জাতীয়

ঘরমুখো মানুষের স্রোত

সরকারি অফিস ছুটি হয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ের বেশির ভাগ অফিসও ছুটি হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আপনজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে ঘরমুখো মানুষের স্রোত। কেউ যাচ্ছেন সড়কপথে, কেউ ট্রেনে এবং কেউবা যাচ্ছেন লঞ্চে। সরকারের নানা তৎপরতায় বড় ধরনের ভোগান্তি ছাড়াই ট্রেনে বাড়ি ফিরছে মানুষ। লঞ্চযাত্রায়ও তেমন ভোগান্তি নেই। তবে সড়কপথে যানজটে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে বাড়িফেরা মানুষ। পাশাপাশি বাসের অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে যাত্রীর অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

ট্রেনের অগ্রিম টিকিট কাটা যাত্রীরা বুধবার থেকে যাত্রা শুরু করেছেন। বৃহস্পতিবার ছিল ট্রেনযাত্রার দ্বিতীয় দিন। প্রথম দিন অধিকাংশ ট্রেন বিলম্বে চলাচল করলেও দ্বিতীয় দিন সময় অনুযায়ী চলাচল করেছে। বৃহস্পতিবার বিকালে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পরিদর্শন করেছেন রেলপথমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিমসহ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

বৃহস্পতিবার সরেজমিন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ঘুরে দেখা যায় ঈদযাত্রার দ্বিতীয় দিন প্ল্যাটফরম ও স্টেশনে উপচে পড়া ভিড়। বিনা টিকিট রোধে স্টেশনে প্রবেশের ক্ষেত্রে তিন স্তরবিশিষ্ট চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে বাঁশ দিয়ে বিশেষ লাইন। রেলওয়ে-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শতচেষ্টায়ও বিনা টিকিট রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। কাউন্টার থেকে আসনযুক্ত কোনো টিকিট বিক্রি হচ্ছে না। তবে বিভিন্ন কাউন্টার থেকে স্ট্যান্ডিং টিকিট কাটতে দেখা গেছে যাত্রীসাধারণকে। অনলাইনে টিকিট কাটতে ব্যর্থ হওয়ায় কিছু যাত্রী আসনবিহীন টিকিট কেটে ট্রেনে ভ্রমণ করছেন। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে মধ্যরাত পযর্ন্ত ৪৫টি আন্তঃনগর ট্রেন কমলাপুর থেকে ছেড়ে গেছে।

বিলম্বে চলা কিছু ট্রেনের মধ্যে রাজশাহী কমিউটার ট্রেন প্রায় ২ ঘণ্টা দেরিতে কমলাপুর থেকে ছেড়ে গেছে। এছাড়া চট্টলা এক্সপ্রেস ১টা ৪৫ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও ছেড়েছে ৩টা ১৫ মিনিটে। বনলতা এক্সপ্রেস, অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস, নকশিকাঁথা এক্সপ্রেস ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা দেরিতে চলাচল করে।

এদিকে বৃহস্পতিবার বিকালে রেলপথমন্ত্রী কমলাপুর স্টেশন পরিদর্শন শেষে প্ল্যাটফরমে দাঁড়ানো সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনে ভ্রমণ করা যাত্রীদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে কুশল বিনিময় করেন। এ সময় রেলপথমন্ত্রী বলেন, আমরা সফলতার সঙ্গে বুধবার যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছি, যা সম্ভব হয়েছে রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নিরাপত্তা বাহিনীদের সহযোগিতায়। আমরা চেষ্টা করছি সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যেই যাত্রীদের বাড়ি পৌঁছে দিতে। এ সময় রেলপথ সচিব ড. হুমায়ুন কবীর, মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলীসহ রেলওয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বৃহস্পতিবার সরেজমিন রাজধানীর বহির্গমন মুখগুলো ঘুরে দেখা হয়। গাবতলী ও মহাখালী হয়ে উত্তরা রুটে তেমন কোনো দুর্ভোগ ছিল না। তবে গুলিস্তান, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী ও শ্যামপুর হয়ে যারা বাড়ি ফিরেছেন, তাদের অন্তহীন দুর্ভোগ পোহাতে দেখা গেছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে সায়েদাবাদ বাসটার্মিনাল ও আশপাশের বাস কাউন্টার এবং ঢাকা-মাওয়া সড়কের যাত্রাবাড়ী মোড়ে বাস কাউন্টারগুলোয় যাত্রীর প্রচুর চাপ দেখা যায়। তবে বিকাল ৫টার পর থেকে সায়েদাবাদ বাসটার্মিনালে এবং এর আশপাশের বাস কাউন্টারগুলোয় যাত্রীদের তেমন একটা চাপ দেখা যায়নি। অফিস ছুটির পর যাত্রীদের চাপ বেড়ে যায়। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে রাজধানীতে মুষলধারে বৃষ্টি নামে। এতে ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট থমকে যায় যাত্রীদের চলাচল। এরপর বৃষ্টিতে ভিজেই বাসটার্মিনাল ও কাউন্টারগুলোয় আসতে দেখা যায়। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর উপচে পড়া ভিড় হয়। কাউন্টারগুলোয় বাসের সংখ্যা কমে যাওয়ায় যাত্রীদের বাসের অপেক্ষায় বসে থাকতে হয়।

