বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান নানা সময়ে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বলেছেন, মেন্টর বা যে কোনো ভূমিকায় জাতীয় দলে সম্পৃক্ত হতে পারেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। কিন্তু বাস্তব উদ্যোগ কতটা নেওয়া হয়েছে? সেই কৌতূহল মেটালেন মাশরাফি। সাক্ষাৎকারে তিনি কথা বললেন তার মাঠে ফেরা, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাম্প্রতিক ও সবসময়ের নানা বাস্তবতা এবং প্রাসঙ্গিক আরও অনেক কিছু নিয়ে।
আপনাকে দেখে দারুণ ফিট মনে হচ্ছে, ওজন কত এখন? সবশেষ কবে এত হালকা ছিলেন!
মাশরাফি বিন মুর্তজা: ওজন এখন ৭৮ কেজি।
২০১৫ বিশ্বকাপের দিকে ৭৯-৮০ কেজি ছিল। ওই ৩-৪ বছর ৭৯-৮০ বা ৮১ কেজির মতো ছিল। এখন চরমমাত্রায় কম।
কিছুদিন আগেও তো ওজন সেঞ্চুরি ছোঁয়ার অবস্থায় ছিল। এখন এত কম!
মাশরাফি: আমার তো কিছু শারীরিক সমস্যা আছে। অ্যাজমা আছে। একটা পর্যায়ে গেলে অ্যাজমা বাড়ে। আর বেশি ওজনে আমি অভ্যস্ত নই। আগে খুব বেশি গেলেও ৮৬-৮৭ কেজি গিয়েছে। ওর ওপরে গেলেই শারীরিক অস্বস্তি শুরু হয়।
আরেকটা ব্যাপার হলো যে, যেহেতু ওই প্যাশনটা এখনও আছে যে আরও কিছু ক্রিকেট খেলে বিদায় নেব, মাঝখানে কোনো কাজ ছিল না, তাই (সংসদ সদস্য হিসেবে) এলাকার কাজ করার পাশাপাশি ফিটনেসের কাজও করেছি।
গত বছরের ১৮ ডিসেম্বরের পর কোনো ধরনের ক্রিকেটেই দেখা যায়নি আপনাকে। বিপিএল দিয়েই কি মাঠে ফিরতে চান?
গত বছর বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি খেলার পর লম্বা বিরতি শেষে বিপিএল দিয়ে মাঠে ফিরতে চান তিনি।
মাশরাফি: আমার তো ইচ্ছা আছে। তবে সবকিছু তো মিলতে হবে, দল পাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু মিলতে হবে। আমার দিক থেকে ইচ্ছে আছে এবং তৈরিও হয়েছি সেভাবে।
আপনার প্রস্তুতি এমনিতে কেমন? ফিটনেস মানে তো শুধু ওজন কমানোই নয়, আরও ব্যাপার আছে। বোলিং স্কিল অনুশীলনের ব্যাপারও আছে…
মাশরাফি: যেহেতু বায়ো-বাবলের ব্যাপার আছে (সিরিজ ছিল জাতীয় দলের), হুটহাট করে তো মাঠে যেতে পারি না। আর বাংলাদেশে বা ঢাকায় এমন কোনো জায়গা নেই যে খেলোয়াড়রা আলাদা করে অনুশীলন করবে। ওই কারণে এখনও শুরু করিনি।
তবে, দেখা যাক। এই মাসের শেষের দিক থেকে ইচ্ছা আছে বোলিং শুরু করার। আমার দিক থেকে সবসময় যেটা চ্যালেঞ্জ থাকে, সেটা হলো ফিটনেস। একটা টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট হলো আগে (ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ), তখন খেলিনি, কারণ ফিটনেস ঠিক ছিল না।
ওই সময়ই আমার মনে হলো যে, প্রস্তুত থাকা উচিত। কারণ করোনার সময় সুযোগ পেলে বিসিবি হুট করেই টুর্নামেন্টগুলো করবে। আমার প্রস্তুত থাকা নিজেরই নিশ্চিত করা উচিত। এজন্যই শুরু করেছি। আশা করছি, বিপিএল শুরু হতে হতে প্রস্তুত হয়ে যাব।
এখন কি শুধুই বিপিএল খেলবেন?
মাশরাফি: নাহ, ঢাকা লিগ অবশ্যই। বিপিএল তো আছেই, আরও বেশি ফোকাস আমার ঢাকা লিগে। ওয়ানডে ফরম্যাটে হলেও, যেটা আমি খেলে আসছি।
কেন ঢাকা লিগে বেশি ফোকাস?
মাশরাফি: আমার ক্যারিয়ার শুরু এটা দিয়ে। আর এমনিতেও ঢাকা লিগের আলাদা চার্ম আছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এই পর্যন্ত এনেছে এই টুর্নামেন্ট। যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় এখানে, এটার আলাদা একটা মজা আছে। আমি নিশ্চিত, আপনাদেরও এটা ভালো লাগে।
বিপিএলের আলাদা আবেদন আছে। ঢাক-ঢোল বাজে, গান-বাজনা হয়, অনেক কিছু হয়। টাকাও আছে। তবে ঢাকা লিগের আবেদন প্রতিটি ক্রিকেটারের কাছে আলাদা।
আপনি খেলার কথা বলছেন। কিন্তু মাঠের বাইরে আপনাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, বিসিবি সভাপতি খেলার বাইরে আপনার নানা ভূমিকার কথা বলছেন, আপনার জন্য বোর্ডের দুয়ার খোলা, এসব বলছেন। আপনার সঙ্গে তার আলোচনা এটা নিয়ে কতটা হয়েছে?
জাতীয় দলে কাজ করার সুযোগ খুব বেশি দেখেন না মাশরাফি, তার আগ্রহ জাতীয় দলের জন্য ক্রিকেটার তৈরি করায়।
মাশরাফি: দুয়ার খোলা বা বন্ধ নিয়ে কোনো আলোচনা এখনও হয়নি। এটা হলো সত্যি কথা। পাপন ভাইয়ের সঙ্গে যতটা কথা হয়েছে… যেহেতু ব্যক্তিগতভাবে কথা হয়েছে, সেটা গোপনই রাখা উচিত। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সম্পর্কিত কিছু আলোচনা হয়নি। সুনির্দিষ্ট বা আলাদা করে বলার মতো কিছু হয়নি। একেবারে কমন জিনিস, গভীর কিছু না। সুনির্দিষ্ট করে যদি পয়েন্ট আউট করতে বলেন যে ওইখানে আমি ইনপুট রাখতে পারি, সেরকম কোনো আলোচনা হয়নি।জাতীয় দলের কথা বাদ দেওয়া গেল, কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটে আপনি কিভাবে কাজে লাগতে পারেন, এটা নিয়ে আলোচনা হয়নি?
মাশরাফি: না না, আমার ভূমিকা কী হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা হয়নি। সুনির্দিষ্ট করে কিছু যে ‘তুমি এখানটায় কি মনে করো’ বা বদল কিছু করা, এরকম আলোচনাই হয়নি। স্রেফ ‘কী অবস্থা’, ‘কী খবর’, এই ধরনের কথাই হয়েছে। সিরিয়াস ইস্যু কিছুই হয়নি।
কিন্তু বিসিবি সভাপতি তো ক্রমাগতই বলছেন। বিভ্রান্তিও ছড়াচ্ছে এতে… মাশরাফিকে বলা হচ্ছে, কিন্তু তিনি আসছেন না বা এরকম কিছু…
মাশরাফি: হয়েছে কী, যখন মিডিয়া প্রশ্ন করে, তখন হয়তো বলতে হয় বলার খাতিরে। উনার জায়গায় আমি হলেও হয়তো বলতাম যে মাশরাফির দরজা খোলা। আমার তো মনে হয় না, আমি কখনও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছি… ক্রিকেটার হয়তো বড় নাও হতে পারি, তবে না কখনও দলের ক্ষতিকারক কিছু করেছি, না কোনো ফিক্সিং ইস্যুতে জড়িত, না কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত, তাই দুয়ার আমার জন্য খোলা থাকারই কথা।
তবে সত্যি বলতে, আমি এমন একটা প্ল্যাটফর্মে আছি, আমি তো বলতে পারব না কিছু। ক্রিকেট বোর্ড চিন্তা করবে যে তারা আমাকে কোন জায়গায় কাজে লাগাতে চায়।
মানে, আপনি নিজে গিয়ে তো বলতে পারেন না যে ‘আমি কাজ করতে চাই’, তাদেরকে কাজটা দিতে হবে, এই তো?
