অর্থনীতি

২০১৯ সালে সুনামগঞ্জ-১ আসনের সরকারদলীয় সংসদ-সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।

সংস্থাটির নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে রতন তার সম্পদ বিবরণী দুদকে জমা দেন। এরপরও রহস্যজনক কারণে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান-পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ আটকে আছে।

অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে তদন্তে নামে দুদক। ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তাকে তলবি নোটিশ দেয় সংস্থাটি। দুদকে হাজির হলে তাকে টানা ৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদ শেষে দুদকের তৎকালীন জনসংযোগ কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এই প্রকৌশলীর বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের তথ্য আছে দুদকের কাছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কক্সবাজার বিমানবন্দর নির্মাণসহ ৫টি প্রকল্পের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ফলে ওইসব প্রকল্প ও তার ব্যক্তিগত সব নথি তলব করা হয়েছে। এ অবস্থায় ৩৩ মাস পার হয়েছে। অনুসন্ধান এখনো চলছেই।

সংসদ-সদস্য রতন ও প্রকৌশলী হাবিবের মতো শতাধিক রাঘববোয়ালের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জন অভিযোগের অনুসন্ধান ঝুলে আছে বছরের পর বছর। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কারও বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়নি মামলা। অভিযোগ আছে, ছোট ছোট দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান ও মামলার তদন্ত কাজ নিজস্ব গতিতে চললেও

‘রাঘববোয়াল’দের বেলায় তদবিরে স্থবির দুদক। এ অবস্থায় আজ ৯ ডিসেম্বর অনাড়ম্বরভাবে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালন করেছে দুদক। এবার দিবসের প্রতিপাদ্য-‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বিশ্ব’। ২০১৭ সাল থেকে দুদক দিবসটি পালন করে আসছে। এ উপলক্ষ্যে দুর্নীতিবিরোধী প্রচার-প্রচারণা, আলোচনা সভা, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি নিয়েছে দুদক।

ঢাকঢোল পিটিয়ে দিবস পালন করলেও নির্ধারিত সময়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষ করতে পারছে না সংস্থার কর্মকর্তারা। এই ব্যর্থতায় দায়িত্বপ্রাপ্তদের সরিয়ে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটাও করা হয়নি। উলটো সাহসের সঙ্গে অনুসন্ধানে সত্য উদঘাটন করে ফেঁসে গেছেন কোনো কোনো কর্মকর্তা।

খোদ হাইকোর্ট দুদকের কাজের ধীরগতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। হাইকোর্ট বলেছেন, দুদক আইন অনুযায়ী কমিশনের উচিত নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্ত শেষ করে অভিযুক্তকে বিচারের আওতায় আনা। সর্বশেষ বেসিক ব্যাংকের ৫৬ মামলার তদন্ত শেষ করতে ৩ মাস সময় বেঁধে দিয়েছে হাইকোর্ট।

জানতে চাইলে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান মোবাইল ফোনে বলেন, ‘বড় মাছ ধরতে বড় জাল বা হাতিয়ার লাগে। আমাদের দেশে যারা বড় বড় জালিয়াতিতে জড়িত তাদের অনেক লম্বা ও অদৃশ্য হাত থাকে। তাদের ধরতে হলে আমাদেরও আটঘাট বেঁধেই নামতে হয়। তবে আমি এটুকু বলতে পারি, আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন কাজ করে যাচ্ছে। এখানে কোনো ধরনের গাফিলতি নেই। কোভিডের কারণে দুই বছর কাজ অনেক বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এখন সেই অবস্থার উত্তরণ ঘটেছে। তবে সব মিলিয়ে আমরা প্রত্যাশার কাছাকাছি যেতে পারিনি। আমরা এ সংক্রান্ত আলোচনা, সমালোচনা ও মন্তব্য বিবেচনায় রাখছি এবং কাজের গতি বাড়াতে সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন. ‘আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই কেউ কেউ হয়তো ক্লিনচিট পেয়েছেন। প্রাথমিক তদন্তে অনেকেরই নাম আসে। তদন্তে যদি সঠিক সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া না যায় তাহলে তাদের আটকানো যাবে না-সেটাই স্বাভাবিক।’

অনুসন্ধান ও তদন্তে দুদক আইনের বিধান মানতে পারছে না কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে কাজ সম্পন্ন করতে গিয়েই অনুসন্ধান ও তদন্ত বিলম্বিত হয়।’

প্রসঙ্গত, কমিশন আইনের ২০(ক) ১ ও ২ উপধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১৮০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত শেষ করতে ব্যর্থ হলে ৯০ দিনের মধ্যে নতুন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করতে পারবে দুদক। আর ২০০৭ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালার ৭ বিধিতে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাকে নির্দেশ পাওয়ার পর সর্বোচ্চ ৪৫ দিনের মধ্যে অনুসন্ধান শেষ করতে বলা হয়েছে।

এ সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান শেষ করতে না পারলে যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আরও ৩০ দিন সময় নিতে পারবেন। ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ১৯ ও ২০ ধারায় অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষেত্রে দুদককে বিশেষ ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। তবে কমিশন ব্যর্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যথাযথ কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে নজির সৃষ্টি না করায় তদন্ত ও অনুসন্ধানে কেউই বেঁধে দেওয়া সময়ের বিধান মানছেন না।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও ব্যক্তি পর্যায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৯-র সেপ্টেম্বরে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শেষে পর্যায়ক্রমে ২১ সংসদ সদস্যসহ ১১৮ জনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধানে নামে দুদক।

এদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিতর্কিত ঠিকাদার জিকে শামীম, যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, প্রশান্ত কুমার হালদার, বজ গোপাল সরকার, ওমানে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী নাদিম, প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, হাফিজুর রহমান মুন্সী, আবদুল হাই, মোহামেডান ক্লাবের পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, জাতীয় সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরী, সংসদ-সদস্য নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন, সংসদ-সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ, সাবেক যুবলীগ নেতা ওমর ফারুক চৌধুরী, আনিসুর রহমান, কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি, কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ, সাবেক কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মোল্লা আবু কাওসার, প্রকৌশলী শাহাদাত হোসেন, উৎপল কুমার দে, ফজলুল হক মধু, শওকত উল্লাহ, ফজলুল হক, রোকন উদ্দিন, আব্দুল কাদের, আফসার উদ্দিন, আব্দুল মোমেন চৌধুরী, ইলিয়াস আহমেদ, স্বপন চাকমা, সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিল মঈনুল হক মঞ্জু, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল আলম সিদ্দিকী, রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন প্রমুখ।

জানা গেছে, জিকে শামীম, প্রশান্ত কুমার হালদার, ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াসহ হাতেগোনা কয়েকজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শেষে মামলা দায়ের করা হলেও বাকিরা এখনো অধরা। তাদের অনেকেই তদবিরের মাধ্যমে অনুসন্ধান নথি ধামাচাপা দিয়ে রেখেছেন। আবার কেউ কেউ ‘ক্লিনচিট’ নিয়েছেন।

২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সরকার দলীয় সংসদ-সদস্য ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মো. নজরুল ইসলাম বাবুর অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার ও পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাবও তলব করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআরের মাধ্যমে দুদক তার ব্যাংক হিসাব ও সম্পদের ফিরিস্তি সংগ্রহও করে। নির্বাচনি হলফনামায়ও তার সম্পদের অস্বাভাবিক উল্লম্ফন প্রকাশ পেয়েছে।

এরপরও ২০১৮ সালের ৫ মার্চ দুদকের প্রধান কার্যালয়ের এক চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘নজরুল ইসলাম বাবুর বিরুদ্ধে প্রাপ্ত অভিযোগ অনুসন্ধানে প্রমাণিত না হওয়ায় কমিশন কর্তৃক তা পরিসমাপ্ত করা হয়েছে।’ একই প্রক্রিয়ায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের যেসব প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল তাদের প্রায় সবাইকে ‘ক্লিনচিট’ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

আরও জানা গেছে, রাজশাহী-১ আসনের আওয়ামী লীগের এমপি ও সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পেয়েছে দুদক। তার বিরুদ্ধে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, খাসজমি ইজারায় দুর্নীতিসহ অন্তত ২০ ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির একটি অভিযোগ দুদকে জমা পড়ে। সেটি যাচাই-বাছাই করে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। কিন্তু তিন বছর হতে চললেও অনুসন্ধান প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।

