দেশে করোনা সংক্রমণ এখন সর্বোচ্চ চূড়ায়। টানা তিন দিন শতাধিক মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে গতকাল ১১২ জন, সোমবার ১০৪ জন এবং রবিবার ১১৯ জন করোনায় মারা গেছেন। গত সাত দিনে শনাক্ত হয়েছেন ৪৩ হাজার ২৮৫ জন এবং মারা গেছেন ৬৮৬ জন।
নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধির ধারায় ঊনত্রিশ দিনে আরো এক লাখ মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ায় গতকাল দেশে মোট শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা ৯ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ব্যাপকহারে বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী অক্সিজেন সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অক্সিজেনের তীব্র সংকট। রোগীদের অক্সিজেনের জন্য এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। অনেকের ৬ হাসপাতাল ঘুরেও মিলছে না অক্সিজেন। এ কারণে গ্রামাঞ্চলের রোগীরা চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অক্সিজেন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এক বছর আগে। কিন্তু তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, করোনা রোগিদের উপসর্গের মধ্যে শ্বাসকষ্ট অন্যতম। যেসব রোগির শ্বাসকষ্ট সহনীয় মাত্রায় থাকে, তাদের শ্বাস গ্রহণের জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যাঁদের শ্বাসকষ্টের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়, তাঁদের শ্বাসযন্ত্র সচল রাখতে বাইরে থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হয়। সাধারণ রোগিদের জন্য আইসিইউতে যে অক্সিজেন দিতে হয়, তার পরিমাণ এক মিনিটে ৫/৬ লিটার। কিন্তু করোনা রোগির জন্য যে অক্সিজেন প্রয়োজন তার পরিমাণ মিনিটে ৭০/৮০ লিটার।
অনেক সরকারি হাসপাতালে আছে। তবে জেলা পর্যায়ের অধিকাংশ হাসপাতালে নেই। বেসরকারি দুই থেকে তিনটি হাসপাতাল ছাড়া কোথাও এই অক্সিজেন নেই। বাতাসের মাধ্যমে এই অক্সিজেন তৈরি হয়। পিএসএ জেনারেটর স্থাপনের মাধ্যমে সরকারি হাসপাতালে এই অক্সিজেন উত্পাদন করা সম্ভব। কিন্তু সময়মতো তা করা হয়নি।
জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতেও অক্সিজেন সংকট দেখা দিয়েছে। কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের অক্সিজেন সংকটের কারণে গতকাল রোগী পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে যশোরে। সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও এই জেলার সবগুলো উপজেলা হাসপাতালে অক্সিজেনের সংকট। শুধুমাত্র সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অক্সিজেন আছে। অক্সিজেনের অভাবে রোগীরা এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছেন।
পটুয়াখালীর দশমিনায় ৫০ শয্যার হাসপাতালে মাত্রাতিরিক্ত অক্সিজেন সংকট। অক্সিজেনের অভাবে রোগীরা মারা যাচ্ছে। নওগাঁয়ের পত্নীতলায় অক্সিজেন সংকট প্রকট। যশোরের শার্শায় গুরুজবাগান হাসপাতালটি ৫০ শয্যার। সেখানে অক্সিজেনের প্রকট সংকট। সেখানকার রোগীরা যশোরে দৌড়াচ্ছেন। এমন অবস্থা এখন সারাদেশের জেলা-উপজেলায় দেখা দিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত এক দিনে দেশে ৭ হাজার ৬৬৬ জন কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছে। দৈনিক হিসেবে এটি দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শনাক্ত। এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৪ হাজার ৪৩৬ জন। করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে আরও ১১২ জনের মৃত্যু হয়েছে গত এক দিনে।
দৈনিক হিসেবে এটি দেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু। এদের নিয়ে দেশে করোনা ভাইরাসে মোট ১৪ হাজার ৩৮৮ জনের মৃত্যু হল। করোনা ভাইরাসে গত ২৮ জুন ৮৩৬৪ জন শনাক্ত ও ১০৪ জন মারা যান। গত ২৭ জুন ৫২৬৮ জন শনাক্ত ও ১১৯ জন মৃত্যু, গত ২৬ জুন ৪৩৩৪ জন শনাক্ত ও ৭৭ জনের মৃত্যু, গত ২৫ জুন ৫৮৬৯ জন শনাক্ত ও ১০৮ জনের মৃত্যু, গত ২৪ জুন ৬০৫৭ জন শনাক্ত ও ৮১ জনের মৃত্যু এবং গত ২৩ জুন ৫৭২৭ জন শনাক্ত ও ৮৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সরকারি হিসাবে, আক্রান্তদের মধ্যে একদিনে আরও ৪ হাজার ২৭ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তাদের নিয়ে মোট সুস্থ হয়েছেন ৮ লাখ ১১ হাজার ৭০০ জন। গত বছর ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার পর ২০ ডিসেম্বর শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়ে যায়। এরপর ৯৯ দিনে আরো ১ লাখ রোগী শনাক্ত হওয়ায় ২৯ মার্চ দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ৬ লাখ ছাড়ায়। ততদিনে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের কবলে পড়েছে বাংলাদেশ, দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে হুহু করে। মাত্র ১৬ দিনে আরো ১ লাখ মানুষের দেহে সংক্রমণ ধরা পড়লে দেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১৪ এপ্রিল ৭ লাখ পেরিয়ে যায়। এই ১ লাখ শনাক্তে সময় লাগে ৪৭ দিন।
দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা সামলে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমে আসে মে মাসে। পরের ১ লাখ রোগী শনাক্ত হতে সময় লাগে দেড় মাস; দেশে মোট শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা ৮ লাখ ছাড়িয়ে যায় ৩১ মে। ৯ লাখ শনাক্ত রোগীর দুঃখজনক মাইলফলকে পৌঁছানের আগে সোমবার রেকর্ড ৮ হাজার ৩৬৪ জনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার কথা জানায় সরকার।
পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় সোমবার থেকে আবার সারা দেশে লকডাউনের বিধিনিষেধ জারি করা হয়। ১ জুলাই থেকে সাত দিনের জন্য কঠোর লকডাউন জারির ঘোষণাও দিয়ে রাখা হয়েছে।
ঢাকা নগরীসহ জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বাধিক ২ হাজার ২৬৫ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছেন। বিভাগওয়ারি হিসেবে ঢাকায় দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা আগের দিনের ৩ হাজার ৯৯৮ জন থেকে কমে ৩ হাজার ০৬৮ জন এবং খুলনা বিভাগে ১ হাজার ৪৬৪ জন থেকে কমে ১ হাজার ৩৬৭ জন হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম বিভাগে নতুন রোগীর সংখ্যা আগের দিনের ৮১১ জন থেকে বেড়ে ১ হাজার ১২ জন এবং রাজশাহী বিভাগে ৮৮৩ জন থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৫৯ জন। ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৯৭ শতাংশে। দেশে এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
ঢাকা জেলায় দৈনিক শনাক্তের হার আগের দিনের ১৮ দশমিক ১৩ শতাংশ থেকে সামান্য কমে ১৭ দশমিক ১৬ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু ঢাকা বিভাগে এই হার আগের দিনের মতোই সাড়ে ১৯ শতাংশের বেশি। চট্টগ্রাম বিভাগে ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৩ দশমিক ১৬ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে ২০ দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে বেড়ে ২১ দশমিক ৭৬ শতাংশ হয়েছে দৈনিক শনাক্তের হার।
তবে রংপুর বিভাগে এই হার ৪২ দশমিক ২০ শতাংশ থেকে কমে ৪০ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং খুলনা বিভাগে ৪৬ দশমিক ২৮ শতাংশ থেকে কমে ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে। গত এক দিনে ঢাকা বিভাগে যে ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের ১৫ জনই ছিলেন ঢাকা জেলার।