মাশরাফি: সেরকমই। জাতীয় দলের সঙ্গে কাজ করাকে কখনই প্রাধান্য দেই না আমি। আমার কাছে এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। জাতীয় দলের সঙ্গে কী কাজ করব! জাতীয় দলের সঙ্গে কাজ করার জায়গা নেই বলেই মনে করি।
তারপরও যদি সুনির্দিষ্ট করে কোনো প্রস্তাব দেওয়া হয়, অবশ্যই তা বিবেচনা করব।
জাতীয় দলের বাইরে বলতে কোন জায়গায় কাজ করতে চান?
দলকে সাহায্য করতে চান মাশরাফি, তবে বোর্ড থেকে কোনো প্রস্তাব পাননি।
মাশরাফি: অনেক জায়গা আছে, অনেক কাজ করার আছে। জাতীয় দল নিয়েই কাজ করার জায়গা নেই, আমরা ভুল ধারণা নিয়ে দৌড়াচ্ছি।
আপনি তাহলে ডেভেলপমেন্ট পর্যায়ে কাজ করতে চান?
মাশরাফি: আমি বলতে চাচ্ছি, কাজ যদি করতে চাই, সেটার সুযোগ নিচের সারিতেই। জাতীয় দলে অতটা সুযোগ নেই।
আমি জানি না…আপনি আমাকে একটা প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে পারব। একা একা কথা বলে গেলাম, এটা তো কিছু হলো না! ক্রিকেট বোর্ড থেকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব এলে আমি ভাবব। পাপন ভাই যেটা বলেছেন, এটা আমি মনে করি, বলতেই হতো, তাই বলার জন্য বলেছেন। খারাপ কিছু বলেননি, আবার বড় কিছুও নয়।
আপনার সঙ্গে যখন বিসিবি সভাপতির আলাপ হয়, তখন কি আপনার ইচ্ছের কথা বলেছেন?
মাশরাফি: এ ধরনের আলাপই তো হয় না! আমি নিজে তবু পাপন ভাইকে বলেছি যে ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করতে পারলে আমার নিজের কাছে ভালো লাগবে।
একটা ব্যাপার হলো, পাপন ভাই আমাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেন। না হলে ডাকতেন না। কিছু সমস্যা হয়তো উনি অনুভব করছেন যে আমি সমাধান করতে পারি কিনা। এরকমও হতে পারে যে, উনি আমাকে ডেকে বলতেও পারছেন না!
তবে আমি সাহায্য করতে চাই… এটা পাপন ভাইয়ের বিষয় নয়, বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইস্যু। কিন্তু আমাকে না বললে তো আমি হুট করে কিছু বলতে পারি না।
আপনাকে কোনো প্রস্তাব দেওয়া হয়নি বা এ ধরনের আলাপই হয়নি, অথচ মিডিয়ায় বলে যাচ্ছেন উনি। এটা কি তাহলে এক ধরনের স্টান্টবাজি?
