ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা গৌরবের এক অনন্য দিন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের এই দিনে ১৯ মিনিটের এক জাদুকরি ভাষণে বাঙালি জাতিকে স্বপ্নে বিভোর করেছিলেন। সেদিন তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান গর্জে উঠেছিল। উত্তাল জনসমুদ্রের গগনবিদারী স্লোগানের উদ্দামতায় বসন্তের মাতাল হাওয়ায় পত পত করে উড়ে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত লাল-সবুজের পতাকা। অগ্নিঝরা সেই দিনে স্বাধীনতার মহতী কাব্যের কবি হয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু। তার বজ কণ্ঠের নিনাদে বাংলার আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হলো- ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সেদিন শপথের বজ মুষ্টি উত্থিত হয়। সেদিন শুধু স্বাধীনতার চূড়ান্ত আহ্বানটি দিয়েই চুপ থাকেননি, স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখাও দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। মূলত সেই ভাষণই ছিল ৯ মাসব্যাপী বাংলার মুক্তি সংগ্রামের ঘোষণা ও মূল ভিত্তি।
কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণের মুহূর্তটি কবিতায় মূর্ত করেছেন। তিনি লিখেছেন- ‘একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য কি দারুণ অপেক্ষা আর উত্তেজনা নিয়ে/লক্ষ লক্ষ উন্মুক্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে/কখন আসবেন কবি?’/ …‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/…. কে রোধে তাঁহার বজ কণ্ঠ বাণী?/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি/এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।/সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং ১৪ দলের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বলেন, বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দেওয়ার পরে বাঙালি জাতি তাকে মুক্তির দূত এবং ৬ দফাকে মুক্তির সনদ হিসাবে গ্রহণ করেছিল। আগরতলা মামলা দেওয়ার পরে এটা আরও শানিত হয়। বাঙালির ধারণা ছিল তাদের কণ্ঠরোধ করার জন্যই শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে। তাই কারফিউ ভঙ্গ করে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। আইয়ুব খান বাধ্য হন বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্তে মুক্তি দিতে। তারই ধারাবাহিকতায় ৭ মার্চের ভাষণ এবং নির্বাচন এবং সেই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়। তিনি আরও বলেন, ৭ মার্চে বাঙালি ভাবটা এমন ছিল যে তারা রণাঙ্গনে যাচ্ছেন। এভাবেই জনতা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য এসেছিল। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে তিনটি অংশ তুলে ধরেছিলেন। প্রথম অংশে ছিল-পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসন-শোষণের ইতিহাস। দ্বিতীয় অংশে ছিল-১ তারিখ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত কিভাবে নির্বিচারে হত্যা ও নির্যাতন করা হয়েছে। তৃতীয় অংশে ছিল করণীয়। সেখানেই তিনি তার নির্দেশনাগুলো দিয়েছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ দিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করলেন। এটি শুধু একটি ভাষণই ছিল না, এর মাঝে কাব্যময়তা ছিল। মনে হচ্ছিল- কবিতার মতো তিনি বলে যাচ্ছেন, কিন্তু এই কবিতাটি তিনি নিজেই রচনা করছেন। এটার লিখিত কোনো কাগজ তার সামনে ছিল না। এমনকি ক্ষুদ্র নোটও ছিল না। ফলে বোঝা যায় তিনি অন্তর থেকে বলছেন। তিনি তার ভাষণে পাকিস্তানের শাসন-শোষণের কথা বললেন এবং বাঙালির করণীয় কী তাও বললেন। এজন্যই আন্তর্জাতিক নিউজউইকে পত্রিকা এর ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল ইস্যুকৃত সংখ্যার কভার স্টোরিতে বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ (রাজনীতির কবি) হিসেবে অভিহিত করেছিল।
আরেফিন সিদ্দিক আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্যই ভাষণ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই ছিল সেই সময়ের সাড়ে সাত কোটি মানুষের শপথ। ভাষণটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে গোটা জাতি শপথ নেয়। তিনি আরও বলেন, ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে জাতিসংঘের ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে কারণ-বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির আন্দোলন সামনে রেখে ভাষণটি দিলেও এটি সারা পৃথিবীর শোষিত, নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের মুক্তির মাইলফলক।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, বেলা ৩টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আরোহণ করেন। ফাগুনের সূর্য তখনও মাথার উপর। মঞ্চে আসার পর বঙ্গবন্ধু উপস্থিত জনতার উদ্দেশে হাত নাড়েন। তখন পুরো রেসকোর্স ময়দান লাখ লাখ বাঙালির ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব-শেখ মুজিব’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। প্রায় ১৯ মিনিটের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের পুরো ক্যানভাস তুলে ধরেন। বজ কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘সাত কোটি মানুষকে আর দাবায়ে রাখতে পারবা না। বাঙালি মরতে শিখেছে, তাদের কেউ দাবাতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
শহিদ জননী জাহানারা ইমামের লেখা একাত্তরের দিনলিপি গ্রন্থে ৭ মার্চের বর্ণনায় আছে, ‘রেসকোর্স মাঠের জনসভায় লোক হয়েছিল প্রায় তিরিশ লাখের মতো। কত দূরদূরান্ত থেকে যে লোক এসেছিল মিছিল করে, লাঠি আর রড ঘাড়ে করে- তার আর লেখাজোখা নেই। টঙ্গী, জয়দেবপুর, ডেমরা-এসব জায়গা থেকে তো বটেই, ২৪ ঘণ্টা হাঁটা পথ পেরিয়ে ঘোড়াশাল থেকেও বিরাট মিছিল এসেছিল গামছায় চিড়ে-গুড় বেঁধে। অন্ধ ছেলেদের মিছিল করে মিটিংয়ে যাওয়ার কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। বহু মহিলা, ছাত্রী মিছিল করে মাঠে গিয়েছিল শেখের বক্তৃতা শুনতে।’
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল, উজ্জ্বল প্রেরণাভূমি। কিন্তু ৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশে বারবার ইতিহাসের বিকৃতি ঘটেছে। নতুন প্রজন্মের কাছে প্রকৃত ইতিহাস লুকিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধূলিসাৎ করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্মকে বিকশিত করার উদ্যোগ নেয়। বঙ্গবন্ধু, ৭ মার্চ ও মহান স্বাধীনতার প্রকৃত সত্য তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ‘মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ বা ‘বিশ্বের স্মৃতি’ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো।
দিবসটি উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ কেবল আমাদের নয়, বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্যও প্রেরণার চিরন্তন উৎস হয়ে থাকবে। ৭ মার্চ বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় একটি দিন।
বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা নামের এক অমরবাণী শুনান এবং সংগ্রামের মাধ্যমে শৃঙ্খলমুক্তির পথ দেখান। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান এবং ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে অনুপ্রেরণা জোগাবে।
কর্মসূচি : এবারও দিনটি জাতীয় দিবস হিসাবে উদযাপন করা হবে। এ উপলক্ষ্যে কেন্দ্রে জেলা-উপজেলায় ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে আওয়ামী লীগ। ভোর সাড়ে ৬টায় বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় এবং দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। সকাল ৮টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা হবে। বিকাল ৩টায় আওয়ামী লীগের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আয়োজিত সভায় সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জি. মোশাররফ হোসেন এমপি। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।