অর্থনীতি

শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেছেন, মুক্তবাজার অর্থনীতির এ যুগে মানসম্পন্ন সেবা, অনুকূল পরিবেশ ও সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশের উপযোগী স্মার্ট ট্যুরিজম গড়ে তোলা হবে।

তিনি বলেন, ভারত, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ পর্যটন শিল্পে অনেক সমৃদ্ধ। নদী, সমুদ্র, পাহাড়, বন ও অপরূপ প্রকৃতির সমাহারে আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশেরও পর্যটন খাতে যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

সোমবার রাজধানীর হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে এসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) আয়োজিত ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

আটাবের নতুন কমিটিকে স্বাগত জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, পর্যটন একটি বিরাট শিল্প। জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান বৃদ্ধিতে আটাবকে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে।

তিনি বলেন, দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ স্মার্ট ট্যুরিজমের অন্যতম উপাদান। এ লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে যার উদাহরণ হলো ট্যুরিস্ট পুলিশ প্রতিষ্ঠা করা।  শিল্প মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আটাবকে সহযোগিতা করা হবে।

আটাব প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম আরিফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির  বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান, ট্যুরিস্ট পুলিশ প্রধান এডিশনাল আইজিপি (ভারপ্রাপ্ত) মো. আবু কালাম সিদ্দিক ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আটাবের সাধারণ সম্পাদক আফসিয়া জান্নাত সালেহ।

ইফতার মাহফিলে মোনাজাত পরিচালনা করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক গভর্নর মুফতি মাওলানা ড. কাফীলুদ্দীন সরকার সালেহী।

উল্লেখ্য,গত ১০ মার্চ আটাবের নতুন কমিটি গঠিত হয়।

আন্তর্জাতিক

ইসরাইলের অমানবীয় অত্যাচারে দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠেছে গাজা পরিস্থিতি। এতদিন চুপ থেকে গাজার ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছে বিশ্ব। অবশেষে অবরুদ্ধ অঞ্চলটির সমর্থনে এগিয়ে এলো ইউরোপের চার দেশ।

ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্মীকৃতি দিয়ে সম্মত হয়েছে মাল্টা, আয়ারল্যান্ড, স্পেন এবং স্লোভানিয়া। কিন্তু ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর এমন সমর্থনকে মেনে নিতে পারছে না ইসরাইল। এবার ইউরোপের এই চার দেশকে হুঁশিয়ারি দিলেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরাইল কার্টজ। তার মতে, যে দেশগুলো ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র হিসেবে স্মীকৃতি দেবে তারা সন্ত্রাসবাদের পক্ষে। সোমবার নিজের এক্স  অ্যাকাউন্টে ক্ষিপ্ত হয়ে এ বার্তা লিখেন তিনি। রয়টার্স।

ইইউ’র শীর্ষ সম্মেলনে গত শুক্রবার ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্মীকৃতি দেওয়ার কথা জানায় চার দেশ। তাদের মতে, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেই ‘শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জন’ সম্ভব হবে। সম্মেলনে যৌথ বিবৃতিতে চার দেশ জানায়, ‘আমরা একসঙ্গে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করেছি। পরিস্থিতি যখন ঠিক হবে তখন এ বিষয়ে আমরা ইতিবাচক অবদান রাখব।’ তাদের সেই বার্তার প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবেই কার্টজ লিখেছেন, ‘৭ অক্টোবরের গণহত্যার পর একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি হামাস এবং অন্যান্য ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর কাছে এই বার্তাই পাঠায় যে, ইসরাইলিদের উপর হত্যাকারী সন্ত্রাসী হামলা ফিলিস্তিনিদের প্রতি রাজনৈতিক মাধ্যমে প্রতিশোধ নেওয়া হবে।’ অন্যদিকে গাজায় তাৎক্ষণিত যুদ্ধবিরতি নিয়ে ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে।

রাশিয়া এবং চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত একটি পূর্ববর্তী পাঠ্য ভেটো করার পরে এ প্রস্তাবটি সামনে আসে। রাফাহ এবং গাজা উপত্যকার অন্যান্য অংশে ইসরাইলি বিমান হামলায় কয়েকডজন লোক নিহত হওয়ার পরে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে ভেটোর আলোচনা হয়। নতুন পাঠ্যটিতে বলা হয়, পবিত্র রমজান মাসের জন্য ‘অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি করে এবং একটি স্থায়ী টেকসই যুদ্ধবিরতির দিকে নিয়ে যায়।’

এর আগে রোববার উত্তর গাজায় ত্রাণের সাহায্য পৌঁছাতে বাধা দেয় ইসরাইল বাহিনী। এমন পরিস্থিতি গাজার শিশুদের আরও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে বলে সতর্ক করেছে সাহায্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন। সংস্থাটির কান্ট্রি ডিরেক্টর জেভিয়ের জুবার্ট বলেন, ‘শিশুরা ইতোমধ্যেই অনাহারে এবং রোগে মারা যাচ্ছে বিশ্বের সর্বোচ্চ গতিতে, যা রেকর্ড। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে দৃঢ় এবং অবিলম্বে কূটনীতির মাধ্যমে এমন প্রস্তাবকে পালটে দিতে হবে। সেটি হবে আইনি বাধ্যবাধকতার মাধ্যমে।’

এদিকে আল শিফা থেকে পালিয়ে আসা ফিলিস্তিনিদের দাবি, ইসরাইলি ট্যাংক এবং সাঁজোয়া বুলডোজার কমপক্ষে চারটি মৃতদেহ এবং অ্যাম্বুলেন্সের ওপর দিয়ে চালানো হয়েছে। ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, তীব্র গোলাগুলির কারণে তাদের মেডিকেল টিমের সদস্যরা সেখানে আটকা পড়েছেন। অন্যদিকে গাজা উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত আল-আমাল এবং নাসের হাসপাতাল ঘিরে রেখেছে ইসরাইলি বাহিনী। হাসপাতালগুলোর আশপাশে আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়েছে তারা।

গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিসে তীব্র গোলাগুলি এবং বোমা হামলার মধ্যেই আল-আমাল এবং নাসের হাসপাতালের তাদের এক কর্মী নিহত এবং একজন বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট। সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, আল-আমাল হাসপাতাল সম্পূর্ণ খালি করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে ইসরাইল। কিন্তু সেখানে হাসপাতাল কর্মী ও রোগীদের পাশাপাশি বাস্তুচ্যুত লোকজনও আশ্রয় নিয়েছে। এমনকি লোকজনকে সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য করতে ইসরাইল স্মোক বোমা ছুড়ছে।

এদিকে হামাস পরিচালিত মিডিয়া অফিস বলছে, আল শিফা হাসপাতালে গত সাত দিন ধরে চলা অভিযানে পাঁচ ফিলিস্তিনি চিকিৎসককে হত্যা করেছে ইসরাইলি বাহিনী। ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ৩২,৩৩৩ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৭৪,৬৯৪ জন আহত হয়েছে।

জাতীয়

নতুন শিক্ষাক্রম চালুর পর থেকে প্রতিটি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন কীভাবে হবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল। নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনাও ছিল। অবশেষে অভিভাবকদের দাবি মেনে নিয়ে পরীক্ষা পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে এ মাসের শুরুতে সমন্বয় কমিটি গঠন করেছিল সরকার। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী তারা মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে একটি খসড়া চূড়ান্ত করেছে।

