অর্থনীতি

অর্থ সংকটের কারণে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় উন্নয়ন সহযোগীদের দেওয়া স্বাস্থ্য সরঞ্জাম ও অনুদানসামগ্রী বন্দর থেকে খালাস অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিন বন্দরে পড়ে থাকায় পণ্যের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে। এতে বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

খোদ স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এমন আশঙ্কার কথা তুলে ধরে কাস্টম শুল্ক পরিশোধের জন্য ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়কে।

অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি অবহিত করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যানকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য।

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, স্বাস্থ্য বিভাগের চিঠি পাওয়া গেছে। প্রয়োজনীয় অর্থের অঙ্কটি যাচাই-বাছাই করা হবে।

প্রকৃত অর্থে যে টাকা দরকার, তা বরাদ্দ দেওয়া হবে। তবে চিঠি দেখে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি অর্থ চাওয়া হয়েছে।

এর আগে কাস্টম শুল্ক পরিশোধের জন্য ২৩ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু হিসাব করে দেখা গেছে প্রয়োজন ২৫ লাখ টাকা। এ কারণেই এবারও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, এ মুহূর্তে ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাপান সরকারের দেওয়া ৭৭ কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে আছে।

কাস্টম শুল্কের টাকা সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক কোডে বরাদ্দ না থাকায় ৫ মাস ধরে খালাস করা সম্ভব হচ্ছে না।

দেশের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সুবিধা বাড়াতে এক্সরে যন্ত্র, রোগীর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের মনিটর, সিটি স্ক্যানার, ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাফি বা ইসিজি যন্ত্র, ব্লাড গ্যাস অ্যানালাইজার ও অক্সিজেন জেনারেটর বাংলদেশকে দিয়েছে জাপান।

পণ্যসামগ্রীর তালিকায় আরও রয়েছে অ্যাম্বুলেন্স ও ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিক। সব মিলিয়ে চিকিৎসা সরঞ্জামের সংখ্যা ৩১৩।

এসব পণ্য বন্দর থেকে খালাস করতে কাস্টম শুল্ক বাবদ প্রয়োজন ২২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এই অর্থ চেয়ে আরও একটি চিঠি দেওয়া হয় অর্থ বিভাগকে।

এদিকে ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে অর্থ বিভাগকে লেখা চিঠিতে স্বাস্থ্য বিভাগ বলেছে, শুল্কায়নের মাধ্যমে বন্দর থেকে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের অনুদানের স্বাস্থ্য সরঞ্জাম খালাস করা হয়।

কিন্তু সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক কোডে কোনো টাকা বরাদ্দ নেই। যে কারণে মালামাল খালাস করতে বিলম্ব হয়। সেখানে আরও বলা হয়, বন্দরে খালাসের জন্য মালামাল পড়ে থাকলে এর গুণগত মান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

এতে সরকারের বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি হতে পারে। চিঠিতে আরও বলা হয়, এদিকে শিগগিরই দেশে এসে পৌঁছবে বিদায়ি ২০২১-২২ অর্থবছরে ক্রয়কৃত পণ্য।

কিন্তু সংশ্লিষ্ট আর্থিক কোডে আগ থেকে বরাদ্দ না থাকলে পণ্য ছাড় বিলম্ব হবে। এতে পোর্টের জরিমানাও বাড়বে। বিগত বছরে এ ধরনের জটিলতার কারণে পোর্টের জরিমানা গুনতে হয়েছে।

ওই অর্থবছরে দাতা সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর অনুদানের স্বাস্থ্য সরঞ্জাম গ্রহণ করতে কাস্টম শুল্ক বাবদ ব্যয় হয় ১৭০ কোটি টাকা।

তবে অর্থ পরিশোধ বিলম্বের কারণে পোর্ট ডেমারেজ ৫ কোটি টাকা গুনতে হয়েছে। ফলে আগে অভিজ্ঞতার আলোকে চলতি অর্থবছরের চাহিদা পূরণের জন্য ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দের আবেদন করা হলো।

এ খাতে দ্রুত বরাদ্দ নিশ্চিত হলে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ক্রয়কৃত ও উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে পাওয়া স্বাস্থ্যসামগ্রী দ্রুত খালাস করা যাবে। এতে রোগীদের কল্যাণে এসব পণ্য ব্যবহার সম্ভব হবে।

