জাতীয়

আজ শত্রুর আত্মসমর্পণ ও বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়

আমাদের দুর্ভাগ্য মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যখন গৌরব ছড়িয়ে দেব, তখন রাজনৈতিক লাভালাভের জন্য আমাদেরই কোনো কোনো পক্ষ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বারবার কুয়াশার চাদরে ঢাকতে চেয়েছে। কিন্তু সূর্যকে তো আটকে রাখা যায় না। তাই সত্য সামনে চলে আসেই। এ কারণেই নতুন প্রজন্মকে বারবার ফিরিয়ে আনতে হয় ইতিহাসের কাছে।

বিজয় দিবসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাস থেকে কয়েকটি তথ্য উপস্থাপন করতে চাই। যে প্রশ্ন ওরা প্রায়ই আমাকে করে থাকে। ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানের দুর্বল দশা স্পষ্ট হতে থাকে। যৌথবাহিনী বাংলাদেশের অনেকটা অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। কার্যত পাকিস্তানি বিমান ও নৌবাহিনী অকেজো হয়ে গিয়েছিল। এমন অবস্থায় নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল তখন।

প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ড. মালিক জেনারেল নিয়াজীকে গভর্নর হাউসে ডেকে পাঠান। এ সময়ের সেনাবাহিনীর প্রেস কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনাতে (Witness to Surrender) পাকিস্তানি বাহিনীর সংকটের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, নিয়াজী গভর্নরের সামনে নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেননি।

পাকবাহিনীর দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে গভর্নর জানান, তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে বার্তা পাঠাবেন যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে। পাকিস্তানি সামরিক অফিসাররাও অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিলেন। নিজেদের জীবন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করতে থাকেন।

পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রেক্ষাপট রচিত হয় ৯ ডিসেম্বর থেকেই। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকা শত্রুমুক্ত হচ্ছিল। অনেক শহরে হানাদার বাহিনী যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে থাকে। পাকবাহিনীর সৈন্যরা আত্মরক্ষার্থে পালিয়ে আসছিল ঢাকার দিকে। এমন একটি পরিস্থিতিতে ৯ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ড. এএম মালিক ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি বার্তা পাঠান। অতিদ্রুত যুদ্ধ বন্ধের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। ইয়াহিয়া খান তখন অনেকটাই নিরুপায়।

তিনি গভর্নর মালিক ও সেনাপ্রধান নিয়াজী উভয়কেই তাদের বিবেচনা মতো সিদ্ধান্ত নেয়ার নির্দেশ দেন। এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব মার্ক হেনরি পাঁচ দফার একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন যুদ্ধ বন্ধের জন্য। তবে এ প্রস্তাব যে খুব কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পেরেছে তেমনটি মনে হয়নি। এদিকে গভর্নর মালিক পরবর্তী নির্দেশনার জন্য রাওয়ালপিন্ডির দিকে তাকিয়ে ছিলেন।

অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য ১৪ ডিসেম্বর দুপুর ১২টায় গভর্নর হাউসে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের একটি সভা ডাকা হয়। এ সংবাদ সকাল সাড়ে ৯টায় ভারতীয় বাহিনীর সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্সের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লে. কর্নেল পিসি ভাল্লা পেয়ে যান। তিনি দ্রুত টেলিফোনে এয়ার ভাইস মার্শাল দেবাসেরকে জানান।

তারা সিদ্ধান্ত নেন এ সময় গভর্নর হাউসে বিমান আক্রমণ করলে আত্মসমর্পণের বিষয়টি ত্বরান্বিত হবে। সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী, সভায় কর্মকর্তারা যোগ দেয়ার আগেই ভারতীয় বিমান থেকে গভর্নর হাউসে বেশ কয়েকটি বোমা নিক্ষিপ্ত হয়। গভর্নর মালিক ভীত হয়ে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নেন। ১৩ অথবা ১৪ ডিসেম্বর রাতে নিয়াজী পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল হামিদকে অনুরোধ করেন যাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যুদ্ধ বন্ধের পদক্ষেপ নেন। ১৪ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খান নিয়াজীর কাছে বার্তা পাঠান।

নিয়াজী এবং রাও ফরমান আলী ছুটে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল হার্বার্ট স্পিভেকের কাছে। তারা অনুরোধ করেন ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাতে যুদ্ধ বন্ধের ব্যবস্থা করা হয়। স্পিভেক জানান, এ ধরনের আলোচনার যথাযোগ্য পদমর্যাদার তিনি নন।

১৯৭১-এ ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের প্রধান লে. জেনারেল জ্যাক জ্যাকব তার গ্রন্থে (Surrender at Dacca: Birth of a Nation) বলেছেন, ১৪ ডিসেম্বর বিকাল ৫টার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের কলকাতার কনসুলার অফিসের একজন কূটনীতিক তাকে স্পিভেকের সঙ্গে নিয়াজীর সাক্ষাৎ করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন। তিনি জানান, এ সময় যুদ্ধ বন্ধ বা আত্মসমর্পণ নিয়ে তাদের মধ্যে কথা হয়। জ্যাকব তখন কলকাতায় নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল হার্বার্ট গর্ডনকে টেলিফোন করেন।

কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে তার অজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তবুও জ্যাকব বিষয়টি পুনরায় খোঁজ নিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু কনসাল জেনারেল নতুন কোনো তথ্য দেননি। এরপর জ্যাকব সেনাবাহিনী প্রধান মানেকশকে টেলিফোন করে অনুরোধ জানান তিনি যাতে দিল্লিতে নিয়োজিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাম্বাসেডরের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করেন। অ্যাম্বাসেডর জানান, এ ব্যাপারে তার কাছে কোনো তথ্য নেই।

এ সংক্রান্ত একটি বার্তা মানেকশ ১৫ ডিসেম্বর পান। তিনি পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ড ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নিয়াজী আত্মসমর্পণের আহ্বানে সাড়া দেন। এখানে এ তথ্যটিও গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা যায়, ১৫ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো সক্রিয় হয়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ভারতের কাছে যুদ্ধবিরতির পক্ষে দেশ দুটির অভিমত প্রকাশ করে।

১৫ ডিসেম্বর বিকাল ৫টা থেকে পরদিন অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর প্রথমে সকাল ৯টা, পরে তা বাড়িয়ে বিকাল ৩টা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এসময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যুদ্ধবিরতিতে (যা বস্তুতপক্ষে আত্মসমর্পণ হিসেবে গৃহীত হবে) সম্মতি দান করেন।

তবে পাকিস্তান পক্ষ ‘আত্মসমর্পণ’ (Surrender) শব্দটি ব্যবহার না করার জন্য চেষ্টা করেছিল। স্পিভেকের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের দলিলটি নিয়াজী পান এবং এতে তার সম্মতি প্রকাশ করেন। জ্যাকব লিখেছেন, জেনারেল মানেকশ ১৬ ডিসেম্বর সকাল সোয়া ৯টায় তাকে আদেশ দেন দ্রুত ঢাকায় চলে যেতে এবং সন্ধ্যার মধ্যে আত্মসমর্পণের কাজ সম্পন্ন করতে।

জ্যাকব ঢাকা পৌঁছে নিয়াজীর সদর দফতরে যান। এখানে তিনি মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের না আসার পরামর্শ দেন। তার মতে, এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা খুবই উত্তেজিত ছিল। ফলে যে কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তার সঙ্গে শুধু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কয়েকজন সংবাদকর্মী যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা চিৎকার করে বলছিলেন, আমরা ভেতরে যেতে চাই, আমরা নিয়াজী ও তার সহযোগীদের ওপর প্রতিশোধ নেব।

ঘৃণাভরা নানা শব্দে তারা স্লোগান দিচ্ছিলেন। জ্যাকব মুক্তিযোদ্ধাদের বোঝালেন কিছুক্ষণের মধ্যে আত্মসমর্পণ সম্পন্ন হবে। তারা বরং চারদিকের পরিবেশ শান্ত রাখার ব্যবস্থা করেন। এখন যুদ্ধবিরতি চলছে। আর সবারই জেনেভা কনভেনশনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো উচিত। মুক্তিযোদ্ধারা বিষয়টি বুঝতে পেরে সেখান থেকে চলে যান। জ্যাকব দুপুর ১টায় নিয়াজীর দফতরে পৌঁছেছিলেন।

নিয়াজী অভ্যর্থনা জানান ভারতীয় জেনারেলকে। এসময় নিয়াজী ছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল জমশেদ, নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফ, এয়ার কমডোর ইমাম এবং ব্রিগেডিয়ার বাকার সিদ্দিক। এর আগে ভারতীয় বাহিনীর মেজর জেনারেল জিসি নাগরার মেসেজ আসে। যৌথ বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে তিনি ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। বার্তায় তিনি নিয়াজীকে জানান, তিনি তার বাহিনী নিয়ে মিরপুর ব্রিজের কাছে চলে এসেছেন।

তিনি যাতে তার প্রতিনিধি পাঠান। জ্যাকব নিয়াজীকে জানান, টঙ্গীসহ কয়েকটি স্থানে এখনও বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ চলছে। এটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির লংঘন। নিয়াজী তখন একটি নির্দেশনামা পাঠিয়ে দিলেন। জ্যাকব নাগরাকে কয়েকটি কাজ বুঝিয়ে দিলেন। প্রথমত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তিনি যাতে প্রয়োজনীয় সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হন; দ্বিতীয়ত, আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি যাতে সম্পন্ন করেন।

জ্যাকব মনে করলেন ঢাকার অধিবাসী বাঙালিরা অত্যাচারিত হয়েছে, তাই জনসম্মুখে এ আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান করলে সবার কষ্ট অনেকটা প্রশমিত হবে। যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে কয়েক ঘণ্টা লেগে গেল। কাছাকাছি কোথাও মাঝে মাঝেই গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এ সময় ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে জাতিসংঘ এবং রেডক্রসের কর্মকর্তা ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তান সরকার ও বিদেশি কর্মকর্তারা আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়।

সভাকক্ষে আত্মসমর্পণের শর্ত পড়ে শোনানো হয়। ঘরটি মৃতপুরীর মতো নিস্তব্ধ হয়ে যায়। নিয়াজীর গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। অন্যরা নিশ্চল হয়ে যায়। পাকিস্তানি অফিসাররা কিছু শব্দ পরিবর্তনের কথা বলেন। ভারতীয় ও বাংলাদেশি সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পণ করার পরিবর্তে তারা যুদ্ধ বন্ধের মধ্যে থাকতে চেয়েছিল; কিন্তু তাদের এ আবেদন রক্ষা করা যায়নি। নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্যেই তাদের সম্মতি জানাতে হয়। ঠিক হল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে।

এদিন সকালের দিকে যৌথবাহিনীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে বার্তা আসে, আজই আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। এ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যাতে প্রতিনিধি পাঠানো হয়। তাজউদ্দীন আহমদের অফিসের কাছেই প্রধান সেনাপতি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *