যুক্তরাষ্ট্রে যৌন নিপীড়নের মামলায় বিচারের মুখে পড়া ব্রিটিশ রানির ছেলে প্রিন্স অ্যান্ড্রু তার সামরিক ও রাজকীয় খেতাব হারিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বাকিংহাম প্রাসাদ জানিয়েছে, “রানির অনুমোদন ও সম্মতিতে ডিউক অব ইয়র্কের সামরিক সংযুক্তি ও রাজকীয় সম্মান ফেরত নেওয়া হয়েছে।”
বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ডিউক অব ইয়র্ক অ্যান্ড্রুকে (৬১) এখন থেকে আর আনুষ্ঠানিক কেতায় ‘হিজ রয়্যাল হাইনেস’ বলা হবে না।
যৌন হয়রানির মামলায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত প্রিন্স অ্যান্ড্রুর বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর এই পদক্ষেপ নেওয়া হল।
নিউ ইয়র্কে অ্যান্ড্রুর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগটি আনেন ভার্জিনিয়া জোফ্রে নামের এক নারী। ওই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন অ্যান্ড্রু।
তার ঘনিষ্ট একটি সূত্রের বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, অভিযোগ থেকে তিনি নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। ওই সূত্রর যুক্তি, বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের আদালত ওই অভিযোগের ভিত্তিতে বিচার প্রক্রিয়া চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছে মাত্র, সেটি বাদীর অভিযোগের সারবত্তা নিয়ে কোনো রায় নয়।
প্রিন্স অ্যান্ড্রুর বিরুদ্ধে করা মামলায় ভার্জিনিয়া জোফ্রে দাবি করেছেন, ২০০১ সালে তাকে যৌনকর্মে বাধ্য করেছিলেন ডিউক অব ইয়র্ক।
বিবৃতিতে বাকিংহাম প্রাসাদ জানিয়েছে, ডিউক অব ইয়র্ক কোনো ধরনের রাজকীয় দায়িত্বে থাকতে পারবেন না এবং এই মামলা তাকে একজন সাধারণ নাগরিকের মতই লড়তে হবে।
অ্যান্ড্রু রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ও প্রিন্স ফিলিপের তৃতীয় সন্তান এবং দুই ছেলের মধ্যে কনিষ্ঠ। ব্রিটিশ রাজমুকুটের উত্তারিধীকারীদের তালিকার নয় নম্বরে তার অবস্থান।
বিবিসি লিখেছে, প্রিন্স অ্যান্ড্রু যেসব রাজকীয় দায়িত্বের অধিকারী ছিলেন, সেসব রানীর অধীনে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং এই আদেশ তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করা হয়েছে। সেসব দায়িত্ব রাজ পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হবে।
প্রিন্সেস ডায়ানার ছেলে হ্যারি ও তার স্ত্রী মেগানের মতই প্রিন্স অ্যান্ড্রুর নামের আগে ‘হিজ রয়্যাল হাইনেস’ ব্যবহার করতে পারবেন, তবে আগের মত আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বহন করবে না বলে জানিয়েছে রাজপ্রাসাদ।
যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছেন, ডিউকের সামরিক খেতাব রানীর কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে তাদের কোনো মন্তব্য নেই। এটা রাজপ্রাসাদের নিজস্ব বিষয়।
বৃহস্পতিবার রাজতন্ত্র-বিরোধী গোষ্ঠী ‘রিপাবলিক’ একটি চিঠি প্রকাশ করে। রাজকীয় নৌ, বিমান ও সেনা বাহিনীর ১৫০ জন সাবেক সৈনিক ওই চিঠিতে প্রিন্স অ্যান্ড্রুর আটটি সামরিক খেতাব ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য রানির কাছে আহ্বান জানান।
প্রথম রয়্যাল ট্যাংক রেজিমেন্টে দায়িত্ব পালন করা সাবেক লেফটেন্যান্ট স্টুয়ার্ট হান্ট, যিনি ওই চিঠিতে সই করেছেন, প্রিন্সের সামরিক খেতাব ফেরত নেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি এও বলেছেন যে বিষয়টি আরও আগেই মীমাংসা করা দরকার ছিল।
ব্রিটিশ রাজকীয় নৌ বাহিনীতে ২২ বছর নিয়োজিত ছিলেন অ্যান্ড্রু, আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে ফকল্যান্ড যুদ্ধে একজন পাইলট হিসেবে হেলিকপ্টার নিয়ে তিনি অংশ নেন।
বাকিংহাম প্রাসাদের সবশেষ ঘোষণার অর্থ হল, প্রিন্স তার প্রায় সবগুলো সামরিক খেতাব হারিয়েছেন, যার মধ্যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অন্যতম জ্যেষ্ঠ পদাতিক রেজিমেন্ট গ্রেনাডিয়ার গার্ডসের কর্নেল খেতাবও রয়েছে।
এছাড়া কানাডা, নিউ জিল্যান্ডসহ প্রবাসে ডিউক যেসব সম্মানসূচক খেতাব ব্যবহার করে আসছিলেন, সেগুলোও ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
তবে প্রিন্স অ্যান্ড্রুর সামরিক পদবী ভাইস-অ্যাডমিরাল অক্ষুণ্ন থাকবে বলে নিশ্চিত করেছে রাজপ্রাসাদ।
২০১৫ সালে ৫৫-তম জন্মবার্ষিকীতে তার সমসাময়িক যেসব সামরিক কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে অ্যান্ড্রুকেও নৌ বাহিনীর ভাইস-অ্যাডমিরাল পদে উন্নীত করা হয়।
বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা ও বেসরকারি সংগঠনও প্রিন্সের সঙ্গে তাদের প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। অবশ্য এরপরেও বিভিন্ন নামী গলফ ক্লাব, বিদ্যালয় ও সাংস্কৃতিক ট্রাস্টসহ ডজনখানেক প্রতিষ্ঠানে তার রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকের পদ বহাল আছে।
ভার্জিনিয়া জোফ্রের আইনজীবী ডেভিড বোয়িস বিবিসিকে বলেছিলেন, শুধু আর্থিক সমঝোতা তার মক্কেলের জন্য যথেষ্ট নয়- তিনি ন্যয়বিচার চান।
প্রিন্সের আইনজীবীরা এই মামলাটি খারিজ করে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন, যেহেতু ২০০৯ সালে বাদী যৌন নিপীড়নের মামলায় দোষী জেফরি এপস্টেইনের সঙ্গে একটি সমঝোতাপত্রে সই করেছিলেন।
তবে ৪৬-পৃষ্ঠার রায়ে বিচারক লুইস এ কাপলান প্রিন্স অ্যান্ড্রুর পক্ষে দেওয়া যুক্তি খারিজ করেছেন, যেখানে আসামি পক্ষ দাবি করেছে যে অ্যন্ড্রুর বিরুদ্ধে এই মামলাটি ‘আইনিভাবে যথাযথ নয়’ এবং ভবিষ্যৎ শুনানির জন্য এগিয়ে নেওয়া যায় না।
২০২১ সালের অগাস্টে ভার্জিনিয়া জোফ্রে (৩৮) নিউ ইয়র্কে ওই রাজ্যের চাইল্ড ভিকটিম অ্যাক্টের অধীনে প্রিন্স অ্যান্ড্রুর বিরুদ্ধে মামলা করেন। ওই আইনে শৈশবে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন এমন ব্যক্তিদের বিচার চাওয়ার সুযোগ দেওয়া আছে।
জোফ্রের অভিযোগ, দুই দশকের বেশি সময় আগে এপস্টিনের বান্ধবী গিলেইন ম্যাক্সওয়েলের লন্ডনের বাড়িতে অ্যান্ড্রু তাকে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য করেছিলেন। এপস্টিনের মালিকানাধীন দুটি জায়গায় ব্রিটিশ প্রিন্স তার ওপর নিপীড়ন চালিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে মামলায়।
সেখানে বলা হয়, অ্যান্ড্রু যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে মোট তিনবার নিপীড়ন করেন জোফ্রেকে, তখন তার বয়স ছিল ১৭ বছর – যুক্তরাষ্ট্রের আইনে তিনি তখন অপ্রাপ্তবয়স্ক।
২০১৯ সালে বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে রানির ছেলে অ্যান্ড্রু বলেছিলেন ভার্জিনিয়া জোফ্রের সঙ্গে কখনো দেখা হওয়ার কোনো ‘স্মৃতি তার নেই’, এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে তার সঙ্গে যৌনকর্মের ‘কোনো ঘটনাই কখনো ঘটেনি’।
কিশোরীদের যৌননিগ্রহে সহায়তায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত মাসে এপস্টিনের বান্ধবী ম্যাক্সওয়েলকেও দোষী সাব্যস্ত করে আদালত।