ব্যাংকের শাখার প্রায় সব সুবিধাই মিলছে উপশাখাগুলোতে। এসব উপশাখায় ব্যাংকিং সুবিধা পেতে গ্রাহকদের তেমন কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। সাধারণত, একটি ব্যাংকের শাখা চালাতে ব্যাংকগুলোর যে পরিমাণ খরচ ও জনবল নিয়োগ দিতে হয় তার তুলনায় উপশাখা চালাতে অনেক কম খরচ ও জনবল নিয়োগ দিতে হয়। শাখার মতো জাঁকজমকপূর্ণ প্রশস্ত অবকাঠামোর দরকার হয় না উপশাখাগুলোতে। আবার উপশাখা খোলার ক্ষেত্রে রেগুলেটরি ঝামেলাও অনেক কম। এসব কারণে ব্যাংকগুলো এখন উপশাখা খোলার দিকে ঝুঁকছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশের কার্যরত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ৩০টি ব্যাংক গত মাস পর্যন্ত ১ হাজার ২৭৫টি উপশাখা খুলেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩২৮টি উপশাখা খুলেছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। এর পরের অবস্থানে রয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক। তারা ৩০১টি উপশাখা খুলেছে। আর ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ খুলেছে ১৮২টি উপশাখা। এছাড়া ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ৫৯টি, সোশ্যাল ইসলামী ও এক্সিম ব্যাংক ৫৪টি করে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৪০টি, যমুনা ব্যাংক ৩৮টি এবং মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ৩২টি উপশাখা চালু করেছে। দেশে ৬০টি ব্যাংক কর্মরত রয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ব্যাংকগুলো সারাদেশে ১০ হাজার ৬৩০টি শাখা খুলেছে। শাখানির্ভর ব্যাংকিংসেবা সব মানুষের হাতের নাগালে পৌঁছাতে পারেনি। শাখানির্ভর ব্যাংকিং খাতের ঋণ ও ব্যাংকিং সুবিধা মূলত ব্যবহার করছে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং বড় ও মাঝারি শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো। নিম্নবিত্ত সাধারণ জনগণ এবং ছোট শিল্প ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত ব্যাংকের ঋণ ও অন্যান্য সুবিধা যথেষ্ট পরিমাণে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। সব মানুষকে ব্যাংকিংসেবা দিতে নতুন নতুন সেবা চালুর প্রক্রিয়া ২০০৯ সাল থেকে অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঐ বছর থেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিংসেবার ধারণা ব্যাপকভাবে ব্যাংকিং নীতিতে স্থান করে নিয়েছে। খরচ কমিয়ে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং ধারণার একটি হলো উপশাখা ব্যাংকিং।
উপশাখা বিষয়ে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল বলেন, স্বল্প ব্যয়ে মানুষকে বেশি সেবা দেওয়ার জন্য আমাদের ব্যাংকই সবার আগে উদ্যোগ নেয়। এক্সপ্রেস ব্যাংকিং হিসেবে আমরা প্রথম কাজ শুরু করি। উপশাখা বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার দেওয়ার আগে থেকেই আমরা এমন মডেলে কাজ শুরু করি। ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন সেন্টার হিসেবে কাজ শুরু হয়। গার্মেন্টস এলাকা, বিআরটিএ, জমি রেজিস্ট্রেশন অফিসে কাজ শুরু হয়। অন্য ব্যাংকগুলো উপশাখাকে ডিপোজিট হান্টিং সেন্টার করলেও আমরা সার্ভিস সেন্টার হিসেবে তা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছি এবং পেরেছি। ৬০ ফুট থেকে শুরু করে ১ হাজার ফুট পর্যন্ত আয়তনে আমাদের উপশাখাগুলো রয়েছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এনআরবিসির উপশাখা ৩২৮টি থাকলেও এখন তা ৪৫০ হয়ে গেছে। এ বছর শেষে উপশাখা সংখ্যা দাঁড়াবে ৫০০টিতে।
তিনি বলেন, খরচের দিক থেকে উপশাখাকে স্বল্পব্যয়ী ব্যাংকিং সেবার আউটলেট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সে হিসেবে প্রচলিত শাখা স্থাপনের জন্য নির্ধারিত বিভিন্ন ব্যয়সীমার চেয়ে উপশাখা স্থাপনের ব্যয় এবং প্রচলিত শাখা কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাংকিং সেবার জন্য নির্ধারিত ফি, চার্জ ও কমিশনের চেয়ে ব্যাংকিং বুথে সেবা প্রদানের ফি, চার্জ, কমিশন প্রভৃতি কম ছাড়া বেশি হবে না। উপশাখার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে ব্যাংক ব্যবসার প্রসার ঘটিয়ে সুবিধাবঞ্চিত জনগণের কাছে আর্থিক সেবা পৌঁছে দেওয়া এবং স্বল্পব্যয়ী ব্যাংকিং সেবা আউটলেটের মাধ্যমে অধিকতর আর্থিক সেবাভুক্তি নিশ্চিত করা।
এই বিষয়ে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ওসমান আলী বলেন, উপশাখা অত্যন্ত যুগোপযোগী ব্যাংকিং ধারণা। এখানে বৈদেশিক লেনদেন ছাড়া ব্যাংকের সব ধরনের সেবা পাওয়া যায়। অনেক এলাকায় ব্যাংকের শাখা খোলার মতো পরিস্থিতি নেই কিন্তু সেখানকার মানুষের ব্যাংকিং সেবা দরকার। এই পরিস্থিতিতে উপশাখা কার্যকরী সমাধান। শাখা খোলার জন্য ব্যাংকের বিভিন্ন খাতে বেশ মোটা অঙ্কের খরচ করতে হয়। উপশাখা খোলার ক্ষেত্রে এই খরচ অনেক কম।
একসময় ব্যাংকের ব্যবসা হিসেবে শাখা ব্যাংকিং, কৃষি শাখা, এসএমই শাখা, বুথ (কালেকশন বুথ, ফাস্ট ট্র্যাক, সেবাঘর ও ইলেকট্রনিক বুথ) ও ব্যবসা উন্নয়ন কেন্দ্র অন্তর্ভুক্ত ছিল। স্বল্প ব্যয়ে ব্যাংকিংসেবা কীভাবে মানুষের নাগালে পৌঁছানো যায়, তারই আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকিং বুথ স্থাপন-সংক্রান্ত নীতিমালা জারি করে। এতে বলা হয়, ব্যাংকিং বুথের আয়তন হবে এক হাজার বর্গফুটের মধ্যে। এরপরই ব্যাংকগুলো বুথ স্থাপন জোরদার করে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলার জারির মাধ্যমে ব্যাংকিং বুথকে উপশাখায় রূপান্তর করে।