অর্থনীতি

বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগ ৩৫০০ কোটি টাকা

বাংলাদেশ সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বা ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) আকর্ষণের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়ে যাচ্ছে। কর অবকাশ থেকে শুরু করে ব্যাংক ঋণ, প্রণোদনা, অবকাঠামোগত সুবিধার ছড়াছড়ি। তার পরও প্রত্যাশিত হারে সাম্প্রতিক সময়ে এফডিআই বাড়ছে না।

বিদেশ থেকে দেশে এফডিআই না বাড়লেও বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগের হার বেড়েই চলেছে। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে বিদেশে দেশের উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ ছয় কোটি ২৭ লাখ ডলার বেড়ে স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩৯ কোটি ডলারে। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি একটি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এতে শুধু উপস্থান করা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে দেশি উদ্যোক্তাদের বৈধভাবে নেওয়া বিনিয়োগের তথ্য। এর বাইরে অবৈধভাবে বা পাচারের মাধ্যমে আরও অনেক পুঁজি নেওয়া হয়েছে যেগুলো বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করেছে।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা যায়, বৈধভাবে দেশ থেকে পুঁজি নেওয়ার চেয়ে পাচারের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে অনেক বেশি। বিনিয়োগ থেকে অর্জিত মুনাফা দেশে আনা হয়েছে খুবই কম। বরং নেওয়া হচ্ছে বেশি।

এদিকে গত ২৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি নীতিমালা জারি করে দেশের সচ্ছল রপ্তানিকারকদের বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। অনেকে বিদেশে বিনিয়োগের আবেদনও করেছে। এগুলো এখন পর্যালোচনাধীন রয়েছে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হু হু করে বাড়ছিল।

গত অক্টোবরে তা বেড়ে চার হাজার ৭০০ কোটি ডলারে উঠেছিল। যা দিয়ে ওই সময়ে নয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব ছিল। অথচ তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ থাকলেই যথেষ্ট। রিজার্ভকে অনেক বেশি উদ্বৃত্ত মনে করে দেশ থেকে পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ওই নীতিমালার আওতায় এখনো বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগ শুর্নু হয়নি।

তারপর্ ির্থাৎ নীতিমালা জারির এক মাস পরই গত মার্চ থেকে বাজারে ডলার সংকট বাড়তে থাকে। এ মাসের শুরুতে সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এখন রিজার্ভ রক্ষায় বিদেশ ভ্রমণ, বিলাসী পণ্য আমদানি, অন্য পণ্য আমদানিতে লাগাম টানা হয়েছে। দেশ থেকে বিদেশে ডলার নিয়ে বিনিয়োগ স্থগিত করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, রিজার্ভ হচ্ছে বিপদে ব্যবহারের জন্য। সুসময়ে ব্যবহারের জন্য নয়। কিন্তু রিজার্ভকে সুসময়ে ব্যবহার করেই যত বিপত্তি লেগেছে। রিজার্ভ থেকে ডলার নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ দেওয়া হয়েছে। অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ফলে বৈশ্বিক একটু ধকল এখন সহ্য করা যাচ্ছে না। অর্থনীতিকে প্রচণ্ড চাপে ফেলেছে।

মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে এফডিআই বেড়েছে ১৩ শতাংশ। এর বিপরীতে একই সময়ে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের স্থিতি বেড়েছে ১৯ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ দেশে বিদেশিদের বিনিয়োগ বাড়ার চেয়ে বিদেশে বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ ৬ দশমকি ২ শতাংশ বেশি বেড়েছে।

বিনিয়োগের এই চিত্রকে অর্থনীতিবিদরা মোটেই স্বস্তিদায়ক মনে করেন না। তাদের মতে, দেশের চেয়ে বিদেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর মতো পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এখনো পৌঁছেনি। এখন দেশেই বিদেশি বিনিয়োগ দরকার। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রায় স্থানীয় উদ্যোক্তারাও দেশে বিনিয়োগ করতে পারেন। এতে কর্মসংস্থান বাড়বে, দরিদ্রতা কমবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও প্রসারিত হবে। দেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের বিষয়ে বিদেশমুখী না করে দেশমুখী করাটা জরুরি। এ জন্য সরকারি নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। তা না হলে ভুলের মাশুল দিতে হবে দেশের মানুষকে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন দেশে এফডিআইয়ের স্থিতি ছিল ৩২ কোটি ৭১ লাখ ৪০ হাজার ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় তিন হাজার বা দুই হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। ২০২১ সালে এ স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯ কোটি ডলার। যা স্থানীয় মুদ্রায় তিন হাজার ৪৩২ কোটি টাকা বা প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে বিদেশে বিনিয়োগ বেড়েছে ছয় কোটি ২৭ লাখ ডলার বা ৫৫২ কোটি টাকা। আলোচ্য বিনিয়োগ থেকে ২০২০ সালে দেশে মুনাফা হিসাবে এসেছে এক কোটি ৯৫ লাখ ডলার।

