বাম নেতারা বলছেন, আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে সরকার মূল্যবৃদ্ধির বোঝা চাপিয়েছে জনগণের উপর।
মহামারী আর রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাবে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবনে নাভিশ্বাসের মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদ জানিয়েছে বাম দলগুলো।
আইএমএফকে ‘খুশি’ করতেই সরকার এমন পদক্ষেপ নিয়েছে বলে বাম নেতাদের অভিযোগ। এদের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জোট শরিক দলের নেতা রাশেদ খান মেনন একে তুলনা করেছেন ‘বিষ গেলার সঙ্গে’।
শনিবার থেকে এক লাফে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৪২.৫% বেড়ে হয়েছে প্রতি লিটার ১১৪ টাকা। পেট্রোলের দাম ৫১.১৬% বেড়ে প্রতি লিটারের দাম হয়েছে ১৩০ টাকা। আর অকটেনের দাম বেড়েছে ৫১.৬৮%, প্রতি লিটার কিনতে গুনতে হবে ১৩৫ টাকা।
এর আগে গত ৩ নভেম্বর ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ২৩ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৮০ টাকা।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে গণ পরিবহনের ভাড়া বাড়ার পাশাপাশি নিত্যপণ্যের দাম আবার বাড়বে বলে উদ্বেগ রয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি এক বিবৃতিতে বলেছে, “আগের দিন জ্বালানি তেলের মূল্য সহনীয় মাত্রায় বাড়ানোর কথা বলে রাতের বেলায় পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন ও অকটেনের মূল্য প্রায় ৪৫ ভাগ বৃদ্ধি অযৌক্তিক এবং জনগণের প্রতি সংবেদনহীনতার চরম বহিঃপ্রকাশ।
“এমনিতেই মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবনে ত্রাহি অবস্থা; তার উপর এই মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে কঠিন সঙ্কট তৈরি করবে।”
ওয়ার্কার্স পার্টির অভিযোগ, ঋণ পেতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী জ্বালানি খাতের ভর্তুকি প্রত্যাহার করতে সরকার মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে তা জনগণের ওপর চাপিয়েছে।
শনিবার বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক বিক্ষোভ সমাবেশে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, “ঘাটতি সমন্বয়ের নামে আইএমএফর শর্ত মানার মধ্য দিয়ে সরকার বিষ গিললো। এই বিষ এখন অর্থনীতির দেহে ছাড়িয়ে রাজনীতি ও সমাজে বিস্তৃত হবে।”
মেনন বলেন, “আইএমএফ যেসব দেশে তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, সেসব দেশেই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়।”
১৪ দলের আরেক শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এক বিবৃতিতে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে।
তারা বলছেন, “জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, বিশেষ করে ডিজেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি গণপরিবহন, পণ্য পরিবহন, কৃষি সেচসহ সামগ্রিক অর্থনীতি ও উৎপাদন মারাত্মক নেতিবাচক ও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। এর ফলে জনজীবনে দুর্ভোগ ও দুর্দশা বহুগুণ বেড়ে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠবে।”
জ্বালানি তেলের দমি বাড়ানোর প্রতিবাদে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি পল্টনে এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ-মার্ক্সবাদী) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ করেছে।
আইএমএফের কাছে সরকার ৪৫০০ কোটি ডলার ঋণ পেতে ভর্তুকি তুলে নেওয়ার শর্ত পালনে এ পদক্ষেপ নিয়েছে বলে সমাবেশে বক্তারা অভিযোগ করেন। তারা বলেন, বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন কমেছে, তখন দেশে দাম বৃদ্ধি অযৌক্তিক।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ-খালেকুজ্জামান) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ এক বিবৃতিতে বলেন, “বিশ্ববাজারে যখন তেলের দাম নিম্নমুখী প্রবণতায় রয়েছে, তখন তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি কৃষি, শিল্প, পরিবহনসহ সমস্ত ক্ষেত্রে ব্যয় বাড়িয়ে দেবে; আর সাধারণ নাগরিকের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলবে। দুর্নীতি ও লুটপাটের বোঝা জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দুর্বৃত্ত তোষণের রাজনীতি চলছে।”
জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ বাড়ানোর প্রতিবাদ জানিয়ে বাম ঐক্য ফ্রন্ট বলছে, “জনগণের বিপদের সময় শাসকরা তাদের শোষণ, লুণ্ঠন ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। দুই দফা কোভিডের আঘাতে স্বল্প আয়ের মানুষ তাদের সামান্য সঞ্চয় শেষ করে নিঃস্ব হয়ে গেছে, তার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রুশ-ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাবে খাদ্যপণ্যের মূল্য বেড়ে গেছে। ঠিক সেই সময়ে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মত মধ্যরাতে অস্বাভাবিক হারে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার।”
তারা বলছে, বিকল্প থাকার পরেও সরকারের এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে, তারা জনগণের দুর্ভোগ বাড়াতেই বেশি আগ্রহ।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব দলীয় এক অনুষ্ঠানে বলেন, “ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে যেনতেন প্রকারে আইএমএফের শর্ত পূরণে জনগণকে বলি দিচ্ছে সরকার। দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ করেও ঘাটতি সমন্বয়ের শর্ত পূরণ করা যেত; সরকার সে পদক্ষেপ নেয়নি। সরকার সীমাহীন দুর্নীতি ও অবাধ লুন্ঠনের পথ খোলা রেখে দেশের জনগণের বেঁচে থাকার অধিকারকেই তছনছ ও পদদলিত করে দিয়েছে।”
এদিকে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের (টিইউসি) সভাপতি সহিদুল্লাহ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক ওয়াজেদুল ইসলাম খান এক বিবৃতিতে ‘অযৌক্তিক ও অস্বাভাবিকভাবে’ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ এবং বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহারের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
বিবৃতিতে তারা বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন থেকে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি বাজার দর, শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা, শিল্পের সক্ষমতা ও মাথাপিছু জাতীয় আয় বিবেচনায় ন্যূনতম মজুরি কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা নির্ধারণ ও প্রতিবছর বাজার দরের সাথে সংগতি রেখে মহার্ঘ ভাতা প্রদান করতে হবে। সরকার তা না করে উল্টো ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসাবে জালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করে দিয়েছে।”