মাশরাফি: (হাসি) অনুমান করা তো কঠিন! আমি ব্যক্তিগতভাবে ইতিবাচকভাবেই নিয়েছি যে আমাকে ডেকেছেন এবং আমি স্বতস্ফূর্তভাবে আলোচনা করতে চেয়েছি। কিন্তু প্রতিটি আলোচনার পর আমার মনে হয়েছে, কেন গিয়েছিলাম বা কি অর্জন হলো, কিছুই পেলাম না। আমার কাছে মনে হয়েছে, আমি ওখানকার মানুষ নই। ওই সম্পর্কিত বা বোর্ডের কেউ নই।
আমাকে ডেকেছেন, অবশ্যই সম্মানিত বোধ করেছি। কিন্তু আমার কোনো ভূমিকা নেই, এটাও সত্যি। আমি একটা কথা বলব, কিন্তু আমাকে যদি ওই অথোরিটি না দেওয়া হয়, তাহলে তো কাজ করা যায় না।
পাকিস্তানের বিপক্ষে মিরপুর টেস্টের সময় আপনাকে ডেকে কথা বললেন বিসিবি সভাপতি। আগেও আপনাকে ও তামিম ইকবালকে ডেকেছেন। আলোচনার বিষয়বস্ত নাহয় গোপনই থাক, কিন্তু আপনারা যে পরামর্শ দিয়েছেন, সেসব বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েছে এখনও?
মাশরাফি: আমি যে গিয়েছিলাম, যে আলোচনা হয়েছে, আপনি যেসব বলছেন, এসবের ধারেকাছেও কোনো আলোচনা ছিল না। সুতরাং, আমি কীভাবে বলব! বাস্তবায়ন তো পরের জিনিস, আলোচনায় এগুলো ছিলই না! কিছু ব্যাপার থাকে, সিদ্ধান্ত নেওয়া আছে, সেটা করতে বাধা থাকে কিনা, এই ধরনের আলোচনা হয়েছে।
ক্রিকেট বোর্ড তো স্বতন্ত্র একটা জায়গা, যেখানে কারও কোনো চাপ বা কিচ্ছু নেই। বোর্ড চলে বোর্ডের নীতিতে। এখানে বোর্ড যে সিদ্ধান্ত নেবে, ক্রিকেটার হিসেবে আমি স্বাগত জানাই।
দিনশেষে এটা ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্সের মতোই। আমি বিশ্বকাপে (২০১৯) খারাপ করেছি, আমাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তো, লোকে যে সমালোচনা করছে, এসব মেনে নিতে হবে। এটা বোর্ডকে গ্রহণ করতে হবে, ক্রিকেটারদের করতে হবে, দলকে বহন করতে হবে। এসবের উত্তর দিতে যাওয়া বোকামি। এটা পেশাদার জায়গা, সবাই সেরাটা চাইবেই।
শতভাগ দেওয়ার পর ফল না এলে লোকে অন্তত ভাববে যে চেষ্টা করেছে। ভারতের মতো দল, তারা টপ না হতে পারলে লোকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয় না। ইংল্যান্ডে ২-১ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ জয়ের পরও বিশ্বকাপে সেমি-ফাইনাল খেলতে না পারায় ক্রিকেটারদের তুলাধুনা করা হয়েছে। অথচ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল ইংল্যান্ডে টেস্ট সিরিজ জয়, বা অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সিরিজ জয়। সেটাই বলছি যে লোকের সেন্টিমেন্ট এমন, কোনটি কখন কাজ করবে, কেউ জানে না। কাজেই উচিত হলো, কথা কম বলে কাজ করা।
যোগাযোগের ঘাটতি এখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিছুদিন আগে মুশফিকুর রহিমও এই অভিযোগ করেছেন যে, তার সঙ্গে সুনির্দিষ্ট যোগাযোগ করা হয়নি। মাহমুদউল্লাহ অবসর নিয়েও অফিসিয়ালি নিতে পারছিলেন না। নানা সময়ে অনেকেরই এই অভিযোগ আছে। আপনার অভিজ্ঞতা কি বলে, এই যোগাযোগের ঘাটতি কেন থাকে?