২০২১ সালে এসেছে ২৯ লাখ ১৭ হাজার ডলার। করোনার কারণে বৈশ্বিক পরিস্থিতি নেতিবাচক হওয়ায় মুনাফা আসার হার বেশ কমেছে। ২০২০ সালে দেশি উদ্যোক্তারা বিদেশে বিনিয়োগ করেছিলেন তিন কোটি ১১ লাখ ডলার। ২০২১ সালে করেছেন ৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। ওই সময়ে বিনিয়োগ বেড়েছে ছয় কোটি ৩৬ লাখ ডলার। মোট বিনিয়োগের স্থিতির মধ্যে গত বছর মূলধন হিসাবে নেওয়া হয়েছে ৫৮ লাখ ডলার, আয় থেকে পুনরায় বিনিয়োগ করা হয়েছে দুই কোটি ৩৩ লাখ ডলার এবং এক কোম্পানি অন্য কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছে ছয় কোটি ২৬ লাখ ডলার।

২০২১ সালে দেশ থেকে বিদেশে যাওয়া মোট বিনিয়োগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যুক্তরাজ্যে চার কোটি ৮৩ লাখ ডলার। এর পরেই গেছে হংকংয়ে দুই কোটি ডলার, নেপালে এক কোটি ১৩ লাখ ডলার। এ ছাড়া ভারতে ৬৬ লাখ ডলার, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২৪ লাখ ডলার, যুক্তরাষ্ট্রে ২১ লাখ ডলার, ইতালিতে ১১ লাখ ডলার, সিঙ্গাপুরে ৯ লাখ ডলার, দক্ষিণ আফ্রিকায় সাত লাখ ডলার, কেনিয়া ও শ্রীলংকায় পাঁচ লাখ ডলার করে বিনিয়োগ গেছে। এ ছাড়া ওমান, মালয়েশিয়া, চীন, গ্রিস ও পাকিস্তানেও বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ রয়েছে।

দেশি উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগ বাড়তে থাকে ২০০০ সাল থেকে। ওই বছরে স্থিতি ছিল ছয় কোটি ৭৯ লাখ ডলার, ২০০১ সালে আট কোটি ৫২ লাখ, ২০০২ সালে আট কোটি ৮২ লাখ, ২০০৩ সালে ৯ কোটি ৫১ লাখ, ২০০৪ সালে ৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার স্থিতি ছিল। ২০০৬ সালে তা বেড়ে ১০ কোটি ৫০ লাখ ডলারে উন্নীত হয়।

২০১১ সাল থেকে টানা বাড়তে থাকে। মধ্যে শুধু ২০১৮ সালে ২০১৭ সালের চেয়ে সামান্য কমেছিল। ২০১০ সালে স্থিতি ৯ কোটি ৮৩ লাখ ডলার, ২০১১ সালে ১০ কোটি ৬২ লাখ, ২০১২ সালে ১০ কোটি ৭২ লাখ, ২০১৩ সালে ১৪ কোটি ২৫ লাখ ও ২০১৪ সালে ১৬ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। ২০১৫ সালে তা আরও বেড়ে ১৮ কোটি ৮৩ লাখ ডলার, ২০১৬ সালে ২১ কোটি ২৯ লাখ, ২০১৭ সালে ৩৩ কোটি ১০ লাখ, ২০১৮ সালে ৩১ কোটি পাঁচ লাখ ও ২০১৯ সালে ৩২ কোটি ৩৬ লাখ ডলার স্থিতি ছিল।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগ করলে দেশের ব্র্যান্ডিং হবে। কিন্তু দেখতে হবে বিদেশে বিনিয়োগের সক্ষমতা আছে কিনা? বর্তমানে ডলারের বাজারে যে সংকট, তা তো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগের সক্ষমতা দেশের নেই। আগে অর্জন করতে হবে। ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য রিজার্ভ থাকতে হবে। তা না করে বিদেশি বিনিয়োগের অনুমোদন দেওয়াটাও যুক্তিযুক্ত নয়।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া বৈধভাবে বিদেশে কোনো পুঁজি নেওয়ার সুযোগ নেই। বৈধভাবে যারা বিদেশে বিনিয়োগ করেছেন তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে করেছেন। রিজার্ভ বাড়ায় বিদেশে বিনিয়োগের সীমিত অনুমোদন দেওয়া হয়। এছাড়া প্রবাসীরাও বিদেশে বিনিয়োগ করেছে।

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে থাকে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রিজার্ভ বেড়েছে। বৈশ্বিক কারণে আমদানি ব্যয় বাড়ায় ও রেমিট্যান্স কমায় এখন আবার কমছে। রিজার্ভ বাড়ার কারণে সরকার বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগের পক্ষে অবস্থান নেয়। ফলে কেন্দ ীয় ব্যাংক থেকেও বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগের জন্য ২০১৫ সাল থেকে অনুমোদন দেওয়া শুরু হয়। এর আগে বিদেশে বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা, এক্সচেঞ্জ ও সীমিত কিছু বেসরকারি উদ্যোক্তা বিনিয়োগ করেছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষক আউয়াল সরকারের এক গবেষণায় বলা হয়, দেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ১১০ থেকে ২২০ কোটি ডলার পাচার হচ্ছে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৮০০ থেকে ৮৫০ কোটি ডলার পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের তদন্তে আর্থিক খাতের বহুল আলোচিত জালিয়াত পিকে হালদারের ভারত ও কানাডায় বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে। বিসমিল্লাহ গ্রুপ দুবাইয়ে বিনিয়োগ করেছে। তারা অর্থ পাচার করে বিদেশে বিনিয়োগ করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *