সরকারের ১৫টি চিনিকলে পদে পদে অনিয়ম। যেন ‘যেদিকে দৃষ্টি, সেদিকেই দুর্নীতি।’ লুটপাট করা হয়েছে কর্মচারীদের গ্র্যাচুইটি ও ওভারহেডের (উপরি ব্যয়) অর্থ। ভুয়া শ্রমিকের নামে তুলে নেওয়া হয়েছে চারগুণের বেশি মজুরি। ঋণ নেওয়া হয়েছে প্রভিডেন্ট ফান্ড (পিএফ) থেকে। বিপরীতে পরিশোধ করা হয়নি কোনো সুদের টাকা।
পাশাপাশি প্রকৃত লোকসানের চেয়ে অতিরিক্ত দেখিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয় মোটা অঙ্কের অর্থ। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করা হচ্ছে না বছরের পর বছর। শুধু তাই নয়, ডিলারদের জামানতে গড়ে তোলা তহবিলে নেই একটি টাকাও। এই তহবিলের অর্থ ফেরত দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে মিলগুলো। সরকারি চিনিকলগুলোর ওপর পরিচালিত অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে অনিয়ম-দুর্নীতির এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, কোনো কোনো মিলের সম্পদের চেয়ে লোকসানের পরিমাণ দেখানো হয়েছে বেশি। যা সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আর বিক্রি করা চিনির মূল্যের মধ্যে কৌশলে অন্তর্ভুক্ত করা হয় কাঁচামালের মূল্য।
এদিকে চিনির শিল্পের করণীয় নির্ধারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি সারসংক্ষেপ পাঠিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের আখ মাড়াই মৌসুম শেষ হওয়ার পর পরবর্তী মৌসুম থেকে কোন কোন মিল চালানো হবে বা স্থগিত রাখা হবে সে সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে সেখানে ৯টি মিল সম্ভাবনাময় বলে উল্লেখ করা হয়।
জানতে চাইলে চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো. আরিফুর রহমান অপু বলেন, নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অনিয়মের জন্য দায়ী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিধান অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট দায়ী ব্যক্তির বেতন-ভাতা থেকে টাকা কেটে সমন্বয় করা হয়। যেভাবে হোক সে টাকা আদায় করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ৬টি মিলের আখ মাড়াই স্থগিত আছে। এই মুহূর্তে সরকার কয়টি চিনির মিল বন্ধ করবে বা করবে না এখনো পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। সেটি নিয়ে সময় পার হচ্ছে আমাদের। সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে।
সূত্র জানায়, চিনিশিল্পের দুর্নীতি ও অনিয়ম তুলে আনতে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) কার্যালয়। সিএজি’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, একাধিক মিলের শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটির টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনা ধরা পড়েছে এরই মধ্যে। ডিলারদের কাছ থেকে যে জামানত বাবদ অর্থ নেওয়া হয়েছিল, সেই টাকা নিয়মবিহর্ভূতভাবে ব্যয় করা হয়েছে মিলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে।
ফলে অনেক ডিলারের টাকা ফেরত পেতে সমস্যা হচ্ছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, একটি মিল পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, চার শিপট কাজ চলছে সেখানে। প্রতি শিফটে শ্রমিক সংখ্যা ৬ জন করে মোট ২৪ জন কাজ করছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে কাজ করছেন একজন।
বাকিদের অবস্থান জানতে চাইলে উপস্থিত শ্রমিক জানান, অন্যরা দুপুরের খাবারের জন্য বাইরে গেছেন। অডিট টিম সন্ধ্যায় গিয়ে ওই একজন শ্রমিককে কাজ করতে দেখেন। এরপর প্রকৃত ঘটনা জানতে পারেন, সেখানে ২৪ জন শ্রমিকদের স্থলে কাজ করছে চারজন। বাকি ২০ জনকে মিথ্যা হাজিরা দেখিয়ে তাদের পারিশ্রমিক হাতিয়ে নিচ্ছে মিলের একটি চক্র।
অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, দিনাজপুর কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বিডি) লি. সুগার মিলের কর্মচারীদের গ্র্যাচুইটি ফান্ডের প্রায় ১৪ কোটি টাকা এবং শ্রমিকদের ‘ওভার হেড’র প্রায় ৬৪ লাখ টাকা খর্বিত (তছরুপ) হয়েছে।
এছাড়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শ্রমিকদের উপরি ব্যয় খাতে ৯৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। যার হিসাব-নিকাশ সম্পূর্ণ ভুল-এমন মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনে। এছাড়া মিলের ব্যালেন্সশিটে ‘হাতে নগদ’ বাবদ পৌনে এক কোটি টাকা উল্লেখ থাকলেও সেটি এখনো পর্যন্ত সমন্বয় করা হয়নি।
জয়পুরহাট সুগার মিলেও আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে। এই মিলে তিন শিপটে উৎপাদন চলছে। প্রতি শিপটে ৮ ঘণ্টা করে কাজ হচ্ছে। সেখানে মোট ৪৯ জন শ্রমিক কাজ করছে। সময় ও জনবল দিয়ে প্রতি মাসে ৪ হাজার ৫২ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন হওয়ার কথা।
কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ২ হাজার ২৪৯ মেট্রিক টন। প্রতি মাসে ১ হাজার ৮০৩ মেট্রিক টন উৎপাদন কম হচ্ছে। মূলত ৪৯ জন শ্রমিক কাজ দেখানো হলেও বাস্তবে কাজ করছে আরও কম। ভুয়া হাজিরা তুলে ভাগবোটায়ারা করে নিচ্ছে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
কুষ্টিয়া সুগার মিলে দেখা গেছে, শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে প্রায় ৫৭ কোটি টাকার ঋণ নেওয়া হয়েছে। ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ ফান্ডে জমা হওয়ার কথা। কিন্তু সুদের এক টাকাও সেখানে জমা হয়নি। এই প্রতিষ্ঠানের লোকসানের পরিমাণ ৪২৮ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মোবারকগঞ্জ সুগার মিলের ব্যালেন্সশিটে নিট লোকসান দেখানো হয় ৯২ কোটি টাকা। অথচ প্রকৃত লোকসান হচ্ছে ৫০ কোটি টাকা। এই মিলে বর্তমান চলতি দায়-দেনা ৫০৭ কোটি টাকা এবং আগের দায়-দেনা ৪০ কোটি টাকা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে মেশিনারিজ প্লান্টের জন্য ১০ কোটি টাকা ব্যয় এবং নতুন প্ল্যানের জন্য যুক্ত করা হয় ২ লাখ টাকা। কিন্তু এই ব্যয় করার মতো কোনো তথ্য কর্তৃপক্ষ অডিট বিভাগকে দিতে পারেনি। এছাড়া এই ঋণের ৫০ লাখ টাকা দীর্ঘদিন ধরে সমন্বয় করা হয়নি।
একইভাবে নাটোর সুগার মিলে নিট সম্পত্তির তুলনায় লোকসানের পরিমাণ বেশি দেখানো হয়। মিলের চলতি সম্পদের পরিমাণ ২৮০ কোটি টাকা হলেও মোট দায়-দেনা হচ্ছে ৫৫০ কোটি টাকা। যা সন্দেহজনক হিসাবে শনাক্ত হয়। এছাড়া মিলের অভ্যন্তরীণ প্রকল্পের জন্য প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয়ের হিসাব পাওয়া যায়নি। এডিপির ৩৮ লাখ টাকার একটি ঋণ ১৯৮৪ সাল থেকে বহন করা হলেও তা সমন্বয় করা হয়নি। এছাড়া কৃষকের ঋণ বাবদ ২১ লাখ টাকাসহ ৫২ লাখ টাকার অনিয়ম ধরা পড়ে সেখানে।
সেতাবগঞ্জ সুগার মিলে চিনি বিক্রি বাবদ ৭ কোটি টাকা আয় হলেও সেখানে কাঁচামালের দাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যা সন্দেহজনক হিসেবে অবহিত করা হয় প্রতিবেদনে। কারণ কাঁচামাল ও বিক্রয়- এ দুটি হিসাব পৃথক। এছাড়া চলতি মূলধন, নগদ অর্থ প্রবাহ সবই নেতিবাচক বলে মিলটি সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে।
এদিকে ঠাকুরগাঁও মিলের সম্পদ ৫৫৯ কোটি টাকা হলেও লোকসানের পরিমাণ ৫৯১ কোটি টাকা। এই লোকসানের পরিমাণ ঠিক নয় মন্তব্য করেছে অডিট বিভাগ।
এছাড়া রংপুর সুগার মিলের ব্যালেন্সশিটে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে লোকসান ৩৫ কোটি টাকা, সম্পত্তির পরিমাণ ২৫৯ কোটি টাকা দেখানো হয়। আর ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যথাক্রমে লোকসান ৫২ কোটি টাকা এবং ৬১ টাকা। এই দুবছরে সম্পত্তির পরিমাণ দেখানো হয় ৩১৮ কোটি টাকা ও ৩৭৪ কোটি টাকা। এ হিসাব প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে ‘সন্দেহজনক’ বলে মন্তব্য করা হয়। এছাড়া ২৩১ কোটি টাকার একটি ঋণের পাশাপাশি আরও ১৪ কোটি টাকার ঋণ নেওয়া হলেও হিসাবে দেখানো হয়নি।
আর ফরিদপুর সুগার মিলে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যেসব ব্যয়ের প্রস্তাব দেখানো হয়েছে তা সঠিক নয় বলে চিহ্নিত করা হয়েছে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। এছাড়া এই মিলে লোকসানের পরিমাণ ৪০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের প্রধান নিরীক্ষক মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ বলেন, লোকবলের সংকটের কারণে চিনির মিলগুলোতে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা অনেক দিন ধরেই বন্ধ আছে। বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর নিরীক্ষায় আপত্তিগুলোর জবাব দেওয়া হচ্ছে। অডিট রিপোর্টের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধান কার্যালয় ব্যবস্থা নিচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঢালাও মন্তব্য করা সম্ভব নয়। কারণ প্রতিটি মিলের কর্তৃপক্ষ রয়েছে। ব্যবস্থা তারা আগে গ্রহণ করবে।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ : চিনিকলগুলোর ওপর শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে একটি সারসংক্ষেপ পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। সেখানে বলা হয়, প্রতিষ্ঠার পর শুরুতে ২ লাখ ১০ হাজার ৪৪০ মেট্রিক টন উৎপাদন করা হলেও বর্তমানে হচ্ছে ৬৭ হাজার ৫৭৭ মেট্রিক টন।
কিছুসংখ্যক চিনির কল চালু রেখে ডিস্টি লারি ও অন্যান্য বাই প্রডাক্ট উৎপাদনের মাধ্যমে লোকসান ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে অদক্ষ ও সম্ভাবনাহীন মিলগুলোর উৎপাদন আপাতত বন্ধ রাখা যেতে পারে।