ঠিকাদারি কাজে নির্দিষ্ট অঙ্কের কমিশন বাণিজ্য, চাঁদাবাজিসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে চট্টগ্রাম-৩ আসনের এমপি ও স্থানীয় জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মাহফুজুর রহমান মিতার বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান করছে দুদক। সংস্থাটি তার সম্পদ খতিয়ে দেখতে দরকারি নথিপত্র তলব করে। কিন্তু দীর্ঘদিন পার হলেও তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান-পরবর্তী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এছাড়া শরীয়তপুর-১ আসনের সাবেক এমপি বিএম মোজাম্মেল হক, পিরোজপুরের সাবেক এমপি এমএ আউয়াল, নরসিংদী-২ আসনের সাবেক স্বতন্ত্র এমপি কামরুল আশরাফ খান পোটন, ময়মনসিংহের নান্দাইলের এমপি আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহিন, চাঁদপুর-৪ আসনের সাবেক এমপি শামসুল হক ভূঁইয়ার বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান চলছে বছরের পর বছর ধরে। এ তালিকায় পুরান ঢাকার আলোচিত এমপি হাজী মো.সেলিমের নামও আছে। এদের মধ্যে অনুসন্ধান শেষে সাবেক এমপি এমএ আউয়ালের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।

জানতে চাইলে এমএ আউয়াল বলেন, ‘সরকার দলের একজন মন্ত্রীর ইন্ধনে দুদক আমার ও আমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এটা ওপেন সিক্রেট। যেসব অভিযোগে আমার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তাতে আমার কোনো দায় নেই।’

সাবেক এমপি ও বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কামরুল আশরাফ খান টেন বলেন, ‘নির্বাচন ঘনিয়ে আসার কারণে একটি মহল তার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। দুদক অনুসন্ধান চালিয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা না পেয়ে ক্লিয়ারেন্স দিয়ে দিয়েছে।’

সংসদ-সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আছে সেগুলো সত্য নয়। দুদকও কিছু পায়নি। অভিযোগ নিষ্পত্তিও হয়নি।’

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম-৩ আসনের সংসদ-সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতা বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ছিল সেটা নিষ্পত্তি করে দুদক আমাকে চিঠি দিয়েছে। এখন আর আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান নেই।

সংসদ-সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বলেন, ‘দুদক আমার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে। কোনো অঙ্গতি পেলে আমার কাছে কিছু জানতে চাইলে আমি জবাব দেব।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে কিছু না চাইলে আমি আগ বাড়িয়ে জানাতে যাব কেন।’

সংসদ-সদস্য নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন ও আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহিনের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। শাওনের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তুহিন কল রিসিভ করেননি।

বিএনপি নেতা ও সাবেক এমপিদের মধ্যে রয়েছেন লালমনিরহাট-৩ আসনের আসাদুল হাবিব দুলু, নোয়াখালী-৪ আসনের মো. শাহজাহান, বগুড়া-৩ আসনের আব্দুল মোমিন তালুকদার ও ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাবেক এমপি মো. শহিদুজ্জামান বেল্টু। এছাড়া মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের এমপি ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী, জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব এবং পটুয়াখালী-১ আসনের সাবেক এমপি এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুদক।

তবে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাবেক এমপি শহিদুল ইসলাম ও তার স্ত্রী সাবেক নারী সংসদ-সদস্য সেলিনা ইসলামসহ পরিবারের আরও দুই সদস্যের বিরুদ্ধে দ্রুত অনুসন্ধান শেষে মামলা করেছে দুদক। তাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

পাপুল কুয়েতে গ্রেফতার ও সাজা হওয়ার পরই দুদকের অনুসন্ধানে গতি পায় বলে জানা গেছে। তবে পাপুলের অর্থ পাচারের সহযোগী হিসাবে সন্দেহের তালিকায় থাকা এনআরবিসি ব্যাংকের এমডি তমাল পারভেজ ও পরিচালক আদনান ইমামের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কাজ রহস্যজনক কারণে থেমে আছে। বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচারের অভিযোগে তাদের দুদকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদের পর অনুসন্ধানে আর গতি নেই।

জানা গেছে, শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরই নয়, অনেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও আমলাদের দুর্নীতির তদন্তও এগোচ্ছে না। ২০২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদকে তলব করা হয়। এর আগে তার অনিয়ম, দুর্নীতি ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অনুসন্ধানে নামে দুদক। এখন পর্যন্ত সন্ধান অব্যাহত।

এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন. তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ায় দুদকের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। পাশাপাশি অভিযোগের তালিকায় প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা আছেন বলে দুদক প্রভাবিত হচ্ছে-এমন প্রশ্নও উঠতে পারে। তাই আইনি কাঠামোর মধ্যে নির্ধারিত সময়ে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করা দরকার। বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাও কঠিন হয়।

অর্থনীতি

রপ্তানি ও উৎপাদনমুখী শিল্প খাতের টেকসই প্রবৃদ্ধি তরান্বিত করতে পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গ্রাহক পর্যায়ে এ ঋণের সুদ হার পাঁচ শতাংশ।

বুধবার (৭ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংক এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করেছে। এই তহবিল থেকে যোগ্য গ্রাহকরা মূলধনী যন্ত্রাদি ও যন্ত্রাংশের আমদানি মূল্য পরিশোধ পরবর্তী অর্থায়নের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব উৎস থেকে পুণঃঅর্থায়নের মাধ্যমে স্থানীয় মুদ্রায় এ ঋণ দেওয়া হবে। ঋণের মেয়াদকাল হবে পাঁচ থেকে ১০ বছর।

সার্কুলারে বলা হয়েছে, আর্দ্রকরণে পানি ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি, পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সম্পদ ব্যবহারের দক্ষতা ও পুনর্ব্যবহার, নবায়নযোগ্য শক্তি, শক্তি দক্ষতা, তাপ ও তাপমাত্রার ব্যবস্থাপনা, বায়ু চলাচল ও প্রবাহ দক্ষতা, কর্ম পরিবেশ উন্নয়ন উদ্যোগ এবং সময়মতো বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্দেশিত অন্যান্য ক্ষেত্রে রপ্তানি এবং উৎপাদনশীল শিল্প খাতে সবুজ পরিবশেবান্ধব মূলধনী যন্ত্রাদি ও যন্ত্রাংশ আমদানি বা কেনা সহজ করতে এই ঋণ দেওয়া হবে।

ঋণ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্ট বিভাগের সঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংককে চুক্তি করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক চুক্তিবদ্ধ বাণিজ্যিক ব্যাংককে ১ শতাংশ সুদ হারে পুনঃঅর্থায়ন করবে। বাণিজ্যিক ব্যাংক গ্রাহক পর্যায়ে দেবে ৫ শতাংশ হারে। একক গ্রাহক পর্যায়ে সর্বোচ্চ ২০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া যাবে। ঋণের গ্রেস পিরিয়ড থাকবে এক বছর।

সব রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক এই ঋণ বিতরণ করতে পারবে। তবে ১০ শতাংশের নিচে খেলাপি ঋণ আছে, এমন দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকও এই পুনঃঅর্থায়ন নিতে চুক্তি করতে পারবে। খেলাপি ঋণ গ্রহীতারা এই ঋণ সুবিধা পাবে না। এ তহবিল থেকে ঋণ নিতে গ্রাহককে দিতে হবে মোট মূলধনের ৩০ শতাংশ। ৭০ শতাংশ দেবে ব্যাংক। পরপর দুটি রপ্তানি বিল পুরোপুরি বা আংশিকভাবে ব্যর্থ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানও এই ঋণের সুবিধা পাবে না।

অর্থনীতি

অর্থ সংকটের কারণে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় উন্নয়ন সহযোগীদের দেওয়া স্বাস্থ্য সরঞ্জাম ও অনুদানসামগ্রী বন্দর থেকে খালাস অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিন বন্দরে পড়ে থাকায় পণ্যের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে। এতে বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

খোদ স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এমন আশঙ্কার কথা তুলে ধরে কাস্টম শুল্ক পরিশোধের জন্য ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়কে।

অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি অবহিত করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যানকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য।

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, স্বাস্থ্য বিভাগের চিঠি পাওয়া গেছে। প্রয়োজনীয় অর্থের অঙ্কটি যাচাই-বাছাই করা হবে।

প্রকৃত অর্থে যে টাকা দরকার, তা বরাদ্দ দেওয়া হবে। তবে চিঠি দেখে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি অর্থ চাওয়া হয়েছে।

এর আগে কাস্টম শুল্ক পরিশোধের জন্য ২৩ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু হিসাব করে দেখা গেছে প্রয়োজন ২৫ লাখ টাকা। এ কারণেই এবারও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, এ মুহূর্তে ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাপান সরকারের দেওয়া ৭৭ কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে আছে।

কাস্টম শুল্কের টাকা সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক কোডে বরাদ্দ না থাকায় ৫ মাস ধরে খালাস করা সম্ভব হচ্ছে না।

দেশের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সুবিধা বাড়াতে এক্সরে যন্ত্র, রোগীর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের মনিটর, সিটি স্ক্যানার, ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাফি বা ইসিজি যন্ত্র, ব্লাড গ্যাস অ্যানালাইজার ও অক্সিজেন জেনারেটর বাংলদেশকে দিয়েছে জাপান।

পণ্যসামগ্রীর তালিকায় আরও রয়েছে অ্যাম্বুলেন্স ও ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিক। সব মিলিয়ে চিকিৎসা সরঞ্জামের সংখ্যা ৩১৩।

এসব পণ্য বন্দর থেকে খালাস করতে কাস্টম শুল্ক বাবদ প্রয়োজন ২২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এই অর্থ চেয়ে আরও একটি চিঠি দেওয়া হয় অর্থ বিভাগকে।

এদিকে ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে অর্থ বিভাগকে লেখা চিঠিতে স্বাস্থ্য বিভাগ বলেছে, শুল্কায়নের মাধ্যমে বন্দর থেকে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের অনুদানের স্বাস্থ্য সরঞ্জাম খালাস করা হয়।

কিন্তু সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক কোডে কোনো টাকা বরাদ্দ নেই। যে কারণে মালামাল খালাস করতে বিলম্ব হয়। সেখানে আরও বলা হয়, বন্দরে খালাসের জন্য মালামাল পড়ে থাকলে এর গুণগত মান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

এতে সরকারের বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি হতে পারে। চিঠিতে আরও বলা হয়, এদিকে শিগগিরই দেশে এসে পৌঁছবে বিদায়ি ২০২১-২২ অর্থবছরে ক্রয়কৃত পণ্য।

কিন্তু সংশ্লিষ্ট আর্থিক কোডে আগ থেকে বরাদ্দ না থাকলে পণ্য ছাড় বিলম্ব হবে। এতে পোর্টের জরিমানাও বাড়বে। বিগত বছরে এ ধরনের জটিলতার কারণে পোর্টের জরিমানা গুনতে হয়েছে।

ওই অর্থবছরে দাতা সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর অনুদানের স্বাস্থ্য সরঞ্জাম গ্রহণ করতে কাস্টম শুল্ক বাবদ ব্যয় হয় ১৭০ কোটি টাকা।

তবে অর্থ পরিশোধ বিলম্বের কারণে পোর্ট ডেমারেজ ৫ কোটি টাকা গুনতে হয়েছে। ফলে আগে অভিজ্ঞতার আলোকে চলতি অর্থবছরের চাহিদা পূরণের জন্য ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দের আবেদন করা হলো।

এ খাতে দ্রুত বরাদ্দ নিশ্চিত হলে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ক্রয়কৃত ও উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে পাওয়া স্বাস্থ্যসামগ্রী দ্রুত খালাস করা যাবে। এতে রোগীদের কল্যাণে এসব পণ্য ব্যবহার সম্ভব হবে।

এদিকে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারকে চিঠি দিয়েছে সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরস ডিপো (সিএমএসডি)।

এতে কাস্টম শুল্ক খাতে দ্রুত অর্থ বরাদ্দের বিষয় উল্লেখ করা হয়। চিঠিতে আরও বলা হয়, জাপানের দেওয়া চিকিৎসা সরঞ্জাম বন্দরে ফেলে রাখায় দেশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে।

ভবিষ্যতে জাপানের কাছে স্বাস্থ্য খাতে সহায়তা চাইলে তারা নাও দিতে পারে। প্রসঙ্গত, প্রচলিত রাজস্ব আইন অনুযায়ী সরকারের নির্ধারিত কিছু খাত ছাড়া সব পণ্যেই শুল্ককর পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক।

অনুদানের সরঞ্জামে শুল্ক ছাড় দিতে হলে আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করতে হয়। ওদিকে বন্দরের মাসুল মওকুফ করার ক্ষমতা রয়েছে শুধু নৌ প্রতিমন্ত্রীর।

অর্থনীতি

নভেম্বরে ১৫৯ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা; যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৭ হাজার ৬৩ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১০৭ টাকা হিসাবে)। এর আগের মাসে এসেছিল ১৫২ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। অর্থাৎ আগের মাসের তুলনায় নভেম্বরে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য।

রেমিট্যান্সের ওপর আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। অন্যদিকে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়াতে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) যৌথভাবে ব্যাংকগুলোকে রেমিট্যান্স কেনার জন্য দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। বর্তমানে ১০৭ টাকায় রেমিট্যান্স ও ১০০ টাকায় রপ্তানি বিলের মাধ্যমে আসা ডলার সংগ্রহ করছে ব্যাংক। এতেও গত মাসগুলোতে কোনো কাজ হচ্ছিল না। তবে সর্বশেষ নভেম্বর মাসে আগের তুলনায় রেমিট্যান্সের অংক সামান্য বেড়েছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের নভেম্বরে সরকারি মালিকানাধীন পাঁচ বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার। বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ১২৮ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৫২ লাখ ডলার এবং বিশেষায়িত একটি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৩ কোটি ২১ লাখ ডলার।

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) টানা ২ বিলিয়ন ডলার করে রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কমে যাওয়ায় আগের দুই মাসের তুলনায় রেমিট্যান্স কমে যায় সেপ্টেম্বরে। অক্টোবর মাসে আরও কমে ৫২ কোটি ৫৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আসে।

অর্থপাচার ও কালো টাকা না কমলে বৈধ পথে রেমিট্যান্সও বাড়বে না। বিভিন্ন মহলের এমন বার্তার পর হুন্ডি প্রতিরোধের নতুন কৌশলে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধে গঠন করা হয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সম্প্রতি হুন্ডির মাধ্যমে প্রেরিত রেমিট্যান্সের ২৩০ জন বেনিফিশিয়ারির হিসাবে সাময়িকভাবে উত্তোলন স্থগিত করে বিএফআইইউ।

বলা হয়, ভবিষ্যতে বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠাবে এমন প্রতিশ্রুতি দিলে হিসাবগুলো খুলে দেওয়া হবে। হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রতিরোধে নতুন কৌশল নিয়েছে বিএফআইইউ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবরে ১৫২ কোটি ডলার পাঠান প্রবাসীরা। এই অংক গত ৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।

এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ১৪৯ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ (২১ দশমিক ৩ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে; যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ কম।

অর্থনীতি

ডলারের উত্তাপে নিত্যপণ্যের বাজারও গরম হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গত কয়েক মাস ধরে পণ্যের দাম কমলেও স্থানীয় বাজারে কমছে না। বরং ডলারের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে। এ অজুহাতে সর্বশেষ চিনি ও সয়াবিন তেলের দাম ফের বাড়ানো হয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার পর থেকে যেসব পণ্যের এলসি খোলা হয়েছিল সেগুলো দেশে আসতে শুরু করেছে। যেখানে এগুলোর দাম কমার কথা, সেখানে ডলারের দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে বাড়ানো হচ্ছে। এতে একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা।

অন্যদিকে দাম বাড়ায় ক্রেতার কষ্ট বেড়েছে। নানা অজুহাতে প্রায় সব ধরনের আমদানি পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। অথচ এসব ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত কোনো বিশ্লেষণ হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকেও বিষয়টি সেভাবে তদারকি হচ্ছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

জাতিসংঘের কৃষি বিষয়ক সংস্থা ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল অরগানাইজেশনের (এফএও) প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই থেকে অক্টোবর এই ৪ মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম ১২ শতাংশ, সয়াবিনের দাম ১৮ শতাংশ, চিনির দাম ২২ শতাংশ কমেছে। এছাড়া ডালের দাম ৬ শতাংশ, ডিমের দাম ৮ শতাংশ কমেছে। তবে এক বছরের হিসাবে খাদ্যপণ্যের দাম এখনও গড়ে ১২ শতাংশ বেশি রয়েছে।

জুনে আমদানির জন্য ডলারের দাম ছিল ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা। বর্তমানে প্রতি ডলার ১০৭ টাকা। ওই সময়ে প্রতি ডলারের দাম বেড়েছে ১৩ টাকা ৫৫ পয়সা। অর্থাৎ টাকার মান কমেছে ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ।

করোনার পর খাদ্যপণ্যের দাম এক দফা বেড়েছে। এর ধকল কাটিয়ে উঠার আগেই ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর প্রভাবে মার্চ থেকে খাদ্যপণ্যের দাম আরও লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকে। ফলে দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়তে থাকে।

এলসি খোলার পর ওই পণ্য দেশে আসতে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ মাস সময় লাগে। ওইসব পণ্য দেশীয় কারখানায় পরিশোধন হয়ে বাজারে আসতে আরও ১ মাস পার হয়। এ হিসাবে আমদানি পণ্য বাজারে আসতে ৪ থেকে ৫ মাস সময় লাগে। তবে তৈরি পণ্য হলে ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে বাজারে আসে। বাড়তি দামে মার্চে যেসব পণ্যের এলসি খোলা হয়েছে সেগুলো বাজারে এসেছে জুন-জুলাইয়ে। সেগুলো পরিশোধ হয়ে বাজারে এসেছে জুলাই-আগস্টে। কিন্তু পণ্যের দাম বেড়েছে এপ্রিল থেকেই।

জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমতে শুরু করে। আগস্টে এসে বেশ কমে যায়। কম দামে জুলাইয়ে যেসব পণ্যের এলসি খোলা হয়েছে সেগুলো সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বাজারে এসেছে। কিন্তু দাম তেমন একটা কমেনি। বরং কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ডলারের দাম বাড়লে আমদানি পণ্যের খরচ বেশি পড়ে। তবে কত বেশি পড়ে সেটি নির্ধারণ করতে গবেষণা হওয়া উচিত। এর একটি স্থায়ী পলিসি দরকার। ডলারের দাম কত বাড়লে কেজিতে কত বাড়বে। বর্তমানে এ ধরনের কোনো পলিসি নেই। দেখা যাচ্ছে সেপ্টেম্বরের তুলনায় এখন ডলারের দাম কমেছে। কিন্তু পণ্যের দাম ডলারের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে বাড়ানো হয়েছে। এ ধরনের হলে ভোক্তার সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত আচরণ হবে না। ডলারের মূল্য যেহেতু অস্থির, সে কারণে আগেই একটি পলিসি করা দরকার ছিল। আগে যেহেতু হয়নি, দ্রুত করা উচিত। ভোক্তার স্বার্থে এটি প্রয়োগ করাও জরুরি।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়লে দেশের বাজারেও প্রভাব পড়বে। কারণ অনেক পণ্য আছে যা আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয়। তবে বিশ্ববাজারে কিছু পণ্যের দাম কমছে। তার প্রভাব দেশের বাজারে পড়েনি। এর একটা কারণ হতে পারে, ডলার সংকট ও মূল্য বৃদ্ধি। তাই বিশ্ববাজারে দাম কমলেও ডলারের দাম বেশি হওয়ায় দেশীয় ব্যবসায়ীদের বেশি দরেই কিনতে হচ্ছে। পাশাপাশি এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট আছে। তারা অতি মুনাফা করতে পণ্যের দাম কমলেও বেশি দরে বিক্রি করে। তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। সঙ্গে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

এদিকে জুনে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা। ২১ জুলাই তা বেড়ে হয় ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা। ৮ আগস্ট আরও বেড়ে ৯৫ টাকা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর এক লাফে বেড়ে হয় ১০৮ টাকা। ৩১ অক্টোবর তা আরও কিছুটা কমে দাঁড়ায় ১০৩ টাকা। এখন ব্যাংক ভেদে ১০১ থেকে ১০৭ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। সরকারি ব্যাংকগুলো বর্তমানে আমদানির এলসি বেশি খুলছে। এসব ব্যাংকে প্রতি ডলার ১০৫ থেকে ১০৭ টাকা।

বাড়তি দামে ডলার কিনে এলসি খুললেও পণ্যের দাম সঙ্গে সঙ্গে বাড়ার কথা নয়। বাড়তি দামে ডলার কিনে এলসি খুলে পণ্য দেশে আসার পর বাড়ার কথা। কিন্তু তার আগেই পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। ডলারের দাম ১০০ টাকার উপরে উঠেছে সেপ্টেম্বরে। ওই সময়ে যেসব পণ্যের এলসি খোলা হয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগই এখনও দেশে আসেনি। দেশে আসার পর এগুলো পরিশোধন হয়ে বাজারে যেতে সময় লাগবে আরও এক মাস। এ হিসাবে ডলারের দাম বাড়ার প্রভাব ডিসেম্বরে পড়ার কথা।

কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন ও চিনির দাম যখন কমেছে তখন ১৭ নভেম্বর শুধু ডলারের দাম ১০০ টাকার উপরে চলে গেছে এই অজুহাতে দাম বাড়ানো হয়েছে। ওই দিন প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ১২ টাকা বেড়ে ১৯০ টাকা এবং চিনির দাম কেজিতে ১৩ টাকা বেড়ে ১০৮ টাকা করা হয়েছে। অথচ এই দামেও বাজারে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। এখন প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২৫ টাকা। যা এক মাস আগে (অক্টোবর) ছিল ১০৫ টাকা। সেপ্টেম্বরে বিক্রি হয়েছে ৯৫ টাকা, আগস্টে ৯০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। অথচ অক্টোবরের তুলনায় এখন ডলারের দাম কমেছে। তাহলে এখন যেসব পণ্যের এলসি খোলা হচ্ছে সেগুলোর দাম কি ৩-৪ মাস পর কমবে। উত্তর সহজ-কমবে না। তখন অন্য অজুহাতে দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলবে।

আন্তর্জাতিক দাম কমার কারণে যেখানে দেশেও কমতির দিকে থাকার কথা, সেখানে চার মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি চিনি কিনতে একজন ক্রেতাকে ২৫ টাকা বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কমতির মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম ৮৪ টাকা ও প্যাকেট চিনি ৮৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ৬ অক্টোবর প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম ছয় টাকা বাড়িয়ে ৯০ ও প্যাকেট চিনি ৯৫ টাকা করা হয়। সর্বশেষ ১৭ নভেম্বর বৃহস্পতিবার দাম আরেক দফা বাড়ানো হয়। নতুন মূল্য হচ্ছে প্রতি কেজি ১০২ টাকা এবং প্যাকেট চিনি ১০৮ টাকা।

২৬ জুন প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১৮০ টাকা, বোতলজাত সয়াবিনের মূল্য ছিল ১৯৯ টাকা। মে থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম কমেছে। কিন্তু দেশের বাজারে ২৮ আগস্ট এক দফা মূল্য কমিয়ে প্রতি লিটার খোলা ১৭৫ ও বোতলজাত সয়াবিন ১৯২ টাকায় নামিয়ে আনা হয়। বিশ্ববাজারে দাম আরও কমার পরিপ্রেক্ষিতে ৩ অক্টোবর লুজ সয়াবিনের লিটার ১৫৮ টাকা ও বোতলজাত সয়াবিনের মূল্য ১৭৮ টাকায় নামানো হয়।

তবে কিছু দিন বাজারে সরকার ঘোষিত মূল্য কার্যকর থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে বিক্রেতারা কারসাজি করে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১৭০ ও বোতলজাত ১৮০ টাকায় বিক্রি করে। সর্বশেষ ১৭ নভেম্বর নতুনভাবে দাম বাড়ানো হয় ভোজ্যতেলের। এক লাফে লিটারপ্রতি ১২ টাকা বাড়িয়ে খোলা সয়াবিনের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১৭২ টাকা এবং বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতিলিটারের দাম নির্ধারণ করা হয় ১৯০ টাকা।

তবে বাজার পরিস্থিতি পর্যালচনা করে দেখা গেছে-শুক্রবার প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ১৮৫ টাকা। এক মাস আগে (অক্টোবর) বিক্রি হয়েছে ১৬৬ টাকা। এছাড়া বোতল সয়াবিন প্রতি লিটার বিক্রি হয়েছে ১৯০ টাকা। যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ১৮৫ টাকা।

জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সব ধরনের আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়েছে। সেই প্রভাব দেশেও পড়ছে। তবে কেউ দাম নিয়ে অসাধুতা বা কারসাজি করতে না পারে সেদিকে তদারকি করা হচ্ছে। কোনো অনিয়ম পেলেই আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি খোলা আটা বিক্রি হয়েছে ৬২ টাকা। যা এক মাস আগে (অক্টোবর) ছিল ৫৮ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে কমায় সেপ্টেম্বরে কমে ৫৫ ও আগস্টে বিক্রি হয়েছে ৫২ টাকায়। তিন মাস ২৫ দিনের ব্যবধানে প্রতি কেজি আটা খুচরা বাজারে ১০ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি খোলা ময়দা প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৭৫ টাকা।

যা এক মাস আগে (অক্টোবর) বিক্রি হয়েছে ৬৫ টাকা। মাসের ব্যবধানে কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরে ৬২ টাকা, আগস্টে বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা কেজি। সেক্ষেত্রে ৩ মাস ২৫ দিনের ব্যববধানে প্রতি কেজি খোলা ময়দা কিনতে একজন ক্রেতাকে ১৫ টাকা বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। অথচ ওই সময়ে বিশ্ববাজারে গমের দাম কমেছে। মাঝারি মানের মসুর ডালের কেজি এখন ১৪০ টাকা। এক মাস আগে ছিল ১৩০ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে ডালের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। শুধু ডলারের দাম ও জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধির অজুহাতে চার মাসে ডালের দাম কেজিতে ৩০ টাকা বাড়ানো হয়েছে।

অর্থনীতি

কোনো সন্দেহ নেই, পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের মতো আমাদের এখানেও একটা অর্থনৈতিক সংকট চলছে। তেমনই কোনো সন্দেহ নেই, কিছু লোক খারাপ উদ্দেশ্যে বার্তা দিচ্ছে ব্যাংকের টাকা তুলে নেওয়ার কিংবা হিসাব দিচ্ছে-‘ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেলে আপনি আপনার আমানতের কতটুকু খোয়াবেন।’

আমার এ লেখা দেশের অর্থনৈতিক সংকটকে অস্বীকার করার জন্য নয়। সেই সংকটের সমাধান যদি জানতে চান, তাহলেও এ লেখা পড়ে আপনার লাভ নেই। কিন্তু ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেওয়ার মতো কোনো যৌক্তিক পরিস্থিতির মোটেই সৃষ্টি হয়েছে কি না, সে বোঝাবুঝিটা যেন আপনি করে নিতে পারেন, সেই কারণেই এই লেখা।

প্রশ্ন হলো, মানুষ ব্যাংকে টাকা কেন রাখে? মোটা দাগে মানুষ কাজটা করে তিন কারণে। এক. ব্যাংকে টাকার নিরাপত্তা মেলে; দুই. চাহিবামাত্র সেই টাকা তোলা যায়; তিন. কিছু মুনাফা বা সুদ পাওয়া যায়। বুঝলাম দেশের রিজার্ভ কমছে, ডলার মার্কেটের তারল্য কমছে; বুঝলাম টাকা দিয়ে ডলার কিনতে সমস্যা হচ্ছে।

কিন্তু টাকার তারল্য কি কমেছে? সোজা উত্তর, না। এ মুহূর্তে দেশের ব্যাংকব্যবস্থায় যে পরিমাণ তারল্য থাকার কথা, তার অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে আরও ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার। এই পরিমাণ উদ্বৃত্ত তারল্য জমা আছে মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে, তাছাড়া ব্যাংকে নগদ আকারে।

এ মুহূর্তে দেশের ব্যাংকগুলোয় জমা থাকা মোট আমানত বা ডিপোজিটের পরিমাণ ১৪ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। আমানতকারীদের ওই টাকা চাহিবামাত্র ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা পরিমাপের অন্য নাম ব্যাংকের তারল্য। আমাদের এ তারল্যের পরিমাণ বর্তমানে ৪ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু হিসাবমতে আমাদের এই তারল্য থাকা লাগত আড়াই লাখ কোটি টাকার মতো। অন্য কথায়, নিয়মমাফিক দেশের মোট আমানতের ১৭ শতাংশ টাকা নিরাপদে তুলে রাখার জায়গায় আমরা রেখেছি ২৮ শতাংশ টাকা।

এ রকম উদ্বৃত্ত তারল্য বিদ্যমান থাকতে আপনি লোকের কথা শুনে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে রাখবেন কোথায়? বাসা কি ব্যাংকের চেয়ে নিরাপদ? সত্য একটা ঘটনা বলি। এই সেদিন আমাদের এক জেলা শহরের শাখা ব্যবস্থাপক জানালেন, তার এক গ্রাহক ১৩ লাখ টাকা বাসায় নিয়ে গেছেন। কারণ, তার ইতালি প্রবাসী ভাই বলেছেন ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ নয়। দুই সপ্তাহ পর তিনি ব্যাংকে ফিরে এসেছেন ৯ লাখ টাকা নিয়ে। বাকি ৪ লাখ টাকা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না, সেটা চুরি হয়ে গেছে।

ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনার একটা বড় তত্ত্ব হলো, সব আমানতকারীর একসঙ্গে সব টাকা নগদ করার দরকার পড়ে না কখনো। গ্রাহকদের ব্যাংকে রাখা সঞ্চয় যদি সবার একসঙ্গে দরকার পড়ত, তাহলে পৃথিবীতে ব্যাংকিং বলে কোনো কিছু আবিষ্কারই হতো না। ব্যাংক আপনার আমানত নিয়ে অন্যকে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ দেয় বলেই মানুষ ঋণ নিয়ে তার ব্যবসার আকার বড় করে বা বাসস্থানের জন্য দীর্ঘমেয়াদে গৃহঋণ নেয়।

এখন সব আমানতকারী যদি এসে বলেন, ‘সব টাকা ফেরত দাও’, তাহলে ব্যাংকগুলোকে সব ঋণগ্রহীতার কাছে গিয়ে বলতে হবে, ‘আপনার ফ্যাক্টরি বা বাড়ি বিক্রি করে সব টাকা ফেরত দিন।’ সেটা অবাস্তব। এখন প্রশ্ন আসে, পুরো টাকাটা ব্যাংক থেকে মানুষ একযোগে তুলে নিতে চাইলে কতটা নিতে পারে? ইতিহাস এ ব্যাপারে কী বলে? সামগ্রিক অর্থনীতির সমূহ পতন কিংবা বিশ্বযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে এমন কোনো উদাহরণ নেই যে ব্যাংক খাত থেকে মোট আমানতের ১০-১২ ভাগের বেশি টাকা একযোগে বা এক মৌসুমে বেরিয়ে গেছে

। সেখানে আমরা এ দেশের গ্রাহকদের মোট আমানতের ১৭ ভাগ টাকা রক্ষিত রাখার বদলে রেখেছি ২৮ ভাগ। মোদ্দা কথা, পৃথিবীর কোনো দেশই তার ব্যাংকিং ব্যবস্থায় জনগণের রাখা মোট আমানত নিয়ে চিন্তিত থাকে না। আমরাও ১৪ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকার মোট আমানত নিয়ে চিন্তিত নই।

এবার ‘কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক’ নামের একটা বিষয়ে কিছু কথা বলি। অর্থাৎ ব্যাংকিংব্যবস্থার বাইরের টাকা। আপনি আপনার ব্যাংক হিসাব থেকে ১০০ টাকা তুলে নিলে সেই ১০০ টাকাকে বলা হয় ‘কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক’, যে টাকার অর্থনীতিতে গভীর অবদান রাখার ক্ষমতা তুলনামূলক কম। এটাই আপনার দৈনন্দিন লেনদেনের টাকা। এ মুহূর্তে লেনদেনে ব্যবহৃত আমাদের এ টাকার পরিমাণ ২ লাখ ৪১ হাজার কোটি।

