প্রকাশকেরা প্রস্তুতির জন্য কম সময় পেলেও ‘অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো’ এবার মেলায় প্রকাশ পাবে বলে আশা মাজহারুল ইসলামের।
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে অমর একুশে বইমেলা আয়োজনের রীতি থাকলেও নির্বাচন আর রোজার কারণে এবার তা এগিয়ে আনা হয়েছে ডিসেম্বর মাসে; এর জন্য কতটা প্রস্তুত প্রকাশক ও ছাপাখানা সংশ্লিষ্টরা?
কারণ নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ছাপাখানায় ডায়েরি, ক্যালেন্ডার এবং বিভিন্ন পাঠ্যবই ছাপার ব্যস্ততা থাকে, তার মধ্যে সৃজনশীল বই ছাপা নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তার কথাই বলেছেন তারা।
প্রকাশক ও ছাপাখানা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডায়েরি-ক্যালেন্ডার ছাপার কাজের মধ্যে সৃজনশীল বইয়ের কাজ ‘দ্বিগুণ চাপ’ হয়ে যাবে। তবে বই ছাপায় কাগজের কোনো ঘাটতি হবে না বলে মনে করছেন কাগজ ব্যবসায়ীরা।
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে রোজা শুরু হবে। তার আগেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের সব প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ দুটো বিষয় মাথায় রেখেই একুশে বইমেলার তারিখ চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বললেন।
তিনি বলেন, “ফেব্রুয়ারি মাসে যেহেতু জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। নির্বাচনের আগে নিরাপত্তা এবং মানুষের আগ্রহ বইমেলাকে ঘিরে কতটা থাকবে, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।
“আর ঈদের ছুটিতে তো ঢাকা শহর ফাঁকা হয়ে যাবে। এখন ঈদের ছুটির পর মেলা করতে চাইলে সেটা এপ্রিলে চলে যাবে। এপ্রিল মাসে ঝড়-বৃষ্টির একটা ব্যাপার থাকে। সে সময় বইমেলা আয়োজন করা খুব একটা বাস্তবসম্মতও হবে না। বইমেলা সংক্রান্ত সভায় আমরা ডিসেম্বরে মেলা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির ফটকে চট বিছিয়ে প্রকাশনা সংস্থা মুক্তধারার প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন সাহা যে বই বিক্রি শুরু করেছিলেন, তা পরে একুশে বইমেলায় রূপ নেয়।
১৯৮৩ সালে এরশাদের সময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কারণে একবার বইমেলা বন্ধ হয়েছিল। এছাড়া বইমেলা বন্ধ থাকার নজির নেই। তবে কোভিড মহামারীর সময় ২০২১, ২০২২, ২০২৩ সালে বইমেলার সময় পরিবর্তন করে মার্চ মাসে নেওয়া হয়েছিল।
ছাপাখানায় ‘দ্বিগুণ চাপ’
সাধারণত অক্টোবরের শেষের দিকে বইমেলার বই ছাপার কাজ শুরু হয়। এ বছর সেভাবেই কাজ এগোচ্ছে। বইমেলাকে সামনে রেখে পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করার কাজ করছেন প্রকাশকরা। তারপর ছাপার জন্য তা প্রস্তুত করে পাঠানো হবে ছাপাখানায়।
অপর দিকে নভেম্বর, ডিসেম্বর মাসে সাধারণত ছাপাখানাগুলো নতুন বছরের জন্য ডায়েরি, ক্যালেন্ডার ছাপা হয়। এ সময় পাঠ্যপুস্তক ছাপার ব্যস্ততাও থাকে। এজন্য সৃজনশীল বই ছাপা ও বাঁধাইয়ের ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা হবে বলে মনে করছেন বই বিপণনকেন্দ্র ও প্রকাশনা সংস্থা বাতিঘরের কর্ণধার দীপঙ্কর দাশ।
তিনি বলেছেন, “নভেম্বর মাসে ছাপাখানাগুলোতে ডায়েরি, ক্যালেন্ডার কিংবা পাঠ্যপুস্তক ছাপার জন্য কিছু চাপ থাকবে, তাতে সৃজনশীল বই ছাপার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা হবে।”
‘আধুনিক আলিফ বুক বাইন্ডিং’ এর স্বত্ত্বাধিকারী মাহিন মিয়া বলেন, “আমাদের কাছে যেসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে বই বাঁধাইয়ের জন্য আসে, তাদেরকে বলছি- এবার একটু আগে পাঠাইয়েন।
“কারণ ওই সময় তো ডায়েরি-ক্যালেন্ডারের কাজের চাপ থাকে। ফলে বইমেলার কাজটা ডাবল চাপ হয়ে যাবে।”
বই ছাপতে কাগজের সংকট হবে কি না, জানতে চাইলে নয়াবাজারের ‘সুইস করপোরেশন’ এর স্বত্ত্বাধিকারী অসীম আচার্য্য বলেছেন, “বাজারে পর্যাপ্ত কাগজ আছে। আর বাজারে কাগজের দামও এখন অন্য সময়ের তুলনায় কম আছে। ১০০ গ্রাম কাগজ প্রতি রিম ৩৮০০ টাকা এবং ৮০ গ্রাম কাগজ প্রতি রিম ৩১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।”
এই ব্যবসায়ীর ভাষ্য, “বইমেলায় সাধারণত যে সৃজনশীল বই ছাপা হয়, আমাদের কাছে যে কাগজ থাকে–তা দিয়েই হয়ে যায়। বিদেশ থেকে আমদানি করা লাগে না। আর সৃজনশীল বই তো ছাপাও খুব বেশি হয় না।”
“ডায়েরি বা অন্যান্য পাঠ্যবই যেমন লাখ লাখ কপি ছাপা হয়, সৃজনশীল বই তো এত বেশি ছাপা হয় না। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত কাগজ আছে। বইমেলাকেন্দ্রিক যে কাগজ বিক্রি, তা এখনো বিক্রি তেমন শুরু হয়নি।”
কাঁটাবনের ‘এস আর এল প্রিন্টিং প্রেস’ এর স্বত্ত্বাধিকারী মোহাম্মদ শাহীন মিয়া বলেন, “নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে তো ক্যালেন্ডার ছাপার কাজ বেশি থাকে। সৃজনশীল বই তো ছাপা হয় কম। লাভও কম হয়।
“বইমেলা যদি জানুয়ারিতেও করা হইত, আমাদের চাপটা কমত। এখন চাপ বেশি হয়ে যাবে।”
লেখক, প্রকাশকেরা কী বলছেন
বইমেলা ডিসেম্বরে এগিয়ে আনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে চলছে নানামুখি আলোচনা। কেউ মেলা এগিয়ে আনার সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন; আবার কেউ মনে করছেন ফেব্রুয়ারি মাসের ‘একুশে বইমেলা’ ডিসেম্বরে আয়োজন করা হলে মেলার ঐহিত্য ও চেতনা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডকটমকে বলেন, “মেলা না হওয়ার চেয়ে ‘অসময়েই’ মেলা হওয়াটা তো ভালো। আমরা জানি নির্বাচনের তারিখ জানিয়ে দেওয়া হলে দলগুলো হুড়মুড় করে পথে নেমে যাবে। নির্বাচনের আগে কমপক্ষে চার সপ্তাহ মাঠ খুব গরম থাকবে। মেলাটি তার আগেই শেষ হয়ে যাওয়া ভালো।”
এবারের মেলাতেও ‘মব’ আতঙ্ক থাকা নিয়ে শঙ্কার কথা বললেন মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, “মেলায় ভবঘুরে আর বখাটেদের উৎপাত কীভাবে ঠেকানো যায় ভাবতে হবে, যার সাম্প্রতিক রূপ হচ্ছে ‘মব’। গত বছর এ কারণে মেলার আবহ নষ্ট হয়েছিল। লেখক ও প্রকাশকরা অনেক ক্ষতির শিকার হয়েছিলেন। এবার যেন তার পুনরাবৃত্তি না হয়।”
প্রকাশকদের একটি বড় অংশই মনে করছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনি আবহে বইমেলা জমবে না। আর মেলা যদি ফেব্রুয়ারি মাসের পরে করা হয়, তাতেও আমেজ থাকবে না। এজন্য মেলা এগিয়ে আনাটাই বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত।
বইমেলা ফেব্রুয়ারির আগে আয়োজনের প্রস্তাব করে গত ১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি লিখিত আকারে তিনটি সম্ভাব্য তারিখের কথা বলেছিল। তাদের প্রস্তাবে ১৫ ডিসেম্বর হতে ১৫ জানুয়ারি, ১ জানুয়ারি হতে ৩১ জানুয়ারি এবং ৫ জানুয়ারি হতে ৫ ফেব্রুয়ারির যে কোনো একটি সময়ে মেলা হতে পারে বলা হয়েছিল।
বইমেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি গত ১৮ সেপ্টেম্বর এক সভায় ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে ১৭ জানুয়ারি ২০২৬ পর্যন্ত বইমেলার তারিখ নির্ধারণ করে।
পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির পরিচালক ও বইমেলা স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক আবুল বাশার ফিরোজ শেখ বলেছেন, “এবার বাস্তবতার কারণেই বইমেলা এগিয়ে আনা হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় সমিতির বইমেলা স্ট্যান্ডিং কমিটি সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে মেলা এগিয়ে আনার। আমরা এ প্রস্তাব লিখিত আকারে মেলা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলামও।”
প্রকাশন প্রতিষ্ঠান অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলামও বলেছেন, বাস্তবতা মেনে এবার মেলা ডিসেম্বরে আয়োজনের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলা একাডেমি, তা ইতিবাচক।
তিনি বলেন, “ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের কারণে মেলায় নিরাপত্তা এবং নানান রকম সংকট তৈরি হবে। সেক্ষেত্রে ডিসেম্বরে মেলা হওয়াটা ভালো সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমার মনে হয় ডিসেম্বরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও পরীক্ষা শেষ হবে। শীতের আমেজ থাকবে। সব মিলিয়ে ডিসেম্বরে মেলা বেশ জমজমাটই হবে।”
প্রকাশকেরা প্রস্তুতির জন্য কম সময় পেলেও ‘অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো’ এবার মেলায় প্রকাশ পাবে বলে আশা মাজহারুল ইসলামের।
বাতিঘরের দীপঙ্কর দাশ বলছেন, ‘মেলা ফেব্রুয়ারির আগে আয়োজন করাটা বাস্তবতা মেনে সঠিক সিদ্ধান্তই হয়েছে। তবে একটু বেশি এগিয়ে আনা হয়েছে। এখন যে প্রশ্নটা উঠেছে, ২৬ সালের মেলা কেন ২৫ সালে হচ্ছে। মেলা যদি জানুয়ারি মাসে আয়োজন করা হতো। তবে এই প্রশ্নটা উঠত না।”
মাসব্যাপী না করে মেলা ১৫ দিন আয়োজন করার প্রস্তাবও দীপঙ্করের। তিনি বলেন, “জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে ১৫ দিন মেলা হলে ভালো হতো।”