এতে বলা হয়েছে, প্রতিটি মিডটার্ম ও চূড়ান্ত পরীক্ষা হবে ৫ ঘণ্টার। মাঝে এক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত পরীক্ষা বা মূল্যায়ন প্রক্রিয়া চলবে। এতে ছয়টি সেশন থাকবে। চার ঘণ্টা থাকবে ব্যবহারিক।

জানা গেছে, রোববার শিক্ষা বোর্ডগুলোর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়। সে অনুযায়ী, শ্রেণিভিত্তিক পরীক্ষা নেওয়া হবে বছরে দুটি। প্রতি বিষয়ে ৫ ঘণ্টার লিখিত ও ব্যবহারিক পরীক্ষা নেওয়া হবে। তবে আগের পদ্ধতিতে আর পরীক্ষা হবে না। পরীক্ষাকে এখানে ‘মূল্যায়ন’ বলা হবে।

এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, রোববার মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সভা হয়েছে। সেখানে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সভায় পরীক্ষা পদ্ধতি ফেরানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। আরেকটি সভা করে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।

জানা গেছে, নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতিতে মার্কিং (চিহ্নিত) করার নিয়ম থাকবে না। ‘রিপোর্ট ভালো’, ‘অর্জনের পথে’ এবং ‘প্রাথমিক পর্যায়’ এমন তিন ভাগে ফলাফল হবে। চতুর্থ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মিডটার্ম ও ফাইনাল পরীক্ষা হবে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হবে চূড়ান্ত পরীক্ষার মাধ্যমে।

খসড়া অনুযায়ী, মিডটার্ম ও বার্ষিক পরীক্ষায় সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে নতুন কারিকুলামের আলোকে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা হবে অন্য কেন্দ্রে। আর চতুর্থ থেকে নবম শ্রেণির পরীক্ষা হবে নিজ স্কুলে।

চলতি বছরের জুন থেকে এ প্রক্রিয়ায় মূল্যায়ন হবে স্কুলে। এর আগেই সব চূড়ান্ত হবে জানিয়ে এনসিটিবির সদস্য (কারিকুলাম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেছেন, অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদদের নিয়ে খসড়া করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বিষয়টি চূড়ান্ত করবেন।

চলতি মাসের শুরুতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চ‚ড়ান্ত করতে সমন্বয় কমিটি গঠন করে সরকার। সমন্বয় কমিটির আহবায়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন)। কমিটিতে সদস্য হিসাবে কাজ করছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান। এছাড়া আরও বিভিন্ন দপ্তরের ৯ কর্মকর্তাকে সদস্য হিসাবে যুক্ত করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০টি সাধারণ বিষয় পড়তে হবে। এসএসসি পরীক্ষা হবে দশম শ্রেণির পাঠ্যক্রমের ওপর। আর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে প্রতিবছর একটি করে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে। গত বছর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছে। চলতি বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে এবং আগামী বছর চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে চালু হবে এ নিয়ম। এর আলোকে ২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা হবে।

জাতীয়

১৯১১-তে সম্রাট পঞ্চম জর্জ ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতা গোখেলকে প্রশ্ন করেছিলেন, ইংরেজরা ভারতের অনেক উন্নতি করিয়ে দিলেও ভারতীয়রা স্বাধীনতা চায় কেন। গোখেলের ঝটপট উত্তর ছিল, ভারতীয়রা স্বাধীন হয়ে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অর্থাৎ গোখেলের বিবেচনায় স্বাধীনতা আত্মমর্যাদার সমার্থক ছিল। কবি শামসুর রাহমানের পঙক্তি আছে-‘স্বাধীনতা মানে ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।’ বুঝতে অসুবিধা হয় না, এখানে স্বাধীনতা মানে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলা হয়েছে।

খ্যাতকীর্তি মার্কিন ইতিহাসবিদ হানাহ আরেন্ডেটের একটি সাড়া জাগানো প্রবন্ধ আছে, যার শিরোনাম ‘Freedom’। প্রবন্ধটির একটি নজরকাড়া বাক্য হলো, স্বাধীনতা মানে দায়িত্ব (Freedom means responsibility)। স্বাধীন সত্তায় বিকশিত হওয়া দায়িত্বই তো বটে, বিশেষ করে স্বাধীন জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বের জন্য।

স্বাধীনতার তিনটি নির্দেশিত মানে ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতার মানে এবং তার স্থিতিপত্র তৈরি করা যায়। স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন মানে তা শুধু অনুষ্ঠানসর্বস্বতা নয়, বা নয় আবেগে উদ্বেলিত হওয়া; স্বাধীনতার উদ্যাপন মানে মনের গহিনে স্বাধীনতার একটি স্থিতিপত্রও তৈরি করা। উল্লেখ্য, বছর বছর এমন স্থিতিপত্র তৈরি করার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার মানে পরিস্ফুট হবে। অর্থাৎ আমরা বুঝতে পারব স্বাধীনতার মানে অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছি কিনা। অবশ্য আমরা কজন তা করি বা কেউ আদৌ তা করে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। কিন্তু মনে হয় তা করা উচিত। কারণ, তা না হলে স্বাধীনতাকে ঘিরে প্রত্যাশা-প্রাপ্তির সমীকরণ হয় না।

অবশ্য এমন স্বাধীনতার মানে প্রত্যাশী স্থিতিপত্র তৈরি করতে হলে আমাদের হতে হয় কিংবদন্তির রোমক দেবতা জেনাসের মতো। জানা আছে, জেনাসের দুটো মুখ আর চারটি চোখ ছিল। ফলে সে সামনে-পেছনে উভয় দিকেই দেখতে পেত। অবয়বে আমরা জেনাস হতে পারব না; কিন্তু মানসিকভাবে পারি। মনের চোখ সামনে-পেছনে ছড়িয়ে অতীত-বর্তমানের তুলনামূলক পর্যালোচনা করতে পারি; এমনকি ভবিষ্যৎও ভেবে নিতে পারি।

তাহলে এবার আসা যাক স্থিতিপত্রের প্রথম খাতের কথায়; যা হলো আত্মমর্যাদা। বহুশ্রুত কবির পঙ্ক্তি আছে ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় বল’। স্বাধীনতাহীনতায় বাঁচা মানে মর্যাদাহীন বাঁচা। ব্যক্তিগতভাবেই হোক আর সমষ্টিগতভাবেই হোক, স্বাধীন সত্তা তাই পরম কাঙ্ক্ষিত। উভয় পরিপ্রেক্ষিতে এমন প্রত্যাশার রূপায়ণ প্রক্রিয়াকে বলে আত্মঅধিকার (self-determination) প্রতিষ্ঠা। ’৭১-এর ৭ মার্চের ভাষণে যখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাঙালিকে ‘আর দাবায়ে রাখতে পারবা না’, তখন তাতে বাঙালির আত্মঅধিকার প্রতিষ্ঠার বার্তা নিহিত ছিল। আর আত্মঅধিকার প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটি ছিল মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ প্রমাণ করেছিল সাবাস বাংলা দেশ,

এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়,

জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার,

তবুও মাথা নোয়াবার নয়।

আমরা মাথা নোয়াইনি; শত্রুহননের সাফল্যে মাথা তুলে মেরুদণ্ড সোজা করে স্বাধীনতাকে নির্বিঘ্ন করে বিশ্বের বুকে স্থান করে নিয়েছি। উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিতে কবি সুকান্ত বাঙালির চিরদ্রোহী সত্তার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ যে আমাদের দ্রোহী সত্তার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ, তা বলার জন্য কোনো যুক্তি-প্রমাণের প্রয়োজন নেই। বলা বাহুল্য, বাঙালির দ্রোহী সত্তা ভাষিক জাতীয়তাবাদের পাটাতনে স্বাধীন বাংলাদেশ নামে এক রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব নির্মাণ করেছে। এ রাষ্ট্রই বাঙালির আত্মমর্যাদার সূচক। স্বাধীনতা আমাদের অর্জন। স্বাধীনতার সংরক্ষণ আমাদের কৃতিত্ব।

বিগত সাড়ে চার দশকে এ অর্জন ও কৃতিত্বে কি কোনো সংযোজন হয়েছে? একাধিক সূচকের ভিত্তিতে আমাদের নির্দ্বিধ উচ্চারণ হতে পারে যে, আমাদের সংযোজন অনেক। বাহাত্তরের ধ্বংসস্তূপ বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে থাকা দেশের নাম। আমাদের অনেক ব্যর্থতা আছে, আছে বিচ্যুতিও। তবুও বাংলাদেশ এখন নানা কারণে তৃতীয় দুনিয়ার এক মডেল দেশ।

কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় স্বাধীনতার অনেক মানে তুলে ধরা হয়েছে। তবে উদ্ধৃত পঙ্ক্তিতে যে মানে আছে, তা অর্থনৈতিক মুক্তির। স্মর্তব্য, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে মুক্তির প্রসঙ্গ এসেছে একাধিকবার; স্বাধীনতার প্রসঙ্গ মাত্র একবার। তবে স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে মুক্তির সোপান রচিত হয়। আর বঙ্গবন্ধু সার্বিক মুক্তির নির্দেশনা দিয়েছিলেন, যা অর্জিত হবে স্বাধীন বাংলাদেশে। সেই কারণে বলা চলে, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর; আর মুক্তির যুদ্ধ শুরু হয়েছে ’৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর থেকে, যা আজও চলমান। মুক্তির এ যুদ্ধ অনিঃশেষ, চলে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত। অবশ্য চূড়ান্ত মুক্তি অর্জন কোনো দেশে বা ব্যবস্থায় সম্ভব হয়নি; কিন্তু লক্ষ্যে অবিচল থাকাটাই আসল কথা। মুক্তির লক্ষ্যহীন স্বাধীনতা অন্য কথায় স্বাধীনতার প্রহসন বৈ আর কিছু নয়। সুতরাং, বাংলাদেশে সার্বিক মুক্তির যে যুদ্ধ চলমান, তা অব্যাহত থাকবে যতদিন না লক্ষ্য অর্জিত হয়। এ যুদ্ধে আজ পর্যন্ত আমাদের সাফল্য আছে, আছে ব্যর্থতাও। অবশ্য ব্যর্থতার অর্থ হলো, আমরা যা অর্জন করতে পারিনি; কিন্তু যা অর্জন করা উচিত ছিল বা যা অর্জন করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।

আর্থসামাজিক অঙ্গনে যে সাফল্যগুলো আমাদের শ্লাঘা ও বিশ্বের বিস্ময়ের কারণ, তার সূচনা হয়েছিল চরম প্রতিকূল পরিবেশে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর ধ্বংসস্তূপ বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে একজন ড. হেনরি কিসিঞ্জারের তির্যক ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, বাংলাদেশ হবে তলাহীন ঝুড়ি। ড. কিসিঞ্জার কাগুজে কূটনীতিক হিসাবে খ্যাতকীর্তি ছিলেন; কিন্তু বাস্তবে নয়। কারণ বাংলাদেশের অভ্যুদয় রুখে দেওয়ার বাস্তব কূটনীতিতে তিনি ব্যর্থ ছিলেন। আর যা হোক, তিনি ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা ছিলেন না। তার প্রমাণ আর্থসামাজিক খাতে শনৈ শনৈ এগিয়ে চলা আজকের বাংলাদেশ। অনস্বীকার্য, শুরুতে বাংলাদেশ তলাহীন ঝুড়ি হিসাবে প্রতীয়মান হয়েছিল; কিন্তু আজ বাংলাদেশ নামের ঝুড়িটির শক্ত তলা হয়েছে। উপরন্তু, ঝুড়িটি কানায় কানায় পূর্ণ না হলেও, তা করার আয়োজন-উদ্যোগের কমতি নেই; এবং যা পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতির মোড়ল বিশ্বব্যাংকেরও নজর কেড়েছে।

অবশ্য উল্লেখ্য, বাংলাদেশকে তলাহীন ঝুড়ি হিসাবে চিরদিন রেখে দেওয়ার লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অভাব ছিল না বা এখনো নেই। কিন্তু তবু বাংলাদেশ তার স্বীয়তানির্ভর (autonomy-based) অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রেখেছে। স্মর্তব্য, স্বাধীনতার পর ষড়যন্ত্রের কারণে বিগত শতকের ষাট-সত্তর দশকে আফ্রিকীয় সমাজতন্ত্র (African Socialism) ব্যর্থ হয়েছিল। আফ্রিকার নিজস্ব ধাঁচের এ সমাজতন্ত্র টিকে থাকলে আফ্রিকার দেশগুলো আজ অনেক এগিয়ে যেতে পারত; কিন্তু বিপরীতে বাংলাদেশকে দমিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। আজ বাংলাদেশ অন্তত আর্থসামাজিক মানদণ্ডে ঘুরে দাঁড়ানো এক বিস্ময়কর দেশ; এবং অনেক ক্ষেত্রে দেশটি ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে।

অবশ্য আর্থসামাজিক প্রবৃদ্ধি ও প্রগতির মানে এ নয়, আমরা মুক্তির চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করেছি। আমাদের প্রত্যাশা-প্রাপ্তির মধ্যে এখনো বিরাজমান দুস্তুর ব্যবধান। আপাতদৃষ্টিতে ধনীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান; আর সেই কারণে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধানও ক্রমবর্ধমান, যা সামাজিক অস্থিরতার কারণ। রয়েছে সামাজিক অপরাধ-সূচকের ঊর্ধ্বগতি। উপরন্তু আছে শহর আর গ্রামের বৈষম্য। আছে কর্মসংস্থানের ঘাটতি ও বেকার সমস্যা। ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তার একটি জায়গায় বলেছিলেন, ‘দেশের মানুষ যদি খেতে না পায়, বেকার যুবক যদি চাকরি না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে।’ দেশের মানুষ এখন খেতে পায়; কারণ বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতির দেশ নয়। গণদারিদ্র্যের হারও কমেছে। কিন্তু বেকারত্ব সমস্যার আশানুরূপ সমাধান এখনো হয়নি। উদ্যোগ আছে, সময়ের ব্যবধানে সাফল্য অনিবার্য।

