কান্না চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ। এ কান্না ছেলের মৃত্যু শোকের সঙ্গে একরকম আনন্দেরও। কারণ ছেলের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলো। বুধবার দুপুরে এমন দৃশ্য দেখা যায় পুরান ঢাকার নিম্ন আদালত প্রাঙ্গণে। ওই সময় বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল-১।
রায়ে ২০ আসামির মৃত্যুদণ্ড ও ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। রায় ঘোষণার পর আসামি ও তাদের স্বজনদের অঝোরে কাঁদতে দেখা যায়। অন্যদিকে রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন মামলার বাদী আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ। তার চোখ দিয়ে ঝরছিল জল।
তিনি প্রায় দুই বছর আদালত প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়িয়েছেন। সূদুর কুষ্টিয়া থেকে ভোরে ঢাকায় আসতেন-যেতন মধ্যরাতে। খেয়ে না খেয়ে ছেলে হত্যার বিচার চেয়েছেন। রায় শেষে অসহায় এ বাবার সঙ্গে যুগান্তরের এই প্রতিবেদক কথা বলেছেন। তারই মোবাইলে গ্রামে (কুষ্টিয়ায়) থাকা আবরারের মায়ের সঙ্গেও কথা হয় ৫ মিনিট ৩ সেকেন্ড। বলছিলেন- রায় এসেছে-হয়তো সেটি কার্যকরও হবে। কিন্তু আমাদের বুকের ধন কি কখনো ফিরে আসবে। আমাদের শূন্য বুক-শূন্যস্থান কী কখনো পূরণ হবে?
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর ছিল একটি কালো অধ্যায়। ওই দিন বুয়েটের শেরেবাংলা হলে মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ছেলের মৃত্যুশোক আজও মা-বাবাকে স্তব্ধ করে। বুধবার ভোরেই আদালতে হাজির ছিলেন বাবা। সঙ্গে আসা ছোটভাই মনিরুল ইসলাম বললেন, এখনো (দুপুর ১টা ৩৩ মিনিট) ভাই এখনও কিছু খায়নি। অনেক বলেছি-কিছু খেতে, ওই সময় বোবার মতো একপলকে চেয়ে থাকে। চোখের পানি গাল বেয়ে গড়ায়। রায় শেষে সাংবাদিকরা ভাইকে ঘিরে ধরেছিল প্রতিক্রিয়া জানতে। মিডিয়া কর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও দিচ্ছিলেন।
দুপুর পৌনে ২টার দিকে আবরারের বাবাকে এই প্রতিবেদক অনুরোধ করেন যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত কথা বলার। আদালত ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি উম্মুক্ত জায়গায় কথা হয় অসহায় এ বাবার সঙ্গে। অশ্রুভেজা কণ্ঠে বললেন, অনেক তো বলছি- প্রায় দুই বছর ধরে বলেই আসছি। বিচারের জন্য গ্রাম থেকে রাজধানীতে আসি ভোরে-আবার মধ্যরাতে গ্রামে ফিরি। আজ রায় হয়েছে। এ রায়ের জন্য খেয়ে না খেয়ে কতবার যে আদালতে ঘুরেছি, এ হিসাব নেই। এখন আর কাঁদতে পারি না। বুকে ব্যথা হয়। শ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। অনেক কষ্ট করেই বড় ছেলে আবরারকে পড়িয়ে ছিলাম।
