জাতীয়

গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর বরখাস্ত

আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদ থেকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

জাহাঙ্গীরের মেয়র পদের ভবিষ্যত নিয়ে গুঞ্জনের মধ্যেই বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিযোগ দাখিল হয়েছে। সেগুলো সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আমলে নেওয়া হয়েছে। আইনের ধারা অনুযায়ী সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।”

অভিযোগগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে না চাইলেও মন্ত্রী জানান, জমি দখল, জনগণের স্বার্থ পরিপন্থি কাজ, ক্ষমতার অপব্যাবহার, সরকারি সম্পদ আত্মসাতের মত অভিযোগ রয়েছে এর মধ্যে।

একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি বিষয়গুলো তদন্ত করছে বলে জানান স্থানীয় সরকারমন্ত্রী।

তদন্ত শেষ করতে কতদিন লাগবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে নথিভুক্ত করা হয়েছে। এটা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। তদন্ত করতে কতদিন সময় লাগবে এটা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।”

বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীরকে গত ১৯ নভেম্বর দল থেকে বহিষ্কার করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

জাহাঙ্গীর ছিলেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ মণ্ডলকে বৃহস্পতিবার সেখানে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়ার কথা জানানো হয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে।

২০১৮ সালে গাজীপুর সিটি করপোরশেন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে দলীয় প্রতীকে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন জাহাঙ্গীর। দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ায় এখন তিনি মেয়র পদে থাকতে পারেন কি না, সেই আলোচনা চলছিল গত কয়েক দিন ধরে।

নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে মেয়রদের কেউ আদালতে দণ্ডিত হলে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনে তাকে অপসারণের বিধান রয়েছে। কিন্তু দল থেকে বহিষ্কৃত হলে কী হবে, সে বিষয়ে আইনে স্পষ্ট কিছু বলা নেই।

তাছাড়া দলীয় প্রতীকে সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচন শুরুর পর গত পাঁচ বছরে কোনো মেয়রকে দল থেকে বহিষ্কারের ঘটনা এটাই প্রথম। ফলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও কিছু বলতে পারছিলেন না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক কোনো মন্তব্য না করে বল ঠেলে দিয়েছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর দিকে। আর স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম শনিবার বলেছিলেন, তার মন্ত্রণালয় আইন পর্যালোচনা করে দেখবে। তারপর এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এর মধ্যেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে রাজবাড়ী ও মাদারীপুরে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

তাছাড়া জমি সংক্রান্ত এক মামলায় আদালতের আদেশ অমান্য করায় তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেছে হাই কোর্ট।

জাহাঙ্গীর আলমকে বরখাস্তের ব্যাখ্যায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, “সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরত কোনো ব্যক্তি যদি দায়িত্ব পালনে গর্হিত কাজ করেন, অকল্যাণকর কাজের সঙ্গে জড়িয়ে যান, সেসব ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিতে পারে।

“মেয়র জাহাঙ্গীরের ক্ষেত্রে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী, যে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে সেটা আমরা ব্যবহার করেছি।”

মেয়রের অবর্তমানে দায়িত্ব পালনের জন্য তিনজন কাউন্সিলরকে নিয়ে প্যানেলও গছন করে দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তাদের মধ্যে যিনি জ্যেষ্ঠ, তিনি প্যানেল মেয়র (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

ক্রমানুসারে এই প্যানেলের তিন কাউন্সিলর হলেন: আসাদুর রহমান কিরণ, মো. আব্দুল আলীম মোল্লা ও আয়েশা আক্তার।

ভারপ্রাপ্ত মেয়র কবে দায়িত্ব নেবেন জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, “কিছুক্ষণের মধ্যেই সাময়িক বরখাস্তের প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে এবং তিন দিনের মধ্যে নতুন মেয়রকে দায়িত্ব দেওয়া হবে।”

জাহাঙ্গীরনামা

জাহাঙ্গীরের রাজনীতিতে হাতেখড়ি ছাত্রলীগের মাধ্যমে। গাজীপুরের কানাইয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরোনোর পর চান্দনা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৪ সালে মানবিক শাখায় এসএসসি পাস করেন তিনি। এরপর ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। এর মধ্যে ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন, দায়িত্ব পান কেন্দ্রীয় কমিটিতে।

এলএলবি পাস করলেও ব্যবসায়ী হিসেবেই নিজেকে তৈরি করেন জাহাঙ্গীর, সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। গাজীপুর উপজেলা পরিষদে ভাইস চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন।

এরপর মেয়র হওয়ার সাধ জাগে তার। ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনের আগে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে মেয়র পদের প্রার্থী হয়ে যান।

কিন্তু ওই নির্বাচনে জাহাঙ্গীরের বদলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী করেছিল টঙ্গী পৌরসভার মেয়র আজমত উল্লাহ খানকে। আর জাহাঙ্গীরকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিতে হয়। অবশ্য তারপর নবগঠিত গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পান তিনি।

শেষ পর্যন্ত ওই নির্বাচনে আজমত উল্লাহ হেরে যান বিএনপি নেতা এম এ মান্নানের কাছে। পাঁচ বছর পর প্রবীণ আজমত উল্লাহকে বাদ দিয়ে নবীন জাহাঙ্গীরের হাতেই নৌকার বৈঠা তুলে দেয় আওয়ামী লীগ। বিএনপির হাসান উদ্দিন সরকারকে হারিয়ে ২০১৮ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের  মেয়রের চেয়ারে বসেন ৩৫ বছর বয়সী জাহাঙ্গীর।

মেয়রের দায়িত্বে গত তিন বছরে আরও অন্তত দুটি ঘটনায় আলোচনার জন্ম দেন জাহাঙ্গীর। করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর পর ২০২০ সালে তিনি চীন থেকে ৫০ হাজার র্যাপিড টেস্ট কিট নিয়ে আসেন, যদিও দেশে তখনও র্যাপিড টেস্টের অনুমোদন ছিল না। আর নিয়ম অনুযায়ী  ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কোনো অনুমতিও তিনি নেননি।

সে সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। এর জবাবে তিনি বলেছিলেন, “মানুষ মরে গেলে আইন দিয়ে কী করব! … কিন্তু আমার এখানে ৪০ লাখ মানুষ আমাকে ভোট দিয়েছে। যে কোনোভাবে হোক আগে তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করা আমার দায়িত্ব। মানবিক কারণে আমি আনছি, বাঁইচা থাকলে তখন আইন আদালত।”

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে গতবছর এপ্রিলে দেশের সব মসজিদে বাইরে থেকে মুসল্লি ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল সরকার। সরকারের ওই নিষেধাজ্ঞা ওঠার আগেই এপ্রিলের শেষে মসজিদ খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন মেয়র জাহাঙ্গীর আলম।

তার ওই ঘোষণায় সে সময় বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন স্থানীয় প্রশাসন ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। একজন জনপ্রতিনিধির এ ধরনের ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন’ পদক্ষেপের সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন অনেকেই।

শেষ পর্যন্ত ওই ঘোষণা থেকে সরে এসে মেয়র জাহাঙ্গীর বলেছিলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সবাই যেন তা মেনে চলে।

গত সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে মেয়র জাহাঙ্গীরের একটি মন্তব্যের অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে নতুন করে তোলপাড় শুরু হয়। ওই অডিওতে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে মন্তব্য করতে শোনা যায় তাকে।

দল থেকে তাকে জাহাঙ্গীরকে বহিষ্কারের দাবিতে গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হয় সে সময়। এই প্রেক্ষাপটে দলীয় ‘স্বার্থ পরিপন্থি কর্মকাণ্ড ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের’ অভিযোগে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে গত ৩ অক্টেবর জাহাঙ্গীরকে নোটিস দেয় আওয়ামী লীগ।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জাহাঙ্গীর সে সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “একটি মহল আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে একটি এডিটেড ভিডিও বের করেছে, যা সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে, এমনকি কিছু গণমাধ্যমও প্রকাশ করেছে।”

দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাক্ষরিত ওই নোটিসে ১৫ দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছিল জাহাঙ্গীরকে। নির্ধারিত সময়ের আগেই তিনি জবাব দিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমাও চেয়েছিলেন।

তবে গত ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে তাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “আত্মপক্ষ সমর্থনে জাহাঙ্গীর আলম তার বক্তব্য দিয়েছিল। সেটা আমি আজকের মিটিংয়ে পড়ে শুনিয়েছি। এরপর গোটা হাউস কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে মতামত দিয়েছে। এবং এ ব্যাপারে আমাদের সভাপতি সবার মতামত নিয়েছেন। সবাই এক বাক্যে তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানায়।”

জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, “তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। যেহেতু তার বক্তব্য বঙ্গবন্ধু ও আমাদের ইতিহাসকে কটাক্ষ করে। কাজেই এটা প্রশাসনিকভাবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে আজকের দলীয় সিদ্ধান্ত অফিসিয়ালি জানানো হবে।”

পরদিন গাজীপুর শহরে নিজের বাড়িতে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় কেঁদে ফেলেন জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, “ষড়যন্ত্রকারীরা আমার সম্পর্কে ভুলভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করেছেন। আমি যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সরাসরি আমার ওই অডিও/ভিডিওর বিষয়ে কথা বলতে পারতাম, তবে প্রধানমন্ত্রী সবকিছু বুঝতে পারতেন। তখন তিনি হয়ত আমার ব্যাপারে এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেন না।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *