে।

হাঁড়িয়া গ্রামের গাঁদা ফুলচাষি বাবু জানান, গতকাল (সোমবার) ও আজ (মঙ্গলবার) ভালো দামে গাঁদা ফুল বিক্রি হয়েছে। তিনি হাজার প্রতি ৪৫০ টাকা দরে ৪ হাজার ফুল বিক্রি করেছেন।

বেনেয়ালি গ্রামের শহিদুল গাজী বলেন, দশ হাজার গাঁদা ফুল নিয়ে এসেছি। প্রতি হাজার বিক্রি হয়েছে ৬০০ টাকা। এসব ফুল ক্রেতারা বসন্ত উৎসবের জন্য কিনছেন। ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে এই ফুলের দাম আরও বাড়বে।

ফুল ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, এ বছর সর্বোচ্চ দামে গাঁদাফুল বিক্রি হচ্ছে। রোববার ও সোমবার ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত প্রতি হাজার ফুল বিক্রি হয়েছে।

যশোর ফুল উৎপাদক ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, এই অঞ্চলে অন্তত ৩০০ হেক্টর জমিতে গাঁদা ফুলের চাষ হয়। বসন্তবরণ উৎসব ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে গাঁদা ফুলের চাহিদা বাড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গাঁদা ফুলের দাম সর্বোচ্চ থাকবে।

আড়তদারের মাধ্যমে কৃষকের কাছ থেকে ব্যাপারীরা গাঁদা ফুল কিনে স্থানীয় নারীদের দিয়ে মালা তৈরি করিয়ে নেন। ওই মালা বস্তায় ভরে সারা দেশের খুচরা ফুলের দোকানে পাঠানো হয়। গদখালী বাজার লাগোয়া সদিরালী গ্রামের অন্তত ২০০ নারী বাড়ির আঙিনায় বসে গাঁদা ফুলের মালা গাঁথার কাজ করেন। প্রতিপিস মালা গাথা বাবদ তারা মজুরি নেন ২০ টাকা। এখন প্রতিদিন তারা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় করছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, নুপুর বেগমের বাড়ির বাড়ির উঠান ও বারান্দায় মালা গাথার কাজ করছেন দীপা, সামসুন্নাহার, সুমাইয়া, তহুরন, কোহিনুরসহ অন্তত দশ নারী। নুপুর বলেন, সংসার বাচ্চা সামাল দিয়ে আমরা গাঁদা ফুলের মালা গাঁথার কাজ করি। এখন কাজের চাপ অনেক বেশি। ব্যাপারীরা আমার কাছে ফুল ও সূতা দিয়ে যান। যে যত বেশি মালা গাঁথতে পারবে সে ততো টাকা পাবে।

দীপা বলেন, প্রতিটা মালার জন্য ব্যাপারীরা ২০ টাকা মজুরি দেন। এখন কাজের চাপ বেশি, প্রতিদিন ২০টা মালা গাঁথতে পারি। এখন ৪০০ টাকা আয় হচ্ছে।

গাঁদা ফুল গাঁথার কাজে ব্যস্ত বৃদ্ধা কোহিনুর বেগম বলেন, এ বয়সে এসে মালা গাঁথার কাজ করে আয় করতে পারছি এটাই বড় পাওয়া।

এদিকে সোমবার সকালে অনেক কৃষক তাদের উৎপাদিত গোলাপ বিক্রি না করতে পেরে ফিরে গেছেন। অনেকেই কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে কম দামে বিক্রি করেছেন। তাদের অভিযোগ, ভারত থেকে আনা গোলাপ বাজারে সয়লাবের কারণে সোমবার কৃষকদের গোলাপ বিক্রি কম হয়েছে।

হাঁড়িয়া নিমতলা গ্রামের কৃষক রাসেল হোসেন বলেন, সোমবার বাজারে প্রচুর পরিমাণ গোলাপ উঠেছে। আমার গোলাপ বিক্রি না করতে পেরে বাড়ি ফেরত এনেছি। তিনি দাবি করেন, এদিন বাজারে প্রচুর পরিমাণ ভারত থেকে আনা গোলাপ উঠেছে। এ জন্য বিক্রি কমে গেছে।

নীলকণ্ঠনগর গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, অনেক চাষি তাদের গোলাপ বিক্রি করতে পারেননি। ভোরের বাজারে ২০-২২ টাকা বিক্রি হলেও পরে দাম কমে যায়। সবাই বলছে ইন্ডিয়ান গোলাপ আমদানির কারণে গোলাপের দাম পড়ে গেছে।

এ বিষয়ে যশোর ফুল উৎপাদক ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, এ বছর বৈরী আবহাওয়ার কারণে গোলাপের উৎপাদন কম হয়েছে। দাম বেশি পাওয়ায় কৃষকরা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারতেন। সোমবার হঠাৎ কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ভারত থেকে গোলাপ আমদানি করেন। ফলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ঢাকার ফুল ব্যবসায়ী ইমামুল হোসেন বলেন, আমরা ভারত থেকে সারা বছরই চায়না গোলাপ আমদানি করি। এটার দাম স্বাভাবিক গোলাপ থেকেও অনেক বেশি। এটা আমদানি করলে দেশের চাষিদের ক্ষতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।

গদখালি বাজারের ফুল ব্যবসায়ী ইমামুল হোসেন বলেন, আমি কোনো ফুল আমদানির সঙ্গে জড়িত না। দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসায়ীদের চাহিদার ভিত্তিতে আমদানিকারকের কাছ থেকে ফুল কিনে সরবরাহ করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *