ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখতে তরুণ বয়স থেকেই সচেতন হতে হবে।
সুস্থ, টানটান ও উজ্জ্বল ত্বক সব সময়েই কাম্য। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্বকের দৃঢ়তা কমে যায়, ভাঁজ পড়ে এবং প্রাকৃতিক জৌলুস হারায়।
চিকিৎসা-বিজ্ঞানের ভাষায়- এর প্রধান কারণ হল কোলাজেনের ঘাটতি।
সাম্প্রতিক সময়ে ‘কোলাজেন ব্যাংকিং’ শব্দটি ত্বক সচেতন মানুষের আলোচনায় জায়গা করে নিয়েছে। এটি আসলে এমন একটি পদ্ধতি যা আগেভাগেই ত্বকে কোলাজেন সংরক্ষণে সাহায্য করে, যাতে বয়সের ছাপ দ্রুত না পড়ে।
কোলাজেন কী?
কোলাজেন হল এক ধরনের প্রোটিন, যা আমাদের শরীরের অন্যতম প্রধান গঠন উপাদান।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘শেফার ক্লিনিক ফিফথ অ্যাভিনিউ’-এর ত্বক বিশেষজ্ঞ ডা. ডেন্ডি এঙ্গেলম্যান ওয়েলঅ্যান্ডগুড ডটকম-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেন, “শরীরে পানির পরেই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে যে অণু পাওয়া যায় তা হল কোলাজেন। শরীরের মোট প্রোটিনের প্রায় ২৫-৩৫ শতাংশ কোলাজেন দিয়ে গঠিত।”
নিউইয়র্কের ‘টার্নার ডার্মাটোলজি’র প্রতিষ্ঠাতা ডা. রায়ান টার্নার বলেন, “ত্বকের দৃঢ়তা, স্থিতিস্থাপকতা এবং ‘বাউন্সি’ ভাবের জন্য কোলাজেন অপরিহার্য। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোলাজেন কমে যায়, ফলে ত্বক পাতলা হয়ে যায়, ঝুলে পড়ে এবং বলিরেখা দেখা দেয়।”
কোলাজেন ব্যাংকিং কী?
এটি আসলে ত্বকের জন্য এক ধরনের ‘সঞ্চয় প্রকল্প’। যেমন- ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য ব্যাংকে টাকা জমানো হয়, ঠিক তেমনি জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে ত্বকে কোলাজেনের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ রাখাই এর উদ্দেশ্য।
ডা. টার্নার এটিকে বলেন ‘প্রিজুভেনেইশন’ কৌশল— যেখানে জীবনধারা, খাদ্যাভ্যাস, ত্বকের যত্ন ও চিকিৎসা একসঙ্গে কাজ করে ত্বকের কোলাজেনকে সুরক্ষিত ও শক্তিশালী রাখে।
কখন থেকে শুরু করা উচিত?
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০ বছরের পর থেকেই শরীরে কোলাজেনের উৎপাদন ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ত্বক বিশেষজ্ঞ ডা. রবিন মাইরেক একই প্রতিবেদনে বলেন, “প্রতি বছর শরীর থেকে প্রায় ১ শতাংশ কোলাজেন কমে যায়, আর মেনোপজের পর এ হ্রাস আরও দ্রুত হয়। তাই আগেভাগেই প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়া সবচেয়ে কার্যকর।”
ডা. এঙ্গেলম্যান বলেন, “শিশু বা কিশোর বয়সে ত্বকে কোলাজেন বাড়ানোর সক্রিয় পণ্য ব্যবহার প্রয়োজন নেই। তাদের জন্য সুষম খাদ্য, যেমন- প্রোটিন, শাকসবজি, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল— প্রাথমিক কোলাজেন গঠনে যথেষ্ট। তবে ১৬ বছর পেরোনোর পর ধীরে ধীরে কোলাজেন সহায়ক ত্বকের পরিচর্যা শুরু করা যেতে পারে, যেমন- ময়েশ্চারাইজার ও সূর্যরশ্মি থেকে সুরক্ষা।”
ঘরে বসে কোলাজেন ব্যাংকিং
সূর্যরশ্মি থেকে সুরক্ষা: সবচেয়ে বড় শত্রু হল অতিবেগুনি রশ্মি। প্রতিদিন নিয়মিত সানস্ক্রিন ব্যবহার করা আবশ্যক।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: ডা. এঙ্গেলম্যান বলেন, “ভিটামিন সি সমৃদ্ধ পণ্য ত্বককে ‘ফ্রি র্যাডিকেল’ ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং প্রদাহ কমায়।”
রেটিনল ও বিকল্প: ডা. এঙ্গেলম্যান রেটিনল’কে ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ বলে আখ্যা দেন। কারণ এটি কোলাজেন বাড়াতে সবচেয়ে কার্যকর।
যাদের রেটিনল সহ্য হয় না, তারা ‘বাকুচিওল’ ব্যবহার করতে পারেন, যা উদ্ভিজ্জ-উৎপন্ন উপাদান।
অন্যান্য উপাদান
নিয়াসিনামাইড: কোলাজেন উৎপাদনে সহায়তা করে।
পেপটাইডস: প্রোটিনের ক্ষুদ্র অংশ, যা ত্বককে দৃঢ় করে।
লাইট থেরাপি: ডা. গমিরেক বলেন, “ঘরে ব্যবহারের জন্য লাল আলো বা ‘ইনফ্রারেড’ আলোভিত্তিক এলইডি যন্ত্র কোলাজেন উৎপাদনকে উদ্দীপিত করতে পারে।”
খাবারের মাধ্যমে কোলাজেন: যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ভিশা স্কিনকেয়ার-এর প্রতিষ্ঠাতা পুরভিশা প্যাটেল বলেন, “কোলাজেন সাপ্লিমেন্ট খেলে তা শরীরে অ্যামিনো অ্যাসিডে ভেঙে যায় এবং রক্তপ্রবাহে ছড়িয়ে পড়ে। তবে এগুলো সরাসরি ত্বকে ব্যবহৃত হবে কিনা, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই প্রাকৃতিক খাবারের ওপর ভরসা করাই ভালো।”
পুষ্টিকর খাদ্যতালিকায় থাকতে পারে- উচ্চমানের প্রোটিন (মাছ, ডিম, মুরগি), সবুজ শাকসবজি, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল (কমলা, লেবু, পেয়ারা), খনিজ ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার
চিকিৎসা
কেমিক্যাল পিল ও মাইক্রোনিডলিং
এগুলো ত্বকের ক্ষুদ্র ক্ষত তৈরি করে শরীরকে প্রাকৃতিকভাবে কোলাজেন উৎপাদনে সাহায্য করে।
রেডিওফ্রিকোয়েন্সি (আরএফ)
এটি ত্বকে তাপ প্রয়োগ করে কোলাজেন উৎপাদন বাড়ায়।
আরএফ এবং মাইক্রোনিডলিং
একসঙ্গে দুটি প্রক্রিয়া চালানো হয়, ফলে গভীর স্তরেও কোলাজেন সক্রিয় হয়।
পিআরপি থেরাপি
ডা. মিরেক বলেন, “চিকিৎসা গ্রহণকারীর নিজের রক্ত থেকে নেওয়া ‘গ্রোথ ফ্যাক্টর’ ব্যবহার করে কোলাজেন বাড়ানো যায়।”
বায়োস্টিমুলেটর
নিউইয়র্কভিত্তিক ত্বক বিশেষজ্ঞ ডা. কিরণ মিয়ান বলেন, “স্কাল্পট্রার মতো ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করা হয় যা দীর্ঘমেয়াদে কোলাজেন বৃদ্ধি করে।”
আলট্রাসাউন্ড ও লেজার থেরাপি
সফট ওয়েভ, আলথেরা, ফ্র্যাক্সেল ডুয়াল-এর মতো চিকিৎসা ত্বক টানটান করে এবং কোলাজেন উৎপাদনে সহায়ক।
বিশেষ সতর্কতা
ডা. টার্নার বলেন, “এসব চিকিৎসা দক্ষ বিশেষজ্ঞের কাছেই করতে হবে, কারণ ভুল প্রয়োগ ত্বকের ক্ষতি করতে পারে। পাশাপাশি অধিকাংশ চিকিৎসার ফল পেতে সময় লাগে। প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে।”