অর্থনীতি

গত অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ বাবদ বেশি গুনতে হয়েছে ৪৪ কোটি মার্কিন ডলার, দেশীয় মুদ্রায় চার হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। মূলত ডলারের ঊর্ধ্বমুখীর কারণে টাকার অবমূল্যায়ন এবং ঋণ পরিশোধের চাপ বৃদ্ধির ফলে এটি ঘটেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩০ শতাংশের মতো। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের ওপর। গেল (২০২২-২৩) অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে মোট ব্যয় হয় ৯৪ কোটি মার্কিন ডলার। এর আগের অর্থবছরে এ খাতে ব্যয়ের অঙ্ক ছিল ৫০ কোটি ডলার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে এ তথ্য।

সূত্রমতে, সুদ পরিশোধ ব্যয়ের চাপ চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরে থাকবে। অর্থবছরের শুরুতে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে যে বরাদ্দ রাখা হয়, তার চেয়ে কমপক্ষে চার হাজার কোটি টাকা বেশি গুনতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে কয়েকটির মধ্যে সুদ পরিশোধ ব্যয় মোকাবিলাও একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছে অর্থ বিভাগ। সম্প্রতি অর্থনৈতিক কো-অডিনেন্স কাউন্সিল বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনায় উঠে আসে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বিদেশি ঋণ পরিশোধে যে ব্যয় বাড়ছে, তার বড় অংশই বিনিময় হারের সমন্বয় করতে হচ্ছে বলে এটা এড়ানো সম্ভব নয়, আবার এ কারণে খুব উদ্বিগ্ন হওয়ারও কারণ নেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতা নিয়ে উদ্বেগের কারণ রয়েছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধে ডলারের প্রয়োজন রয়েছে, সমস্যাটা সেখানে। কারণ ডলার কিনতে টাকার দরকার; কিন্তু সরকারের রাজস্ব আহরণে সীমাবদ্ধতার কারণে এই কাজটিও চ্যালেঞ্জিং।

অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয় ২৬৭ কোটি ডলার। এর আগের অর্থবছরে এ অঙ্ক ছিল ২০৮ কোটি ডলার। ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে এক বছরের ব্যবধানে বেশি গুনতে হয় ৫৯ কোটি ডলার। সেখানে আরও বলা হয়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ ও সুদ পরিশোধে বরাদ্দ ছিল ২৭৯ কোটি ডলার।

সরকার দুটি খাত থেকে ঋণ করে ব্যয় পরিচালনা করে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বিদেশি ঋণ, অপরটি অভ্যন্তরীণ ঋণ (ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র)। ফলে বিদেশি ঋণ এবং ঋণের বিপরীতে যে সুদ আরোপিত হচ্ছে দুটোই পরিশোধ করতে হয় মার্কিন ডলারে। ফলে ডলারের মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক লেনদেনে খরচ বাড়ছে সরকারের। কারণ ডলার কিনতে সরকারকে বেশি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে।

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরী শুক্রবার জানান, বর্তমান বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। পাশাপাশি অনেক দ্বিপাক্ষিক ঋণ নেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ ঋণই দীর্ঘমেয়াদি নয়, স্বল্পমেয়াদি। অনেক ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। ফলে আগামী বছরগুলোতে বিদেশি ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ ব্যয় বাড়বে। ঋণ পরিশোধে কখনোই ব্যর্থ হয়নি সরকার। এসব ঋণের সুদ শোধ দিতে গিয়ে ব্যয় বাড়ছে। জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করা হয় ২০২২ সালের মার্চ ও এপ্রিলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ওই সময় এক ডলারের বিনিময় দর ছিল ৮৬ টাকা। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বাড়তে থাকে এই দর। বর্তমানে যা ২৮ শতাংশ বেড়ে, ১১০ টাকায় পৌঁছেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, টাকার মান কমার ফলেই বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের খরচ বাড়ছে। তাছাড়া বৈশ্বিক নানান কারণে বাজারভিত্তিক ঋণের সুদহারও বাড়ছে। এই ডলারের মূল্য ওই বছর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। আর এর প্রভাব গিয়ে পড়ে বৈদেশিক ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধের ক্ষেত্রে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, এসব কারণ ছাড়াও সহজ শর্তের ঋণের ছাড় কম হওয়া এবং বেশি সুদের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধির কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ায় বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেশি বাড়ছে। পাশাপাশি আছে চীন ও ভারত থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধের চাপ।

ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১১০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ। পরের ১০ বছরে অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে ২০১ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। মূলত চীনের ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ায় গত দু-তিন বছর ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়ছে। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে রাশিয়ার ঋণ। আর এই চাপ সামনে আরও বাড়বে। কেননা চলতি অর্থবছরেই চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প ও পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে।

এদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান দুর্বল হওয়ায় চলতি অর্থবছরে বিদেশি ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধে বাজেট বরাদ্দের চেয়ে সরকারের ব্যয় প্রায় ১১ শতাংশ বাড়বে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে অতিরিক্ত ৪ হাজার ২০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে এমনটি হিসাব করা হচ্ছে। এতে চলতি অর্থবছরে সরকারের বিদেশি ঋণ পরিশোধের অঙ্ক দাঁড়াচ্ছে ৪১ হাজার ৯৬ কোটি টাকায়, অর্থাৎ আগের অর্থবছরের চেয়ে বাড়বে ৫২ শতাংশ। এর মধ্যে সুদ পরিশোধ করা হবে ১৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, বাকিটা বরাদ্দ থাকবে আসল পরিশোধে। আগের অর্থবছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধে ২৬ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।

অর্থনীতি

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন বা ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি অনুমোদন হয়েছে। আইএমএফ বোর্ডের এ অনুমোদনের ফলে ৬৮২ মিলিয়ন বা ৬৮ দশমিক ২ কোটি ডলার পাচ্ছে বাংলাদেশ।

