প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ থেকে শুরু করে কেনাকাটাও চলছে এখন অনলাইনে। বিশেষত করোনাকালে সংক্রমণ থেকে বাঁচতে অনলাইন কেনাকাটায় স্বাস্থ্যসচেতন গ্রাহকদের আগ্রহ বেড়েছে। আর এই সময়ে এসে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রসার বেড়েছে বহুগুণে। প্রচার-প্রসারের পাশাপাশি বেড়েছে কিছু কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণাও। গ্রাহকদের অভিযোগ,কোনো কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সময়মতো পণ্য ডেলিভারি দেয় না। দিলেও একপণ্যের জায়গায় অন্য পণ্য দেয়। কখনো কখনো অর্ডার করা পণ্যের আংশিক সরবরাহ করে বাকি পণ্য দেয় না। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর হেল্পলাইনে অভিযোগ করলে উল্টো ভোক্তাকে হেনস্তার শিকার হতে হয়। সম্প্রতি এসব অনিয়ম-অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ইভ্যালির চেয়ারম্যান ও এমডিকে গ্রেফতারের পর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি ক্রেতারা আস্থা হারাতে বসেছেন। তারা বলছেন, ‘দুষ্টচক্রের’ অসৎ উদ্দেশ্যের বলি হচ্ছে সম্ভাবনাময় এই খাত। দুষ্টচক্রের হাত থেকে ই-কমার্স খাতকে রক্ষা করতে হলে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। সঙ্গে বাড়াতে হবে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও তদারকি।
পণ্যের অর্ডার দিয়ে পণ্য পাননি, মূল্য ফেরত পাননি এমন গ্রাহকদের একজন দৈনিক সময়ের আলোর ক্রীড়া প্রতিবেদক রাজু আহম্মেদ। তিনি বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে আমি একটি মোটর সাইকেল অর্ডার করি ইভ্যালিতে। নিয়মানুযায়ী তাদের ৪৫ দিনের মধ্যে আমার পণ্য সরবরাহের কথা ছিল। কিন্তু ৮ মাস পার হয়ে গেলেও আমার পণ্যটি আমি বুঝে পাইনি। তাহলে কী করে ইকমার্সে আস্থা থাকবে?
রাজধানীর একটি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী মাসুদ রানা। বর্তমান যুগে নিজেকে আপডেট রাখতেই একটি স্মার্ট ঘড়ি কেনার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন অনেক আগেই। তিনি বলেন, ‘ক্রয় ক্ষমতার বাইরে থাকায় কেনা হয়নি। একদিন ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখি, প্রায় অর্ধেক দামেই অনলাইনে কেনা যাচ্ছে সেই ঘড়ি। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, কয়েকজন হাতে পেয়েছেন। আরও কয়েকজন অর্ডার করেছেন। ৭ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে অর্ধেক দামে ঘড়ি পাওয়ার আশায় ১ হাজার ৬০০ টাকা জমা করে অর্ডার দিলাম। ৪৫ দিন দূরের কথা, ৮ মাসেও মিলছে না সেই ঘড়ি। ই-কমার্সে ভরসা করতে গিয়ে আস্থাই হারিয়ে ফেলেছি এখন।’
চাকরিজীবী খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘রোজার ঈদের কেনাকাটার জন্য আগেই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেখলাম, একটি পণ্যের ৩ হাজার টাকায় কুপন কিনে ১০ হাজার টাকার কেনাকাটা করার সুযোগ পাওয়া যাবে। নিজের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকার কারণে ব্যক্তিগত অর্থের সঙ্গে বন্ধুর কাছ থেকে ৩ হাজার টাকা লোন করে এপ্রিল মাসে ৬ হাজার টাকা পরিশোধ করে ২টি কুপন কিনি। কিন্তু আজ পর্যন্ত কুপনের কোনো খোঁজ পাইনি। কয়েকবার যোগাযোগ করেছি সেই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের অফিসে। প্রতিবারই তারা সময় চেয়েছে।’
তবে ই-কমার্সে গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে নতুন করে আইন না করে বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা তৈরি না করে, ভোক্তা অধিকার আইনকে সময়োপযোগী করার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ অ্যাসেসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর। তিনি বলেন, ‘আমাদের যে ডিজিটাল কমার্স নির্দেশিকা আছে, তা যদি প্রতিটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান প্রতিপালন করে, তাহলে এই সেক্টরে গ্রাহকের আস্থা ফেরত আসবে। আর এটা পর্যবেক্ষণের জন্য একটা কমিটি করে দেওয়া যেতে পারে। তবে, আমি কোনোভাবেই এই খাতের জন্য নতুন করে আইন বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা করার পক্ষে না। কারণ, এটাও স্বাভাবিক বাণিজ্যিক প্রক্রিয়ার মতোই। শুধু কেনাকাটার মাধ্যম আলাদা। তাই আমাদের যেই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন আছে। সেটিকেই যদি পুনঃপর্যালোচনা করা হয়। সেখানে প্রয়োজনবোধে সময়োপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই আইন হালনাগাদ করা হয় তাতেই সমস্যা সমাধান হতে পারে।’
