অর্থনীতি

জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে প্রথমে শুরু হয় ছন্দপতন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের ১ বছর বা ৬ মাস আগে থেকে শুরু হয় এই ছন্দপতন। একটি নির্বাচনের পর টানা ৪ বছর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ার যে গতি থাকে নির্বাচনি বছরে বা নির্বাচনের ১ বছর বা ৬ মাস আগে থেকে এটি কমতে থাকে।

একপর্যায়ে রিজার্ভ বাড়ার গতি থেমে গিয়ে নিম্নমুখী হয়। কখনো বাড়লেও তা খুবই সামান্য। চূড়ান্ত হিসাবে নির্বাচনের ৬ মাস আগের পরিমাণে রিজার্ভ নির্বাচনি মাসে থাকে না। তা বেশ কমে যায়। নির্বাচনের পর আবার রিজার্ভ বাড়তে থাকে। সব মিলে নির্বাচনি বছরে রিজার্ভে চলে উত্থান-পতন।

অথচ নির্বাচনি বছরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে। ঋণ প্রবৃদ্ধির হারও কমে যায়। তারপরও রিজার্ভ কমাকে ভালো চোখে দেখছেন না দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে নির্বাচনের আগে দেশের রাজনীতিতে যে অনিশ্চয়তা দেখা দেয় তাতে করে অনেকে বিদেশে টাকা পাচার করে দেন। আমদানি-রপ্তানির আড়ালে বা হুন্ডির মাধ্যমে এসব টাকা পাচার হয়। যে কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়ে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে উত্থান-পতন হয়েছে। নির্বাচনের বছরের শুরুর দিকে রিজার্ভ বেড়ে রেকর্ড পরিমাণ উচ্চতা ছুঁয়েছে। কমপক্ষে ৬ মাস আগে থেকে কমতে শুরু করে। কোনো কোনো মাসে বাড়লেও পরিমাণে তা খুব কম। নির্বাচনি বা তার আগের মাসে রিজার্ভ কমে যায় বেশ। নির্বাচনের পর আবার বাড়তে শুরু করে। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। তবে এবার গত ২ বছর ৪ মাস ধরে রিজার্ভ কমছে। এবার রিজার্ভ কমার অন্যতম কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া ও বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব। এছাড়া দেশ থেকে নানা ভাবে টাকা পাচার হচ্ছে। এ কারণেও রিজার্ভ কমছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দুর্নীতির মাধ্যমে যেসব টাকা অর্জিত হয় সেগুলো নির্বাচনি বছরে একটি চক্র বিদেশে পাচার করে দেয়। কারণ নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল হলে একপক্ষ নানাভাবে নাজেহাল হবেন। এ আশঙ্কায় তারা টাকা বিদেশে পাচার করে সেখানে বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। যে কারণে নির্বাচনি বছরে আমদানি ব্যয় অস্বাভিকভাবে বেড়ে যায়। রপ্তানি আয়ের মূল্য দেশে না আসার প্রবণতা বাড়ে। একই কারণে কার্ব মার্কেটে ডলারের দামে বড় ধরনের ওঠানামা করে। এবারের নির্বাচনের আগে থেকে ডলার সংকটের কারণে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। টাকা পাচারের বাকি সবই হচ্ছে। ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই নির্বাচনের অনেক আগে থেকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। তবে এবারের রিজার্ভ কমার সঙ্গে বৈশ্বিক কারণের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নানা কারণ জড়িত। এর মধ্যে নির্বাচনের কারণে এক ধরনের অনিশ্চয়তাও দেখা দিয়েছে। এ কারণে অনেকেই টাকা পাচার করছেন। নির্বাচনের ২ বছর ৪ মাস আগে ২০২১ সালের আগস্টে দেশের রিজার্ভ বেড়ে রেকর্ড ৪ হাজার ৮০৬ কোটি ডলারে ওঠেছিল। এরপর থেকে তা কমছে। কমার গতি এখনও অব্যাহত রয়েছে। জুলাইয়ে রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৯৭৩ কোটি ডলার। আগস্টে তা কমে ২ হাজার ৯২৬ কোটি ডলারে নামে। সেপ্টেম্বরে আরও কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৬০৮ কোটি ডলারে। অক্টোবরে ২ হাজার ৬৪৮ কোটি ও নভেম্বরে ২ হাজার ৪৮৯ কোটি ডলারে নামে। আইএমএফ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণের কিস্তি ছাড় হওয়ায় সম্প্রতি রিজার্ভ কিছুটা বেড়ে ২ হাজার ৬০৫ কোটি ডলারে ওঠে। নির্বাচনের পর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা শোধ করলে রিজার্ভ আবার কমে যাবে।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদের একাদশ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময়ে রিজার্ভ সাশ্রয় ও আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ সংকোচন নীতি গ্রহণ করে। তারপরেও আমদানি ব্যয় কমেনি। বরং আরও বেড়েছে। শুধু সেপ্টেম্বরই আমদানি ব্যয় বেড়েছিল ২৪ শতাংশের বেশি। আমদানি ব্যয়সহ অন্যান্য খাতে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় বাড়ার কারণে রিজার্ভে গিয়ে চাপ পড়ে। ওই বছরের ৩০ জুন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৩১৭ কোটি ডলার। ২৯ আগস্ট তা কমে ৩ হাজার ২৮০ কোটিতে দাঁড়ায়। ৩১ অক্টোবর আরও কমে ৩ হাজার ২০৮ কোটিতে নেমে যায়। নভেম্বরে তা আরও কমে ৩ হাজার ১০৫ কোটি ডলারে নেমে যায়। ডিসেম্বরের শেষে তা বেড়ে ৩ হাজার ২০২ কোটি ডলারে ওঠে। নির্বাচনের পর জানুয়ারিতে রিজার্ভ কিছুটা কমে ফেব্রুয়ারি থেকে আবার বাড়তে শুরু করে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে সহনশীল রাজনৈতিক পরিবেশ না থাকলে অনিশ্চয়তা বাড়ে। ফলে অনেকের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দেয়। এ কারণে নির্বাচনি বছরে দেশ থেকে টাকা পাচার বাড়ে। ফলে রিজার্ভেও চাপ পড়ে। সুস্থ ও সহনশীল রাজনৈতিক চর্চা গড়ে উঠলে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা হলে এই প্রবণতা কমে আসবে।