এবার স্বাধীনতার মানে নিয়ে সবশেষ প্রসঙ্গে আশা যাক। স্বাধীনতার প্রতি আমরা কতটুকু দায়িত্বশীল ছিলাম বা আছি? এতদিনের যা অর্জন, তাতে নিঃসন্দেহে প্রতিফলিত আমাদের দায়িত্বশীলতা। অন্যদিকে যা কিছু অর্জন করতে পারিনি, তা আমাদের দায়িত্বহীনতার প্রতীক। অবশ্য দায়িত্বহীনতা প্রসঙ্গে পরিস্থিতির প্রতিকূলতা একটি বিবেচ্য অনুষঙ্গ। ধরা যাক গণতন্ত্রের কথা। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের আট হাজার আটশত তিরাশি দিনে আমরা গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলাম। আর এ কারণে গণতন্ত্রের প্রতি এক ধরনের কাঠামোগত অঙ্গীকার (structural commitment) নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছিল। বাহাত্তরের সংবিধান গণতান্ত্রিক অঙ্গীকারের প্রতীক। কিন্তু তারপর গণতন্ত্র যেন মরু পথে হারানো নদীর ধারার মতো হয়ে গেল; যা অকল্পনীয় ছিল বা যা ছিল পাকিস্তানি ঐতিহ্য, সেই সামরিক শাসন এবং প্রকারান্তরে সামরিক শাসন বাংলাদেশের ওপর চেপে বসল, থাকল একানব্বই পর্যন্ত। প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মুখে সামরিক স্বৈরাচার পিছু হটেছিল; গণতন্ত্র মুক্তির দরজাও উন্মুক্ত করল; কিন্তু এখন পেছন ফিরে দেখে যদি প্রশ্ন করি, গণতন্ত্র মুক্তি পেয়েছে কি? উত্তরটি মিশ্র হতে বাধ্য। কারণ আমরা গণতন্ত্রের পথে এগিয়েছি, কিন্তু গন্তব্য এখনো বহুদূর। জানা কথা, গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার; গণতন্ত্র স্বল্প সময়ে বা রাতারাতি হয় না। কোথাও তা হয়নি। সুতরাং, গণতন্ত্রের প্রতি দায়িত্ব পালনে আমাদের ভূমিকা আংশিক। ভূমিকার সম্পূর্ণতার লক্ষ্যে উদ্যোগ অব্যাহত আছে। সুতরাং, আছে আশাবাদও। তবে যতদিন চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত না হচ্ছে, ততদিন বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক না বলে গণতন্ত্রায়নের রাষ্ট্র বলা যৌক্তিক।

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল্স (বিইউপি)

রাজনীতি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে স্বাধীনতা দিবস এবং জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত সম্মিলিত সমরাস্ত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছেন। আজ সকালে ফিতা কেটে বেলুন উড়িয়ে তিনি প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন।

আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রদর্শনী ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত সবার জন্য খোলা থাকবে। এতে বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী তাদের সমরাস্ত্রসহ সরঞ্জাম প্রদর্শন করে। এ উপলক্ষ্যে বিমান বাহিনীর যুদ্ধ বিমানের ফ্লাই-পাস্ট এবং অনুষ্ঠানস্থলে হেলিকপ্টার থেকে সেনা বাহিনীর প্যারাট্রুপারদের সফল অবতরণ প্রত্যক্ষ করেন প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা তিন বাহিনীর বিভিন্ন স্টল ও প্যাভিলিয়ন ঘুরে দেখেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সমরাস্ত্র সম্পর্কে তাকে ব্রিফ করার সময় সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সৈন্যদের ব্যবহৃত বিভিন্ন হালকা ও ভারী অস্ত্র প্রত্যক্ষ করেন।

প্রধানমন্ত্রী ও অতিথিরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের পরিবেশিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন এবং পরে তাদের সাথে ফটোসেশনে যোগ দেন।

জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আবদুল হান্নান।

অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, সচিব, বিদেশি রাষ্ট্রদূত, ঊর্ধ্বতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

জাতীয়

বাঙালি মুক্তি চেয়েছিল। দ্বিজাতিতত্ত্বের অবৈজ্ঞানিক ধারণায় সৃষ্ট পাকিস্তান নামের নরকবাস থেকে বেরিয়ে মাতৃভূমির খোলা আকাশের নিচে নিঃশ্বাস নিতে চেয়েছিল। স্বাধীনতার আশার নেমেছিল রাজপথে। আর পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাঙালিকে দিয়েছিল ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাত। বাঙালির শরীরে রাইফেল ও বেয়োনেটের নৃশংসতায় কেঁপে উঠেছিল পুরো ঢাকা। বর্বরতার ডানায় ভর করে ১৯৭১ সালের সেই রাতে এসেছিল মৃত্যুর ঘনতমসা। পৃথিবীর ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিল আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশে। আজ সেই কালরাত ও গণহত্যা দিবস।

রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরীহ-নিরস্ত্র স্বাধীনতাকামী বাঙালি জনগণের ওপর। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্ণ সামরিক সম্ভার নিয়ে রাত ১০টার পর সারা দেশে পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা শুরু করে তারা। সামরিক ভাষায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচিত ছিল পাক-হানাদারদের এ হত্যা-অভিযান। শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ এড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাঙালি হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের পথেই এগিয়েছিল। অত্যাচার, উৎপীড়ন, পাশবিকতা, নৃশংসতা আর হিংস্রতার কালো থাবায় বিভীষিকা ছড়িয়ে দিয়েছিল পুরো ঢাকা শহরে।

বর্বর হত্যাযজ্ঞের দিনটি ‘গণহত্যা দিবস’ হিসাবে বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে। কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হামলার সেই নৃশংস ঘটনার স্মরণে ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদের চতুর্দশ অধিবেশনে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করা হয়। দিনটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ‘গণহত্যা দিবস’ উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। স্বাধীনতার জন্য প্রাণ উৎসর্গকারীদের প্রতি তারা গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।

১৯৭১ সালে এ বর্বরোচিত হামলায় বিশ্ববাসী হতবাক হয়ে দেখেছিল উš§ত্ত পাকবাহিনীর গণহত্যাকাণ্ড। মধ্যযুগীয় কায়দায় হানাদাররা রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ গোটা ঢাকা শহরে চালায় হত্যাযজ্ঞ, করে অগ্নিসংযোগ। এই রাতেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি দেশকে শত্র“মুক্ত করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে দেশের মানুষের প্রতি আহ্বান জানান।

২৫ মার্চের কালরাতের বেদনাদায়ক ঘটনা সমগ্র জাতিকে শিহরিত করে। নির্বিচারে পাখির মতো গুলি চালিয়ে নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠ স্তব্ধ করা যায়নি। ভয়াবহ সেই কালরাতের হত্যাযজ্ঞ বাঙালিকে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রেরণা জোগায়।

প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের এই দিন সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সরাসরি এয়ারপোর্ট চলে যান। নিরপরাধ বাঙালির ওপর কাপুরুষোচিত সশস্ত্র হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়ে তিনি রাত পৌনে ৮টায় গোপনে বিমানে ঢাকা ত্যাগ করেন। পাক হানাদার বাহিনীর জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে জল্লাদের মতো বাংলার নিরপরাধ জনগণের ওপর মেশিনগান, মর্টার আর ট্যাংক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং শহরে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে।

রাত ১টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনা অনুযায়ী ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের সেনারা পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ চালায়। কেন্দ্রীয় কোয়ার্টারে ১৮ জন বাঙালি গার্ড থাকলেও তারা পালটা আক্রমণের সুযোগ পাননি। পিলখানা আক্রমণের পাশাপাশি রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাঁখারিবাজারসহ ঢাকাজুড়েই শুরু হয় হামলা। বিভিন্ন এলাকায় হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করে বর্বর পাক হানাদার বাহিনী। মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকে ট্যাংক, সঙ্গে সেনা বোঝাই লরি। ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল), জগন্নাথ হলে মধ্যযুগীয় কায়দায় চলে পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতা। শহিদ হন কয়েকশ ছাত্রছাত্রী। ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ নয়জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।

হানাদাররা চলার পথে রাস্তার দুই পাশে গুলি ছুড়ে মেরে ফেলে অসংখ্য নিরীহ, গরিব মানুষকে। মেডিকেল কলেজ ও ছাত্রাবাসে গোলার পর গোলা ছুড়ে হত্যা করা হয় অজস্র মানুষকে। রাজারবাগে পুলিশের বাঙালি সদস্যরা তাদের সামান্য অস্ত্রশস্ত্র দিয়েই প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ট্যাংক আর ভারী মেশিনগানের মুখে এ প্রতিরোধ বেশিক্ষণ টেকেনি। গ্যাসোলিন ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় পুরো সদর দপ্তর।

২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। গোপন ওয়্যারলেস বার্তায় তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ছাত্র-জনতা-পুলিশ-ইপিআর শত্র“র বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছে। আমি ঘোষণা করছিÑআজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সর্বস্তরের নাগরিকদের আমি আহ্বান জানাচ্ছিÑআপনারা যে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন, যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সম্মিলিতভাবে শত্র“র মোকাবিলা করুন। এই হয়তো আপনাদের প্রতি আমার শেষ বাণী হতে পারে। আপনারা শেষ শত্র“টি দেশ থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান।’

এর আগে সকালে প্রেসিডেন্ট ভবনে ভুট্টো-ইয়াহিয়া এবং ইয়াহিয়া ও পিপলস পার্টির উপদেষ্টাদের মধ্যে আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের খবর সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে ছিল। রাত ৯টার পর বাসভবনে উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সর্বাÍক চেষ্টা চালিয়েছি। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছেন। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট অখণ্ড পাকিস্তানের সমাপ্তি টানতে চলেছেন।

পিলখানায় ইপিআর ব্যারাক ও অন্যান্য স্থান থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার লিখিত বাণী ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারা দেশে মেসেজ আকারে পাঠানো হয়। এ বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দপ্তরে পৌঁছায়। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশি জাহাজও এ বার্তা গ্রহণ করে। চট্টগ্রামে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী সাইক্লোস্টাইল করে রাতেই শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন। রাত ১টায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের অদূরে শুক্রাবাদে ব্যারিকেডের মুখোমুখি হয়। এখানে প্রতিরোধ ব্যুহ ভেঙে হানাদাররা রাত দেড়টায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে আসে। হানাদার বাহিনী এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রবেশ করে। বঙ্গবন্ধুকে রাত দেড়টায় তার বাসভবন থেকে বন্দি করে শেরেবাংলা নগরের সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুকে সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয়। সকাল পর্যন্ত আদমজী কলেজের একটি কক্ষে বঙ্গবন্ধুকে আটক রাখা হয়।

কর্মসূচি : যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে সোমবার রাত ১১টা থেকে ১১টা ৩১ মিনিট পর্যন্ত সারা দেশে প্রতীকী ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করা হবে। তবে কেপিআই এবং জরুরি স্থাপনা এ কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে। এদিন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গণহত্যা দিবসের ওপর আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

সারা দেশে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গীতিনাট্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে ২৫ মার্চ গণহত্যার স্মৃতিচারণা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশনে গণহত্যার ওপর দুর্লভ আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করা হবে। এছাড়া ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিহতদের আÍার মাগফিরাত কামনা করে এদিন বাদ জোহর বা সুবিধাজনক সময় দেশের সব মসজিদে বিশেষ মোনাজাত এবং অন্য সব উপাসনালয়ে প্রার্থনা করা হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে একই কর্মসূচি পালন করা হবে।

আওয়ামী লীগের কর্মসূচি : গণহত্যা দিবস উপলক্ষ্যে সোমবার বিকালে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যৌথ উদ্যোগে সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

জাতীয়

রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসের তালিকা প্রণয়ন এক রকম অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টদের অনেকে জানিয়েছেন, কমিটির সদস্যদের নানামুখী বক্তব্য সার্বিক কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো এক ধরনের ‘তামাশা’ চলছে বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেন। প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের বক্তব্য এবং বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে এমন চিত্রই বেরিয়ে এসেছে।

রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের তালিকা প্রণয়ন উপকমিটির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান জানিয়েছেন, আমরা একটি তালিকা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। যাচাই-বাছাই শেষে তা প্রকাশ করা হবে।

কমিটির আরেক সদস্য সাবেক সংসদ-সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদও বলেছেন, একটা তালিকা তৈরি করে তারা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন।

তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, তার কাছে কোনো তালিকা আসেনি। আলাপ-আলোচনা হলেও শাজাহান খানের কমিটি এখনও কোনো তালিকা দিতে পারেনি। অপরদিকে কমিটির আরেক সদস্য সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম বলেছেন, তিনি কমিটিতে থাকতেই চাননি। তার নাম জোর করে ঢোকানো হয়েছে।

রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসের তালিকা প্রণয়ন নিয়ে এই যখন অবস্থা তখন বিশ্লেষকদের অনেকে বিষয়টি নিয়ে কাছে তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, আমি বলব রাজাকারের তালিকা কেউ করতে চায় না। ৭২ সালের তালিকা তো আছেই। এছাড়া নতুন করতে গেলে সমস্যা হবে। অনেকে এগুলো আদালতে চ্যালেঞ্জ করে বসবেন। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে এবং ৩ বছর সে মামলা আমাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। সুতরাং বাস্তবে কেউ এ তালিকা করায় আন্তরিক নন বলে তিনি মনে করেন।

পাকিস্তান সরকারের তালিকা নিয়ে মন্ত্রীর দৃঢ় অবস্থান : রোববার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রণীত রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসের তালিকাই প্রকৃত তালিকা। কারণ রাজাকারদের তালিকা তো তৎকালীন সরকার প্রণয়ন করেছে এবং রাজাকারদের তারা বেতন-ভাতা দিত। নতুন করে তালিকা করতে গেলে সেই তালিকায় ভেজাল ঢুকতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে পাকিস্তান সরকারের তৈরি করা তালিকাকে প্রকৃত ও নির্ভুল তালিকা মনে করি।