এবার আপনি ব্যাংক থেকে টাকা অহেতুক তুলে নিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন দেখবে এর ফলে দৈনন্দিন লেনদেনে ব্যবহৃত টাকার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, তখন মুদ্রানীতিতে ‘রিজার্ভ মানি’র প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখতে তাদের অর্থ সরবরাহ বাড়াতেই হবে।

আর সেই সঙ্গে কিন্তু বাড়বে মুদ্রাস্ফীতি, যে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব পড়বে আমার-আপনার মতো সাধারণ মানুষের ওপর। ব্যাংক থেকে অকারণে টাকা তুলে নেওয়ার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তাহলে কোথায় গিয়ে পড়ছে? সেটা ঘুরে গিয়ে পড়ছে জনগণেরই ঘাড়ে।

এবার আসি যারা ভুল বার্তা ছড়াচ্ছেন, তাদের কিছু উটকো যুক্তি প্রসঙ্গে। প্রথমে বলি বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ২৭১ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ সময়ে এটা দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬০৩ কোটি ডলারে। এরপর করোনার মধ্যে অবৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স পাঠানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ানোয় বৈধ চ্যানেলে বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স আসতে থাকে।

তাছাড়া ব্যাংকগুলো অনেক আমদানি ব্যয় পরিশোধকে ‘ডেফার্ড’ বা প্রলম্বিত করায় ২০২০-২১ অর্থবছরে এ রিজার্ভ উঠে যায় ৪ হাজার ৬৩৯ কোটি ডলারে। কিন্তু করোনা শেষে অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে থাকলে আমদানি ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসা কমতে শুরু করে এবং একই সঙ্গে ‘ডেফার্ড’ আমদানি পরিশোধের দায় মেটাতে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়া শুরু হয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে দেশের রিজার্ভ শেষ হয়ে গেছে অথবা আগামী কয়েক মাস আমদানি ব্যয় ও বিদেশি ঋণের কিস্তি মেটানোর মতো ডলার দেশে নেই। ১৯৯১ সালে বাড়ির পাশের ভারতই এর চেয়ে কত তীব্র এক সংকটের মুখে পড়েছিল।

সে বছরের জানুয়ারি থেকে জুন-মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে ভারতের রিজার্ভ প্রায় ৫০ শতাংশ কমে ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে গিয়েছিল। সংকট এতটাই প্রকট ছিল যে, তখন আমদানি ব্যয় পরিশোধের সামান্য সক্ষমতাটুকুও ভারতের ছিল না। সেবার আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক থেকে প্রায় ২২০ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে ভারত সে সংকট কাটিয়ে উঠেছিল খুব চমৎকারভাবেই। এখানে উল্লেখ্য, ভারত সেদিন যে লোনটা পেয়েছিল, তা ছিল স্বর্ণের বিপরীতে পাওয়া ‘সিকিউরড’ ঋণ। আর আমরা আইএমএফ থেকে যে ঋণ পাচ্ছি, সেটা কিন্তু অমন কিছু বন্ধক রেখে পাওয়া কোনো ঋণ নয়।

রিজার্ভের পরে আসি জিডিপির বিপরীতে ঋণের (সরকারের স্থানীয় ও বৈদেশিক মুদ্রায় নেওয়া সর্বমোট ঋণের) অনুপাতে, যাকে বলা হয় ‘ডেট টু জিডিপি রেশিও’। এ রেশিও বা অনুপাত দিয়ে মাপা যায় একটা দেশের অর্থনীতি কতটা শক্তিশালী। এ অনুপাত যত কম হবে, কোনো দেশ তত বেশি ঋণ নেওয়া ছাড়াই উন্নতি করতে পারবে।

বিশ্বব্যাংকের মতে, ডেট টু জিডিপি রেশিও যদি ৭৭ শতাংশ বা এর চেয়ে কম হয়, তাহলে সেদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী বলা যাবে। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, আমাদের এই ডেট টু জিডিপি রেশিও ৩৬ শতাংশের কম। অথচ ২০২১ সালের হিসাবমতে একই রেশিও ভারতের বেলায় ৯১ শতাংশ, কানাডার বেলায় ১১০ শতাংশ আর যুক্তরাষ্ট্রের বেলায় ১৩৩ শতাংশ। এ পরিমাপক থেকেও বলা যায়, আমরা আইএমএফের ঋণ পরিশোধ করতে এবং একই সঙ্গে বিদেশি গ্রাহকদের কাছে আমাদের পণ্য পৌঁছে দিতে সক্ষম।

এবার আসি শুধু বিদেশি ঋণ প্রসঙ্গে। কিছু মানুষ বলতে শুরু করেছেন, দেশ নাকি বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারবে না। আমাদের বিদেশি ঋণ জিডিপির মাত্র ২০ দশমিক ৪ শতাংশ, যেখানে ভারতের ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের ১০০ দশমিক ২ শতাংশ, জাপানের ৯৭ দশমিক ৯ শতাংশ এবং সিঙ্গাপুরের ৪১৮ দশমিক ৩ শতাংশ। বিশ্বের বহু দেশের তুলনায় আমাদের এই ‘লোন টু জিডিপি রেশিও’ অনেক কম। তবে এটা ঠিক যে, গত কয়েক বছরে আমাদের এই ঋণ বেড়ে গেছে।

টাকা দিয়ে ডলার না কিনতে পারার সংকট আর দায় মেটানোর ডলার তারল্য না থাকার সংকট এক বিষয় নয়। একটির সঙ্গে আরেকটিকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। বৈদেশিক মুদ্রার তারল্য এক বিষয় আর বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় আরেক। আমরা ব্যাংকাররা আমদানি দায় মেটাতে দুটি পদ্ধতিরই আশ্রয় নিয়ে থাকি। সেক্ষেত্রে আমাদের টাকা দিয়ে ডলার কিনতে হয়। আবার তা যদি না পারা যায়, তখন আমরা আমাদের যার যার ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার তারল্য দিয়ে সেই দায় পরিশোধ করি। আবার পরে সুযোগমতো টাকা দিয়ে ডলার কিনে ব্যাপারটার শোধবোধ করি বা ব্যাংকিং পরিভাষায় আমাদের ‘পজিশন স্কয়ার’ করি।

ডলার নেই কথাটা ভুল। আমরা ডলার থাকার সক্ষমতা থেকেই আমাদের আমদানি দায় মেটাচ্ছি এবং এর ফলে কখনো কখনো আমাদের পজিশন ‘শর্ট’ (ঘাটতি) হয়ে যাচ্ছে, সত্য। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার পজিশন শর্ট হওয়া দিয়ে কোনোভাবেই কোনো ব্যাংকের অক্ষমতাকে বোঝানো হয় না। এটা চলমান অর্থনীতির উঠতি-পড়তির এক ধারা। এই যেমন এখন আমদানি শেষমেশ কমতে শুরু করেছে।

অন্য কথায়, হুন্ডির ফাঁদ এড়িয়ে আসল দরে বিদেশের সঙ্গে পণ্যের কেনাবেচা শুরু হয়েছে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে নিয়মিত ডলার বেচে আমাদের ওই ঘাটতি উপশমের চেষ্টাও করে যাচ্ছে। সামনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া নানা ধরনের পদক্ষেপের ফলে দু-তিন মাসের মধ্যে এই সাময়িক সমস্যার সুরাহা হয়ে যাবে, সেটা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরেরই স্পষ্ট আশাবাদ।

এই সার্বিক শক্তিশালী অবস্থায় ব্যাংকের আমানতকারীদের এত চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। এলসি খোলার বেলায় ব্যাংকগুলো যে সাময়িক কড়াকড়ি করছে, তাতে ব্যাংকের একজন আমানতকারী হিসাবে আপনার উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। এলসি হলো ব্যাংকের বৈদেশিক ব্যবসা আর আমানতকারীদের টাকা আমরা বিনিয়োগ করেছি মূলত লোন হিসাবে। এলসি খুলতে না পারার কারণে ব্যাংক কখনো দেউলিয়া হয় না। এতে ব্যাংকের মুনাফা কিছুটা কমে, এই যা।

শেষ কথা : বাংলাদেশ মজবুত এক অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর দাঁড়ানো ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের বড় অর্থনীতির দেশ। সমস্যা যে নেই, তা নয়। কোনো কোনো ব্যাংকে মন্দ ঋণের সমস্যা আছে, কোথাও সুশাসনের সমস্যা আছে। তাই বলে আপনার টাকা তুলে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরির প্রশ্নই ওঠে না। উঠলে এত দিনে এ দেশে দু-একটা ব্যাংক ধসে যেত। যায়নি কারণ, সব সমালোচনার পরও ব্যাংকব্যবস্থায় রয়েছে ওই তারল্য ও উদ্বৃত্ত তারল্যের উপস্থিতি; আর রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মিত কড়া চোখ। এ সময়ে কিছু স্বল্পস্থায়ী সমস্যাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে আপনার ব্যাংক হিসাবের টাকা যারা অকারণে ব্যাংক থেকে তুলে নিতে বলছে, তারা আপনার ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই করছে না। সে ক্ষতিটার শিকার যাতে আপনি না হন, তাই উপরের এতগুলো তথ্য-উপাত্ত-অঙ্ক। অঙ্কই কথা বলুক; আর কথা বলুক আমাদের ব্যাংকিংব্যবস্থার ইতিহাস।

মাসরুর আরেফিন : এমডি ও সিইও, দ্য সিটি ব্যাংক; ভাইস প্রেসিডেন্ট, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স ।

অর্থনীতি

বাজেট সহায়তা দেওয়ার আগে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খতিয়ে দেখছে বিশ্বব্যাংক। এর অংশ হিসাবে সোমবার পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলমের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল। এতে নেতৃত্ব দেন সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়ার রিজিওনাল ডিরেক্টর ম্যাথিউ ভারগিস। বৈঠকে উন্নয়ন প্রকল্পের গতি বৃদ্ধি এবং প্রকল্পের কেনাকাটায় স্বচ্ছতা নিশ্চিতের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ই-জিপি (ই-টেন্ডার) সম্প্রসারণের কথা বলা হয়েছে বলে জানান পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে তার সম্মেলন কক্ষে ব্রিফিং করেন তিনি।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী জানান, প্রতিশ্রুত ২৫ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা ছাড় করার আগে তারা বেশ কিছু বিষয় জানতে চেয়েছেন। এর মধ্যে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি, রিজার্ভের অবস্থা, মূল্যস্ফীতি, ভ্যাট আইন সংস্কার, সিপিটিইউকে পাবলিক প্রকিউমেন্ট অথরিটি করার অগ্রগতি এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। উত্তরে প্রতিমন্ত্রী তাদের বলেছেন, আমাদের রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন থেকে কমে গেছে, এটা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু আমাদের রপ্তানি বাড়ছে ২৫ শতাংশ হারে। আমদানি বাড়ছে ২৩ শতাংশ হারে। এক্ষেত্রে আমদানির তুলনায় রপ্তানি বাড়ছে। গত এক মাসে রেমিট্যান্স এসেছে দুই বিলিয়ন ডলার। ফলে আমরা এখন স্বস্তিদায়ক অবস্থায় আছি। ফলে রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে। এত দুর্যোগের মধ্যেও আমাদের বিনিময় মূল্য স্থিতিশীল আছে। কোথাও উৎপাদন ব্যাহত হয়নি। অর্থনীতি আমাদের আয়ত্তে আছে। তবে রিজার্ভ ধরে রাখতে আমাদের বাজেট সহায়তা প্রয়োজন। প্রচুর বৈদেশিক ঋণ এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ দরকার। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের গতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মেগা প্রকল্পসহ দেশের সব প্রকল্পের গতি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। আমরা গ্রিন গ্রোথে (সবুজ প্রবৃদ্ধি) গুরুত্ব দিচ্ছি। তবে ব্যবস্থাপনার অদক্ষতাই প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে উন্নয়ন করা হচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধানে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়েছে।

উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংকের কাছে নতুন করে ১০০ কোটি ডলার এবং আগে প্রতিশ্রুত ২৫ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা দ্রুত ছাড় করতে অনুরোধ জানায় সরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ সফর করছে।

অর্থনীতি

দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার থেকে মার্কিন ডলার আয় ক্রমশ কমছে। মূলত বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির প্রভাবে উন্নত বিশ্বের ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে এ শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

এছাড়া শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খুলতে বেশি টাকায় ডলার কিনতে হচ্ছে। কিন্তু রপ্তানি আয় (ডলার) নগদায়নের ক্ষেত্রে মিলছে কম টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমদানি বিল পরিশোধসংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারিকৃত প্রজ্ঞাপন। সম্প্রতি এটা জারি করা হয়।

উল্লিখিত কারণগুলো রপ্তানি আয়ের প্রধান খাতে বড় ধরনের সংকট তৈরি করছে। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমএই এবং বিকেএমইএ। বিদ্যমান সংকট মোকাবিলায় দুটি সংগঠনের পক্ষ থেকে একাধিক প্রস্তাবসহ অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সূত্রমতে, সংকট কাটিয়ে উঠার প্রস্তাবে বলা হয়েছে ডলারের বিনিময় মূল্য নির্ধারণের এখতিয়ার শুধুই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। অন্য কোনো সংগঠনের নয়। ডলারের বিনিময় মূল্য নির্ধারণে বৈষম্যের কারণে লোকসান গুনতে হচ্ছে পোশাক শিল্পকে। সেখানে রপ্তানি আয় (মার্কিন ডলার) নগদায়নের ক্ষেত্রে ডলারের মূল্য রেমিট্যান্স নগদায়নের মূল্যের সমান করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এছাড়া রপ্তানিতে উৎসে কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৫০ শতাংশ করার বিষয়টিও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

জানতে চাইলে বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ১০৫ থেকে ১০৭ টাকায় প্রতি ডলার কিনে এখন পোশাক শিল্পের জন্য কাঁচামাল আমদানির এলসি খুলতে হচ্ছে। আবার রপ্তানি আয় ভাঙানোর ক্ষেত্রে ডলারের বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ৯৯ টাকা।

আবার রেমিট্যান্স ভাঙানোর ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের মূল্য পাওয়া যাচ্ছে ১০৭ টাকা। সঙ্গে ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা মিলে ডলারের মূল্য দাঁড়ায় ১১০ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) কাছে। তারা ডলারের মূল্য নির্ধারণ করে ব্যাংকগুলোকে একটি লুটপাটের রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে। ব্যাংকগুলো তাই করছে। এখন রপ্তানি খাতে ডলারের মূল্য পুনর্নিধারণ করতে হবে।

একটি শীর্ষ রপ্তানিকারক বলেন, ডলার সংকটের কারণে ইতালি থেকে একজন বায়ার তাদের অর্ডারের পণ্য নিতে দেরি হবে এমন বার্তা দিয়েছেন। তার কারখানায় প্রায় সাড়ে ৮ লাখ ডলারের পোশাক পড়ে আছে রপ্তানির অপেক্ষায়।

এ উদ্যোক্তার মতে, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি নির্দেশনা জারি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে নির্ধারিত সময়ে আমদানি বিল পরিশোধে ব্যর্থ হলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা বাণিজ্যের অনুমোদিত ডিলার (এডি) লাইসেন্স বাতিল করবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। এরপর অনেক ব্যাংক ভয়ে এলসি খুলছে না। তিনি (ওই রপ্তানিকারক) বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। ওই কর্মকর্তাও স্বীকার করেছেন এই মুহূর্তে এমন নির্দেশনা দেওয়া সঠিক হয়নি।

এদিকে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক থেকে ডলার আয় কমে যাওয়ার তথ্য উঠে আসছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর প্রতিবেদনে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবরে পোশাক খাতে প্রায় ১২৬ কোটি মার্কিন ডলার আয় হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দশমিক ৭৪ শতাংশ কম। এদিকে বিজিএমইএ’র আগাম পূর্বাভাসে বলা হয়েছে-রপ্তানির গতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যাচ্ছে, আগামী মাসগুলোতে এ ঋণাত্মক ধারা অব্যাহত থাকবে।

সূত্রমতে, সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে তৈরি পোশাক শিল্পের সার্বিক সংকট তুলে ধরে সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দিয়েছেন বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট ফারুক হাসান। সেখানে তিনি বলেছেন, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মূল্যস্ফীতির চরম আকার ধারণ করেছে। যার প্রভাবে শিল্পের কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে অস্বাভাবিক হারে। এছাড়া জ্বালানি সংকটের কারণে ব্যয় বৃদ্ধিসহ উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বিদেশি ক্রেতারা রপ্তানি আদেশ কমিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া ইতঃপূর্বের দেওয়া রপ্তানি আদেশ ধীরগতিতে শিপমেন্ট করতে বলা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বাতিল করছে রপ্তানির আদেশও।

ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, এর বিরূপ প্রভাব কিছু সংখ্যক রপ্তানিমুখী শিল্প তাদের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সময়মতো পরিশোধ করতে পারছে না। এতে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে। বর্তমান এই সংকটকালীন দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে আর্থিক সহায়তা প্রদান একান্ত প্রয়োজন। বিশেষ করে চলতি বাজেটে উৎসে কর দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। সেটি পুনরায় কমিয়ে দশমিক ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে অর্থমন্ত্রীকে। এ প্রস্তাব আগামী ৫ বছর পর্যন্ত কার্যকর করার কথা বলা হয়।

এদিকে ডলার বিনিময় হার জটিলতা তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারকে চিঠি দিয়েছে বিকেমএই। সেখানে বলা হয়, আমদানির দেনা পরিশোধের জন্য ১০৮.৫০ টাকা ডলারের মূল্য নির্ধারণ করা হলেও ব্যাক টু ব্যাক এলসি বা অন্য যে কোনো আমদানির দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ১০৫ থেকে ১০৬ টাকা দিয়ে ডলার কিনতে হয়।

অন্যদিকে রপ্তানি আয় নগদায়নের ক্ষেত্রে প্রতি ডলারে ৯৯ টাকা দেওয়া হচ্ছে। ডলার বিনিময় হারে এ নীতির কারণে বিশাল অঙ্কের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে পোশাক রপ্তানিকারকরা। এক্ষেত্রে পূর্বের ন্যায় ইডিএফ’র মাধ্যমে ব্যাক টু ব্যাক এলসির দেনা পরিশোধ সমন্বয় করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

অর্থনীতি

সাতটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এগুলো বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৯৮১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে তিন হাজার ৩৯২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, বৈদেশিক ঋণ সহায়তা থেকে ৩২২ কোটি ২১ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থা থেকে ২৬৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে।

মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত একনেক বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ, ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) সত্যজিত কর্মকার, আইএমইডির সচিব আবু হেনা মোর্শেদ জামান এবং তথ্য ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন।

পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, সন্দ্বীপসহ উপকূলীয় অনেক স্থানে জেটি নির্মাণ করা হলে স্থানীয়সহ পর্যটকদের সুবিধা হবে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের যেসব এলাকায় অবকাঠামো ঘাটতি আছে, অনুমোদিত প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সেই ঘাটতির অনেকটাই পূরণ হবে।

একনেকে অনুমোদিত প্রকল্পগুলো হচ্ছে— চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপ ও টেকনাফ অংশের জেটিসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনাদি নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৯১৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় অঞ্চল-২ ও অঞ্চল ৪-এর ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক অবকাঠামোসহ অঞ্চল-২, অঞ্চল ৫-এর সার্ভিস প্যাসেজগুলোর উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৬৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার বৈদ্যুতিক-যান্ত্রিক ও নিরাপত্তাব্যবস্থাসহ অন্যান্য উন্নয়ন কাজের ব্যয় ধরা হয়েছে ৯২ কোটি ১৭ লাখ টাকা। বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৬১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। নবীনগর-আশুগঞ্জ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা। দিনাজপুর অঞ্চলে টেকসই কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০২ কোটি ৪১ লাখ টাকা।

এ ছাড়া ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া চতুর্থবার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে দুটি প্রকল্পের, সেগুলো হলো— খুলনা শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন প্রকল্প। বরিশাল মেট্রোপলিটন ও খুলনা পুলিশ লাইন নির্মাণ প্রকল্প।

অর্থনীতি

গেল আগস্টে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি সরকারের ভর্তুকি কমাতে সাহায্য করবে। অপরদিকে আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে কমতে পারে বিনিয়োগ। অর্থ বিভাগের কাছে এমন মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, আগামী দিনে রাজস্ব আহরণ আরও হ্রাস পাবে। ক্রমাগত মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি অর্থনীতিতে মারাত্মক আঘাত হানছে। সব মিলিয়ে বৈশ্বিক সংকটের একাধিক ধাক্কায় দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি গভীর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাটি সম্প্রতি অর্থ বিভাগকে এসব তথ্য লিখিত আকারে জানিয়েছে।

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, আইএমএফ সামষ্টিক অর্থনীতির বিষয়ে নানা দিক জানতে চেয়েছে। অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে। ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তার প্রক্রিয়া হিসাবে ঢাকা সফর করছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। মিশনটি বুধবার ঢাকা ত্যাগ করার কথা। এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয়; জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়; বাংলাদেশ ব্যাংক; জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে।

সূত্র জানায়, দেশের অর্থনীতির সার্বিক বিষয় নিয়ে সম্প্রতি অর্থ সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের সঙ্গে সংস্থাটির প্রতিনিধিরা বৈঠক করেছেন। আইএমএফ-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯-এর প্রভাব কাটিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গতি ফিরে আসে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ফের আঘাত করে। এই যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বেড়েছে। পণ্যের সরবরাহ চেইনে বাধা সৃষ্টি এবং বৈশ্বিক চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। এর প্রভাবে চলতি হিসাবে ঘাটতি আরও বেড়েছে। পাশাপাশি টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। এছাড়া ক্রমাগত কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে অর্থনীতিতে আঘাত হেনেছে। আমদানি করতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে।

সংস্থাটি মনে করছে, এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন জিডিপির প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বলা হয়, গত এপ্রিলে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রতিবেদনে আইএমএফ-এর পর্যবেক্ষণ ছিল ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ অর্জন করতে পারে। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি এ প্রবৃদ্ধির হার আরও কমবে। আইএমএফ মনে করছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ৬ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।

সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২০০২ থেকে ২০০৬ অর্থবছর পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল। কিন্তু ২০০৯ থেকে ২০২২ অর্থবছর পর্যন্ত এ প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এটি ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ অর্জন হবে।

আইএমএফ মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে বলেছে, ঊর্ধ্বমুখীর কারণে অভ্যন্তরীণ খাদ্যপণ্যের দাম বেশি। সংস্থাটি মনে করছে, চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়াবে ৯ দশমিক ১ শতাংশ। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী থাকবে। ওই বছর মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৮ শতাংশে বিরাজ করতে পারে। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এটা কমতে পারে বলে ধারণা দিয়েছে। তবে অর্থ বিভাগ থেকে জানানো হয়, ২০০৮ সালে মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এটি জুনে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ ওঠে। তবে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ১ শতাংশ।

আইএমএফ বাজেট ঘাটতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাদের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বাজেট ঘাটতি চলতি অর্থবছরে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হবে। আর আগামী অর্থবছরে এটি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া চলতি ও আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায় কমবে। রাজস্ব আহরণ জিডিপির ১১ শতাংশ হবে এবং আগামী অর্থবছরে সেটি ১০ দশমিক ৯ শতাংশ হবে। এটি জিডিপির ৯ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে। তবে আগস্টে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করেছে সরকার। এতে সরকারের ভর্তুকি কিছুটা কমবে, যা স্বস্তিদায়ক। সরকারের পরিচালন ব্যয়ও কমবে।

জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আইএমএফ ৪৫০ কোটি ডলারের মধ্যে ১৩০ কোটি ডলার দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। এজন্য বৈঠক শেষে আইএমএফ-এর একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে আসছে। এই ঋণের বিপরীতে ভ্যাট যৌক্তিককরণ, প্রশাসনিক অটোমেশন, ভর্তুকি টার্গেটসহ নানা ধরনের শর্ত দেওয়া হয়েছে। তবে খুব বেশি কিছু করতে হবে না। মোটা দাগে দুই থেকে তিনটি সংস্কার করলে এই ঋণ পাওয়া যাবে। তিনি আরও বলেন, এ মুহূর্তে আইএমএফ-এর ঋণ পেলে অনেক ভালো হবে। কারণ রিজার্ভ এখনো সংকটে আছে।