সন্তানহারা বাবার আর্জি, খুনিরা আমার বুকের ধনকে হত্যা করেছে। আমি জানি, আমার বাবা কত ভালো মানুষ ছিল। মাথা নিচু করে হাঁটতেন। এমন কোনো কাজ করতেন না, যার জন্য মানুষ তাকে মন্দ বলবে। পড়াশোনা শেষে দেশের বাহিরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। উচ্চশিক্ষা করে দেশে ফিরে-দেশের উন্নয়ন করবে। কিন্তু, কি নির্মম-আমার সেই ছেলেকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সে বারবার পানি খেতে চেয়েছিল-দেওয়া হয়নি। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন এ বাবা।
আবরারের বাবার সঙ্গে এই প্রতিবেদক যখন কথা বলছিলেন, ওই সময় আদালত ভবনের নিচে, প্রিজনভ্যান ঘিরে আসামি, আসামিদের স্বজনরা কান্না করছিল। আসামিরা সূর-চিৎকার করছিল। এমনটা দেখে আবরারের বাবা বলছিলেন, আমার বাবা হয়তো কান্নাও করতে পারেনি। বুকের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। আজ তারা কাঁদছে, স্বজনরা কাঁদছে। আর আমরা দীর্ঘ দুই বছর ধরে কেঁদে যাচ্ছি। ফাঁসির রায় কার্যকর হলে-তাদের অভিভাবকরাও বুঝবে, শূন্য বুক কীভাবে হাহাকার করে। সন্তান হারানোর ব্যথা কি। কেমন লাগে। আমি জানি, সন্তান হারানোর যন্ত্রণার সঙ্গে ক্ষতিপূরণ কিংবা আসামিদের ফাঁসির কোনো অঙ্কই যে মেলে না। যাদের ফাঁসি হবে, তাদের অভিভাবকরাও আমাদের মতো কাঁদবে-যন্ত্রণায় ভুগবে।
আর যেন কোন সন্তান খুন না হয়-খুনের দায়ে কারও ফাঁসি না হয়- এমন আকুতি জানিয়ে বরকত উল্লাহ বললেন, এ রায় যেন দ্রুত কার্যকর করা হয়। রায় কার্যকর হলেই আমার বাবা (আবরার) শান্তি পাবে। এমন বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটাতে কেউ সাহস পাবে না। রাজনৈতিক দল প্রধান-নেতাদের কাছে অনুরোধ, শিক্ষার্থীদের হত্যাকারী বানাবেন না। হিংস্র-বর্বর হতে সহযোগিতা করবেন না। নতুন করে সন্তান হারানোর তালিকায় আর যেন কোন মা-বাবার নাম না উঠে। ফের আরেকবার যন্ত্রণাবিদ্ধ মুখে তিনি বললেন- সন্তানের লাশ বাবার কাঁধে; এ মৃত্যুশোকের যন্ত্রণা প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায়।
দুপুর ২টা ৩ মিনিটে আবরারের মা রোকেয়া বেগমের (৫৭) সঙ্গে মোবাইল ফোনে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। কলটি রিসিভ করলেই কানে ভেসে আসে কান্না। নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলতেই বললেন, আমার বাবাকে আমি ভুলি না, চোখের সামনে ভেসে আসে সব। এখন নিজেকে অপরাধীও মনে হয়- বাবাকে যদি ঢাকায় না পাঠাতাম হয়তো বেঁচে যেত। আমি নিজ হাতে বাবাকে বুয়েটে ভর্তি করিয়েছি। দিনের পর দিন বাবার সঙ্গে ঢাকায় ঘুরেছি। তার বাবা গ্রামে থাকতো, ছেলেদের পড়াশোনার সব দায়িত্ব যেন আমার কাঁধে। আসামিদের ফাঁসি এবং যাবজ্জীবন দণ্ডের যায় হয়ে-দ্রুত হয়তো দ্রুত কার্যকর হবে। আমি ভাবছি, যাদের ফাঁসি হবে, তাদের অভিভাবকদের কথা। কোনো বাবাই চায় না সন্তান সস্ত্রাসী হোক-কাউকে খুন করুক। কেউ না কেউ তাদের সস্ত্রাসী বানায়-খুন করতে সাহস দেয়। তারা কারা?
রোকেয়া বেগম বললেন, ১৯৯৩ সালে তিনি মাস্টার্স করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ঢাকায় বহু সময় ছিলেন। ছেলেদের (ছোট ছেলেসহ) ভর্তি করাতেও ঢাকায় থাকতে হয়েছে। কিন্তু যে দিন আবরারের লাশ গ্রামের বাড়িতে এলো-সেই দিন থেকে আর কোনো দিন ঢাকায় যাইনি। আবরারের বয়স যখন ১৩ দিন, তখন বিসিএস পরীক্ষা ছিল। ছেলেকে কার কাছে রেখে যাব, তার বাবা ব্যাংকে চাকরি করতেন। পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। কিছুদিন পর সিলেটে একটি ভালো চাকরি হয়। কিন্তু ছেলের জন্য চাকরিতেও যোগদান করিনি। আমার বয়স যখন ৩ বছর ৭ মাস তখন আমরা বাবা মারা যান। বাবার মুখ আমি স্মরণ করতে পারিনি। যখন আবরার আমার কূলজুড়ে এলো-সেই দিন থেকেই মনে হয়েছে-আবার বাবা আমার কাছে ফিরে এসেছে। বাবা বলেই তাকে ডাকতাম। সেই বাবাকেও খুন করা হয়েছে-আমার পূর্ণ বুক শূন্য করে দেওয়া হয়েছে। কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন এই মা।
কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, আমার ছেলের হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা অমিত শাহ হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলে না থাকলেও মোবাইলের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের সমস্ত পরিকল্পনা করেছে। তার মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব। কীভাবে মৃত্যুদণ্ড থেকে ৫ জনের নাম বাদ গেল-আমি চাই, অমিত শাহসহ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া সবার ফাঁসি হোক। এখন ছোট ছেলেকে নিয়েও ভয় হয়। আমি আর কাউকে হারাতে চাই না। কেউ কি আমার বেঁচে থাকা ছেলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। কেউ কি নিশ্চিত করে বলবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আর কারও সন্তান খুন হবে না। কারও মায়ের বুক খালি হবে না। শিক্ষার পরিবেশ, ছাত্র রাজনীতি, হিংস্র শিক্ষার্থীদের অপদার্থতাকেই কাঠগড়ায় তুলে ছেলেহারা মায়ের কান্নাভেজা গলায় এ প্রশ্নটাই ছুড়ে দিলেন মা রোকেয়া বেগম।
এদিকে বিকাল সাড়ে ৩টা পযর্ন্ত আবরারের বাবা আদালত ভবনের দ্বিতীয় তলায় হাঁটছিলেন। তার সঙ্গে তার ভাই, শ্যালক ও বোনের মেয়ে ছিলেন। চাচা মনিরুল ইসলাম বললেন, আবরারকে তিনি স্কুলে নিয়ে যেতেন। কূলে-পিঠে করে বড় করেছিলেন। মামা মোফাজ্জেল হোসেন বললেন- সে ছিল আমাদের আলোকরশ্মি। যেমন মেধাবী-তেমনি ভদ্র। সেই প্রিয় ভাগ্নেকেই নির্মমভাবে খুন করা হলো। ফুফুতো বোন আফরিদা তানজীনার ভাষ্য- আবরার তার চেয়ে কয়েক বছরের ছোট। একসঙ্গে খেলা করতেন। তাদের বোন নেই-আপন বোন হিসেবেই দেখতেন-মানতেন। সেই ভাইটাকে কেড়ে নিল সন্ত্রাসীরা।
এদিকে আসামিদের কয়েকজন স্বজনের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামির বড়ভাই বললেন- তার ভাই সোজা-সাপ্টা মানুষ ছিল। বুয়েটে ভর্তির আগেও কোনো রাজনীতি করত না। রাজনীতির নামে কারা তাদের ক্ষমতাবান করে তুলে। কারা তাদের ব্যবহার করে। ফাঁসির আরেক আসামির বৃদ্ধা মা ছেলের দিকে তাকিয়ে কাঁদছিলেন। নাম জানতে চাইলে, পাশে থাকা এক যুবক প্রতিনিধিকে ধাক্কা দেন। প্রিজন ভ্যানে থাকা ওই আসামি চিৎকার দিয়ে বলছিলেন- তার কোনো অপরাধ নেই। সে অপরাধে সম্পৃক্ত নয়। যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ইসতিয়াক হোসেনের মা কুলসুমা বেগম ছেলের জন্য কাঁদছিলেন। তিনি জানালেন, তার ছেলে ভালো মানুষ; কিন্তু ছেলে কেন ফাঁসল। কে তাদের হিংস্র করল— মিডিয়া কর্মীদের কাছে প্রশ্ন রাখেন এই মা।