এদিকে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারকে চিঠি দিয়েছে সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরস ডিপো (সিএমএসডি)।

এতে কাস্টম শুল্ক খাতে দ্রুত অর্থ বরাদ্দের বিষয় উল্লেখ করা হয়। চিঠিতে আরও বলা হয়, জাপানের দেওয়া চিকিৎসা সরঞ্জাম বন্দরে ফেলে রাখায় দেশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে।

ভবিষ্যতে জাপানের কাছে স্বাস্থ্য খাতে সহায়তা চাইলে তারা নাও দিতে পারে। প্রসঙ্গত, প্রচলিত রাজস্ব আইন অনুযায়ী সরকারের নির্ধারিত কিছু খাত ছাড়া সব পণ্যেই শুল্ককর পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক।

অনুদানের সরঞ্জামে শুল্ক ছাড় দিতে হলে আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করতে হয়। ওদিকে বন্দরের মাসুল মওকুফ করার ক্ষমতা রয়েছে শুধু নৌ প্রতিমন্ত্রীর।

অর্থনীতি

নভেম্বরে ১৫৯ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা; যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৭ হাজার ৬৩ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১০৭ টাকা হিসাবে)। এর আগের মাসে এসেছিল ১৫২ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। অর্থাৎ আগের মাসের তুলনায় নভেম্বরে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য।

রেমিট্যান্সের ওপর আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। অন্যদিকে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়াতে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) যৌথভাবে ব্যাংকগুলোকে রেমিট্যান্স কেনার জন্য দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। বর্তমানে ১০৭ টাকায় রেমিট্যান্স ও ১০০ টাকায় রপ্তানি বিলের মাধ্যমে আসা ডলার সংগ্রহ করছে ব্যাংক। এতেও গত মাসগুলোতে কোনো কাজ হচ্ছিল না। তবে সর্বশেষ নভেম্বর মাসে আগের তুলনায় রেমিট্যান্সের অংক সামান্য বেড়েছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের নভেম্বরে সরকারি মালিকানাধীন পাঁচ বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার। বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ১২৮ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৫২ লাখ ডলার এবং বিশেষায়িত একটি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৩ কোটি ২১ লাখ ডলার।

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) টানা ২ বিলিয়ন ডলার করে রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কমে যাওয়ায় আগের দুই মাসের তুলনায় রেমিট্যান্স কমে যায় সেপ্টেম্বরে। অক্টোবর মাসে আরও কমে ৫২ কোটি ৫৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আসে।

অর্থপাচার ও কালো টাকা না কমলে বৈধ পথে রেমিট্যান্সও বাড়বে না। বিভিন্ন মহলের এমন বার্তার পর হুন্ডি প্রতিরোধের নতুন কৌশলে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধে গঠন করা হয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সম্প্রতি হুন্ডির মাধ্যমে প্রেরিত রেমিট্যান্সের ২৩০ জন বেনিফিশিয়ারির হিসাবে সাময়িকভাবে উত্তোলন স্থগিত করে বিএফআইইউ।

বলা হয়, ভবিষ্যতে বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠাবে এমন প্রতিশ্রুতি দিলে হিসাবগুলো খুলে দেওয়া হবে। হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রতিরোধে নতুন কৌশল নিয়েছে বিএফআইইউ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবরে ১৫২ কোটি ডলার পাঠান প্রবাসীরা। এই অংক গত ৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।

এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ১৪৯ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ (২১ দশমিক ৩ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে; যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ কম।

অর্থনীতি

ডলারের উত্তাপে নিত্যপণ্যের বাজারও গরম হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গত কয়েক মাস ধরে পণ্যের দাম কমলেও স্থানীয় বাজারে কমছে না। বরং ডলারের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে। এ অজুহাতে সর্বশেষ চিনি ও সয়াবিন তেলের দাম ফের বাড়ানো হয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার পর থেকে যেসব পণ্যের এলসি খোলা হয়েছিল সেগুলো দেশে আসতে শুরু করেছে। যেখানে এগুলোর দাম কমার কথা, সেখানে ডলারের দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে বাড়ানো হচ্ছে। এতে একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা।