মাশরাফি: কেন হয়, আমিও জানি না। দেখুন, বিরাট কোহলির মতো ক্রিকেটার এখন আর অধিনায়ক নন (সাদা বলের ক্রিকেটে)। কল্পনা করেন! কোহলির চেয়ে বড় ক্রিকেটার বাংলাদেশের ক্রিকেটে আছে?
কোহলিকে যখন অধিনায়ক থেকে সরানো হয়েছে, কোনো কথা কি বাইরে এসেছে? ভেতরে যা-ই থাকুক, প্রকাশ্যে কতটা পারস্পরিক শ্রদ্ধা! পেশাদারি যে আচরণ থাকা উচিত, সেটা দেখা গেছে। তাতে যোগাযোগের কথা বলছি আমি। অবশ্যই কোহলিকে সরানোর আগে তাকে জানানো হয়েছে। সৌরভ গাঙ্গুলি বলেছেন যে, ‘হ্যাঁ, আমার সঙ্গে কথা হয়েছে ওর।” তার মানে, তাদের সিস্টেম কতটা ভালো। মিডিয়ার সামনে যতটা বলা উচিত, সবাই ততটুকুই বলছে। এটাকে বলে পেশাদারীত্ব। এখানে আত্মীয়তা, ভালোবাসার মূল্য নেই। কেবলই পেশাদারীত্ব।
যোগাযোগ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মুশফিককে কিপিং করাবেন না, এটা তো ড্রেসিং রুমেই শেষ হওয়া উচিত। টিভিতে দেখে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন কেন? পরে প্রশ্ন করবেন। কিন্তু আগেই যখন বলে দিচ্ছেন, তার মানে আপনি এতই কনফিউজড এবং লোকে সমালোচনা করবে, এই ভয়ে আপনি আগে এসেই বলে দিচ্ছেন।
মুশফিককে টি-টোয়েন্টিতে রাখা হলো না (পাকিস্তান সিরিজে), পরে সে বলল যে তাকে জানানো হয়নি, পরে নান্নু ভাই (প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন) বললেন যে বলা হয়েছে… আমার ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছিল। অন্যান্য বোর্ড তো আমার চেয়ে হাজার গুণ বড় ক্রিকেটারদের সঙ্গেও ভালোভাবে যোগাযোগটা করতে পারছে!
ক্রিকেট বোর্ড তো যে কোনো সিদ্ধান্ত চাইলেই নিতে পারে। দেশের চেয়ে কোনো ক্রিকেটার বড় নয়। যদি কেউ দেশের চেয়ে বড় হয়, তাকে না খেলানোই উচিত। এটা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হাজার, লাখ, কোটি মানুষ মাশরাফির পক্ষে থাকুক, কিন্তু মাশরাফি যদি মনে করে সে বাংলাদেশ ক্রিকেটের চেয়ে বড়, তাহলে তাকে বাদ দেওয়া উচিত। কে কী বলল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ক্রিকেট বোর্ড তাই যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু কমিউনিকেশন ঠিক করে। যোগাযোগ ঠিক রাখতে পারলে, তারপর কোনো ক্রিকেটার কিছু করলে তাকে বাদ দিন! বাংলাদেশের ক্রিকেট তো এমনিতেই খুঁড়িয়ে যাচ্ছে। তো ওইসব ক্রিকেটার রেখে লাভ নেই।
যোগাযোগ ঠিক রেখে যে কোনো অ্যাকশনে যাওয়া যায়। কিন্তু যোগাযোগ ঠিক না রাখলে ওই ক্রিকেটারের প্রতি অন্যায় হয়।
আমাকে যখন বাদ দেওয়া হলো, আমি বলেছিলাম যে এটা পেশাদারভাবেই নিচ্ছি। তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। তারপরও আমি ইতিবাচকভাবে নিয়েছি এজন্য যে, আমি বাংলাদেশ ক্রিকেটের চেয়ে বড় নই। আমার দায়িত্ব বাংলাদেশের ক্রিকেটকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দেশের ক্রিকেটের দায়িত্ব নয় আমাকে টেনে তোলা।
যেটা করা উচিত, আমি যে দেশকে সার্ভিস দিয়েছি, ওই সম্মানটুকু দেওয়া উচিত যে যদি বাদও দেয়, আমার সঙ্গে যেন যোগাযোগ করা হয়। বা আমাকে কোনো সিরিজে বিশ্রাম দেওয়া হচ্ছে, সেটা পরিষ্কার করে বলা। সেটা ভালো লাগে বা মুশফিকের কাছে ভালো লাগত।
হতে পারে, আমাদের (বোর্ডের) ওই ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বলার সাহস নেই। কিংবা হতে পারে, এসব আমাদের মাথায়ই আসে না, মনে হয় এসবের প্রয়োজনই নেই!
