সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রেখে ঘোষিত হাইকোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আবারও মাঠের আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা। গত ৭ ও ৮ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি দিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অচল করে দিয়েছে এই আন্দোলনকারীরা।
একইসাথে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট দিয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছেন তারা।
শুরুতে চার দফা দাবি নিয়ে নানা কর্মসূচি পালন করলেও ৭ জুলাই থেকে এক দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। আজ (৯ জুলাই) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এক দফা দাবির ব্যাখ্যা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয় স্পষ্ট করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সমম্বয়কারীরা।
তারা জানান, শুরুতে ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল, কমিশন গঠন করে করে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল, কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহারের সুযোগ না দেওয়াসহ ৪ দফা দাবিতে তারা আন্দোলন করেছেন। সেখানে শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী তথা ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডের কথা ছিল। তবে এখন আর ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল মূলকথা নয়। বরং ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীসহ সকল গ্রেডে ‘অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক’ কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লেখিত অনগ্রসর গোষ্ঠী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের কোটাকে ন্যায্যতার ভিত্তিতে ন্যূনতম পর্যায়ে এনে সংসদে আইন পাস করে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবি জানাচ্ছেন তারা।
তারা আরও জানান, এতদিন তারা আদালত থেকে সিদ্ধান্ত প্রত্যাশা করলেও নতুন দাবিতে আদালতের সম্পৃকতা নেই। বরং সরকারের নির্বাহী বিভাগের প্রতি তারা এই দাবি জানাচ্ছেন।
আন্দোলনের অন্যতম সমম্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা যে আন্দোলন করছি তা কোটা বাতিলের আন্দোলন নয়। বরং বাস্তবতার সাথে সমন্বয় রেখে কোটার যৌক্তিক সংস্কার আন্দোলন।
তিনি বলেন, এই আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিরোধিতা কী না-আমরা একাধিকবার এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। এই আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরোধিত নয়। মুক্তিযুদ্ধ যারা করেছে, তারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। বাংলাদেশকে যে ধারণ করে সে কখনো মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের প্রশ্নে আঙুল তুলতে পারে না। যারা আঙুল তোলে, তাদেরকে আমরা বাংলাদেশের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই।
‘মুক্তিযোদ্ধাদের পুরস্কার নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলিনি। সরকার যদি মুক্তিযোদ্ধাদের সুবিধা আরও বিস্তৃত করতে চায়, আমরা তা স্বাগত জানাব। বরং মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিদের যে কোটা দেওয়া হয়েছে, আমরা তার বিরোধিতা করছি। ’
৫ শতাংশ কোটা থাকা যৌক্তিক
শিক্ষার্থীদের দাবিতে ‘অনগ্রসর ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন গোষ্ঠী’ এবং কোটাকে ‘ন্যায্যতার ভিত্তিতে ন্যূনতম পর্যায়ে’ নিয়ে আসার শব্দবন্দ নিয়ে অস্পষ্টতা তৈরি হয়। শিক্ষার্থীরা কত শতাংশ কোটা চান, তা নিয়ে নানা মতও দেখা যায়।
কাদের জন্য কোটা প্রণয়ন করা যেতে পারে এবং কত শতাংশ হবে, এ নিয়ে হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, কোটাতে কাদের অন্তর্ভুক্ত করা যায় এ বিষয়ে আমরা শিক্ষক, নীতিনির্ধারক, আইনজ্ঞদের সাথে কথা বলেছি। গণমাধ্যমের সংবাদ বিশ্লেষণ ও টিভি-টকশো পর্যালোচনা করেছি। আমরা দেখেছি কোটা কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে হতে পারে। এই তিন ক্ষেত্র ছাড়া বাকি কোটাকে আমরা অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক বলে বিবেচনা করছি।
তিনি বলেন, কোটা কত শতাংশ হতে পারে, তা নিয়ে আমরা স্টেকহোল্ডারদের সাথে কথা বলেছি। আমরা মনে করছি ৫ শতাংশ কোটা ন্যূনতম এবং যৌক্তিক পর্যায়। সরকার যে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে সেখানে মেধাকেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। অর্থাৎ (সরকারি চাকরিতে) ৫ শতাংশ কোটা রাখা যেতে পারে।
তিনি বলেন, আমাদের এই আন্দোলন এখন গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। অভিভাবক-কৃষক-শ্রমিক-রেমিটেন্স যোদ্ধারা আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছেন। তারা চান, তাদের সন্তান যেন পড়াশোনা শেষে নিরাপদ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারে। তারা দেখেছেন, এক্ষেত্রে কোটা একটি বাধা।
‘এছাড়া বাংলাদেশের সচেতন মহল মেধাভিত্তিক স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে কোটাকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ২০২১ সালের এক বিবৃতিতে বুয়েট জানিয়েছে, কোটা প্রথা চালু করলে বুয়েটের শিক্ষার মান ব্যহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা এসব থেকে নিশ্চিত হতে পারি, কোটা মেধাকে অতিক্রম করে গেলে বাংলাদেশের মান ব্যহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ’
২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল হলেও আন্দোলন চলবে
এদিকে ২০১৮ সালের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সভাপতি আল সাদী ভুইয়া এবং উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী আহনাফ সাঈদ খান।
তবে এই রিটের সাথে আন্দোলনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে জানিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। একইসাথে আদালত থেকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসলেও এক দফা দাবিতে আন্দোলন চলমান থাকবে বলেও জানান তারা।
আন্দোলনের সমন্বয়কারী আসিফ মাহমুদ বলেন, দুজন শিক্ষার্থী যে রিট করেছে, তা নিয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই। তাদের আদালতে যাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। তারা ব্যাক্তিগতভাবে এই রিট করেছেন। এর সাথে আমাদের (বৈষম্যবিরোধী) ছাত্র আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই।
আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, আদালত যদি বুধবার পরিপত্র বহালও করে, তবুও আমাদের দাবি আদায় হচ্ছে না। আমরা সকল গ্রেডের চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি জানিয়েছি। ফলে মহামান্য হাইকোর্টের শুনানি থেকে আমাদের দাবি পূরণ সম্ভব নয়।
‘আমরা এতদিন ১ম ও ২য় শ্রেণিতে কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। তবে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণিতে বৈষম্য আরও বেশি। ২০১৮ সালের পরিপত্রে সমস্যা ছিল বলেই হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছে। ফলে এখন এটিকে বহাল করা হলেও ভবিষ্যতে যে পুনরায় অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
তিনি বলেন, এটা যেহেতু সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত। তাই আমরা নির্বাহী বিভাগ থেকে একটি সিদ্ধান্ত প্রত্যাশা করি। এটা হতে পারে কমিশন গঠন করার পরিপত্র। যদি লিখিত কোনো আশ্বাস দেওয়া হয়, তাহলে আমরা পড়ার টেবিলে ফিরে যাব।
সমম্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আদালতের প্রতি আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে। সরকার চাইলে (এক দফা দাবির উপর) নতুন পরিপত্র জারি করতে পারে। সে হিসেবে আমাদের আন্দোলন আর আদালতের প্রেক্ষাপটে নেই। আন্দোলন এখন নির্বাহী বিভাগ ও সরকারে প্রতি। যদি সরকার থেকে কোনো কমিশন গঠন করে কোটা সংস্কারের লিখিত পরিপত্র দেয়া হয়, তাহলেই আমরা আন্দোলন থেকে ফিরে আসব।
প্রসঙ্গত, সরকারি সকল গ্রেডের চাকরিতে কোটা প্রথাকে ৫ শতাংশে নামিয়ে এনে সংস্কারের দাবিতে আগামীকাল আবারও মাঠে নামছে শিক্ষার্থীরা। কাল সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করবেন। এদিন সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে শিক্ষার্থীরা জড়ো হবেন।