প্রাপ্ত্য তথ্যে দেখা যায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদের দশম নির্বাচন। এর আগে পরে রিজার্ভে বেশ উঠানামা ছিল। ওই সময়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ছিল বেশ উত্তপ্ত। ওই নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের আগস্টে রিজার্ভ বেড়ে ১ হাজার ৬২৫ কোটি ডলারে ওঠে। সেপ্টেম্বরে আবার কমে ১ হাজার ৬১৫ কোটি ডলারে নেমে যায়। অক্টোবরে আবার বেড়ে ১ হাজার ৭৩৪ কোটি ডলারে ওঠে। নভেম্বরে আবার ১ হাজার ৭১০ কোটি ডলারে নেমে যায়। ডিসেম্বরে বেড়ে ১ হাজার ৮০৯ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এটি আবার বাড়তে থাকে । ওই মাস শেষে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৮১২ কোটি ডলারে। ওই বছরে নির্বাচন বেশিরভাগ বিরোধী দল বর্জন করেছিল। ফলে নির্বাচনি উত্তাপ ছিল না মাঠে। উলটো রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত ছিল। আমদানি-রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কার্যক্রম ছিল কম। ফলে রিজার্ভে খুব বেশি প্রভাব পড়েনি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর শান্তিপূর্ণভাবে সংসদের নবম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে সব দল অংশ নেয়। রাজনৈতিক উত্তাপের পরিবর্তে ছিল নির্বাচনি উত্তাপ। ২০০৮ সালের জুনে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৬১৫ কোটি ডলার। জুলাইয়ে তা কমে ৫৮২ কোটি ডলার, আগস্টে সামান্য বেড়ে ৫৯৬ কোটি ডলারে ওঠে। সেপ্টেম্বরে তা আবার কমে ৫৮৬ কোটি ডলার নেমে যায়। অক্টোবরে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৫৫৫ কোটি ডলারে। নভেম্বরে আরও কমে ৫২৪ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। নির্বাচনের পর ওই মাসে রিজার্ভ কিছুটা বেড়ে ৫৭৯ কোটি ডলারে ওঠে। জানুয়ারিতে আবার কমে ৫৫৮ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ফেব্রুয়ারিতে আবার বেড়ে ৫৯৫ কোটি ডলার ওঠে।

২০০১ সালের ১ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হয় অষ্টম সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনের আগে-পরেও রিজার্ভে উত্থান-পতন হয়েছিল। ওই সময়ে ক্ষমতাসীন সরকার ক্ষমতা ছাড়ার আগে রিজার্ভ আগের ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে ৯৯ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নিলে রিজার্ভ আবার বাড়তে থাকে। ২০০১ সালের জুলাইয়ে রিজার্ভ ছিল ১১৪ কোটি ডলার। আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২৫ কোটি ডলারে। সেপ্টেম্বরে আবার কমে ১১৫ কোটি ডলারে নেমে যায়। অক্টোবরে আরও কমে ১০৮ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। নভেম্বর থেকে রিজার্ভ আবার বাড়তে থাকে। নভেম্বরে এর পরিমাণ বেড়ে ১১১ কোটি ডলার এবং ডিসেম্বরে তা আরও বেড়ে ১৩০ কোটি ডলারে দাঁড়ায়।

অর্থনীতি

নিরবিচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিদ্যুৎ উৎপাদন আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করা হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

আজ বুধবার রাজধানীর হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার ঘোষণাকালে তিনি এই প্রতিশ্রুতি দেন।

শেখ হাসিনা বলেন, বিদ্যুৎ খাতে আমরা গত ১৫ বছরে যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক উন্নয়ন ঘটিয়েছি। নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত, এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার ও ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, পরিবেশবান্ধব জ্বালানি থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। নবায়নযোগ্য ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য গ্রিড যুগোপযোগী করার কাযক্রম শুরু হয়েছে।

এছাড়াও দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গ্যাস ও এলপিজির সরবরাহ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হবে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।