ক্রিকেট কালচারটা আগে ঠিক করতে হবে। ক্রিকেট সংস্কৃতি যদি সেট না হয়, তখন এসবও সেট হবে না।
সংস্কৃতি গড়ে উঠবে কবে?
মাশরাফি: এটা তো আমি জানি না। তবে ক্রিকেট সংস্কৃতি গড়ে তোলা খুব কঠিন কিছু না। ১০ কোটি মানুষের আলোচনা-সমালোচনা শুনে যদি আপনি দল ঠিক করেন, তাহলে ওইখানে আপনার না থাকাই উচিত। যদি সোশাল মিডিয়া দেখে দল তৈরি করেন, এই চাপ যদি না নিতে পারেন, তাহলে এই জায়গায় বসা আপনার উচিত নয়।
একটা আদর্শ চিত্র কল্পনা করা যাক। আপনাকে যদি ডেভেলপমেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়, কিভাবে কাজ করবেন?
মাশরাফি: এখানে যেভাবে চলছে, আমার মনে হয় না এটা কোনো পথ।
অস্ট্রেলিয়ার দিকে যদি দেখেন, ২০০৭ বিশ্বকাপের পর ওরা বিশ্বকাপ জিতেছে ২০১৫ সালে। মাঝের সময়টায় কিন্তু একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে গিয়েছে ওরা। ২০০৭ সালের পর যে ক্রিকেটাররা অবসরে গেছেন, তারপর ওদের দাঁড়াতে সময় লেগেছে। ওদের সিস্টেমের বিন্দুমাত্র ভুল ধরতে গেলে আপনাকে অনেক স্টাডি করতে হবে। ভারতেরও একই। ভারত ২০১১ বিশ্বকাপের পর আর কোনো বিশ্বকাপ জেতেনি। অথচ তাদের সিস্টেম অনুসরণ করে এখন অস্ট্রেলিয়া।
আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, ভারতের এত মাঠ, এত সুযোগ-সুবিধা, তারপরও একটা বিশ্বকাপ পাচ্ছে না। কিন্তু সামগ্রিক চিত্র দেখলে কিন্তু আপনি জানেন, ওদের ক্রিকেট ওপরের দিকে আছে। সেখান থেকে আমাদের ফ্যাসিলিটিজের কথা ভাবেন!
এটা ভাবার পর আপনি কিভাবে আশা করছেন যে ভাগ্যের সহায়তা ছাড়া, কিংবা সাকিবের অসাধারণ পারফরম্যান্স ছাড়া বা তামিম-মুশফিক-রিয়াদ অসাধারণ ক্রিকেট না খেললে আপনি কিছু অর্জন করবেন? কিভাবে আশা করছেন?