সোমবার (১২ ডিসেম্বর) রাতে বিষয়টি জানান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। রাত সাড়ে ১২টায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা গাজী তৌহিদুল ইসলাম বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন।

আইএমএফ চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করে। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় এ ঋণ দেওয়া হয়। ঋণ অনুমোদনের পরপরই প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার ছাড় দেয় সংস্থাটি। ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে সাত কিস্তিতে পুরো অর্থ দেওয়ার কথা রয়েছে।

ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের জন্য জুনভিত্তিক বিভিন্ন সূচকে শর্ত পালনের অগ্রগতি দেখতে ৪ অক্টোবর আইএমএফের একটি মিশন ঢাকায় আসে। মিশনের নেতৃত্ব দেন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিশনকে জানানো হয়েছিল, অন্যান্য শর্তের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা কারণে রিজার্ভ এবং রাজস্ব আয় সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হয়নি। দেশের জাতীয় নির্বাচনের পর এ বিষয়ে জোরালো উদ্যোগ নেওয়া হবে। মিশনটি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের সঙ্গে টানা ১৬ দিন বৈঠক করে।

বৈঠক শেষে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়ে যায় আইএমএফ প্রতিনিধিদল। বলা হয়, আইএমএফের পরবর্তী বোর্ড সভায় কিস্তি অনুমোদন হবে। অর্থমন্ত্রী জানান, মঙ্গলবার সে অনুযায়ী দ্বিতীয় কিস্তির অনুমোদন করে আইএমএফ।

অর্থনীতি

দেশে বৈদেশিক ঋণ গত এক বছরে বেড়েছে ৩৪৯ কোটি ডলার। টাকার অঙ্কে যা ৩৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। গত বছরের (২০২২) জুনে মোট বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৯ হাজার ৫৪৫ কোটি ডলার। আর চলতি বছরের জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৮৯৪ কোটি ডলার। এই সময়ে ব্যাপকভাবে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরও পরিমাণ বেড়ে চলেছে। আলোচ্য সময়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছে, কমেছে স্বল্পমেয়াদি ঋণ।

রোববার প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বৈদেশিক ঋণ ও বিনিয়োগে গত জুন পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের (২০২২) জুনের তুলনায় চলতি বছরের জুনে দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়েছে। দেশে আসা সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই কমেছে। আর বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগের স্থিতিও সামান্য কমেছে।

গত বছরের (২০২২) জুনে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ছিল ৭ হাজার ৪৮০ কোটি ডলার। আর চলতি বছরের জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ২৯০ কোটি ডলার। গত বছরের (২০২২) জুনে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল ২ হাজার ৬৫ কোটি ডলার। আর চলতি বছরের জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬০৩ কোটি ডলার। সাম্প্রতিক সময়ে এ ঋণ আরও কমেছে।

সূত্র জানায়, গত দেড় বছর ধরে দেশে প্রকট ডলার সংকট চলছে। স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের কারণে এ সংকট আরও বেড়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে স্বল্পমেয়াদি ঋণ কমলেও এখন বেড়ে গেছে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। ফলে সার্বিকভাবে মোট বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়ে গেছে, যা পরিশোধে ডলারের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, বাজারে ডলারের প্রবাহ বেড়েছে। আগে যেসব ঘাটতি ছিল তা এখন কমে এসেছে। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধে ডলারের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে না।

প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বৈদেশিক ঋণ বাড়লেও প্রবৃদ্ধির হার কমেছে। ২০২১ সালের জুনে মোট ঋণ বেড়েছিল ১৯ শতাংশের বেশি। গত বছরের জুনে তা কমে ঋণ বৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ১৭ শতাংশে। চলতি বছরের জুনে তা আরও কমে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। গত বছরের (২০২২) জুনে তুলনায় চলতি বছরের জুনে স্বল্পমেয়াদি ঋণ কমেছে ২২ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ কমেছে প্রায় ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ। গত বছরের (২০২২) জুনে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেড়েছিল ৪৭ শতাংশ এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছিল ১১ শতাংশ।

প্রতিবেদনের তথ্যে আরও দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে এফডিআই এসেছিল ৩৪৪ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে এসেছে ৩২৫ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে এফডিআই কমেছে ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। মোট এফডিআইয়ের মধ্যে মাত্র ৮০ কোটি ডলার এসেছে বিদেশ থেকে পুঁজি হিসাবে। বাকি অর্থ দেশে কার্যরত বিদেশি কোম্পানিগুলোর মুনাফা থেকে পুনরায় বিনিয়োগ ও এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণ। দেশে ক্রিয়াশীল বিদেশি কোম্পানিগুলোর অর্জিত মুনাফা থেকে পুনরায় বিনিয়োগ হিসাবে এফডিআই এসেছে ২৩৭ কোটি ডলার। মাত্র ৮ কোটি ডলার এসেছে এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণ হিসাবে। গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি নিট পুঁজি এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৬ কোটি ডলার। সব মিলে এসেছে ২৯ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ এসেছিল ৬২ কোটি ডলার। আলোচ্য এক বছরের ব্যবধানে দেশটি থেকে বিনিয়োগ কমেছে।

বিদেশে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের স্থিতি গত বছরের জুনে ছিল ৪০ কোটি ডলার, চলতি বছরের জুনে তা সামান্য কমে ৩৮ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। আলোচ্য সময়ে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগের স্থিতি কমেছে ২ কোটি ডলার।

অর্থনীতি

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে বিদ্যমান দ্বন্ধের  কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প (আরএমজি) বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। একই সঙ্গে রয়েছে দেশের বাজারে বিভিন্ন জ্বালানি উপকরণের দাম বাড়ানো, আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দামে ব্যাপক ওঠানামা। এছাড়া করোনা মহামারির কারণে বিদেশি ক্রেতাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ভিয়েতনামের মুক্তবাণিজ্য চুক্তিও দেশের পোশাকশিল্পে চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জের কারণে দেশের পোশাক রপ্তানির ধারাবাহিকতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।

বৃহস্পতিবার রাতে প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি পর্যায়ে আরও কিছু চ্যালেঞ্জ আসছে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকার কারণে কিছু দেশে পোশাক রপ্তানিতে শুল্ক ও কোটা সুবিধা পাওয়া যায়। এ তালিকা থেকে বের হলে ওইসব সুবিধা আর মিলবে না। তখন উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা করে পোশাক রপ্তানি করতে হবে। তখন বাংলাদেশকে আরও কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে। সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে মধ্যম থেকে দীর্ঘ মেয়াদে সমাধান করতে হবে। এজন্য বাণিজ্য খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করার অঙ্গীকার করতে হবে। এর মধ্যে কিছু খাতে রপ্তানি ভর্তুকি প্রত্যাহার করতে হবে। বিনিয়োগনীতিতে সমন্বয়, মেধা সম্পত্তিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার নীতি জোরদার করতে হবে।

রপ্তানির প্রবৃদ্ধিনির্ভর করছে বৈশ্বিক পরিস্থিতির ওপর। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও এখন বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণের উচ্চ সুদের হার, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা, ভূরাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা, উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে দুর্বলতা এবং একটি জটিল আর্থিক পরিবেশ রপ্তানি খাতের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশাগুলোকে আগামীতে আরও কিছুটা সঙ্কুচিত করে দিতে পারে।

সূত্র জানায়, গত ২৮ অক্টোবর থেকেই দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়েছে। ওই সময় থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্র্যন্ত ২০ দিন হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। আগামী রবি ও সোমবারও অবরোধ ডাকা হয়েছে। এতে তৈরি পোশাকশিল্পের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে একদিকে উৎপাদন খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে পণ্য রপ্তানি করতে বাড়তি সময় লাগছে। যা ক্রেতাদের ভাবিয়ে তুলেছে। এ কারণে অনেক ক্রেতা রপ্তানির নতুন আদেশ দেওয়া কমিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমই্এ) পক্ষ থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিবর্তে সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বৈশ্বিক মন্দা ও দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ইতোমধ্যে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ ব্যবসা হারিয়েছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনে আরও খারাপ অবস্থা হবে।

ভ‚রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এখন জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি। দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি শীতল সম্পর্কের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর দ্বারা ইউরোপীয় ইউনিয়নও প্রভাবিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র শ্রমনীতি প্রয়োগের হুমকি দিয়েছে। এর দ্বারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে পোশাক রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

দেশের মোট পোশাক রপ্তানির ৮২ শতাংশ যাচ্ছে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে। এর মধ্যে এককভাবে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থাৎ ২২ শতাংশ। জার্মানিতে ১৩ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে সাড়ে ১২ শতাংশ পোশাক রপ্তানি হচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের পোশাকের বড় বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। এখানে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হলে এ শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমে যাবে। যা সামাজিক অস্থিরতাকে উসকে দিতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা।

এছাড়া অর্থনৈতিক খাতের চ্যালেঞ্জগুলোও বাড়ছে। দেশে ঋণের সুদ ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে সাড়ে ১১ শতাংশ হয়েছে। রপ্তানি ঋণের সুদ ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে সাড়ে ১০ শতাংশ হয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে কম সুদে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নেওয়ার সুযোগ সঙ্কুচিত হয়েছে। কারণ এ তহবিলের আকার ৭০০ কোটি ডলার থেকে কমিয়ে ৪০০ কোটি ডলারে নামিয়ে আনা হয়েছে। এর আকার আরও কমানো হচ্ছে। বৈশ্বিকভাবে সুদ বাড়ায় ও রিজার্ভ সংকটের কারণে বিদেশি ঋণ গ্রহণের সুযোগও সঙ্কুচিত হয়েছে। যে কারণে বিদেশি ঋণের প্রবাহও কমেছে। বৈশ্বিকভাবে সুদ ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ভ‚রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সব মিলে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত পোশাকশিল্পের ওপর এক ধরনের নেতিবাচক পরিস্থিতির আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী দেশ হচ্ছে ভিয়েতনাম। দেশটির সঙ্গে সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ফলে ভিয়েতনাম ইউরোপে পোশাক রপ্তানিতে বিশেষ সুবিধা পাবে। যেটি বাংলাদেশ পাবে না।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে তৈরি পোশাকের রপ্তানিকারকদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে আরএমজি সেক্টর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উলে­খযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। নারীর ক্ষমতায়নকে শক্তিশালী করা এবং বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়াতে বড় ভ‚মিকা রাখছে। এখন পর্র্যন্ত এ খাত থেকেই সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রার জোগান আসছে। যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে বড় ভ‚মিকা রাখছে।

গত অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপিতে পোশাকশিল্প খাত ১০ দশমিক ৩৫ শতাংশের মতো অবদান রেখেছিল। গত অর্থবছরে এ খাত থেকে মোট রপ্তানি আয় হয়েছিল ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলার। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশই আসে এ খাত থেকে। মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৭০ শতাংশই আসে পোশাক রপ্তানি থেকে।

এদিকে প্রতিবছরই পোশাকশিল্পে মূল্য সংযোজনের হার বাড়ছে। ২০২০ সালের জুলাই সেপ্টেম্বরে পোশাক খাতে নিট মূল্য সংযোজন ছিল ৬৫ শতাংশ। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১ শতাংশে।

আন্তর্জাতিক বড় ক্রেতাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ এখন রপ্তানির আদেশ বাড়াতে শুরু করেছে। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বিশ্বব্যাপী খ্যাতিমান ব্র্যান্ডগুলো আবার সক্রিয় হতে শুরু করেছে। এটি দেশের জন্য একটি সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে।

এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পোশাক তৈরিতে বৈচিত্র্য আনা, রপ্তানি আদেশ দেওয়ার পর দ্রুত সময়ে পণ্য জাহাজীকরণ, দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দ্রুত উৎপাদন ও খরচ কমানো, কার্যকর গবেষণা এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করা, রপ্তানি বাড়াতে নতুন বিশ্ববাজার খুঁজে বের করা, দক্ষ আরএমজি কর্মী বাহিনী এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আধুনিকীকরণ অগ্রাধিকারের ক্ষেত্র হওয়া উচিত। যাতে ভবিষ্যতে আরএমজি রপ্তানি আয়ে বিশ্বে তৈরি পোশাকের রপ্তানিকারকদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম থাকতে পারে।

অর্থনীতি

অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেশি কমেছে। অক্টোবরে রিজার্ভ কমেছিল ৪৯ কোটি ডলার। আর নভেম্বরে কমেছে ১২৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ, অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে রিজার্ভ কমেছে ৭৭ কোটি ডলার বেশি। নভেম্বরে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা বাবদ ১০০ কোটি ডলারের বেশি পরিশোধ করায় রিজার্ভ বেশি কমেছে।

বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৯৪০ কোটি ডলার। অক্টোবরের শেষে রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৬৬ কোটি ডলার। ওই ১ মাসে নিট রিজার্ভ কমেছে ১২৬ কোটি ডলার। একই সময়ে গ্রস রিজার্ভ কমেছে ১৪৬ কোটি ডলার। বৃহস্পতিবার গ্রস রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৫০২ কোটি ডলার। অক্টোবরের শেষে গ্রস রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৬৪৮ কোটি ডলার।

সূত্র জানায়, আমদানি ব্যয় ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। এর বিপরীতে রিজার্ভে অর্থ জমা হচ্ছে কম। যে কারণে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। এদিকে বৈশ্বিক মন্দায় রপ্তানি আয় কমছে। রেমিট্যান্স গত মাসে বাড়লেও এ মাসে আবার কমে যেতে পারে। কারণ ডলারের দাম কমানোর ফলে রেমিট্যান্স আসার প্রবাহ কমে গেছে।

এদিকে ডিসেম্বরে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি বাবদ ৬৮ কোটি ডলার ছাড় হতে পারে। এছাড়া বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকে আরও কিছু অর্থ ছাড় হবে। এসব মিলে ডিসেম্বরে রিজার্ভ কিছুটা বাড়তে পারে। তবে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আবার আকুর দেনা শোধ করতে হবে। তখন আবার রিজার্ভে চাপ বাড়বে।

সূত্র জানায়, ২৩ নভেম্বর নিট রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৯৫৩ কোটি ডলার। এ হিসাবে বৃহস্পতিবার ১ সপ্তাহে কমেছে ১৩ কোটি ডলার। ওই সময়ে গ্রস রিজার্ভ কমেছে ১৪ কোটি ডলার। এছাড়া রিজার্ভ থেকে ডলার নিয়ে গঠন করা বিভিন্ন তহবিলের আকার ছোট করা হচ্ছে। এতে গ্রস রিজার্ভ বেশি কমছে।

এদিকে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডলারের দাম দুদফায় ৭৫ পয়সা কমিয়েছে। ২৩ নভেম্বর প্রতি ডলারে ৫০ পয়সা ও রোববার থেকে ২৫ পয়সা কমিয়েছে। কিন্তু বাজারে ডলারের দাম কমছে না। উলটো আরও বাড়ছে। বৃহস্পতিবারও অনেক ব্যাংক সর্বোচ্চ ১২৩ টাকা করে রেমিট্যান্স কিনেছে। বেশি দামে ডলার কেনায় তারা আমদানিতেও বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে। ফলে ডলারের দাম কমানোর কোনো প্রভাব পড়ছে না বাজারে।

অর্থনীতি

মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ৫৭ হাজার কোটি টাকার আরোপিত সুদ আয় খাতে নিতে পারছে না। এসব অর্থ স্থগিত সুদ হিসাবে একটি আলাদা হিসাবে রাখা হয়েছে। বৈশ্বিক ও দেশীয় মন্দায় ব্যাংকগুলোর আয় কমছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের কারণে মোটা অঙ্কের সুদ আয় খাতে নিতে না পারায় ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমে যাচ্ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যাংক খাতের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে এসব তথ্য।

প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো যেসব সুদ নগদ আদায় করে এবং নিয়মিত ঋণের বিপরীতে যেসব সুদ আরোপিত হয়, সেগুলো আদায় না হলেও আয় খাতে দেখাতে পারে। কিন্তু কোনো ঋণ খেলাপি হলে তার বিপরীতে সুদ নগদ আদায় ছাড়া আয় খাতে নিতে পারে না। সেগুলোকে স্থগিত সুদ হিসাবে একটি আলাদা হিসাবে জমা রাখতে হয়। কেবল ওইসব সুদ নগদ আদায় হলেই আয় খাতে নিতে পারে। এছাড়া যেসব খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হবে, ওইসব সুদ আয় খাতে নেওয়া যাবে। এছাড়া আর কোনো সুদ আয় খাতে নেওয়া যাবে না। বর্তমানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো মোটা অঙ্কের সুদ আয় খাতে নিতে পারছে না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক খাতে সুশানের চরম সংকট। যাচাই-বাছাই ছাড়াই ক্ষমতাসীনদের চাপে বিতরণ করা হচ্ছে ঋণ। বিতরণ হলেও আদায়ের অঙ্ক অতি নগণ্য। অন্যদিকে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের শাস্তির আওতায় না এনে দেওয়া হচ্ছে নীতি সহায়তার আওতায় বিশেষ ছাড়। এ কারণে ক্রমেই বাড়ছে খেলাপি ঋণ। কমে যাচ্ছে ব্যাংকের আয়। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শেয়ারহোল্ডার ও আমানতকারীরা। এসব সমস্যা সমাধানে সুশাসন নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি বিদ্যমান আইনের বাস্তবায়ন খুবই জরুরি।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি প্রতিবেদনে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আরোপিত সুদের পরিমাণ ৫৬ হাজার ৮৪১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। কিন্তু এসব সুদ নগদ আদায় না হওয়ায় বা খেলাপি ঋণ নবায়ন না করায় এগুলো আয় খাতে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এগুলো স্থগিত নামে একটি আলাদা হিসাবে স্থানান্তর করে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকেরই আছে ২৫ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা, যা মোট স্থগিত সুদ আয়ের অর্ধেক। এ বিপুল আয় স্থগিত হয়ে যাওয়ায় কমে গেছে ব্যাংকের নিট আয়। এছাড়া সরকারি আরও দুটি বিশেষায়িত ব্যাংকের সুদ আয় স্থগিত করা হয় প্রায় ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বেসরকারি ৪৩ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের কারণে ২৮ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকার সুদ আয় স্থগিত রাখা হয়েছে।

খেলাপি ঋণের কারণে আরোপিত এসব সুদ ব্যাংকগুলো আয় খাতে নিতে পারছে না। অন্যদিকে এসব ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের অর্জিত মুনাফা থেকে প্রভিশন খাতে অর্থ জমা রাখতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলো দুভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

প্রচলিত বিধান অনুযায়ী, নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয়। এছাড়া খেলাপি ঋণের মধ্যে মন্দ ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণেল বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়।

নিয়মিত ও খেলাপি ঋণেল বিপরীতে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন রাখার কথা ১ লাখ ৬ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে প্রভিশন রাখা আছে ৮১ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। এ খাতে ঘাটতি ২৫ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। প্রভিশন ঘাটতি থাকার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো দুর্বলতার তালিকায় স্থান পেয়েছে। কারণ, ওইসব ব্যাংকের একদিকে খেলাপি ঋণ বেশি, অন্যদিকে তাদের আয় কম হওয়ায় রিজার্ভ তহবিলে অর্থ স্তানান্তর কম হচ্ছে। এসব কারণে তারা মুনাফা বা রিজার্ভ তহবিল থেকে অর্থ নিয়ে প্রভিশন করতে পারছে না।

অর্থনীতি

মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতি সুদহার বাড়ানোর একদিন পরই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদহার আরও বাড়ানোর নির্দেশনা জারি করল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এই দফায় নতুন ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সুদহার আরও দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়বে। ফলে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ। রপ্তানি ঋণের সুদহার হবে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ। ফলে রপ্তানি ঋণের সুদহার দীর্ঘ সময় পর ডাবল ডিজিট অতিক্রম করল।

একই সঙ্গে বাড়বে আমানতের সুদহারও। তবে আগে বিতরণ করা ঋণের সুদের হার অপরিবর্তিত থাকবে। সেগুলোর সুদহার ঋণ বিতরণের ছয় মাস পর থেকে ব্যাংকগুলো বাড়াতে পারবে।

এ বিষয়ে সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি সার্কুলার জারি করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এই বিধান মঙ্গলবার থেকে কার্যকর হবে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। এর মানেই হলো ঋণের সুদহার বাড়বে। বাজারে টাকার প্রবাহ কমবে। ঋণের সুদহার বাড়ানোর ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বিনিয়োগ কম হবে।

সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের শর্তে ঋণের সুদহারকে বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। এ কারণে বর্তমানে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে সরকারের ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদের হারের ভিত্তিতে। বর্তমানে ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

এর সঙ্গে ব্যাংকগুলো আগে সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ শতাংশ যোগ করে ঋণের সুদহার নির্ধারণ করত। ফলে আগে ঋণের সর্বোচ্চ সুদ ছিল ১০ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আজ মঙ্গলবার থেকে এ সুদ বেড়ে দাঁড়াবে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ।

একই সঙ্গে রপ্তানি ঋণের সুদহারও বাড়ানো হয়েছে। এ ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ট্রেজারি বিলের গড় সুদহারের সঙ্গে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ যোগ করতে হবে। ফলে আজ মঙ্গলবার থেকে এ ঋণের সুদহার বেড়ে দাঁড়াবে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ। আগে এর সুদহার ছিল সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ফলে রপ্তানি ঋণের সুদহার ডাবল ডিজিট অতিক্রম করল।

আগে রপ্তানি ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে ছিল দীর্ঘ সময়। রপ্তানি খাতকে সহায়তা করতে এর সুদের হার কম রাখা হতো। সাম্প্রতিক সময়ে আইএমএফের চাপ ও মূল্যস্ফীতির হার কমাতে রপ্তানি ঋণের সুদহারও বাড়ানো হয়েছে। কয়েক দফায় এর সুদহার বাড়িয়ে ডাবল ডিজিট অতিক্রম করল।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বৈশ্বিক মন্দায় এমনিতেই রপ্তানি খাত বড় ধরনের চাপে আছে।

এর মধ্যে রপ্তানি ঋণের সুদহার বাড়ানোর ফলে এ খাতে চাপ আরও বাড়বে। আগে রপ্তানি ঋণের সুদহার ছিল ৫ শতাংশ। পরে তা ধাপে ধাপে বাড়ানোর ফলে এখন ডাবল ডিজিট অতিক্রম করল। এতে রপ্তানি খাতের খরচ বাড়বে।

এদিকে ঋণের সুদহার বাড়ানো হলে আমানতের সুদহারও বাড়বে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদহার বাড়ানোর বিষয়ে কিছু বলেনি। তবে ব্যাংকগুলোতে এখন আমানতের প্রবাহ তুলনামূলকভাবে আগের চেয়ে কম। বাড়তি আমানত সংগ্রহ করার জন্য ব্যাংকগুলো এর সুদহারও বাড়াবে।

অর্থনীতি

কিছু ব্যাংকের কাছে ডলার সংকট থাকলেও সার্বিকভাবে দেশে ডলারের সংকট নেই। বেশিরভাগ ব্যাংকের কাছেই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার রয়েছে। এসব বিবেচনায় ব্যাংকগুলো ডলারের দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক।

তিনি জানান, বাফেদা রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও আমদানি সব ক্ষেত্রেই ডলারের দাম ৫০ পয়সা কমিয়েছে। এতে করে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশের টাকার মান বাড়বে। যেটা এতদিন ছিল উল্টো। আমদানি কমে যাওয়ার কারণে ডলার চাহিদা কমে এসেছে এবং আগামী বছরের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে বিল পরিশোধের চাপ একেবারে কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন ।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।

দেশের ডলার সংকট নিরসনে গৃহীত নানা পদক্ষেপের বিষয়ে জানাতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সাংবাদিকদেরে এক প্রশ্নের উত্তরে মেজবাউল হক জানান, বেশিরভাগ ব্যাংকের কাছেই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ডলার আছে।

পক্ষান্তরে সংকটেও রয়েছে কিছু ব্যাংক। এসব ব্যাংকের গ্রাহক চাইলে চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র খুলতে পারছেন না। তাই তারা বাধ্য হয়ে অন্য ব্যাংকের শরণাপন্ন হচ্ছেন। কতগুলো ব্যাংক সংকটে আছে জানতে চাইলে মুখপাত্র বলেন, ২১ ব্যাংকের ডলার সংকটে আছে। এর বিপরীতে ৩৯ ব্যাংকের কাছে পর্যাপ্ত ডলার মজুত রয়েছে ।

রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির প্রসঙ্গে মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে সরকার তার প্রয়োজনে ডলার নেয়। প্রয়োজন হলে দেশের স্বার্থে সেটা দিতে হয়। বন্ধ করার কোন সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, দেশের ডলার খরচের মূল খাত দুইটি। আমদানি মূল্য পরিশোধ করা এবং অন্যটি সেবামূল্য পরিশোধ। দুই জায়গাতে আমরা চাহিদা কমাতে সক্ষম হয়েছি। ইতোমধ্যে আমাদের ডলার পরিশোধের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা ইতোমধ্যে বেশ কিছু পণ্য আমদানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছি। পাশাপাশি এখন দীর্ঘমেয়াদি ঋণপত্র খোলার হার কমে গেছে। ব্যবসায়ীরা এখন যেসব ঋণপত্র খুলে তার বেশিরভাগই তাৎক্ষণিক। তাই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ডলার সংকটের পাশাপাশি দেশের মূল্যস্ফীতি ও নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

গতকাল বুধবার প্রতি ডলারে ৫০ পয়সা করে মূল্য কমিয়ে আমদানিতে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স ১১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকের সংগঠন বাফেদার যৌথ সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।

অর্থনীতি

বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বহুমুখী বৈদেশিক বাণিজ্য কমতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি এবং বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি কমেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহও কমে শীর্ষ থেকে চতুর্থ অবস্থানে নেমেছে। কমে গেছে বৈদেশিক অনুদান আসার প্রবণতাও।

পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগও কমেছে। সামগ্রিকভাবে কমেছে দেশটি থেকে বাংলাদেশের ঋণ পাওয়ার প্রবণতাও। এর মধ্যেও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ কমছে, সামান্য বেড়েছে স্বল্পমেয়াদি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি বিভিন্ন প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। মানবাধিকার ও নির্বাচন ইস্যুতে ইতোমধ্যে ভিসানীতি আরোপ করেছে। এর পাশাপাশি শ্রমিক অধিকার হরণ করলে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে বলে হুমকি দিয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য হ্রাস পাওয়ার অনেক কারণের মধ্যে ওইসব বিষয়ও জড়িত। একক দেশ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের উৎস। দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। রেমিট্যান্স আহরণের শীর্ষ দেশ ছিল এক সময়। এছাড়া বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগে দেশটির অবস্থান শীর্ষ কাতারে রয়েছে। পাশাপাশি অনুদান থেকেও বৈদেশিক মুদ্রা আসে। বৈদেশিক ঋণের অন্যতম উৎস যুক্তরাষ্ট্র। এসব খাতে দেশটি থেকে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ কমে গেলে বাংলাদেশে ডলারের প্রবাহে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। হঠাৎ করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বিকল্প উৎস খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। তখন ডলার সংকট আরও প্রকট হবে। দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে এর ভয়ানক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, একতরফা নির্বাচন বিদেশিরা মেনে নেবে না। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে শুধু অর্থনৈতিক বিষয়ই নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রে নানা ধরনের বাধা আসতে পারে। বড় কোনো দেশ থেকে এ ধরনের বাধা এলে অর্থনীতির ক্ষতি হবে। দেশের ইমেজ নষ্ট হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ৫১ কোটি ১৭ লাখ ডলার। যা মোট রেমিট্যান্সের ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ এবং মোট রেমিট্যান্স আসার মধ্যে অবস্থান চতুর্থ। গত অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স আহরণে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল শীর্ষে। আলোচ্য সময়ে শীর্ষ অবস্থান থেকে নেমে গেছে চতুর্থ অবস্থানে। গত অর্থবছরের একই সময়ে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ৯৯ কোটি ৯৮ লাখ ডলার। ওই সময়ে যা মোট রেমিট্যান্সের ১৭ দশমিক ২ শতাংশ ছিল। ওই সময়ের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আসা কমেছে ৪৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ৯৯ কোটি ৯৮ লাখ ডলার, অক্টোবর-ডিসেম্বরে এসেছে ৯৬ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিলে ৮৩ কোটি ৪৫ লাখ ডলার, এপ্রিল-জুনে ৭২ কোটি ৮ লাখ ডলার ও জুলাই-সেপ্টেম্বরে এসেছে ৫১ কোটি ১৭ লাখ ডলার। প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী প্রতি প্রান্তিকেই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৬৯ কোটি ডলার, যা মোট রেমিট্যান্সের ১৩ দশমিক ২৩ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আসে ১২০ কোটি ডলার, যা মোট রেমিট্যান্সের ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আসে ১৮৪ কোটি ডলার, যা মোট রেমিট্যান্সের ১১ দশমিক ২২ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছিল ২৪০ কোটি ডলার, যা মোট রেমিট্যান্সের ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৪৬ কোটি ডলার, যা মোট রেমিট্যান্সের ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছে ৩৪৪ কোটি ডলার, যা মোট রেমিট্যান্সের ১৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসেছে ৩৫২ কোটি ডলার, যা মোট রেমিট্যান্সের ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ গত ৬ বছরে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। এখন সেখান থেকে কমছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে ২৮৭ কোটি ডলার। এর মধ্যে জুনে ৮৭ কোটি ডলার, জুলাইয়ে ৮১ কোটি ডলার, আগস্টে ৮০ কোটি ডলার, সেপ্টেম্বরে ৬৮ কোটি ও অক্টোবরে ৫৮ কোটি ডলার রপ্তানি আয় এসেছে।

তথ্যে দেখা যাচ্ছে প্রতি মাসেই আয় কমছে। গত অবছরের জুলাই-অক্টোবরে রপ্তানি আয় এসেছিল ৩০৮ কোটি ডলার। ওই সময়ে দেশটি থেকে রপ্তানি আয় কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ। গত অর্থবছর দেশটিতে রপ্তানি হয়েছিল ৯৭০ কোটি ডলার। যা মোট রপ্তানি আয়ের সাড়ে ১৭ শতাংশ। এককভাবে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এখন রপ্তানি আয় কমছে। ফলে সার্বিকভাবে রপ্তানি আয় কমছে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের আমদানি কমেছে। ডলার সংকটের কারণে গত বছরের এপ্রিল থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। বর্তমানে ওইসব পদক্ষেপ আরও কঠোর করা হয়েছে। ফলে সার্বিকভাবেই আমদানি কমেছে। এর অংশ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকেও আমদানি কমেছে। গত বছরের এপ্রিল-জুনে আমদানি করা হয়েছিল ৮২ কোটি ৯ লাখ ডলারের পণ্য। জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ৫৬ কোটি ডলারের ও এপ্রিল জুনে ৪৪ কোটি ৩৮ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি প্রান্তিকেই আমদানি কমছে। গত বছরের এপ্রিল-জুনের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে আমদানি কমেছে ৪৬ শতাংশ। একই সময়ে মোট আমদানি কমেছে ২৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে আমদানি কমেছিল ১৬ শতাংশ। মোট আমদানির মাত্র ৩ দশমিক ৭ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে করা হয়।

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোক্তাদের সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) স্থিতিও কমছে। জুন পর্যন্ত তাদের বিনিয়োগের নিট স্থিতি ছিল ৩৯৫ কোটি ডলার। এর আগে গত ডিসেম্বরে ছিল ৪১০ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। আলোচ্য সময়ে বিনিয়োগের স্থিতি কমেছে ৪ শতাংশ।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশিদের সামান্য বিনিয়োগ রয়েছে। এর স্থিতিও কমেছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ স্থিতি ছিল ১২ লাখ ৪০ হাজার ডলার। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ছিল ২১ লাখ ডলার। ওই সময়ে বিনিয়োগ কমেছে ৪১ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেসরকারি ঋণের বড় অংশই আসে আমদানির মাধ্যমে। আমদানি কম হওয়ায় এ খাতে ঋণের প্রবাহও কমেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৭৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। গত জুনে তা কমে ৬৯ কোটি ডলারে নামে। ওই সময়ে ঋণের স্থিতি কমেছে ১১ শতাংশ। তবে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বাড়ছে। জুলাইয়ে ছিল ৬২ কোটি ডলার, আগস্টে তা বেড়ে হয় ৭১ কোটি ৫৫ লাখ ডলার, সেপ্টেম্বরে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৭১ কোটি ৯৮ লাখ ডলারে। আগের ঋণের মেয়াদ বাড়ানো ও বাড়তি সুদের কারণে এ খাতে পরিশোধ হচ্ছে কম। যে কারণে স্থিতি বেড়েছে।

অর্থনীতি

বৈশ্বিক মন্দা এবং দেশে ডলারের তীব্র সংকটে অর্থনীতি এমনিতেই নাজুক। ইতোমধ্যে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পড়েছে দেশ। এ অবস্থায় অস্থিরতা আরও বাড়লে অর্থনীতিতে ধস নামার আশঙ্কা করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা।

তারা বলেছেন, অর্থনীতির এ দুঃসময়ে রাজনৈতিক সমঝোতা যেখানে জরুরি, সেখানে অস্থিরতা বাড়লে অর্থনীতিতে শুধু ধসই নামবে না, আরও অনেক কিছু হতে পারে। কারণ, পরপর তিনটি একই ধরনের নির্বাচন বিদেশিরা মানবে না। এটি ইতোমধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে। এতে দেশের অর্থনীতির পাশাপাশি বৈদেশিক ও সামাজিক খাতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

তারা আরও বলেছেন, দেশের স্বার্থে এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের কোনো বিকল্প নেই। তা না হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। এজন্য দ্রুত রাজনৈতিক সমঝোতা জরুরি।

এদিকে অর্থনীতির কথা চিন্তা করে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংস কর্মসূচি পরিহারের আহ্বান জানিয়েছেন শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা। তাদের মতে, অর্থনীতি ও রাজনীতি একে অন্যের পরিপূরক। তাই সংহিস কর্মসূচি দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত করলে পুরো দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যার বোঝা দেশের সব মানুষকে বহন করতে হবে। তফশিল ঘোষণার পর অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা সঙ্গে আলাপকালে এসব পরিহারের আহ্বান জানান।