অর্থনীতি

গত অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ বাবদ বেশি গুনতে হয়েছে ৪৪ কোটি মার্কিন ডলার, দেশীয় মুদ্রায় চার হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। মূলত ডলারের ঊর্ধ্বমুখীর কারণে টাকার অবমূল্যায়ন এবং ঋণ পরিশোধের চাপ বৃদ্ধির ফলে এটি ঘটেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩০ শতাংশের মতো। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের ওপর। গেল (২০২২-২৩) অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে মোট ব্যয় হয় ৯৪ কোটি মার্কিন ডলার। এর আগের অর্থবছরে এ খাতে ব্যয়ের অঙ্ক ছিল ৫০ কোটি ডলার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে এ তথ্য।

সূত্রমতে, সুদ পরিশোধ ব্যয়ের চাপ চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরে থাকবে। অর্থবছরের শুরুতে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে যে বরাদ্দ রাখা হয়, তার চেয়ে কমপক্ষে চার হাজার কোটি টাকা বেশি গুনতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে কয়েকটির মধ্যে সুদ পরিশোধ ব্যয় মোকাবিলাও একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছে অর্থ বিভাগ। সম্প্রতি অর্থনৈতিক কো-অডিনেন্স কাউন্সিল বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনায় উঠে আসে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বিদেশি ঋণ পরিশোধে যে ব্যয় বাড়ছে, তার বড় অংশই বিনিময় হারের সমন্বয় করতে হচ্ছে বলে এটা এড়ানো সম্ভব নয়, আবার এ কারণে খুব উদ্বিগ্ন হওয়ারও কারণ নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতা নিয়ে উদ্বেগের কারণ রয়েছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধে ডলারের প্রয়োজন রয়েছে, সমস্যাটা সেখানে। কারণ ডলার কিনতে টাকার দরকার; কিন্তু সরকারের রাজস্ব আহরণে সীমাবদ্ধতার কারণে এই কাজটিও চ্যালেঞ্জিং।

অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয় ২৬৭ কোটি ডলার। এর আগের অর্থবছরে এ অঙ্ক ছিল ২০৮ কোটি ডলার। ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে এক বছরের ব্যবধানে বেশি গুনতে হয় ৫৯ কোটি ডলার। সেখানে আরও বলা হয়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ ও সুদ পরিশোধে বরাদ্দ ছিল ২৭৯ কোটি ডলার।

সরকার দুটি খাত থেকে ঋণ করে ব্যয় পরিচালনা করে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বিদেশি ঋণ, অপরটি অভ্যন্তরীণ ঋণ (ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র)। ফলে বিদেশি ঋণ এবং ঋণের বিপরীতে যে সুদ আরোপিত হচ্ছে দুটোই পরিশোধ করতে হয় মার্কিন ডলারে। ফলে ডলারের মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক লেনদেনে খরচ বাড়ছে সরকারের। কারণ ডলার কিনতে সরকারকে বেশি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে।

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরী শুক্রবার জানান, বর্তমান বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। পাশাপাশি অনেক দ্বিপাক্ষিক ঋণ নেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ ঋণই দীর্ঘমেয়াদি নয়, স্বল্পমেয়াদি। অনেক ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। ফলে আগামী বছরগুলোতে বিদেশি ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ ব্যয় বাড়বে। ঋণ পরিশোধে কখনোই ব্যর্থ হয়নি সরকার। এসব ঋণের সুদ শোধ দিতে গিয়ে ব্যয় বাড়ছে। জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করা হয় ২০২২ সালের মার্চ ও এপ্রিলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ওই সময় এক ডলারের বিনিময় দর ছিল ৮৬ টাকা। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বাড়তে থাকে এই দর। বর্তমানে যা ২৮ শতাংশ বেড়ে, ১১০ টাকায় পৌঁছেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, টাকার মান কমার ফলেই বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের খরচ বাড়ছে। তাছাড়া বৈশ্বিক নানান কারণে বাজারভিত্তিক ঋণের সুদহারও বাড়ছে। এই ডলারের মূল্য ওই বছর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। আর এর প্রভাব গিয়ে পড়ে বৈদেশিক ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধের ক্ষেত্রে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, এসব কারণ ছাড়াও সহজ শর্তের ঋণের ছাড় কম হওয়া এবং বেশি সুদের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধির কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ায় বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেশি বাড়ছে। পাশাপাশি আছে চীন ও ভারত থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধের চাপ।

ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১১০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ। পরের ১০ বছরে অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে ২০১ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। মূলত চীনের ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ায় গত দু-তিন বছর ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়ছে। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে রাশিয়ার ঋণ। আর এই চাপ সামনে আরও বাড়বে। কেননা চলতি অর্থবছরেই চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প ও পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে।

এদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান দুর্বল হওয়ায় চলতি অর্থবছরে বিদেশি ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধে বাজেট বরাদ্দের চেয়ে সরকারের ব্যয় প্রায় ১১ শতাংশ বাড়বে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে অতিরিক্ত ৪ হাজার ২০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে এমনটি হিসাব করা হচ্ছে। এতে চলতি অর্থবছরে সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধের অঙ্ক দাঁড়াচ্ছে ৪১ হাজার ৯৬ কোটি টাকায়, অর্থাৎ আগের অর্থবছরের চেয়ে বাড়বে ৫২ শতাংশ। এর মধ্যে সুদ পরিশোধ করা হবে ১৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, বাকিটা বরাদ্দ থাকবে আসল পরিশোধে। আগের অর্থবছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধে ২৬ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।

অর্থনীতি

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন বা ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি অনুমোদন হয়েছে। আইএমএফ বোর্ডের এ অনুমোদনের ফলে ৬৮২ মিলিয়ন বা ৬৮ দশমিক ২ কোটি ডলার পাচ্ছে বাংলাদেশ।

সোমবার (১২ ডিসেম্বর) রাতে বিষয়টি জানান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। রাত সাড়ে ১২টায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা গাজী তৌহিদুল ইসলাম বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন।

আইএমএফ চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করে। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় এ ঋণ দেওয়া হয়। ঋণ অনুমোদনের পরপরই প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার ছাড় দেয় সংস্থাটি। ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে সাত কিস্তিতে পুরো অর্থ দেওয়ার কথা রয়েছে।

ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের জন্য জুনভিত্তিক বিভিন্ন সূচকে শর্ত পালনের অগ্রগতি দেখতে ৪ অক্টোবর আইএমএফের একটি মিশন ঢাকায় আসে। মিশনের নেতৃত্ব দেন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিশনকে জানানো হয়েছিল, অন্যান্য শর্তের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা কারণে রিজার্ভ এবং রাজস্ব আয় সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হয়নি। দেশের জাতীয় নির্বাচনের পর এ বিষয়ে জোরালো উদ্যোগ নেওয়া হবে। মিশনটি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের সঙ্গে টানা ১৬ দিন বৈঠক করে।

বৈঠক শেষে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়ে যায় আইএমএফ প্রতিনিধিদল। বলা হয়, আইএমএফের পরবর্তী বোর্ড সভায় কিস্তি অনুমোদন হবে। অর্থমন্ত্রী জানান, মঙ্গলবার সে অনুযায়ী দ্বিতীয় কিস্তির অনুমোদন করে আইএমএফ।

অর্থনীতি

দেশে বৈদেশিক ঋণ গত এক বছরে বেড়েছে ৩৪৯ কোটি ডলার। টাকার অঙ্কে যা ৩৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। গত বছরের (২০২২) জুনে মোট বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৯ হাজার ৫৪৫ কোটি ডলার। আর চলতি বছরের জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৮৯৪ কোটি ডলার। এই সময়ে ব্যাপকভাবে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরও পরিমাণ বেড়ে চলেছে। আলোচ্য সময়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছে, কমেছে স্বল্পমেয়াদি ঋণ।

রোববার প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বৈদেশিক ঋণ ও বিনিয়োগে গত জুন পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের (২০২২) জুনের তুলনায় চলতি বছরের জুনে দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়েছে। দেশে আসা সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই কমেছে। আর বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগের স্থিতিও সামান্য কমেছে।

গত বছরের (২০২২) জুনে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ছিল ৭ হাজার ৪৮০ কোটি ডলার। আর চলতি বছরের জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ২৯০ কোটি ডলার। গত বছরের (২০২২) জুনে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল ২ হাজার ৬৫ কোটি ডলার। আর চলতি বছরের জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬০৩ কোটি ডলার। সাম্প্রতিক সময়ে এ ঋণ আরও কমেছে।

সূত্র জানায়, গত দেড় বছর ধরে দেশে প্রকট ডলার সংকট চলছে। স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের কারণে এ সংকট আরও বেড়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে স্বল্পমেয়াদি ঋণ কমলেও এখন বেড়ে গেছে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। ফলে সার্বিকভাবে মোট বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়ে গেছে, যা পরিশোধে ডলারের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, বাজারে ডলারের প্রবাহ বেড়েছে। আগে যেসব ঘাটতি ছিল তা এখন কমে এসেছে। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধে ডলারের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে না।

প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বৈদেশিক ঋণ বাড়লেও প্রবৃদ্ধির হার কমেছে। ২০২১ সালের জুনে মোট ঋণ বেড়েছিল ১৯ শতাংশের বেশি। গত বছরের জুনে তা কমে ঋণ বৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ১৭ শতাংশে। চলতি বছরের জুনে তা আরও কমে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। গত বছরের (২০২২) জুনে তুলনায় চলতি বছরের জুনে স্বল্পমেয়াদি ঋণ কমেছে ২২ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ কমেছে প্রায় ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ। গত বছরের (২০২২) জুনে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেড়েছিল ৪৭ শতাংশ এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছিল ১১ শতাংশ।

প্রতিবেদনের তথ্যে আরও দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে এফডিআই এসেছিল ৩৪৪ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে এসেছে ৩২৫ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে এফডিআই কমেছে ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। মোট এফডিআইয়ের মধ্যে মাত্র ৮০ কোটি ডলার এসেছে বিদেশ থেকে পুঁজি হিসাবে। বাকি অর্থ দেশে কার্যরত বিদেশি কোম্পানিগুলোর মুনাফা থেকে পুনরায় বিনিয়োগ ও এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণ। দেশে ক্রিয়াশীল বিদেশি কোম্পানিগুলোর অর্জিত মুনাফা থেকে পুনরায় বিনিয়োগ হিসাবে এফডিআই এসেছে ২৩৭ কোটি ডলার। মাত্র ৮ কোটি ডলার এসেছে এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণ হিসাবে। গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি নিট পুঁজি এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৬ কোটি ডলার। সব মিলে এসেছে ২৯ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ এসেছিল ৬২ কোটি ডলার। আলোচ্য এক বছরের ব্যবধানে দেশটি থেকে বিনিয়োগ কমেছে।

বিদেশে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের স্থিতি গত বছরের জুনে ছিল ৪০ কোটি ডলার, চলতি বছরের জুনে তা সামান্য কমে ৩৮ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। আলোচ্য সময়ে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগের স্থিতি কমেছে ২ কোটি ডলার।

অর্থনীতি

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে বিদ্যমান দ্বন্ধের  কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প (আরএমজি) বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। একই সঙ্গে রয়েছে দেশের বাজারে বিভিন্ন জ্বালানি উপকরণের দাম বাড়ানো, আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দামে ব্যাপক ওঠানামা। এছাড়া করোনা মহামারির কারণে বিদেশি ক্রেতাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ভিয়েতনামের মুক্তবাণিজ্য চুক্তিও দেশের পোশাকশিল্পে চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জের কারণে দেশের পোশাক রপ্তানির ধারাবাহিকতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।

বৃহস্পতিবার রাতে প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি পর্যায়ে আরও কিছু চ্যালেঞ্জ আসছে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকার কারণে কিছু দেশে পোশাক রপ্তানিতে শুল্ক ও কোটা সুবিধা পাওয়া যায়। এ তালিকা থেকে বের হলে ওইসব সুবিধা আর মিলবে না। তখন উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা করে পোশাক রপ্তানি করতে হবে। তখন বাংলাদেশকে আরও কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে। সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে মধ্যম থেকে দীর্ঘ মেয়াদে সমাধান করতে হবে। এজন্য বাণিজ্য খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করার অঙ্গীকার করতে হবে। এর মধ্যে কিছু খাতে রপ্তানি ভর্তুকি প্রত্যাহার করতে হবে। বিনিয়োগনীতিতে সমন্বয়, মেধা সম্পত্তিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার নীতি জোরদার করতে হবে।

রপ্তানির প্রবৃদ্ধিনির্ভর করছে বৈশ্বিক পরিস্থিতির ওপর। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও এখন বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণের উচ্চ সুদের হার, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা, ভূরাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা, উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে দুর্বলতা এবং একটি জটিল আর্থিক পরিবেশ রপ্তানি খাতের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশাগুলোকে আগামীতে আরও কিছুটা সঙ্কুচিত করে দিতে পারে।

সূত্র জানায়, গত ২৮ অক্টোবর থেকেই দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়েছে। ওই সময় থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্র্যন্ত ২০ দিন হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। আগামী রবি ও সোমবারও অবরোধ ডাকা হয়েছে। এতে তৈরি পোশাকশিল্পের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে একদিকে উৎপাদন খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে পণ্য রপ্তানি করতে বাড়তি সময় লাগছে। যা ক্রেতাদের ভাবিয়ে তুলেছে। এ কারণে অনেক ক্রেতা রপ্তানির নতুন আদেশ দেওয়া কমিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমই্এ) পক্ষ থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিবর্তে সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বৈশ্বিক মন্দা ও দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ইতোমধ্যে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ ব্যবসা হারিয়েছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনে আরও খারাপ অবস্থা হবে।

ভ‚রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এখন জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি। দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি শীতল সম্পর্কের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর দ্বারা ইউরোপীয় ইউনিয়নও প্রভাবিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র শ্রমনীতি প্রয়োগের হুমকি দিয়েছে। এর দ্বারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে পোশাক রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

দেশের মোট পোশাক রপ্তানির ৮২ শতাংশ যাচ্ছে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে। এর মধ্যে এককভাবে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থাৎ ২২ শতাংশ। জার্মানিতে ১৩ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে সাড়ে ১২ শতাংশ পোশাক রপ্তানি হচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের পোশাকের বড় বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। এখানে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হলে এ শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমে যাবে। যা সামাজিক অস্থিরতাকে উসকে দিতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা।

এছাড়া অর্থনৈতিক খাতের চ্যালেঞ্জগুলোও বাড়ছে। দেশে ঋণের সুদ ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে সাড়ে ১১ শতাংশ হয়েছে। রপ্তানি ঋণের সুদ ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে সাড়ে ১০ শতাংশ হয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে কম সুদে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নেওয়ার সুযোগ সঙ্কুচিত হয়েছে। কারণ এ তহবিলের আকার ৭০০ কোটি ডলার থেকে কমিয়ে ৪০০ কোটি ডলারে নামিয়ে আনা হয়েছে। এর আকার আরও কমানো হচ্ছে। বৈশ্বিকভাবে সুদ বাড়ায় ও রিজার্ভ সংকটের কারণে বিদেশি ঋণ গ্রহণের সুযোগও সঙ্কুচিত হয়েছে। যে কারণে বিদেশি ঋণের প্রবাহও কমেছে। বৈশ্বিকভাবে সুদ ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ভ‚রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সব মিলে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত পোশাকশিল্পের ওপর এক ধরনের নেতিবাচক পরিস্থিতির আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী দেশ হচ্ছে ভিয়েতনাম। দেশটির সঙ্গে সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ফলে ভিয়েতনাম ইউরোপে পোশাক রপ্তানিতে বিশেষ সুবিধা পাবে। যেটি বাংলাদেশ পাবে না।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে তৈরি পোশাকের রপ্তানিকারকদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে আরএমজি সেক্টর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উলে­খযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। নারীর ক্ষমতায়নকে শক্তিশালী করা এবং বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়াতে বড় ভ‚মিকা রাখছে। এখন পর্র্যন্ত এ খাত থেকেই সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রার জোগান আসছে। যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে বড় ভ‚মিকা রাখছে।

গত অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপিতে পোশাকশিল্প খাত ১০ দশমিক ৩৫ শতাংশের মতো অবদান রেখেছিল। গত অর্থবছরে এ খাত থেকে মোট রপ্তানি আয় হয়েছিল ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলার। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশই আসে এ খাত থেকে। মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৭০ শতাংশই আসে পোশাক রপ্তানি থেকে।

এদিকে প্রতিবছরই পোশাকশিল্পে মূল্য সংযোজনের হার বাড়ছে। ২০২০ সালের জুলাই সেপ্টেম্বরে পোশাক খাতে নিট মূল্য সংযোজন ছিল ৬৫ শতাংশ। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১ শতাংশে।

আন্তর্জাতিক বড় ক্রেতাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ এখন রপ্তানির আদেশ বাড়াতে শুরু করেছে। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বিশ্বব্যাপী খ্যাতিমান ব্র্যান্ডগুলো আবার সক্রিয় হতে শুরু করেছে। এটি দেশের জন্য একটি সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে।

এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পোশাক তৈরিতে বৈচিত্র্য আনা, রপ্তানি আদেশ দেওয়ার পর দ্রুত সময়ে পণ্য জাহাজীকরণ, দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দ্রুত উৎপাদন ও খরচ কমানো, কার্যকর গবেষণা এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করা, রপ্তানি বাড়াতে নতুন বিশ্ববাজার খুঁজে বের করা, দক্ষ আরএমজি কর্মী বাহিনী এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আধুনিকীকরণ অগ্রাধিকারের ক্ষেত্র হওয়া উচিত। যাতে ভবিষ্যতে আরএমজি রপ্তানি আয়ে বিশ্বে তৈরি পোশাকের রপ্তানিকারকদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম থাকতে পারে।

অর্থনীতি

অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেশি কমেছে। অক্টোবরে রিজার্ভ কমেছিল ৪৯ কোটি ডলার। আর নভেম্বরে কমেছে ১২৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ, অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে রিজার্ভ কমেছে ৭৭ কোটি ডলার বেশি। নভেম্বরে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা বাবদ ১০০ কোটি ডলারের বেশি পরিশোধ করায় রিজার্ভ বেশি কমেছে।

বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৯৪০ কোটি ডলার। অক্টোবরের শেষে রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৬৬ কোটি ডলার। ওই ১ মাসে নিট রিজার্ভ কমেছে ১২৬ কোটি ডলার। একই সময়ে গ্রস রিজার্ভ কমেছে ১৪৬ কোটি ডলার। বৃহস্পতিবার গ্রস রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৫০২ কোটি ডলার। অক্টোবরের শেষে গ্রস রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৬৪৮ কোটি ডলার।

সূত্র জানায়, আমদানি ব্যয় ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। এর বিপরীতে রিজার্ভে অর্থ জমা হচ্ছে কম। যে কারণে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। এদিকে বৈশ্বিক মন্দায় রপ্তানি আয় কমছে। রেমিট্যান্স গত মাসে বাড়লেও এ মাসে আবার কমে যেতে পারে। কারণ ডলারের দাম কমানোর ফলে রেমিট্যান্স আসার প্রবাহ কমে গেছে।

এদিকে ডিসেম্বরে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি বাবদ ৬৮ কোটি ডলার ছাড় হতে পারে। এছাড়া বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকে আরও কিছু অর্থ ছাড় হবে। এসব মিলে ডিসেম্বরে রিজার্ভ কিছুটা বাড়তে পারে। তবে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আবার আকুর দেনা শোধ করতে হবে। তখন আবার রিজার্ভে চাপ বাড়বে।

সূত্র জানায়, ২৩ নভেম্বর নিট রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৯৫৩ কোটি ডলার। এ হিসাবে বৃহস্পতিবার ১ সপ্তাহে কমেছে ১৩ কোটি ডলার। ওই সময়ে গ্রস রিজার্ভ কমেছে ১৪ কোটি ডলার। এছাড়া রিজার্ভ থেকে ডলার নিয়ে গঠন করা বিভিন্ন তহবিলের আকার ছোট করা হচ্ছে। এতে গ্রস রিজার্ভ বেশি কমছে।

এদিকে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডলারের দাম দুদফায় ৭৫ পয়সা কমিয়েছে। ২৩ নভেম্বর প্রতি ডলারে ৫০ পয়সা ও রোববার থেকে ২৫ পয়সা কমিয়েছে। কিন্তু বাজারে ডলারের দাম কমছে না। উলটো আরও বাড়ছে। বৃহস্পতিবারও অনেক ব্যাংক সর্বোচ্চ ১২৩ টাকা করে রেমিট্যান্স কিনেছে। বেশি দামে ডলার কেনায় তারা আমদানিতেও বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে। ফলে ডলারের দাম কমানোর কোনো প্রভাব পড়ছে না বাজারে।