অন্যদিকে দাম বাড়ায় ক্রেতার কষ্ট বেড়েছে। নানা অজুহাতে প্রায় সব ধরনের আমদানি পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। অথচ এসব ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত কোনো বিশ্লেষণ হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকেও বিষয়টি সেভাবে তদারকি হচ্ছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

জাতিসংঘের কৃষি বিষয়ক সংস্থা ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল অরগানাইজেশনের (এফএও) প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই থেকে অক্টোবর এই ৪ মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম ১২ শতাংশ, সয়াবিনের দাম ১৮ শতাংশ, চিনির দাম ২২ শতাংশ কমেছে। এছাড়া ডালের দাম ৬ শতাংশ, ডিমের দাম ৮ শতাংশ কমেছে। তবে এক বছরের হিসাবে খাদ্যপণ্যের দাম এখনও গড়ে ১২ শতাংশ বেশি রয়েছে।

জুনে আমদানির জন্য ডলারের দাম ছিল ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা। বর্তমানে প্রতি ডলার ১০৭ টাকা। ওই সময়ে প্রতি ডলারের দাম বেড়েছে ১৩ টাকা ৫৫ পয়সা। অর্থাৎ টাকার মান কমেছে ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ।

করোনার পর খাদ্যপণ্যের দাম এক দফা বেড়েছে। এর ধকল কাটিয়ে উঠার আগেই ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর প্রভাবে মার্চ থেকে খাদ্যপণ্যের দাম আরও লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকে। ফলে দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়তে থাকে।

এলসি খোলার পর ওই পণ্য দেশে আসতে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ মাস সময় লাগে। ওইসব পণ্য দেশীয় কারখানায় পরিশোধন হয়ে বাজারে আসতে আরও ১ মাস পার হয়। এ হিসাবে আমদানি পণ্য বাজারে আসতে ৪ থেকে ৫ মাস সময় লাগে। তবে তৈরি পণ্য হলে ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে বাজারে আসে। বাড়তি দামে মার্চে যেসব পণ্যের এলসি খোলা হয়েছে সেগুলো বাজারে এসেছে জুন-জুলাইয়ে। সেগুলো পরিশোধ হয়ে বাজারে এসেছে জুলাই-আগস্টে। কিন্তু পণ্যের দাম বেড়েছে এপ্রিল থেকেই।

জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমতে শুরু করে। আগস্টে এসে বেশ কমে যায়। কম দামে জুলাইয়ে যেসব পণ্যের এলসি খোলা হয়েছে সেগুলো সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বাজারে এসেছে। কিন্তু দাম তেমন একটা কমেনি। বরং কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ডলারের দাম বাড়লে আমদানি পণ্যের খরচ বেশি পড়ে। তবে কত বেশি পড়ে সেটি নির্ধারণ করতে গবেষণা হওয়া উচিত। এর একটি স্থায়ী পলিসি দরকার। ডলারের দাম কত বাড়লে কেজিতে কত বাড়বে। বর্তমানে এ ধরনের কোনো পলিসি নেই। দেখা যাচ্ছে সেপ্টেম্বরের তুলনায় এখন ডলারের দাম কমেছে। কিন্তু পণ্যের দাম ডলারের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে বাড়ানো হয়েছে। এ ধরনের হলে ভোক্তার সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত আচরণ হবে না। ডলারের মূল্য যেহেতু অস্থির, সে কারণে আগেই একটি পলিসি করা দরকার ছিল। আগে যেহেতু হয়নি, দ্রুত করা উচিত। ভোক্তার স্বার্থে এটি প্রয়োগ করাও জরুরি।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়লে দেশের বাজারেও প্রভাব পড়বে। কারণ অনেক পণ্য আছে যা আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয়। তবে বিশ্ববাজারে কিছু পণ্যের দাম কমছে। তার প্রভাব দেশের বাজারে পড়েনি। এর একটা কারণ হতে পারে, ডলার সংকট ও মূল্য বৃদ্ধি। তাই বিশ্ববাজারে দাম কমলেও ডলারের দাম বেশি হওয়ায় দেশীয় ব্যবসায়ীদের বেশি দরেই কিনতে হচ্ছে। পাশাপাশি এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট আছে। তারা অতি মুনাফা করতে পণ্যের দাম কমলেও বেশি দরে বিক্রি করে। তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। সঙ্গে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

এদিকে জুনে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা। ২১ জুলাই তা বেড়ে হয় ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা। ৮ আগস্ট আরও বেড়ে ৯৫ টাকা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর এক লাফে বেড়ে হয় ১০৮ টাকা। ৩১ অক্টোবর তা আরও কিছুটা কমে দাঁড়ায় ১০৩ টাকা। এখন ব্যাংক ভেদে ১০১ থেকে ১০৭ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। সরকারি ব্যাংকগুলো বর্তমানে আমদানির এলসি বেশি খুলছে। এসব ব্যাংকে প্রতি ডলার ১০৫ থেকে ১০৭ টাকা।

বাড়তি দামে ডলার কিনে এলসি খুললেও পণ্যের দাম সঙ্গে সঙ্গে বাড়ার কথা নয়। বাড়তি দামে ডলার কিনে এলসি খুলে পণ্য দেশে আসার পর বাড়ার কথা। কিন্তু তার আগেই পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। ডলারের দাম ১০০ টাকার উপরে উঠেছে সেপ্টেম্বরে। ওই সময়ে যেসব পণ্যের এলসি খোলা হয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগই এখনও দেশে আসেনি। দেশে আসার পর এগুলো পরিশোধন হয়ে বাজারে যেতে সময় লাগবে আরও এক মাস। এ হিসাবে ডলারের দাম বাড়ার প্রভাব ডিসেম্বরে পড়ার কথা।

কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন ও চিনির দাম যখন কমেছে তখন ১৭ নভেম্বর শুধু ডলারের দাম ১০০ টাকার উপরে চলে গেছে এই অজুহাতে দাম বাড়ানো হয়েছে। ওই দিন প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ১২ টাকা বেড়ে ১৯০ টাকা এবং চিনির দাম কেজিতে ১৩ টাকা বেড়ে ১০৮ টাকা করা হয়েছে। অথচ এই দামেও বাজারে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। এখন প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২৫ টাকা। যা এক মাস আগে (অক্টোবর) ছিল ১০৫ টাকা। সেপ্টেম্বরে বিক্রি হয়েছে ৯৫ টাকা, আগস্টে ৯০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। অথচ অক্টোবরের তুলনায় এখন ডলারের দাম কমেছে। তাহলে এখন যেসব পণ্যের এলসি খোলা হচ্ছে সেগুলোর দাম কি ৩-৪ মাস পর কমবে। উত্তর সহজ-কমবে না। তখন অন্য অজুহাতে দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলবে।

আন্তর্জাতিক দাম কমার কারণে যেখানে দেশেও কমতির দিকে থাকার কথা, সেখানে চার মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি চিনি কিনতে একজন ক্রেতাকে ২৫ টাকা বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কমতির মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম ৮৪ টাকা ও প্যাকেট চিনি ৮৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ৬ অক্টোবর প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম ছয় টাকা বাড়িয়ে ৯০ ও প্যাকেট চিনি ৯৫ টাকা করা হয়। সর্বশেষ ১৭ নভেম্বর বৃহস্পতিবার দাম আরেক দফা বাড়ানো হয়। নতুন মূল্য হচ্ছে প্রতি কেজি ১০২ টাকা এবং প্যাকেট চিনি ১০৮ টাকা।

২৬ জুন প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১৮০ টাকা, বোতলজাত সয়াবিনের মূল্য ছিল ১৯৯ টাকা। মে থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম কমেছে। কিন্তু দেশের বাজারে ২৮ আগস্ট এক দফা মূল্য কমিয়ে প্রতি লিটার খোলা ১৭৫ ও বোতলজাত সয়াবিন ১৯২ টাকায় নামিয়ে আনা হয়। বিশ্ববাজারে দাম আরও কমার পরিপ্রেক্ষিতে ৩ অক্টোবর লুজ সয়াবিনের লিটার ১৫৮ টাকা ও বোতলজাত সয়াবিনের মূল্য ১৭৮ টাকায় নামানো হয়।