চাঁদপুর-কচুয়াগামী নিয়াজ সেমি তার বোন নিশিকে নিয়ে বিকাল পৌনে ৪টায় সায়েদাবাদ বাসটার্মিনালে যান। তিনি বলেন, আমার বিশ্ববিদ্যালয় ও বোনের স্কুল বন্ধ হয়েছে বুধবার। বিকাল ৫টার পর যাত্রীদের চাপ বেড়ে যাবে। সেজন্য একটু তাড়াতাড়ি রওয়ানা হলাম।

আবুল কালাম স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বরিশাল যাচ্ছেন যাত্রাবাড়ী মোর বাস কাউন্টার থেকে। তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ২৫০ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে টিকিট কেটেছি। তাকে বিআরটির কাছে অভিযোগ করার কথা বললে তিনি বলেন, এসব সবই বিআরটির লোকজন জানেন। আমি বললে হয়তো লোকদেখানো একটু তদারকি করবে আবার আমি চলে গেলে যেই সেই হবে। বলে সময় নষ্ট না করাই ভালো।

এদিকে পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ সড়কপথে বাড়ি ফিরছেন। আগে যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরিঘাটে অপেক্ষা করতে হতো, সেখানে এখন ৬ থেকে ৭ মিনিটেই পদ্মা সেতু দিয়ে গন্তব্যে যেতে পারছেন তারা। এতে তাদের মনে স্বস্তির ভাব দেখা যায়।

বরিশালগামী বাসের যাত্রী মনির হোসেন বলেন, বর্তমান সরকার দ্রব্যমূল্যে আমাদের কষ্ট দিলেও পদ্মা সেতু করে বাড়িতে দ্রুত যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এজন্য সরকারের প্রতি আমি অত্যন্ত খুশি। কেননা আগে আমাদের চলাচলের একমাত্র পথ ছিল লঞ্চ। সেখানে নানা অব্যবস্থায় অনেক দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ট্রাফিক পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ আশরাফ ইমাম বলেন, ঈদ উপলক্ষ্যে বাস ও যাত্রীর চাপ প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায়। সড়কের স্পেসের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায় যানবাহন। যে কারণে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা অক্লান্ত পরিশ্রম করার পরও সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। তখন আমাদের মনে কষ্ট হয়। তারপরও আমরা হাল ছাড়িনি। ঈদে মানুষ যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে যেতে পারে, আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট দীর্ঘ যানজটে নাকাল হতে হয়েছে যাত্রী ও বিভিন্ন পরিবহণচালকের। রাজধানীর শ্যামপুর, জুরাইন, পোস্তগোলা, গুলিস্তান, হানিফ ফ্লাইওভারসহ আশপাশের এলাকাজুড়ে ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়। প্রায় প্রতিটি সড়কে যানবাহনের দীর্ঘ লাইনে থাকা যাত্রী ও চালকদের নাভিশ্বাস উঠেছে। গুলিস্তান হানিফ ফ্লাইওভার ও নিচের সড়ক থেকে শুরু হওয়া যানজটের দীর্ঘ লাইন পোস্তগোলা ব্রিজ পর্যন্ত এসেছে বলে মানুষের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে।
এদিকে দীর্ঘ এ যানজট নিরসনের জন্য ওয়ারী ট্রাফিক বিভাগ পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে ফুটপাত উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে। সড়কে নানা অনিয়মের জন্য নিয়ন্ত্রণহীন যানজটের কবলে পড়ে কর্মস্থলে যাওয়া মানুষ ও সাধারণ যাত্রীরা পড়েছেন বিপাকে। তবে এ বিরক্তিকর যানজট নিরসনে ট্রাফিক বিভাগ অক্লান্ত পরিশ্রম করছে।

সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীর মতিঝিল থেকে শুরু হয়ে গুলিস্তান থেকে যাত্রাবাড়ী সায়েদাবাদ এলাকার সড়কের দুপাশেই ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও শ্যামপুর থানাধীন জুরাইন রেলগেটসংলগ্ন মহাসড়কের দুই পাশে নারায়ণগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জ থেকে আসা সিএনজি ও অন্যান্য পরিবহণ পার্কিং করে রাখায় যানজট আরও দীর্ঘ হয়েছে। এদিকে প্রতিদিনের মতো সড়কের দুপাশের এলাকায় প্রাইভেট কার ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। মূল সড়কে যানজট থাকায় অনেকে অলিগলির রাস্তার প্রাইভেট কার ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে ঢুকে পড়েছেন বলে সেখানেও দেখা দিয়েছে যানবাহনের লম্বা লাইন।

যানজটে আটকে থাকা জুরাইন এলাকার বসিন্দা মো. নান্নু বলেন, জুরাইন থেকে রাইদা নামের যাত্রীবাহী বাসে উঠে দীর্ঘ যানজটের কারণে তিন থেকে চার ঘণ্টা সড়কে আটকে আছি। তবে সকাল থেকে প্রতিটি সড়কের অসহনীয় যানজট শুরু হয়েছে। এতে দূরদূরান্ত থেকে আসা অফিসগামী যাত্রীদের নাভিশ্বাস উঠেছে।

যানজটের বিষয় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দোলাইখালে মেইন সড়কে বসছে কুরবানির গরুর বাজার, ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক যাত্রাবাড়ী থানাধীন শনিরআখড়া মেইন সড়কে গরুর হাট বসানোয় এ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে দীর্ঘ যানজট দেখা দিয়েছে।

পোস্তগোলার যাত্রী শেখ ওমর ফারুক বলেন, ঢাকা শহরের সব রাস্তা কাটার কারণে বেশি যানজট লেগেই থাকে। যানজটের বিষয়ে শ্যামপুরের বাসিন্দা প্রাইভেট কার চালক মোখলেস বলেন, জুরাইনে সড়কের দুপাশে অবৈধ নানা স্থাপনা, অন্যদিকে নিষিদ্ধ জেলার সিএনজি পার্কিং করে রাখা- সবমিলিয়ে শ্যামপুরে সবসময় যানজট লেগেই থাকে।

এ বিষয়ে জুরাইনের ট্রাফিক পুলিশ টিআই মো. ইসমাইল বলেন, ঈদ সামনে রেখে সকাল থেকে সড়কের অন্যা দিনের তুলনায় গাড়ির চাপ বেশি হয়েছে। পাশাপাশি শ্যামপুরের দিকে সব ফিডার রোডের কাজ করার কারণে ভেতরের সড়কে গাড়ি চলাচল করতে না পারায় এলাকায় যানজট একটু বেশি। এদিকে যানজটের কারণে অনেকেই সকাল থেকে কর্মস্থলে বের হয়েছেন বলে সড়কের ওপর চাপও বেড়েছে।

এ বিষয়ে ডিসি ট্রাফিক ওয়ারী বিভাগ আশরাফ ইমাম বলেন, কুরবানির গরু রাখতে না দেওয়া, যথাস্থানে গরু আনলোড করা এবং ভারী যানবাহনগুলোকে দিনে শহরে প্রবেশ না করতে দেওয়ার কারণে কুরবানির হাটের জন্য যানজট বৃদ্ধি পায়নি। তবে ঈদ উপলক্ষ্যে ঘরমুখী মানুষের যাত্রার কারণে এবং যানবাহনের চলাচল বেড়ে যাওয়ায় যানজট হয়েছে। এছাড়া সাপ্তাহিক শেষ কর্মদিবস হওয়ায় স্বাভাবিক নিয়মেই যানজট বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া হানিফ ফ্লাইওভারে ধারণক্ষমতার বেশি গাড়ি চলাচল করায় এবং এর নিচের অনেকাংশ পিলার দ্বারা দখল থাকায় মাঝেমধ্যেই যানজট সৃষ্টি হয়ে থাকে। ট্রাফিক ওয়ারী বিভাগের কর্মকর্তারা মধ্যরাত পর্যন্ত যানজট নিয়ন্ত্রণে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিসি) যুগ্মপরিচালক আলমগীর কবির বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ৪৭টি লঞ্চ ঢাকা নদীবন্দর থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। তবে বৈরী আবহাওয়ার কারণে বিকাল ৫টার পর কিছু সময় লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখা হয়। আবহাওয়া পরিস্থিতির উন্নতি হলে লঞ্চ চলাচল আবারও শুরু হয়েছে।

তিনি বলেন, সকাল থেকে ঢাকা নদীবন্দরে যাত্রীর পরিমাণ কম ছিল। তবে সন্ধ্যার দিকে যাত্রীর চাপ বেড়েছে। সব ধরনের শৃঙ্খলা অক্ষুন্ন রেখে লঞ্চ চলাচল অব্যাহত রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *