এমন বছর আর কাটায়নি তেলের বাজার; এমনিতেই মন্দা, তার ওপর অভূতপূর্ব মহামারীর আঘাতে তেলের ঐতিহাসিক দরপতন। বছর কাটলেও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি নেই; উদ্বেগ নিয়েই শুরু হয়েছে নতুন বছরের পথচলা।
বছর শেষে তেলের দর দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫১ ডলারে। এই দাম ২০১৫-১৭ মেয়াদের কাছাকাছি, থাকলেও বাজার পুরো বছরই ছিল টালমাটাল।
কোভিড-১৯ মহামারী এবং তেলকুবের সৌদি আরব ও রাশিয়ার মধ্যে মূল্যযুদ্ধের প্রভাবে এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত তেলের দর পড়তে পড়তে এক পর্যায়ে শূন্যের নিচে ও ব্রেন্টের দর ২০ ডলারের নিচে পড়ে যায়।
বিশ্বজুড়ে মহামারী তেলের চাহিদা ধসিয়ে দেওয়ার কারণে ওই পতন সামলে ওঠতেই ২০২০ সালের বাকি সময়টা কেটেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের তেলের আগাম দর ব্যারেলপ্রতি ঋণাত্মক (৪০) ডলারের নিচে নেমে যাওয়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়ত ২০২১ সালে আর হবে না।
কিন্তু নতুন লকডাউন ও কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য পর্যায়ক্রমে ভ্যাকসিন প্রয়োগের ফলে আগামী বছর বা তার পরও তেলের চাহিদা সংকুচিত থাকবে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান থার্ড ব্রিজের বিশ্লেষক পিটার ম্যাকন্যালি বলেন, “আমরা আসলেই ৯/১১ এর পরে অর্থনৈতিক সংকটে এরকম কিছু দেখিনি। চাহিদায় প্রভাব ছিল অভাবীয় এবং দ্রুত।“
জলবায়ু পরিবর্তনের গতি শ্লথ করার লক্ষ্য থাকায় আগামী বছরগুলোতে এমনকি মহামারীর পরও জীবাশ্ম জ্বালানির চাহিদা কমের দিকে থাকতে পারে বলে আভাস মিলছে।
বিপি পিএলসি ও টোটাল এসইর মতো বড় তেল কোম্পানিগুলো যে পূর্বাভাস প্রকাশ করেছে, তাতে যেযব চিত্র ওঠে উঠেছে, তার মধ্যে বৈশ্বিক তেলের চাহিদা যে ২০১৯ সালে চূড়ায় ওঠেছিল সেকথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইআইএ) বলছে, বিশ্বের তেল ও তরল জ্বালানির উৎপাদন ২০১৯ সালে দৈনিক ১০ কোটি ৬ লাখ ১০ হাজার ব্যারেল থেকে কমে ২০২০ সালে দৈনিক ৯ কোটি ৪২ লাখ ৫০ হাজারে নেমেছে। আগামী বছর নাগাদ উৎপাদন আর কিছুটা বাড়লেও তা দৈনিক ৯ কোটি ৭৪ লাখ ২০ হাজার ব্যারেলের বেশি হবে না।
ডালাস, টেক্সাস-ভিত্তিক তেল উৎপাদনকারী টিল ন্যাচারাল রিসোর্স এলএলসির প্রধান নির্বাহী জন রবি বলেন, কেটে যাওয়া কালকে সব সময় সবচেয়ে খারাপ মনে হয়। কিন্তু গত বছরটা আসলেই অনন্য ছিল।
ইআইএর তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশে দেশে সরকার ‘লকডাউন’ আরোপ করে মানুষকে রাস্তা সরিয়ে ঘরের মধ্যে আবদ্ধ রাখে। এর ফলে সদ্য বিদায়ী বছরে বিশ্বের অপরিশোধিত ও তরল জ্বালানির ব্যবহার কমে গড়ে দৈনিক ৯ কোটি ২৪ লাখ ব্যারেলে নামে, যা তার আগের বছরের দৈনিক ১০ কোটি ১২ লাখ ব্যারেলের চেয়ে ৯ শতাংশ কম।
মর্গান স্ট্যানলি বলছে, বদলে যাওয়া এই চিত্র তেল পরিশোধনাকারীদের সামনে হুমকি হিসেবে হাজির হয়েছে। দৈনিক প্রায় ১৫ লাখ ব্যারেল পরিশোধন ক্ষমতা বাজার থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
গ্লোবালডেটার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে তেল পরিশোধন ক্ষমতা বাড়তে থাকবে বলেই আশা করা হচ্ছে, কিন্তু গ্যাসোলিন, ডিজেল ও অন্যান্য জ্বালানির পতনোন্মুখ চাহিদা ও স্বল্প মুনাফা এশিয়া ও উত্তর আমেরিকার তেল পরিশোধনকারীদের বাধ্য করেছে যুক্তরাষ্ট্রের উপসাগরীয় উপকূলজুড়ে কিছু স্থাপনা বন্ধসহ সার্বিক উৎপাদন বন্ধ রাখতে বা কমিয়ে দিতে।
সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত আউটলুকে বিপি বলেছে, অধিকতর উন্নত দেশগুলোতে সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় বন্ধ থাকায় উচ্চ প্রতিযোগিতার পণ্য রপ্তানির বাজারের সামনে পরিশোধনকারীদের আরও ‘নাঙ্গা’ করে দিয়েছি।
বাজার সামনের আরও কয়েকটা মাস টালমাটালই থাকবে। কারণ নগন্য চাহিদার বিপরীতে তেল সরবরাহে ওপেক ও মিত্র শক্তিসহ উৎপাদকদের কাছ থেকে আরও একটি সম্ভাব্য উত্থানের বিষয়ে উদ্বিগ্ন রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
মিতসুবিশি ইউএফজে ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপের বিশ্লেষকরা বলছেন, গত ১২ মাসে বাজারের আচরণ ছিল পাগলা ঘোড়ার মতো বিশৃঙ্খল, যার রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী পরিণতি। এমন একটি সময়ে ভাইরাস-উত্তর পথে স্বাভাবিকতার নতুন নকশা কষতে শুরু করেছি।
রেফিনিটিভ ইকনের তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিলে সিবো ক্রুড অয়েল ইটিএফ ভোলাটাইলিটি ইনডেক্স বেড়ে রেকর্ড ৫১৭ দশমিক ১৯ পয়েন্টে ওঠেছিল। ওই সূচক এর পরে প্রায় ৪০ পয়েন্টের মতো কমলেও একবছর আগের তুলনায় তা ৬০ শতাংশেরও বেশি।