ছয় বছর ধরে জন্মদিনের আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এই বছরগুলোতে তাঁর জন্মদিনে শুধু মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হবে না বলে বিএনপির দলীয় সূত্র কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছে।
আগামীকাল ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার ৭৬তম জন্মদিন। ১৯৪৫ সালের এই দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন না করার জন্য বিএনপির প্রতি বরাবরই আবেদন জানিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ। এর পরও ২২ বছর ১৫ আগস্ট কেক কেটে জন্মদিন পালন করেছেন খালেদা জিয়া।
২০১৫ সালের সংঘাতময় রাজনীতির মধ্যে প্রথমবারের মতো এক দিন পিছিয়ে ১৫ আগস্ট রাতে গুলশান কার্যালয়ে কেক কাটা হয়। ওই বছর অতি উৎসাহী নেতাদের তৎপরতা অবশ্য কিছুটা কম দেখা যায়।
তবে ২০১৫ সালের পরে ওই আনুষ্ঠানিকতা একেবারেই পরিহার করা হয়। কিন্তু কী কারণে খালেদা জিয়া বা বিএনপির এই বাঁক পরিবর্তন, তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেশ কিছু ঘটনার কথা জানা যায়।
সুধীসমাজে বিএনপিপন্থী বলে পরিচিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দাবি করেছেন, তিনি অনুরোধ করার পর ১৫ আগস্টে কেক কাটা বন্ধ করেন খালেদা জিয়া। গত বুধবার কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে জন্মদিন পালন না করার জন্য আমি খালেদা জিয়াকে না করেছিলাম। আমি বললাম যে দেখেন, ১৫ আগস্ট জন্ম-মৃত্যু থাকবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দিনে পাবলিকলি আপনি এটা পালন কইরেন না।’
বিশিষ্ট এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘আমি বলার পরে খালেদা জিয়া কিছু বলেননি। কিন্তু তার পর থেকেই দেখছি উনি আর পালন করছেন না। তার মানে তিনি আমার কথা শুনেছেন বলেই মনে হয়।’
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের দিনে জন্মদিন পালনের বিরুদ্ধে বরাবরই বেশ সোচ্চার ছিলেন কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। বিএনপির সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের আগে ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট ‘ফিরোজা’য় খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন তিনি। ওই সময় তিনি ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন না করার জন্য খালেদা জিয়াকে অনুরোধ করেন বলে জানা যায়।
জানতে চাইলে গত বুধবার কাদের সিদ্দিকী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার ওই অনুরোধের পর খালেদা জিয়া বলেছিলেন, আমিও এমন মহান একজন নেতার মৃত্যুর দিনে জন্মদিন পালন করতে চাই না। কিন্তু দলের নেতাকর্মীদের চাপে এটা করতে হয়েছে।’
কাদের সিদ্দিকী দাবি করেন, ‘আমার ওই কথার পর উনি হজে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে ফিরে আর জন্মদিন পালন করেননি।’ ২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর হজ পালনের জন্য সৌদি আরবে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া।
বিএনপি চেয়ারপারসনের জন্মদিন নিয়ে প্রকাশ্যে এই দুই নেতা কথা বললেও সুধীসমাজের বেশ কয়েকজন প্রতিনিধি একবার গুলশান কার্যালয়ে দেখা করে ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালনের বিষয়ে নিরুৎসাহিত করেছিলেন বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিনিয়র তিনজন নেতা কালের কণ্ঠকে জানান, প্রয়াত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ও প্রয়াত সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহসহ অনেকেই সেদিন জন্মদিনের বিষয়টি খালেদা জিয়ার কাছে তুলেছিলেন। তবে তাঁদের যাওয়ার আগে স্থায়ী কমিটির কয়েক নেতার তরফ থেকেও ওই বিষয়ে কথা বলতে অনুরোধ করা হয়েছিল। স্থায়ী কমিটির ওই নেতারা জানান, কৌশলগত কারণে তাঁদের পক্ষে খালেদা জিয়াকে এ বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া সম্ভব ছিল না। তবে জন্মদিন পালন নিয়ে সিনিয়র বেশির ভাগ নেতার মধ্যেই অস্বস্তি ছিল। জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে এলেও অস্বস্তি ছিল সেই বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও।
কালের কণ্ঠকে বিএনপি নেতারা বলেন, বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া তাঁদের জানিয়েছেন, ১৯৯১-পরবর্তী বিএনপি সরকারের সময় অতি উৎসাহী একদল নেতাকর্মী ও শুভান্যুধায়ীর পরামর্শে ১৫ আগস্ট তাঁর জন্মদিন পালন শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে তখনকার প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ের দু-একজন সদস্যের তৎপরতা বেশি ছিল। তাঁদের দাবি, খালেদা জিয়াকে কখনোই এ বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহী মনে হয়নি। আবার ছেলে তারেক রহমানও কখনোই এ বিষয়ে উৎসাহ দেখাননি। তবে ২০১০ সালে শহীদ মইনুল রোডের বাড়ি থেকে খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ এবং এর আগে ১৯৯৭ সালে জিয়ার কবরস্থানে যাওয়ার বেইলি ব্রিজ সরিয়ে নেওয়ার পরে জন্মদিনের অনুষ্ঠান পালন গতি পেয়েছে বলে তাঁদের মনে হয়েছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) নিজে উৎসাহী হয়ে কখনোই জন্মদিন পালন করেননি। নেতাকর্মীদের উৎসাহে এটা হয়েছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন ম্যাডাম নিজেই বাতিল করেছেন। উনি নিজে মন থেকে জন্মদিন পালনে উৎসাহীও ছিলেন না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জন্মদিনের অনুষ্ঠান বন্ধে আমাদের ভূমিকা দৃশ্যমান না থাকলেও ধারণা করি বুদ্ধিজীবীরা এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকতে পারেন।’
সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১৪ আগস্ট রাত ১২টা এক মিনিটে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে নিয়ে কেক কাটেন খালেদা জিয়া। ২০১৬ সালে দেশব্যাপী বন্যা, গুম ও খুনের কারণ দেখিয়ে কেক কাটার কর্মসূচি বাতিল করা হয়। ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই থেকে ১৮ আক্টোবর পর্যন্ত লন্ডনে ছেলে তারেক রহমানের বাসায় থাকলেও সেখানে কেক কাটা হয়নি। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি একটি দুর্নীতি মামলায় কারাগারে যাওয়ায় ১৫ আগস্ট কেক কাটার বদলে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। ২০১৯ সালে বিতর্ক এড়াতে জন্মদিন পালন করা হয় এক দিন পরে ১৬ আগস্ট। তখনো কেক কাটার পরিবর্তে খালেদার রোগমুক্তি ও সুস্বাস্থ্য কামনা করে দোয়া মাহফিল কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। ওই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। ২০২০ সালে কারামুক্ত হয়ে বাসায় থাকলেও জন্মদিনের আনুষ্ঠানিকতা থেকে দূরে ছিলেন খালেদা। এ বছর মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের কর্মসূচি এক দিন পরে হতে পারে।