বাংলা ভাষার কথা সাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ‘অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার-১৪২৭’ পেলেন লেখক ও কথাসাহিত্যিক ঝর্না রহমান। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, গল্পকার, কবি, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও সাহিত্যসংগঠক।
মঙ্গলবার (১৬ মার্চ) জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে আনুষ্ঠানিকভাবে তার হাতে এই পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন লেখক-নির্মাতা ফরিদুর রহমান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অনন্যা-সম্পাদক তাসমিমা হোসেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে লেখক ও নির্মাতা ফরিদুর রহমান বলেন, ঝর্ণা রহমান যখন লিখেন তখন জেন্ডার নিরপেক্ষ হয়ে উঠেন। সেখানে নারী পুরুষের কোনো ধরনের ছাপ থাকে না, নারী হিসেবে কখনো সাহিত্যে প্রভাবও রাখেন না তিনি। তার জায়গাটি থাকে একেবারে নিরপেক্ষ। নির্ভুল বাক্য লেখেন, নির্ভুল শব্দ তুলে আনেন। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে তার একটি স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যার মধ্যে দিয়ে তাকে নিজের মতো করে চেনা যায়।
এ সময় অতিথিরা ঝর্ণা রহমানের নিকট উত্তরীয়, ক্রেস্ট ও সম্মাননা অর্থ তুলে দেন।
সাহিত্য পুরস্কার পেয়ে নিজের অভিব্যক্তি জানান লেখক ঝর্ণা রহমান। তিনি বলেন, অনন্যা দীর্ঘ ২৬ বছর সাহিত্য পুরস্কৃত করার কাজুটুকু দক্ষতার সঙ্গে করে আসছে। এটি অত্যন্ত দক্ষ এবং সুনির্বাচিত পুরস্কার। যে সমস্ত নারী তাদের জীবন, শিল্প সংস্কৃতি দিয়ে নিজের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, আলোকোজ্জ্বল করছেন তাদের এখানে পুরস্কৃত করা হয়। এ তালিকায় আমার নাম যে সংযোজিত হলো, তা অত্যন্ত আনন্দের, সম্মানের।
অনন্যা সম্পাদকের প্রশংসায় তিনি বলেন, তাসমিমা হোসেন একজন স্মরণীয় বরণীয় ও অনুকরণীয় মানুষ। তিনি প্রতিভাময়ী ও আলোকোজ্জ্বল হয়ে আছেন। তিনি শুধু নারীদের প্রতিষ্ঠা করছেন না, মেধাবী ও আলোকিত নারীদের তিনি নির্বাচিত করেছেন। কাজেই পুরস্কারটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ঝর্ণা রহমান পাঠককে খুব সহজে সঙ্গী করতে পারেন। ঝর্ণা রহমানের একটা ভাষা আছে, তিনি নিজস্ব একটি ভাষা তৈরি করে রেখেছেন। কিছুদুর পড়লেই বোঝা যায় ঝর্ণা রহমানের লেখাই পড়ছি। সংস্কৃতিকে তিনি তার কর্মকাণ্ডে নিয়ে এসেছেন। সাহিত্য অনেকগুলো মুহূর্ত নিয়ে আসে, সব সাহিত্য মুহূর্তে আসে না, সব মুহূর্তে সাহিত্য আসে না, সব মুহূর্ত সাহিত্যিকও ধরতে পারে না।
সভাপতির বক্তব্যে তাসমিমা হোসেন বলেন, জীবনটা খুব সুন্দর। ঝর্ণার লেখা এতো সুন্দর সেটা এই দুঃসময়ে পড়ে বুঝেছি। ঝর্ণার মত অসংখ্য গুণী মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। আমি হাল ছাড়ি নাই।
পাশাপাশি অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন লায়লা আফরোজ, সঙ্গীতায়োজনে ছিল নারীভিত্তিক ব্যান্ড এফ-মাইনর এবং ভিডিও নির্মাণ ও উপস্থাপনায় ছিলেন তাপস কুমার দত্ত।
এছাড়া অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে পাক্ষিক অনন্যা আয়োজিত ‘রচনা ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতা’য় বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন পাক্ষিক অনন্যা ও দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেন।
ঝর্না রহমানের জন্ম ১৯৫৯ সালে। প্রধানত কথাসাহিত্যিক। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, নাটক, কবিতা, ছড়া, ভ্রমণ, শিশুসাহিত্য, সংগীত-সবক্ষেত্রেই তার কমবেশি বিচরণ। তবে গল্পকার হিসেবে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। তার সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তিনি বিশদ বিবরণের ভেতর দিয়ে সমাজ ও ব্যক্তিমানসের নানা সংকট উন্মোচন করেন। তার আখ্যানরীতি এবং বর্ণনাশৈলি যেমন স্বতন্ত্র তেমনই উপভোগ্য। নারী পুরুষের সম্পর্ক, নারীজীবনের অন্তর্গত বেদনা তার সাহিত্যের প্রিয় বিষয় হলেও তিনি দেশজ এবং সামাজিক প্রায় প্রতিটি অনুষঙ্গকে তার সাহিত্যের বিষয় করে তুলেছেন।
তার উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ: ঘুম-মাছ ও একটু করো নারী, অগ্নিতা, স্বর্ণতরবারি, কৃষ্ণপক্ষের ঊষা, পেরেক, জাদুবাস্তবতার দুই সখী, বিপ্রতীপ মানুষের গল্প, বিষ পিঁপড়ে, তপতীর লাল ব্লাউজ, আয়নামামি। অনূদিত গল্পগ্রন্থ: Dawn of the Waning moon, উপন্যাস: পিতলের চাঁদ, ভাঙতে থাকা ভূগোল, কাব্যগ্রন্থ: জল ও গোলাপের ছোবল, হরিৎ রেহেলে হৃদয়, চন্দ্রদহন, নাট্যকাব্য: উড়ন্ত ভায়োলিন। কিশোর উপন্যাস: আদৃতার পতাকা, হাতিমা ও টুনটুনি, নাটক: বৃদ্ধ ও রাজকুমারী, ভ্রমণ: আমরা যখন নেপালে। ১৯৮০ সনে বাংলাদেশ পরিষদ আয়োজিত একুশে সাহিত্য পুরস্কার প্রতিযোগিতায় ছোটগল্পে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ। এ পর্যন্ত তার প্রায় ৬০টির মতো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ঝর্না বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে সম্প্রতি অবসরে গেছেন। তিনি সাহিত্যসংগঠন ‘পরণকথা’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এ ছাড়া তিনি ছোট কাগজ ‘পরণকথা’এবং ‘ত্রৈমাসিক অগ্রসর বিক্রমপুর’-এর সম্পাদক।
বাংলা ১৪০১ সন (১৯৯৩ সাল) থেকে অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রতিবছর একজন নারী-সাহিত্যিককে সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। এ-পর্যন্ত যারা এই পুরস্কার পেয়েছেন, তারা হলেন- সেলিনা হোসেন, রিজিয়া রহমান, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, দিলারা হাশেম, রাবেয়া খাতুন, ড. সন্জীদা খাতুন, শহিদ জননী জাহানারা ইমাম (মরণোত্তর), নূরজাহান বেগম, রাজিয়া খান, রুবী রহমান, পূরবী বসু, আনোয়ারা সৈয়দ হক, মকবুলা মনজুর, ঝর্ণাদাশ পুরকায়স্থ, সালেহা চৌধুরী, নূরজাহান বোস, মালেকা বেগম, কাজী রোজী, ড. নিয়াজ জামান, জাহানারা নওশিন, সোনিয়া নিশাত আমিন, বেগম মুশতারি শফী, বেগম আকতার কামাল, আকিমুন রহমান ও নাদিরা মজুমদার।