তবে কিছু দিন বাজারে সরকার ঘোষিত মূল্য কার্যকর থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে বিক্রেতারা কারসাজি করে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১৭০ ও বোতলজাত ১৮০ টাকায় বিক্রি করে। সর্বশেষ ১৭ নভেম্বর নতুনভাবে দাম বাড়ানো হয় ভোজ্যতেলের। এক লাফে লিটারপ্রতি ১২ টাকা বাড়িয়ে খোলা সয়াবিনের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১৭২ টাকা এবং বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতিলিটারের দাম নির্ধারণ করা হয় ১৯০ টাকা।

তবে বাজার পরিস্থিতি পর্যালচনা করে দেখা গেছে-শুক্রবার প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ১৮৫ টাকা। এক মাস আগে (অক্টোবর) বিক্রি হয়েছে ১৬৬ টাকা। এছাড়া বোতল সয়াবিন প্রতি লিটার বিক্রি হয়েছে ১৯০ টাকা। যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ১৮৫ টাকা।

জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সব ধরনের আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়েছে। সেই প্রভাব দেশেও পড়ছে। তবে কেউ দাম নিয়ে অসাধুতা বা কারসাজি করতে না পারে সেদিকে তদারকি করা হচ্ছে। কোনো অনিয়ম পেলেই আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি খোলা আটা বিক্রি হয়েছে ৬২ টাকা। যা এক মাস আগে (অক্টোবর) ছিল ৫৮ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে কমায় সেপ্টেম্বরে কমে ৫৫ ও আগস্টে বিক্রি হয়েছে ৫২ টাকায়। তিন মাস ২৫ দিনের ব্যবধানে প্রতি কেজি আটা খুচরা বাজারে ১০ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি খোলা ময়দা প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৭৫ টাকা।

যা এক মাস আগে (অক্টোবর) বিক্রি হয়েছে ৬৫ টাকা। মাসের ব্যবধানে কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরে ৬২ টাকা, আগস্টে বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা কেজি। সেক্ষেত্রে ৩ মাস ২৫ দিনের ব্যববধানে প্রতি কেজি খোলা ময়দা কিনতে একজন ক্রেতাকে ১৫ টাকা বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। অথচ ওই সময়ে বিশ্ববাজারে গমের দাম কমেছে। মাঝারি মানের মসুর ডালের কেজি এখন ১৪০ টাকা। এক মাস আগে ছিল ১৩০ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে ডালের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। শুধু ডলারের দাম ও জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধির অজুহাতে চার মাসে ডালের দাম কেজিতে ৩০ টাকা বাড়ানো হয়েছে।

অর্থনীতি

কোনো সন্দেহ নেই, পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের মতো আমাদের এখানেও একটা অর্থনৈতিক সংকট চলছে। তেমনই কোনো সন্দেহ নেই, কিছু লোক খারাপ উদ্দেশ্যে বার্তা দিচ্ছে ব্যাংকের টাকা তুলে নেওয়ার কিংবা হিসাব দিচ্ছে-‘ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেলে আপনি আপনার আমানতের কতটুকু খোয়াবেন।’

আমার এ লেখা দেশের অর্থনৈতিক সংকটকে অস্বীকার করার জন্য নয়। সেই সংকটের সমাধান যদি জানতে চান, তাহলেও এ লেখা পড়ে আপনার লাভ নেই। কিন্তু ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেওয়ার মতো কোনো যৌক্তিক পরিস্থিতির মোটেই সৃষ্টি হয়েছে কি না, সে বোঝাবুঝিটা যেন আপনি করে নিতে পারেন, সেই কারণেই এই লেখা।

প্রশ্ন হলো, মানুষ ব্যাংকে টাকা কেন রাখে? মোটা দাগে মানুষ কাজটা করে তিন কারণে। এক. ব্যাংকে টাকার নিরাপত্তা মেলে; দুই. চাহিবামাত্র সেই টাকা তোলা যায়; তিন. কিছু মুনাফা বা সুদ পাওয়া যায়। বুঝলাম দেশের রিজার্ভ কমছে, ডলার মার্কেটের তারল্য কমছে; বুঝলাম টাকা দিয়ে ডলার কিনতে সমস্যা হচ্ছে।

কিন্তু টাকার তারল্য কি কমেছে? সোজা উত্তর, না। এ মুহূর্তে দেশের ব্যাংকব্যবস্থায় যে পরিমাণ তারল্য থাকার কথা, তার অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে আরও ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার। এই পরিমাণ উদ্বৃত্ত তারল্য জমা আছে মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে, তাছাড়া ব্যাংকে নগদ আকারে।