বেসিস সভাপতি আরও বলেন, ‘গ্রাহকরা যদি ই-কমার্স থেকে কেনাকাটা করার আগে তাদের পেমেন্ট ও ডেলিভারি সিস্টেম, টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন সম্পর্কে ভালো করে তথ্য যাচাই করে নেয়, তাহলে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে। আর যদি কেউ প্রতারিত হয়েই যান, তাহলে ভোক্তা অধিকারে যেন সেই গ্রাহক অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই ওই প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি দেওয়া হবে। তাহলেই গ্রাহকের আস্থা ফিরে আসবে।’
এছাড়া, এই খাত সংশ্লিষ্টদের সচেতনতা আরও বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে আলমাস কবীর বলেন, ‘অনলাইনেই ভোক্তা অধিকারে অভিযোগ দায়ের করা অনেক সহজ। এছাড়া প্রতিটি ই-কমার্সের ওয়েবসাইটে ভোক্তা অধিকারের হটলাইন নম্বরটি প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। আমি মনে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করে গ্রাহকের আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।’
ই-কমার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)-এর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, ‘ই-কমার্সে গ্রাহকদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে ২২ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে ৬টি প্রস্তাব দিয়েছি। যেখানে, লোকবল নিয়োগের মাধ্যমে সেন্ট্রাল ডিজিটাল কমার্স সেলকে আরও কার্যকর করার কথা ছিল। আরও বেশি লোকবল দিয়ে মনিটরিংয়ে বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছিল। ডিজিটাল কমার্সের আদলে যেন ডিজিটাল কমার্স সেলকে পরিচালনা করা হয়। এছাড়া, এই এস্ক্রো সার্ভিস আরও দ্রুতগামী করতে হবে। গ্রাহকদের অভিযোগ জানানোর জন্য একটি সেন্ট্রাল মনিটরিং সেল গঠন করা। এর পাশাপাশি একটি লজিস্টিকস এগ্রিগেটর প্ল্যাটফর্ম করার প্রস্তাব দিয়েছি। যেটি ডাক বিভাগের আওতায় পরিচালনা করা হয়।’
তমাল আরও বলেন, ‘গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে আমাদের আরও বেশি প্রচার প্রচারণা করা উচিত। এই খাতের সব ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে গ্রাহকরা যেন ই-কমার্স থেকে কেনাকাটা করে না ঠকেন, সেই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা দরকার। যারা প্রতারণা করছে, তাদের জন্য দেশের ভোক্তা অধিকার অধিদফতর আছে, প্রতিযোগিতা কমিশন আছে, তারা যদি প্রতারণা করেন, দেশের প্রচলিত আইনে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তাহলেই গ্রাহকদের আস্থা ফিরে আসবে।’
ই-কমার্সে কী করে গ্রাহকদের আস্থা ফিরবে, এমন প্রশ্নের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমান বলেন, ‘সম্প্রতি কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের হাতে বেশ কিছু গ্রাহক প্রতারিত হয়েছেন। আর প্রতারিত হলে সেই খাত থেকে আস্থা কমে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা গত ৪ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সম্পর্কে রিপোর্ট পাই ইভ্যালি সম্পর্কে। যেখানে তারা কী পরিমাণ গ্রাহক ও ভেন্ডরের কাছে দেনা আছে, কী পরিমাণ সম্পদ আছে, তার হিসাব দেওয়া আছে। এই প্রতিবেদন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মঙ্গে একটি জরুরি বৈঠক করি।’
অতিরিক্ত সচিব আরও বলেন, ‘এরআগে ৩০ জুন একটি সার্কুলার জারি করা হয়, যেখানে উল্লেখ করা হয় পণ্য ডেলিভারি না হওয়া পর্যন্ত পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে টাকা দেওয়া হবে না। এর ফলে পণ্য ডেলিভারি যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি লেনদেনও নিরাপদ হবে।’
এদিকে, বৃহস্পতিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের একটি প্রতিনিধিদল বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন হস্তান্তর করতে যায়। এসময় রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘ই-কমার্স একটি সম্ভাবনাময় খাত। কিছু সংখ্যক লোকের কারণে এই খাতটি যেন শুরুতেই মুখ থুবড়ে না পড়ে, সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক হতে হবে। এ খাতে প্রতারণাসহ ভোক্তার স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর বিষয়গুলো চিহ্নিত করে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।’এ সময় প্রতারণা বন্ধ করার কার্যকর উপায় বের করতে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনকে নির্দেশ দেন রাষ্ট্রপতি।