চিন্তা করতে হবে যুক্তি দিয়ে। হুট করে একটা সিরিজ জিতে গেলাম। হয়তো সেটা একটা অর্জন। কিন্তু বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে আপনি কোথায় আছেন? বাংলাদেশের ক্রিকেট কোথায় আছে? এক সাকিব ইনজুরিতে পড়লেই তো ওই সিরিজ শেষ হয়ে যায়। গত ৮-১০ বছর ধরেই এসব দেখে আসছি। এসব তো ভাবতে হবে।
যখনই আমি ক্যামেরার সামনে দাঁড়াব, তখনই স্রেফ জাতীয় দল নিয়ে আলোচনা করব, কথা বলব, এই ধারণা থেকে বের হতে হবে। কথা বলার জায়গা হওয়া উচিত এইচপি, ডেভেলপমেন্ট, অনূর্ধ্ব-১৯। আমাদের প্রথম ভাবনাই হওয়া উচিত যে জাতীয় দল নিয়ে কথা বলব না। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকে ক্রিকেটারদের এগিয়ে চলা, এরপর এইচপিতে যাবে, কীভাবে এই সময়টা তারা পার করবে…
আমাদের বিজয় (এনামুল হক) অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান করেছিল। বাবর আজম, কুইন্টন ডি ককরা খেলেছিলেন সেবার। আজ বিজয় কোথায়?
আমি বিজয়কে দায় দিচ্ছি না। বলছি সিস্টেমের কথা।
অভিষেক দাস অরণ্য, গত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে ৩ উইকেট নিয়েছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখনও পর্যন্ত সেরা অর্জন যুব বিশ্বকাপ জয়। সেই জয়ের ম্যাচে সেরা পারফরমার গত ২ বছর ধরে পিঠের চোট নিয়ে পড়ে আছে। এখন সম্ভবত থাইল্যান্ডে গিয়েছে অস্ত্রোপচার করাতে, ২ বছর পরে।
এগুলো ছোট ছোট উদাহরণ। আমাদের সিস্টেমের কি অবস্থা? অভিষেককে যদি আরও এক বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানো হতো, ঠিকঠাক চিকিৎসা হতো, সে এখন সুস্থ থাকত। সে তো দেশের সম্পদ। যত্ন তো করতে হবে।
দেশের ক্রিকেটে কোনো বিপর্যয় হলেই আওয়াজ ওঠে অমুককে সরাও, তমুককে বদলাও। কিন্তু সিস্টেম না বদলালে কি আদৌ লাভ হবে?
মাশরাফি: প্রত্যেকের কিন্তু নির্দিষ্ট কাজ আছে। আমাকে যখন বোলার হিসেবে নেওয়া হচ্ছে, আমি জানি ভূমিকা কী। ক্রিকেট বোর্ডে যে পরিচালকরা আছেন, তাদের নিজ নিজ ভূমিকা পালন করতে হবে।
সুজন ভাইয়ের (খালেদ মাহমুদ) কথা আমি কেন বলি? কারণ তিনি ফল দিয়েছেন বলেই বাধ্য করিয়েছেন আমাকে বলতে। গত যুব বিশ্বকাপ জয়, এবার ভারত থেকে একটা টুর্নামেন্ট জিতে এলো ছেলেরা। এটা উনার কৃতিত্ব নয়? গেম ডেভেলপমেন্ট তো উনি সাজাচ্ছেন!
এখন সুজন ভাইয়ের কাজ নিয়ে ক্রিকেট অপারেশন্সে গ্যাঞ্জাম হচ্ছে। এটা তো ঠিক নয়! অপারেশন্সের কাজ তারা করুক, সুজন ভাইয়ের কাজ তিনি করবেন, গ্রাউন্ডসের কাজ তারা করবে… সুনির্দিষ্ট ভূমিকা আছে সবার। একজনের সঙ্গে আরেকজনের কামড়াকামড়ি হওয়ার তো সুযোগ নেই। কিন্তু এসব হচ্ছে, সেটির প্রভাবই পড়ছে।
যার যার কাজ সুনির্দিষ্টভাবে করতে পারাটাই বাংলাদেশের ক্রিকেটকে সামনে নিয়ে যাবে। এখানে কোনো রকেট সায়েন্স নেই, যার যে ভূমিকা, তা ঠিকঠাক করুন। সবকিছুই একটা প্রক্রিয়া, সেটা মানতে হবে। প্রক্রিয়া ছাড়া ভালো কিছু আশা করা যায় না।
আপনি যদি এখন বিসিবি সভাপতি কিংবা বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রধান হতেন, আপনি কি করতেন এই মুহূর্তে?