এ মুহূর্তে দেশের ব্যাংকগুলোয় জমা থাকা মোট আমানত বা ডিপোজিটের পরিমাণ ১৪ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। আমানতকারীদের ওই টাকা চাহিবামাত্র ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা পরিমাপের অন্য নাম ব্যাংকের তারল্য। আমাদের এ তারল্যের পরিমাণ বর্তমানে ৪ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু হিসাবমতে আমাদের এই তারল্য থাকা লাগত আড়াই লাখ কোটি টাকার মতো। অন্য কথায়, নিয়মমাফিক দেশের মোট আমানতের ১৭ শতাংশ টাকা নিরাপদে তুলে রাখার জায়গায় আমরা রেখেছি ২৮ শতাংশ টাকা।

এ রকম উদ্বৃত্ত তারল্য বিদ্যমান থাকতে আপনি লোকের কথা শুনে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে রাখবেন কোথায়? বাসা কি ব্যাংকের চেয়ে নিরাপদ? সত্য একটা ঘটনা বলি। এই সেদিন আমাদের এক জেলা শহরের শাখা ব্যবস্থাপক জানালেন, তার এক গ্রাহক ১৩ লাখ টাকা বাসায় নিয়ে গেছেন। কারণ, তার ইতালি প্রবাসী ভাই বলেছেন ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ নয়। দুই সপ্তাহ পর তিনি ব্যাংকে ফিরে এসেছেন ৯ লাখ টাকা নিয়ে। বাকি ৪ লাখ টাকা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না, সেটা চুরি হয়ে গেছে।

ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনার একটা বড় তত্ত্ব হলো, সব আমানতকারীর একসঙ্গে সব টাকা নগদ করার দরকার পড়ে না কখনো। গ্রাহকদের ব্যাংকে রাখা সঞ্চয় যদি সবার একসঙ্গে দরকার পড়ত, তাহলে পৃথিবীতে ব্যাংকিং বলে কোনো কিছু আবিষ্কারই হতো না। ব্যাংক আপনার আমানত নিয়ে অন্যকে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ দেয় বলেই মানুষ ঋণ নিয়ে তার ব্যবসার আকার বড় করে বা বাসস্থানের জন্য দীর্ঘমেয়াদে গৃহঋণ নেয়।

এখন সব আমানতকারী যদি এসে বলেন, ‘সব টাকা ফেরত দাও’, তাহলে ব্যাংকগুলোকে সব ঋণগ্রহীতার কাছে গিয়ে বলতে হবে, ‘আপনার ফ্যাক্টরি বা বাড়ি বিক্রি করে সব টাকা ফেরত দিন।’ সেটা অবাস্তব। এখন প্রশ্ন আসে, পুরো টাকাটা ব্যাংক থেকে মানুষ একযোগে তুলে নিতে চাইলে কতটা নিতে পারে? ইতিহাস এ ব্যাপারে কী বলে? সামগ্রিক অর্থনীতির সমূহ পতন কিংবা বিশ্বযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে এমন কোনো উদাহরণ নেই যে ব্যাংক খাত থেকে মোট আমানতের ১০-১২ ভাগের বেশি টাকা একযোগে বা এক মৌসুমে বেরিয়ে গেছে

। সেখানে আমরা এ দেশের গ্রাহকদের মোট আমানতের ১৭ ভাগ টাকা রক্ষিত রাখার বদলে রেখেছি ২৮ ভাগ। মোদ্দা কথা, পৃথিবীর কোনো দেশই তার ব্যাংকিং ব্যবস্থায় জনগণের রাখা মোট আমানত নিয়ে চিন্তিত থাকে না। আমরাও ১৪ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকার মোট আমানত নিয়ে চিন্তিত নই।

এবার ‘কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক’ নামের একটা বিষয়ে কিছু কথা বলি। অর্থাৎ ব্যাংকিংব্যবস্থার বাইরের টাকা। আপনি আপনার ব্যাংক হিসাব থেকে ১০০ টাকা তুলে নিলে সেই ১০০ টাকাকে বলা হয় ‘কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক’, যে টাকার অর্থনীতিতে গভীর অবদান রাখার ক্ষমতা তুলনামূলক কম। এটাই আপনার দৈনন্দিন লেনদেনের টাকা। এ মুহূর্তে লেনদেনে ব্যবহৃত আমাদের এ টাকার পরিমাণ ২ লাখ ৪১ হাজার কোটি।