উল্লেখ্য, বুধবার রাতে নির্বাচন কমিশন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করেছে। এ তফশিল অনুযায়ী আগামী বছরের ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে একতরফা তফশিল ঘোষণা করা হলে তারা লাগাতার হরতাল-অবরোধসহ আরও কঠোর কর্মসূচি দেবেন। এ ধরনের কর্মসূচিতে অর্থনীতি আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মনে করেন, করোনার সময়ে অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুনরুদ্ধার করার আগেই রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে শুরু হয় বৈশ্বিক সংকট। এর প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়ে যায়। দেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকে। দেশেও সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে মূল্যস্ফীতির হার। একই সঙ্গে ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এতে দেশের প্রায় সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়লে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা সতর্ক করে বলেছেন, এতে পুরো দেশ বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, বৈশ্বিক ও দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে অর্থনীতির অবস্থা এমনিতেই খারাপ। এর মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই সহিংস হয়ে উঠছে। সব ধরনের পরিবহণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে মানুষ ও পণ্যের বিপণন ব্যাহত হচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার আরও হ্রাস পাবে।

তিনি আরও বলেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলতে থাকলে বিনিয়োগ ব্যাহত হবে। করোনা, বৈশ্বিক মন্দা ও ডলার সংকটের কারণে এমনিতেই বিনিয়োগ কমে গেছে। অস্থিরতা চলতে থাকলে বিনিয়োগ আরও কমবে। দেশে বিনিয়োগের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে ব্যাংক। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। এর মানে হচ্ছে, বিনিয়োগও কম হচ্ছে। বিনিয়োগ বাড়লে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহও বাড়ে। বিনিয়োগ কমার কারণে বেসরকারি খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। এতে কর্মসংস্থানের হার কমবে। সব মিলে প্রবৃদ্ধির হার কমে যাবে।

তিনি আরও বলেন, কোনো দেশে বিনিয়োগ বাড়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, সন্তোষজনক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এসব না থাকলে বিনিয়োগ বাড়বে না। বিনিয়োগ না বাড়লে গতিশীল হবে না অর্থনীতি। আর অর্থনীতি গতিশীল না হলে বেকারদের ভালো কর্মসংস্থান হবে না। উন্নতি হবে না মানুষের জীবনমানের।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বলেছেন, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা লাগামহীনভাবে বাড়লে অর্থনীতিতে ধস নেমে যাবে। বৈশ্বিক মন্দা ও দেশে ডলারের তীব্র সংকটের কারণে অর্থনীতি এমনিতেই কঠিন সংকটের মধ্যে দিয়ে চলছে। করোনার কারণে অর্থনীতিতে যে ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েনি। এ অবস্থায় জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে ইতোমধ্যে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়েছে। চলমান অস্থিরতা আরও বাড়লে দেশের অর্থনীতি ধসে পড়বে।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচন একতরফা হলে বা অংশগ্রহণমূলক না হলে শুধু অর্থনীতিতে নয়, আরও বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব আসতে পারে দেশের ওপর। বিদেশিরা একতরফা নির্বাচনকে মেনে নেবে না। তখন অর্থনীতিতে নানা জটিলতা দেখা দেবে।

তিনি আরও বলেন, দেশে বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। সমঝোতার মাধ্যমে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এমনিতেই অর্থনৈতিক চাপ চলছে, তার ওপর বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এটা বলার জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। এ অবস্থায় চলমান ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতি, ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টরের সমস্যা এবং খেলাপি ঋণসহ জটিল সংকটগুলো মোকাবিলায় কতটা মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হবে, সেটিও বড় প্রশ্ন। এখন বিষয়টি হলো বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কতটা সংঘাতময়, কতটা ব্যাপক, গভীর ও কতটা স্থায়ী হয়, তার ওপরই নির্ভর করবে আর্থিক ক্ষতি কতটা হবে। তবে স্বাভাবিকভাবেই দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সব পক্ষের আন্তরিকতা দরকার। কেননা ২০১৪ সালের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সংস্থা থেকে বলা হয়েছিল, সে সময়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, রাজনীতি ও অর্থনীতি একে অন্যের পরিপূরক। তাই তফশিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলগুলোর এমন কোনো কর্মসূচি দেওয়া উচিত হবে না, যাতে রপ্তানিমুখী শিল্প তথা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এমনিতে বৈশ্বিক কারণে তৈরি পোশাকশিল্প একটি কঠিন সময় পার করছে, মূল্যস্ফীতির কারণে রপ্তানির অর্ডার কমে যাচ্ছে। গত কয়েকদিনের শ্রমিক অসন্তোষের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে অর্ডার হারানোর আশঙ্কা তৈরি হবে। কর্মসূচি দেওয়ার আগে রাজনীতিবিদরা দেশের অর্থনীতির কথা ভাববেন বলে আশা করেন এ ব্যবসায়ী নেতা।

তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ীরা এমন কোনো কর্মসূচি প্রত্যাশা করে না, যাতে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, কখনোই কোনো সংহিস কর্মসূচি প্রত্যাশিত নয়, হোক সেটা নির্বাচনকেন্দ্রিক বা অন্য কোনো কারণে। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি দেওয়ার আগে অর্থনীতির কথা ভাবা উচিত। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিদেশি ক্রেতারা আগের দেওয়া অর্ডার সময়মতো ডেলিভারি পাবে কি না, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, নতুন অর্ডার তো দিচ্ছেই না। তাই আগামী তিন মাসে রপ্তানিমুখী শিল্প কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। সার্বিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থনীতির বিষয় মাথায় রেখে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফজলুল হক বলেন, সত্যি বলতে ব্যবসায়ীরা অতল সমুদ্রে আছে, কেউ ভালো নেই। সব খাতেই একই অবস্থা। দেশ এখন ক্রান্তিলগ্ন সময় পার করছে। তাই বৃহত্তর স্বার্থে দলমতনির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে একসঙ্গে নির্বাচনে অংশ নিয়ে দেশকে বাঁচানো উচিত। কারও সঙ্গে কারও মতানৈক্য থাকলে সংলাপের মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে। যে কোনো দলেরই কর্মসূচি দেওয়ার আগে দেশের অর্থনীতির কথা চিন্তা করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।