অর্থনীতি

মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ৫৭ হাজার কোটি টাকার আরোপিত সুদ আয় খাতে নিতে পারছে না। এসব অর্থ স্থগিত সুদ হিসাবে একটি আলাদা হিসাবে রাখা হয়েছে। বৈশ্বিক ও দেশীয় মন্দায় ব্যাংকগুলোর আয় কমছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের কারণে মোটা অঙ্কের সুদ আয় খাতে নিতে না পারায় ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমে যাচ্ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যাংক খাতের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে এসব তথ্য।

প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো যেসব সুদ নগদ আদায় করে এবং নিয়মিত ঋণের বিপরীতে যেসব সুদ আরোপিত হয়, সেগুলো আদায় না হলেও আয় খাতে দেখাতে পারে। কিন্তু কোনো ঋণ খেলাপি হলে তার বিপরীতে সুদ নগদ আদায় ছাড়া আয় খাতে নিতে পারে না। সেগুলোকে স্থগিত সুদ হিসাবে একটি আলাদা হিসাবে জমা রাখতে হয়। কেবল ওইসব সুদ নগদ আদায় হলেই আয় খাতে নিতে পারে। এছাড়া যেসব খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হবে, ওইসব সুদ আয় খাতে নেওয়া যাবে। এছাড়া আর কোনো সুদ আয় খাতে নেওয়া যাবে না। বর্তমানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো মোটা অঙ্কের সুদ আয় খাতে নিতে পারছে না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক খাতে সুশানের চরম সংকট। যাচাই-বাছাই ছাড়াই ক্ষমতাসীনদের চাপে বিতরণ করা হচ্ছে ঋণ। বিতরণ হলেও আদায়ের অঙ্ক অতি নগণ্য। অন্যদিকে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের শাস্তির আওতায় না এনে দেওয়া হচ্ছে নীতি সহায়তার আওতায় বিশেষ ছাড়। এ কারণে ক্রমেই বাড়ছে খেলাপি ঋণ। কমে যাচ্ছে ব্যাংকের আয়। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শেয়ারহোল্ডার ও আমানতকারীরা। এসব সমস্যা সমাধানে সুশাসন নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি বিদ্যমান আইনের বাস্তবায়ন খুবই জরুরি।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি প্রতিবেদনে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আরোপিত সুদের পরিমাণ ৫৬ হাজার ৮৪১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। কিন্তু এসব সুদ নগদ আদায় না হওয়ায় বা খেলাপি ঋণ নবায়ন না করায় এগুলো আয় খাতে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এগুলো স্থগিত নামে একটি আলাদা হিসাবে স্থানান্তর করে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকেরই আছে ২৫ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা, যা মোট স্থগিত সুদ আয়ের অর্ধেক। এ বিপুল আয় স্থগিত হয়ে যাওয়ায় কমে গেছে ব্যাংকের নিট আয়। এছাড়া সরকারি আরও দুটি বিশেষায়িত ব্যাংকের সুদ আয় স্থগিত করা হয় প্রায় ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বেসরকারি ৪৩ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের কারণে ২৮ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকার সুদ আয় স্থগিত রাখা হয়েছে।

খেলাপি ঋণের কারণে আরোপিত এসব সুদ ব্যাংকগুলো আয় খাতে নিতে পারছে না। অন্যদিকে এসব ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের অর্জিত মুনাফা থেকে প্রভিশন খাতে অর্থ জমা রাখতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলো দুভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

প্রচলিত বিধান অনুযায়ী, নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয়। এছাড়া খেলাপি ঋণের মধ্যে মন্দ ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণেল বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়।

নিয়মিত ও খেলাপি ঋণেল বিপরীতে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন রাখার কথা ১ লাখ ৬ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে প্রভিশন রাখা আছে ৮১ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। এ খাতে ঘাটতি ২৫ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। প্রভিশন ঘাটতি থাকার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো দুর্বলতার তালিকায় স্থান পেয়েছে। কারণ, ওইসব ব্যাংকের একদিকে খেলাপি ঋণ বেশি, অন্যদিকে তাদের আয় কম হওয়ায় রিজার্ভ তহবিলে অর্থ স্তানান্তর কম হচ্ছে। এসব কারণে তারা মুনাফা বা রিজার্ভ তহবিল থেকে অর্থ নিয়ে প্রভিশন করতে পারছে না।

অর্থনীতি

মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতি সুদহার বাড়ানোর একদিন পরই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদহার আরও বাড়ানোর নির্দেশনা জারি করল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এই দফায় নতুন ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সুদহার আরও দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়বে। ফলে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ। রপ্তানি ঋণের সুদহার হবে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ। ফলে রপ্তানি ঋণের সুদহার দীর্ঘ সময় পর ডাবল ডিজিট অতিক্রম করল।

একই সঙ্গে বাড়বে আমানতের সুদহারও। তবে আগে বিতরণ করা ঋণের সুদের হার অপরিবর্তিত থাকবে। সেগুলোর সুদহার ঋণ বিতরণের ছয় মাস পর থেকে ব্যাংকগুলো বাড়াতে পারবে।

এ বিষয়ে সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি সার্কুলার জারি করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এই বিধান মঙ্গলবার থেকে কার্যকর হবে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। এর মানেই হলো ঋণের সুদহার বাড়বে। বাজারে টাকার প্রবাহ কমবে। ঋণের সুদহার বাড়ানোর ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বিনিয়োগ কম হবে।

সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের শর্তে ঋণের সুদহারকে বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। এ কারণে বর্তমানে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে সরকারের ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদের হারের ভিত্তিতে। বর্তমানে ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

এর সঙ্গে ব্যাংকগুলো আগে সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ শতাংশ যোগ করে ঋণের সুদহার নির্ধারণ করত। ফলে আগে ঋণের সর্বোচ্চ সুদ ছিল ১০ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আজ মঙ্গলবার থেকে এ সুদ বেড়ে দাঁড়াবে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ।

একই সঙ্গে রপ্তানি ঋণের সুদহারও বাড়ানো হয়েছে। এ ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ট্রেজারি বিলের গড় সুদহারের সঙ্গে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ যোগ করতে হবে। ফলে আজ মঙ্গলবার থেকে এ ঋণের সুদহার বেড়ে দাঁড়াবে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ। আগে এর সুদহার ছিল সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ফলে রপ্তানি ঋণের সুদহার ডাবল ডিজিট অতিক্রম করল।

আগে রপ্তানি ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে ছিল দীর্ঘ সময়। রপ্তানি খাতকে সহায়তা করতে এর সুদের হার কম রাখা হতো। সাম্প্রতিক সময়ে আইএমএফের চাপ ও মূল্যস্ফীতির হার কমাতে রপ্তানি ঋণের সুদহারও বাড়ানো হয়েছে। কয়েক দফায় এর সুদহার বাড়িয়ে ডাবল ডিজিট অতিক্রম করল।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বৈশ্বিক মন্দায় এমনিতেই রপ্তানি খাত বড় ধরনের চাপে আছে।

এর মধ্যে রপ্তানি ঋণের সুদহার বাড়ানোর ফলে এ খাতে চাপ আরও বাড়বে। আগে রপ্তানি ঋণের সুদহার ছিল ৫ শতাংশ। পরে তা ধাপে ধাপে বাড়ানোর ফলে এখন ডাবল ডিজিট অতিক্রম করল। এতে রপ্তানি খাতের খরচ বাড়বে।

এদিকে ঋণের সুদহার বাড়ানো হলে আমানতের সুদহারও বাড়বে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদহার বাড়ানোর বিষয়ে কিছু বলেনি। তবে ব্যাংকগুলোতে এখন আমানতের প্রবাহ তুলনামূলকভাবে আগের চেয়ে কম। বাড়তি আমানত সংগ্রহ করার জন্য ব্যাংকগুলো এর সুদহারও বাড়াবে।

অর্থনীতি

কিছু ব্যাংকের কাছে ডলার সংকট থাকলেও সার্বিকভাবে দেশে ডলারের সংকট নেই। বেশিরভাগ ব্যাংকের কাছেই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার রয়েছে। এসব বিবেচনায় ব্যাংকগুলো ডলারের দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক।

তিনি জানান, বাফেদা রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও আমদানি সব ক্ষেত্রেই ডলারের দাম ৫০ পয়সা কমিয়েছে। এতে করে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশের টাকার মান বাড়বে। যেটা এতদিন ছিল উল্টো। আমদানি কমে যাওয়ার কারণে ডলার চাহিদা কমে এসেছে এবং আগামী বছরের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে বিল পরিশোধের চাপ একেবারে কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন ।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।

দেশের ডলার সংকট নিরসনে গৃহীত নানা পদক্ষেপের বিষয়ে জানাতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সাংবাদিকদেরে এক প্রশ্নের উত্তরে মেজবাউল হক জানান, বেশিরভাগ ব্যাংকের কাছেই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ডলার আছে।

পক্ষান্তরে সংকটেও রয়েছে কিছু ব্যাংক। এসব ব্যাংকের গ্রাহক চাইলে চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র খুলতে পারছেন না। তাই তারা বাধ্য হয়ে অন্য ব্যাংকের শরণাপন্ন হচ্ছেন। কতগুলো ব্যাংক সংকটে আছে জানতে চাইলে মুখপাত্র বলেন, ২১ ব্যাংকের ডলার সংকটে আছে। এর বিপরীতে ৩৯ ব্যাংকের কাছে পর্যাপ্ত ডলার মজুত রয়েছে ।

রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির প্রসঙ্গে মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে সরকার তার প্রয়োজনে ডলার নেয়। প্রয়োজন হলে দেশের স্বার্থে সেটা দিতে হয়। বন্ধ করার কোন সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, দেশের ডলার খরচের মূল খাত দুইটি। আমদানি মূল্য পরিশোধ করা এবং অন্যটি সেবামূল্য পরিশোধ। দুই জায়গাতে আমরা চাহিদা কমাতে সক্ষম হয়েছি। ইতোমধ্যে আমাদের ডলার পরিশোধের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা ইতোমধ্যে বেশ কিছু পণ্য আমদানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছি। পাশাপাশি এখন দীর্ঘমেয়াদি ঋণপত্র খোলার হার কমে গেছে। ব্যবসায়ীরা এখন যেসব ঋণপত্র খুলে তার বেশিরভাগই তাৎক্ষণিক। তাই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ডলার সংকটের পাশাপাশি দেশের মূল্যস্ফীতি ও নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

গতকাল বুধবার প্রতি ডলারে ৫০ পয়সা করে মূল্য কমিয়ে আমদানিতে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স ১১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকের সংগঠন বাফেদার যৌথ সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।