তিনি বলেন, সেই তালিকাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জেলা প্রশাসক (ডিসি) অফিসে সংরক্ষিত। সেই তালিকার একটি কপি আমার সংগ্রহে আছে। দরকার হলে তা আপনাদের দেখাতে পারি। মন্ত্রী আরও বলেন, আমরা ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ১০ হাজার ৭৮৯ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেছি। যা পাকিস্তান সরকারের সময় প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু সেই তালিকার বিরুদ্ধে সাংবাদিকরাই সোচ্চার প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে শাজাহান খানকে প্রধান করে ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। সেই কমিটি এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত তালিকা আমাকে দেয়নি।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আরও বলেন, ১৯৭১ সালে অনেকে বাধ্য হয়ে রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে, সেই মন্ত্রিসভায় কি সবাই স্বেচ্ছায় শপথ নিয়েছে? বরং বন্দুকের নলের মুখে অনেকে শপথ নিতে বাধ্য হয়েছে। সুতরাং ১৯৭১ সালেও অনেকে রাজাকারের খাতায় নাম লেখাতে বাধ্য হয়েছে। সে ক্ষেত্রে যারা বাধ্য হয়ে রাজাকার হয়েছে তাদের সংজ্ঞা কি হবে? আর যারা প্রকৃত রাজাকার ছিল, তারা তো পাকিস্তানিদের তালিকায় ভাতাভোগী। বিষয়গুলো নিয়ে নানা ধরনের সমস্যা আছে। তাহলে কি রাজাকারের তালিকা হচ্ছে না-এমন প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, ‘হবে। হবে না কেন? বলতে পারেন কাজ চলছে।’

আংশিক তালিকা প্রকাশ থেকে পিছু হটল কমিটি : রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসের তালিকা প্রণয়ন উপকমিটির সভাপতি এবং সাবেক নৌপরিবহণমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, দেশের ৪৯৫ উপজেলার মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৫০টি উপজেলার রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসের তালিকা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। আরও যাচাই-বাছাই হচ্ছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে আংশিক তালিকা প্রকাশ না করে একসঙ্গে সব রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করতে। কারণ আংশিক তালিকা প্রকাশ করলে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমরা পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন কাজের মধ্যে আছি।

রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের তালিকা প্রণয়ন কমিটির সদস্য এবং সাবেক সংসদ-সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, যতটা সম্ভব কাজ করে আমরা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। সব উপজেলার তথ্য পাওয়া যায়নি। ৫৩ বছর হয়ে গেছে। অনেকে অনেক কিছু ভুলে গেছেন। অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। যাদের নাম এসেছে তাদের সময়কার সাক্ষ্য লাগবে। এখন সাক্ষ্য পাওয়া যাচ্ছে না। যাচাই- বাছাই করে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে রাজাকারের তালিকা তৈরি করতে হবে। কাজটি বেশ জটিল। তবে মনে রাখতে হবে, এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া।

রাজাকারদের সাহায্য করার বয়ান : কমিটির আরেক সদস্য সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এবি তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কমিটিতে থাকতেই চাইনি। শাজাহান খান আমার নাম দিয়েছেন। জেলায় জেলায় আনসারের উপপরিচালকের (ডিডি) কাছে রাজাকারের তালিকা আছে। জেলা থেকে যে তালিকাগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো তো ইতোমধ্যে জামুকায় জমা দেওয়া হয়েছে। অনেক রাজাকার মারা গেছে। মনে রাখতে হবে, এটা একটা জনযুদ্ধ ছিল। অন্য দশটি কাজের সঙ্গে রাজাকাররা ব্রিজ পাহারা দিত। আমি যখন কাওরানের ব্রিজ ভাঙতে যাই, তখন রাজাকাররা আমাদের অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে। রাজাকাররা আমাদের বলেছে, পাকিস্তান আর্মির গাড়ি দেখলে আমরা রেললাইনে লোহা দিয়ে ৫টি আঘাত করব। তখন আপনারা লুকিয়ে থাকবেন। আবার যখন পাকিস্তান আর্মির গাড়ি চলে যাবে, তখন আমরা রেললাইনে লোহা দিয়ে ৩টি আঘাত করব। তখন আপনারা বেরিয়ে আসবেন। এভাবে রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে। তিনি আরও বলেন, বর্ডারের স্মাগলাররা মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তান আর্মির গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা দিয়ে, তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে। দেশে কোনো কাজ নেই, অভাবে পড়ে অনেকে রাজাকারের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। অনেকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজাকারে যোগ দিতে হয়েছে। তাদের আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন।’

তিনি আরও বলেন, নির্ভুল তালিকা করতে হলে অনেক বছর সময় লাগবে। এলাকায় এলাকায় গিয়ে ইন্টারভিউ নিয়ে নিশ্চিত হয়ে তালিকা করতে হবে। কেউ একজন তালিকা করে এনে আমাকে দেবে আর আমি সেই তালিকায় স্বাক্ষর করব, তা আমি করব না। কাজটা বেশ কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। নিজে ইন্টারভিউ নিয়ে যতক্ষণ না আমি সন্তুষ্ট হব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি কেন দায়িত্ব নেব? কাজটা ইবাদতের ন্যায় করতে হবে। একজন রাজাকারের নাম বাদ যাক এটা যেমন চাচ্ছি না, তেমনি আরেকটা ভালো লোকের নাম রাজাকারের তালিকায় আসুক সেটাও চাই না। আমি সময় দিতে পারিনি এবং পারব না। তারপরও কমিটিতে আমার নাম রাখা হয়েছে। আর সময় না দিয়ে কারও তৈরি করা তালিকায় আমি স্বাক্ষরও করতে পারব না। তিনি আরও জানান, তালিকা প্রণয়নের বিষয়ে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন শাজাহান খান।

সব উপজেলার রাজাকারের নাম না পাওয়া এবং অনেক রাজাকার বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকায় বা আত্মীয়স্বজনরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের সম্পর্কে অনেকে তথ্য দিতেও অপারগতা প্রকাশ করছে। ফলে তালিকা তৈরির কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এমনটিই জানিয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ৯ মাস দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা ব্যক্তিদের রাজাকার বলা হয়। পাকিস্তানিদের সহযোগী আরও দুটি সংস্থার নাম ছিল আলবদর ও আলশামস। পাকিস্তানিদের নানা অপকর্ম যেমন-হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে তারা।

২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করেছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তবে ওই তালিকায় অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর ও ভাষাসৈনিক সদ্যপ্রয়াত গোলাম আরিফ টিপুসহ আরও অনেকের নাম আসে ওই তালিকায়। অথচ তারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ছিলেন বলে প্রমাণ রয়েছে। এ নিয়ে সারা দেশে সমালোচনা শুরু হলে বিতর্কের মুখে রাজাকারের তালিকা স্থগিত করেছিল মন্ত্রণালয়। ওয়েবসাইট থেকে তালিকাটি সরিয়ে ফেলা হয়। পরবর্তী সময়ে যাচাই-বাছাই করে তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইন-২০২২ সংশোধিত আকারে পাশ হওয়ার পর তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয় ২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। এতে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীর মধ্যে রাজাকারের তালিকা তৈরি ও প্রকাশের দায়িত্ব দেওয়া হয় জামুকাকে।

আইনে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্য হিসাবে কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন বা আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসাবে কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন বা আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসাবে সশস্ত্র যুদ্ধে নিয়োজিত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন বা খুন, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের অপরাধমূলক ঘৃণ্য কার্যকলাপ দ্বারা নিরীহ মানুষকে হত্যার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছেন অথবা একক বা যৌথ বা দলীয় সিদ্ধান্তক্রমে প্রত্যক্ষভাবে, সক্রিয়ভাবে বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন তাদের তালিকা প্রণয়ন ও গেজেট প্রকাশের জন্য জামুকা সরকারের কাছে সুপারিশ প্রেরণ করবে।

মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাজাকারের তালিকা চেয়ে জেলা প্রশাসকদের কাছে চিঠি পাঠানো হলে অনেকে জানিয়েছেন তাদের জেলার রেকর্ড রুমে রাজাকারদের নামের কোনো তালিকা নেই। কমিটির সদস্যরা জেলা ও উপজেলায় গিয়েও সঠিক তথ্য পাচ্ছেন না। অনেকে শত্রুতা করে কারও নাম দিতে পারে সে বিষয়টিও মাথায় রাখতে হচ্ছে তাদের। আবার অনেক রাজাকার বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকায় বা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের সম্পর্কে অনেকে তথ্য দিতেও অপারগতা প্রকাশ করছে। ফলে তালিকা তৈরির কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে।

আন্তর্জাতিক

ফিলিস্তিনের গাজায় দখলদার ইসরায়েলের গণহত্যা বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্ব গাজায় হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করছে, কিন্তু তা বন্ধে কেউ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

রোববার (২৪ মার্চ) গণভবনে সফররত ফিলিস্তিনের ফাতাহ আন্দোলনের (শাসক দল) মহাসচিব লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেবরেল আলরজউবের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে তিনি এ কথা বলেন।

পরে প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।

নজরুল ইসলাম বলেন, গাজায় ইসরায়েলি হামলার বিষয়ে নীরব অবস্থানের জন্য মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কঠোর সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এটি এক ধরনের ভণ্ডামি।

মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ থাকা উচিত এবং মুসলিম উম্মাহর নিরাপত্তা এবং ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা লাঘবের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত।

শেখ হাসিনা ১৯৬৭ সালে গৃহীত প্রস্তাব অনুসরণ করতে বলেন, যাতে বলা হয়েছিল যে পূর্ব জেরুজালেম ফিলিস্তিনের রাজধানী হবে।

প্রধানমন্ত্রী ফিলিস্তিনিদের প্রতি তার দ্ব্যর্থহীন সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে গাজায় নারী ও শিশুসহ হাজার হাজার মানুষ হত্যাসহ ইসরায়েলি বাহিনীর হাসপাতালে হামলার নিন্দা করেন।

তিনি গাজায় মৃত্যুর জন্য শোক প্রকাশ করেন এবং গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি জানান।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে মিশরের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য দুই দফা ত্রাণ সহায়তা পাঠিয়েছে।

তিনি বলেন, আমি যেখানেই সুযোগ পেয়েছি ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য আন্তর্জাতিক ফোরামে সবসময় আওয়াজ তুলেছি।

আওয়ামী লীগ শাসনামলে ১৯৯৭ সালে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাতের বাংলাদেশ সফরের কথাও স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।

ফিলিস্তিনের ফাতাহ আন্দোলনের মহাসচিব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার নিঃশর্ত সমর্থন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আওয়াজ তোলার জন্য ধন্যবাদ জানান।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেবরেল আলরজউব বলেন, অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করা দরকার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই উদ্দেশ্যে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া।

তিনি বলেন, সেখানে খাদ্যের তীব্র সংকট বিরাজ করছে এবং মানুষ অনাহারে রয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেবরেল আলরজউব বলেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতিই এই সংকট সমাধানের একমাত্র পথ।

আরব দেশগুলোতে ৪০০ মিলিয়ন মানুষ বসবাস করলেও তারা ঐক্যবদ্ধ নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা ঐক্যবদ্ধ হলে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন সহজেই বন্ধ হয়ে যাবে। আরব বিশ্বের শক্তি ও সম্পদ আছে, শুধু ঐক্যই ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ করতে পারে।

ফাতাহ আন্দোলনের মহাসচিব বলেন, এই যুদ্ধ বন্ধ না হলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও বৈশ্বিক শান্তি কখনোই প্রতিষ্ঠিত হবে না।

তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে দৃঢ় ভূমিকার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানান।

ফাতাহ আন্দোলনের মহাসচিব প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের একটি চিঠিও হস্তান্তর করেন।

প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এবং ঢাকায় ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসেফ এস ওয়াই রামাদান এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

আন্তর্জাতিক

চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে আজ ঢাকায় আসছেন ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক। সকাল ১০টায় একটি বিশেষ ফ্লাইটে তার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছার কথা রয়েছে। এই সফরে তার সঙ্গে রানি জেতসুন পেমাসহ একটি প্রতিনিধি দল থাকছে। সফরকালে রাজা ও রানি বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে তিনটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর এবং একটি নবায়ন হবে। আওয়ামী লীগ সরকার গত জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর এটি বাংলাদেশে কোনো দেশের শীর্ষ নেতার প্রথম সফর।

রোববার দুপুরে ভুটানের রাজার বাংলাদেশ সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি জানান, বিমানবন্দরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ভুটানের রাজাকে স্বাগত জানাবেন। ভুটানের রাজার সফরে নতুন করে তিনটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে। সেগুলো হলো- ভুটানের থিম্পুতে একটি বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট প্রতিষ্ঠা, বাংলাদেশের কুড়িগ্রামে ভুটানের জন্য বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং ভোক্তা সুরক্ষায় প্রযুক্তিগত সহযোগিতা। এছাড়া সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতাসংক্রান্ত একটি চুক্তি আছে- সেটির নবায়ন করা হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সফরের শুরুর দিন রাজা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন এবং জাতির পিতার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। বাংলাদেশ সফরকালে তিনি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। প্রথম দিন রাজার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ২৬ মার্চ ভোরে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করবেন রাজা।

মন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশ সফরে ভুটানের রাজা পদ্মা সেতু পরিদর্শন করবেন। তিনি শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি হাসপাতাল নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে অবস্থিত বাংলাদেশ বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শন করবেন। কুড়িগ্রামে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলটি পরিদর্শনের জন্য বিমানযোগে ঢাকা ত্যাগ করে তিনি সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ছাড়বেন। স্থলবন্দরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করবে। সেখানে তাকে বিদায় জানাবেন নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।

রাজার সফরের তাৎপর্য তুলে ধরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বাংলাদেশে প্রথম কোনো উচ্চ পর্যায়ের রাষ্ট্রীয় সফর এটি। এ সফরে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশে (বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে) ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। থিম্পুতে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট প্রতিষ্ঠা উদ্যোগের মাধ্যমে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের বৃহত্তর কল্যাণ সাধন হবে। ট্রানজিট এবং অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তির (পিটিএ) মাধ্যমে ভুটানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির সুযোগ হবে। বিদ্যুৎ খাতে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার চুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বিনিময়ের সুযোগ তৈরি হবে।

তিনি বলেন, আগামী বছর থেকে বাংলাদেশের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে এমবিবিএস কোর্সে ভুটানের শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ আসন সংখ্যা ২২ থেকে বাড়িয়ে ৩০ করা হবে। প্রতি বছর ভুটানের ফরেন সার্ভিস অফিসারদের জন্য বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য দুটি আসন বরাদ্দ করা হবে।

বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমি ভুটানে একটি কূটনৈতিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় কারিগরি সহযোগিতা দেবে। বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ কাউন্সিলে ভুটানের কৃষিবিষয়ক কর্মকর্তাদের বিভিন্ন মেয়াদে তিন বছরব্যাপী প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এই সফর বাংলাদেশ-ভুটানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত হবে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সুপ্রতিবেশীসুলভ পররাষ্ট্রনীতির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের অবস্থান সুদৃঢ হবে।

বাংলাদেশে মহান স্বাধীনতার প্রথম স্বীকৃতিদানকারী দেশ ভুটান। মহান স্বাধীনতা মাসে দেশটির রাজার এ সফর এবং স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া ভুটানের রাজার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা যায়। সফরে ঢাকায় রাজাকে ব্যাপক উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হবে। রাজার আগমন উপলক্ষ্যে ইতোমধ্যে ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কে ভুটানের রাজা এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি টানানো হয়েছে।

বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় চিকিৎসাধীন ভুটানি তরুণী : ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট হাসপাতালে কয়েক দফা সফল অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হয়ে উঠেছেন ভুটানি তরুণী কারমা দেমা (২৩)। ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক ও রানি জেতসুন পেমা আগামীকাল (মঙ্গলবার) তাকে হাসাপতালে দেখতে যাবেন। এরপর রাজা ও চিকিৎসকদের গ্রিন সিগনাল পেলেই দেশে ফিরতে পারবেন ক্যানসার জয়ী কারমা দেমা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন নিজেই এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল ভুটান। এবার বাংলাদেশ ভুটানের ক্যানসার আক্রান্ত একজন রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করল। দুই দেশের এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও জোরদার করতে এবার ভুটানে বার্ন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে দেবে বাংলাদেশ। এছাড়া দেশটির চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা ঢাকার জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণ নিতে আসতে পারবেন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক দশক আগে নাকের গহ্বরে ক্যানসার ধরা পড়ে ভুটানি তরুণী কারমা দেমার। নিজ দেশে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ না হওয়ায় ছুটে যান পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। সেখানকার টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে কয়েক দফা চিকিৎসা নেন। এক পর্যায়ে নাকে পচন ধরা শুরু হলে চিকিৎসকরা আশা ছেড়ে দিয়ে তাকে দেশে পাঠিয়ে দেন। পরে ওই বিদেশি নাগরিককে দেশে এনে গত ১৪ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘ভুটান স্বাধীন বাংলাদেশকে প্রথম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এজন্য বঙ্গবন্ধু ও এদেশের মানুষ ভুটানের প্রতি কৃতজ্ঞ প্রকাশ করেছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ভুটানকে উপহারস্বরূপ একটি বার্ন ইউনিট করে দিতে চাচ্ছেন। সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ভুটানের রাজা ও প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আমি ও দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী একটি সমোঝতা স্মারক স্বাক্ষর করব। ওই স্মারকের আলোকে প্রাথমিক পর্যায়ে ভুটানে ২০ শয্যার একটি বার্ন হাসপাতাল করে দেওয়া হবে। যার সব ব্যয় বহন করবে বাংলাদেশ।

আন্তর্জাতিক

মস্কোর ক্রোকাস সিটি কনসার্ট হলে হামলা চালানোর জন্য পাঁচ লাখ রুবল বা পাঁচ হাজার ৪০০ ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন গ্রেফতার এক ব্যক্তি।

রোববার এ তথ্য জানিয়েছে রাশিয়ার বার্তা সংস্থা তাস। হামলার পর দীর্ঘ চেষ্টার শেষে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত করা হয়েছে। তবে তল্লাশি অভিযান চলবে বলে জানিয়েছেন মস্কোর গভর্নর আন্দ্রে ভোরোবিভ। এদিকে হামলায় নিহতের ঘটনায় শোক ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশ্ব নেতারা। খবর বাসস, বিবিসি, আল জাজিরার।

নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক সন্দেহভাজন ওই ব্যক্তি বলেছেন, ‘টাকার জন্য আমি ক্রোকাসে মানুষের ওপর গুলি ছুড়েছি। আমাকে প্রায় ৫,০০,০০০ রুবল দেওয়ার প্রতিশ্র“তি দেওয়া হয়েছিল।’

তাসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য হামলায় আগেই ওই ব্যক্তিকে কার্ডে প্রতিশ্রুত অর্থের অর্ধেক অগ্রিম পরিশোধ করা হয়েছিল। এছাড়া কাজ শেষ হওয়ার পর বাকি টাকা দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছিল।

যদিও গ্রেফতারের আগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের হাত থেকে পালাতে গিয়ে ওই ব্যক্তি কার্ডটি হারিয়ে ফেলেছেন বলে জানানো হয়েছে তাসের প্রতিবেদনে।

এদিকে, হামলায় নিহতদের স্মরণে রোববার রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালন করছে রাশিয়া। প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘোষণা অনুযায়ী, সংসদের নিন্মকক্ষ দুমাসহ রোববার সারা দেশে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। ক্রোকাস সিটি হলের বাইরে ফুল, মোমবাতি আর বিভিন্ন ধরনের পোস্টার দিয়ে মোকার্ত রাশিয়ানরা নিহতদের শ্রদ্ধা জানান।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্রোকাস সিটি হলে কাপুরুষোচিত ও বিবেকহীন সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানান। তিনি বলেন, ‘এতগুলো নিরপরাধ লোকের প্রাণহানি ঘটায় আমি অত্যন্ত মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। আমি নিহতদের বিদেহী আত্মার মুক্তির জন্য প্রার্থনা করছি এবং তাদের পরিবারের প্রতি আমার আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।’ শেখ হাসিনা এ হামলায় যারা আহত হয়েছেন তাদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন। এছাড়া এ হামলায় নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, ন্যাটো, চীন, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের আরও অনেক দেশ।

বন্দুকধারীদের হামলার পর ঘটনাস্থল মস্কোর ক্রোকাস সিটিতে শুরু হওয়া উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি টানা হয়েছে বলে জানিয়েছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ‘তাস’। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে রোববার সকাল পর্যন্ত সর্বমোট ১৩৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মস্কো অঞ্চলের গভর্নর আন্দ্রে ভোরোবিভ। তবে ঘটনাস্থলে উদ্ধার অভিযান শেষ হলেও আশপাশের এলাকায় অভিযান অব্যাহত রাখা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।

এছাড়া হামলায় নিহত ১৩৩ ব্যক্তির মধ্যে ৫০ জনের পরিচয় নিশ্চিত হয়েছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া বাকিদের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে বলে জানানো হয়েছে। পাশাপাশি আহত ১০৭ জনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

হামলার ১৪ ঘণ্টা পর রাশিয়ার ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস (এফএসবি) ১১ জনকে আটক করার কথা ঘোষণা করে জানিয়েছে, এদের মধ্যে ‘চার জন সরাসরি হামলায় জড়িত ছিল’। তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। তবে রাশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন এরা বিদেশি নাগরিক। অসমর্থিত সূত্রগুলো এই ব্যক্তিদের তাজিকিস্তানের নাগরিক হিসাবে উল্লেখ করেছে। শুক্রবার এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে আইএস বলেছে তারাই এ হামলা চালিয়েছে। শনিবার তারা মুখে মাস্ক পরিহিত চার হামলাকারীর ছবি প্রকাশ করেছে। তবে রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ এ দাবির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।