ঢাকা থেকে কুয়াকাটা, সরাসরি সড়কপথে ভ্রমণের সেই স্বপ্ন এখন খুব বেশি দূরে নয়; আরও একটি পথ জোড়া লাগছে পায়রা সেতু চালুর অপেক্ষার অবসানের মধ্য দিয়ে।
দেরিতে হলেও নদীবেষ্টিত বরিশালের সঙ্গে পটুয়াখালী, বরগুনা আর কুয়াকাটার সড়ক যোগাযোগে নতুন আরেক যুগের সূচনা করতে যাচ্ছে এ সেতু।
সমুদ্র শহর কুয়াকাটার সঙ্গে রাজধানীসহ সারা দেশের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগের আরেক দ্বার খুলবে পটুয়াখালীর লেবুখালীতে পায়রা নদীর ওপর নির্মাণ করা চারলেনের সেতুটি খুলে দেওয়া হলে। ফেরি পারাপারের ভোগান্তি যেমন কাটবে, বাঁচবে সময় ও অর্থ।
রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ সেতু উদ্বোধন করবেন। এর মাধ্যমে কাজ শুরুর দীর্ঘ নয় বছর পর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে।
অবসান ঘটবে সেই দীর্ঘ অপেক্ষার। সময়ে সময়ে প্রকল্পের কাজ দীর্ঘায়িত হলে যা রূপ নেয় প্রতীক্ষায়।
অবশেষে দক্ষিণাঞ্চলের ওই এলাকার মানুষের এ আকাঙ্খা বাস্তব রূপ পেতে যাচ্ছে দৃষ্টিনন্দনভাবে গড়ে তোলা প্রায় দেড় কিলোমিটারের পায়রা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে।
সেতুটি চালু হলে বরিশাল শহরসহ ওই অঞ্চলের যানবাহন ফেরি পারাপার ছাড়াই পটুয়াখালী, কুয়াকাটা ও বরগুনায় যেতে পারবে।
উদ্বোধন উপলক্ষে সেতু এলাকায় সাজ সাজ রব পড়েছে বলে জানিয়েছেন পায়রা সেতুর প্রকল্প পরিচালক আবদুল হালিম।
তিনি বলেন, “সবাই আগামী রোববার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের দিকে তাকিয়ে আছেন। উদ্বোধনের পর গাড়ি চলাচলের জন্য সেতুটি খুলে দেওয়া হবে। “
তবে পায়রা সেতু চালুর পরও ঢাকা থেকে সরাসরি সড়কপথে কুয়াকাটা যেতে কিংবা পটুয়াখালী ও বরগুনার মানুষকে রাজধানী আসতে আরও একটু অপেক্ষা করতে হবে। তারা এখন তাকিয়ে থাকবেন পদ্মা সেতুর দিকে।
কেননা নিমার্ণাধীন দেশের বৃহ্ত্তম এ সেতু দিয়ে গাড়ি চলাচল শুরু হলে উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা পায়রা সেতুর মাধ্যমে এসব এলাকার সঙ্গে রাজধানীসহ সারাদেশের নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে।
একসময় সড়কপথে ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা যেতে ১০টি নদীতে ফেরি পার হতে হত। এখন শুধু পদ্মা ও পায়রা এ দুই নদীতে ফেরি পারাপার হতে হয়। নদী পারাপারে দীর্ঘ সময় লাগার পাশাপাশি যাত্রীদের ভোগান্তি ও বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয়।
পায়রা সেতু নির্মাণের প্রকল্প পরিচালক আবদুল হালিম জানান, প্রকল্পটির আওতায় মূল সেতু ও সংযোগ সড়কসহ সব কাজ প্রায় শতভাগ শেষ হয়েছে। এখন সেতু এলাকা সাজানো হচ্ছে। রঙ লাগিয়ে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ চলছে।
বাংলাদেশ সরকার ও কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্টের যৌথ অর্থায়নে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘লংজিয়ান রোডস অ্যান্ড ব্রিজ কোম্পানি’ সেতুটি নির্মাণ করেছে।
সর্বাধুনিক ‘এক্সট্রাডোজড কেবল স্টেইড’ প্রযুক্তিতে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ওপর শাহ আমানত সেতুও একইভাবে নির্মাণ করা হয়।
প্রকল্প পরিচালক জানান, নদীর পানির প্রবাহের স্তর থেকে প্রায় ১৮ দশমিক ৩০ মিটার উঁচু করে নির্মাণ করা হয়েছে এ সেতু। এর উদ্দেশ্য যাতে নিচ দিয়ে জলযান চলাচলে কোনও বিঘ্ন না ঘটে।
পানি প্রবাহ ঠিক রাখতে পায়রা নদীর মাঝখানে মাত্র একটি বড় পিলার স্থাপন করে গড়ে তোলা হয়েছে এক হাজার ৪৭০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৯ দশমিক ৭৬ মিটার প্রস্থের সেতুটি। পিলারটি ১৩০ মিটার গভীর পাইলিং করে বসানো হয়েছে। ওই পিলারের উভয় পাশে অন্য দুই পিলারের সঙ্গে বড় বড় তার দিয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।
তিনি জানান, ভূমিকম্প ও বজ্রপাতসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সেতুকে নিরাপদ রাখতে ব্যবহার করা হয়েছে ‘ব্রিজ হেলথ মনিটর’।
দক্ষিণ-পশ্চিমে আশার পিদিম জ্বালছে পদ্মা সেতু
এ প্রযুক্তিতে সেতুর ক্ষতি হতে পারে এমন অতিরিক্ত ভারি যানবাহন সেতুতে উঠলে আপনা আপনি বেজে উঠবে বিপদ সংকেত।
শুক্রবার প্রকল্প এলাকা থেকে পরিচালক হালিম বলেন, “এখন এলাকায় বৃষ্টি হচ্ছে। তাই সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে। তারপরও আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছি।
“উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রকল্প এলাকার অংশে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতারা উপস্থিত থাকবেন।“
৫ বছরের কাজ ৯ বছরে, ব্যয় বেড়েছে সাড়ে তিনগুণ
২০১২ সালের ৮ মে একনেক সভায় অনুমোদনকালে সড়ক পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে হাতে নেওয়া প্রকল্পটি ৪১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল।
তখন ৩৩৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা অর্থায়নে কুয়েত ফান্ডের সঙ্গে চুক্তি হয়।