মাশরাফি: প্রথমেই আমি স্টেটমেন্ট দিতাম, ‘আমার তিন বছর সময় প্রয়োজন।’ এই তিন বছরে বাংলাদেশ দলের ফল কেমন হচ্ছে, তা ভুলে যেতে হবে। এই তিন বছরে কোত্থেকে ফল এনে দেবেন! সেরকম ক্রিকেটারই তো নাই! সিস্টেমই তো নাই। সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে।
এজন্য বললাম, আমার প্রথম পদক্ষেপ হবে দেশের মানুষকে জানানো যে, তিন বছরের আগে সম্ভব নয়। কারণ রাতারাতি তো কিছু বদলানো যায় না।
এই তিন বছরে আপনি কি কাজ করবেন?
মাশরাফি: অনেক কিছু করার আছে। সব বলাও ঠিক হবে না। যেটি বললাম, সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। সেটি বয়সভিত্তিক পর্যায় থেকে, ক্লাব পর্যায় থেকে, সব জায়গায় সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। তার আগে ফ্যাসিলিটিজ গড়ে তুলতে হবে। সুযোগ-সুবিধার জন্য বিনিয়োগ করতে হবে।
প্রায়ই ৯০০ কোটি টাকার কথা শুনি। অবকাঠামোর জন্য যদি আমার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়, সেটাই করতে হবে। কারণ দিনশেষে, টাকাটা এসেছে তো দলের কারণেই। ক্রিকেট দিয়েই। ক্রিকেট না বাঁচলে টাকা দিয়ে করবেন কি?
আগে এই সিস্টেম গড়তে হবে। ক্রিকেটারদের শিক্ষা, ক্রিকেটারদের মনস্তাত্ত্বিক জগতের খেলা, এগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের কি নেই, সেটা খুঁজে বের করতে হবে।
জিম্বাবুয়ের সঙ্গে যদি আমরা ৩৫০ করতে পারি (৫০ ওভারে), নিউ জিল্যান্ডের সঙ্গে কেন পারব না? বুঝলাম নিউ জিল্যান্ডের বোলিং ভালো। তাহলে অন্তত ২৮০ কেন পারব না? কারণ বোলারকে আমরা মাথায় নিয়ে নিচ্ছি। সাকিব কেন সফল? কারণ সে শুধু বলটাকে গোনায় ধরে, চেহারাটাকে নয়। সাকিব মানসিকভাবে এত এগিয়ে, এজন্যই সে দলের অন্যদের চেয়ে অনেক ভালো ক্রিকেটার।
আবার তামিমের উদাহরণ দেই। বিশ্বকাপ এলেই সে কেন পারফর্ম করতে পারে না? কারণ, তার মাথায় ঢুকে যায় যে “এই বিশ্বকাপে আমার ভালো করতে হবে, কোনো বিশ্বকাপ ভালো যায় না।” বাড়তি চাপ সে নিয়ে নেয়।
এটাই ব্যাপার। মানসিকভাবে যে যত ফ্রি থাকে, যতটা সুস্থ থাকে, সে ততটা ভালো খেলবে। ক্রিকেট খেলাটাই এরকম। আমি দায়িত্বে থাকলে আগে এই জায়গাগুলো নিয়েই কাজ করতাম।
সত্যি বলতে, জাতীয় দল নিয়ে কাজ করতে গেলে মনস্তাত্ত্বিক কাজই করা যায়। অন্য কাজ করার জন্য তো কোচ-ম্যানেজার আছেন, ট্রেনার-ফিজিও আছেন। সিস্টেম নাই নিচের সারিতে। যেখানে সব আছে, সেটা নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। যেখানে কিছু নেই, সেখানে কোনো আলোচনাই নেই।