তবে বাস্তবায়নকারী সংস্থা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ভূমি অধিগ্রহণের ব্যয় বৃদ্ধি, ভ্যাট ও আইটি খাতে ব্যয় সমন্বয়ের জন্য ২০১৫ সালের ৩১ মে ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্প সংশোধনের প্রস্তাব করলে তা অনুমোদন করা হয়। তখন খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৪১৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।
এরপর ২০১৭ সালের ২০ জুন আরেক দফা ব্যয় ও মেয়াদ বাড়িয়ে প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। এবার পূর্ত কাজের চুক্তিমূল্য অনুযায়ী অতিরিক্ত ব্যয়, নতুন ঋণ চুক্তি প্রভৃতি বিষয় যুক্ত করে ব্যয় ৮০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে এক হাজার ২৭৮ কেটি ৮২ লাখ টাকা করা করা হয়। একই সঙ্গে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস নির্ধারণ করা হয়।
ওই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হলে এরপর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আরেক সংশোধনীর মাধ্যমে এক হাজার ৪৪৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয় প্রকল্পের ব্যয়। তখন প্রকল্প সাহায্য গিয়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৭৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
অর্থাৎ সবমিলে ৫ বছর মেয়াদের প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল গিয়ে দাঁড়ায় ৯ বছর এবং সাড়ে ৩০০ শতাংশ ব্যয় বেড়ে উন্নীত হয় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকায়।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক আব্দুল হালিম বলেন, “নকশা পরিবর্তন এবং চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লংজিয়ান রোডস অ্যান্ড ব্রিজ কোম্পানিকে নিয়োগ দিতেই ২০১৬ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যায়।
“এরপর ভূমি অধিগ্রহণ ও কোভিড-১৯ মহামারীর কারণেও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাজে বিঘ্ন ঘটে। এসব কারণে প্রকল্পটি বিলম্বিত হয়েছে।”
প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকল্পের ব্যয় ধারণাগত নকশার ভিত্তিতে অনুমান করা হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, “পরে বিস্তারিত নকশা অনুসারে প্রকৃত নির্মাণ ব্যয় চূড়ান্ত করা হয়। ফলে সেতুর নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যায়।“
কমবে ভোগান্তি, বাড়বে ব্যবসা-বাণিজ্য
বরিশাল সিটি করপোরশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ জানান, পায়রা নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণ দক্ষিণাঞ্চলবাসীর দীর্ঘ দিনের দাবি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করেছেন।
“পায়রা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য একটি মাইলফলক। এরফলে বরিশাল থেকে খুব সহজেই কুয়াকাটা যাওয়া যাবে। এমনকি আগামী বছর পদ্মা সেতু খুলে দেওয়া হলে সারা দেশের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যেতে আর কোনো বাধা থাকবে না।”
বরিশাল চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, পায়রা সেতু নির্মাণের ফলে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক কেন্দ্র পায়রা বন্দর, পর্যটন এলাকা কুয়াকাটার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়বে, সময় বাঁচবে। মালামাল পরিবহনে খরচ কমবে, ব্যবসায়ীরা উপকার পাবেন।
“পায়রা সেতু উন্মোচনের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বিশাল দ্বার উন্মোচন হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হলে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগে আসবে। কুয়াকাটায় পাঁচ তারকা মানের হোটেল মোটেল গড়ে উঠবে। ব্যবসার প্রসার ঘটবে।”
সেতু নির্মাণ করে ভোলা থেকে বরিশালে গ্যাস আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেটিও খুব শিগগিরই বাস্তবায়ন হবে বলে আশা প্রকাশ করেন চেম্বার সভাপতি।
পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও বরিশাল-৫ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ ফারুক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পরপরই সেতুটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। ফলে ঢাকা থেকে পায়রা বন্দর বা কুয়াকাটা পর্যন্ত যেতে পদ্মা ব্যতীত আর কোনো ফেরি থাকল না।
পায়রা সেতুর ফলে দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসারও প্রসার ঘটবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পায়রা বন্দরে যে অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে তা এগিয়ে নিতে পায়রা সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ব্যবসায়ীদের পণ্য পরিবহন সহজ হবে।
“নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে। নতুন প্রজন্মের যারা আছেন তাদের চাকরির জন্য বরিশালের বাইরে যেতে হবে না, এখানেই তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।”