এবার আপনি ব্যাংক থেকে টাকা অহেতুক তুলে নিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন দেখবে এর ফলে দৈনন্দিন লেনদেনে ব্যবহৃত টাকার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, তখন মুদ্রানীতিতে ‘রিজার্ভ মানি’র প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখতে তাদের অর্থ সরবরাহ বাড়াতেই হবে।

আর সেই সঙ্গে কিন্তু বাড়বে মুদ্রাস্ফীতি, যে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব পড়বে আমার-আপনার মতো সাধারণ মানুষের ওপর। ব্যাংক থেকে অকারণে টাকা তুলে নেওয়ার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তাহলে কোথায় গিয়ে পড়ছে? সেটা ঘুরে গিয়ে পড়ছে জনগণেরই ঘাড়ে।

এবার আসি যারা ভুল বার্তা ছড়াচ্ছেন, তাদের কিছু উটকো যুক্তি প্রসঙ্গে। প্রথমে বলি বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ২৭১ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ সময়ে এটা দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬০৩ কোটি ডলারে। এরপর করোনার মধ্যে অবৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স পাঠানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ানোয় বৈধ চ্যানেলে বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স আসতে থাকে।

তাছাড়া ব্যাংকগুলো অনেক আমদানি ব্যয় পরিশোধকে ‘ডেফার্ড’ বা প্রলম্বিত করায় ২০২০-২১ অর্থবছরে এ রিজার্ভ উঠে যায় ৪ হাজার ৬৩৯ কোটি ডলারে। কিন্তু করোনা শেষে অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে থাকলে আমদানি ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসা কমতে শুরু করে এবং একই সঙ্গে ‘ডেফার্ড’ আমদানি পরিশোধের দায় মেটাতে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়া শুরু হয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে দেশের রিজার্ভ শেষ হয়ে গেছে অথবা আগামী কয়েক মাস আমদানি ব্যয় ও বিদেশি ঋণের কিস্তি মেটানোর মতো ডলার দেশে নেই। ১৯৯১ সালে বাড়ির পাশের ভারতই এর চেয়ে কত তীব্র এক সংকটের মুখে পড়েছিল।

সে বছরের জানুয়ারি থেকে জুন-মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে ভারতের রিজার্ভ প্রায় ৫০ শতাংশ কমে ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে গিয়েছিল। সংকট এতটাই প্রকট ছিল যে, তখন আমদানি ব্যয় পরিশোধের সামান্য সক্ষমতাটুকুও ভারতের ছিল না। সেবার আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক থেকে প্রায় ২২০ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে ভারত সে সংকট কাটিয়ে উঠেছিল খুব চমৎকারভাবেই। এখানে উল্লেখ্য, ভারত সেদিন যে লোনটা পেয়েছিল, তা ছিল স্বর্ণের বিপরীতে পাওয়া ‘সিকিউরড’ ঋণ। আর আমরা আইএমএফ থেকে যে ঋণ পাচ্ছি, সেটা কিন্তু অমন কিছু বন্ধক রেখে পাওয়া কোনো ঋণ নয়।

রিজার্ভের পরে আসি জিডিপির বিপরীতে ঋণের (সরকারের স্থানীয় ও বৈদেশিক মুদ্রায় নেওয়া সর্বমোট ঋণের) অনুপাতে, যাকে বলা হয় ‘ডেট টু জিডিপি রেশিও’। এ রেশিও বা অনুপাত দিয়ে মাপা যায় একটা দেশের অর্থনীতি কতটা শক্তিশালী। এ অনুপাত যত কম হবে, কোনো দেশ তত বেশি ঋণ নেওয়া ছাড়াই উন্নতি করতে পারবে।

বিশ্বব্যাংকের মতে, ডেট টু জিডিপি রেশিও যদি ৭৭ শতাংশ বা এর চেয়ে কম হয়, তাহলে সেদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী বলা যাবে। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, আমাদের এই ডেট টু জিডিপি রেশিও ৩৬ শতাংশের কম। অথচ ২০২১ সালের হিসাবমতে একই রেশিও ভারতের বেলায় ৯১ শতাংশ, কানাডার বেলায় ১১০ শতাংশ আর যুক্তরাষ্ট্রের বেলায় ১৩৩ শতাংশ। এ পরিমাপক থেকেও বলা যায়, আমরা আইএমএফের ঋণ পরিশোধ করতে এবং একই সঙ্গে বিদেশি গ্রাহকদের কাছে আমাদের পণ্য পৌঁছে দিতে সক্ষম।

এবার আসি শুধু বিদেশি ঋণ প্রসঙ্গে। কিছু মানুষ বলতে শুরু করেছেন, দেশ নাকি বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারবে না। আমাদের বিদেশি ঋণ জিডিপির মাত্র ২০ দশমিক ৪ শতাংশ, যেখানে ভারতের ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের ১০০ দশমিক ২ শতাংশ, জাপানের ৯৭ দশমিক ৯ শতাংশ এবং সিঙ্গাপুরের ৪১৮ দশমিক ৩ শতাংশ। বিশ্বের বহু দেশের তুলনায় আমাদের এই ‘লোন টু জিডিপি রেশিও’ অনেক কম। তবে এটা ঠিক যে, গত কয়েক বছরে আমাদের এই ঋণ বেড়ে গেছে।

টাকা দিয়ে ডলার না কিনতে পারার সংকট আর দায় মেটানোর ডলার তারল্য না থাকার সংকট এক বিষয় নয়। একটির সঙ্গে আরেকটিকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। বৈদেশিক মুদ্রার তারল্য এক বিষয় আর বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় আরেক। আমরা ব্যাংকাররা আমদানি দায় মেটাতে দুটি পদ্ধতিরই আশ্রয় নিয়ে থাকি। সেক্ষেত্রে আমাদের টাকা দিয়ে ডলার কিনতে হয়। আবার তা যদি না পারা যায়, তখন আমরা আমাদের যার যার ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার তারল্য দিয়ে সেই দায় পরিশোধ করি। আবার পরে সুযোগমতো টাকা দিয়ে ডলার কিনে ব্যাপারটার শোধবোধ করি বা ব্যাংকিং পরিভাষায় আমাদের ‘পজিশন স্কয়ার’ করি।

ডলার নেই কথাটা ভুল। আমরা ডলার থাকার সক্ষমতা থেকেই আমাদের আমদানি দায় মেটাচ্ছি এবং এর ফলে কখনো কখনো আমাদের পজিশন ‘শর্ট’ (ঘাটতি) হয়ে যাচ্ছে, সত্য। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার পজিশন শর্ট হওয়া দিয়ে কোনোভাবেই কোনো ব্যাংকের অক্ষমতাকে বোঝানো হয় না। এটা চলমান অর্থনীতির উঠতি-পড়তির এক ধারা। এই যেমন এখন আমদানি শেষমেশ কমতে শুরু করেছে।

অন্য কথায়, হুন্ডির ফাঁদ এড়িয়ে আসল দরে বিদেশের সঙ্গে পণ্যের কেনাবেচা শুরু হয়েছে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে নিয়মিত ডলার বেচে আমাদের ওই ঘাটতি উপশমের চেষ্টাও করে যাচ্ছে। সামনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া নানা ধরনের পদক্ষেপের ফলে দু-তিন মাসের মধ্যে এই সাময়িক সমস্যার সুরাহা হয়ে যাবে, সেটা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরেরই স্পষ্ট আশাবাদ।

এই সার্বিক শক্তিশালী অবস্থায় ব্যাংকের আমানতকারীদের এত চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। এলসি খোলার বেলায় ব্যাংকগুলো যে সাময়িক কড়াকড়ি করছে, তাতে ব্যাংকের একজন আমানতকারী হিসাবে আপনার উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। এলসি হলো ব্যাংকের বৈদেশিক ব্যবসা আর আমানতকারীদের টাকা আমরা বিনিয়োগ করেছি মূলত লোন হিসাবে। এলসি খুলতে না পারার কারণে ব্যাংক কখনো দেউলিয়া হয় না। এতে ব্যাংকের মুনাফা কিছুটা কমে, এই যা।

শেষ কথা : বাংলাদেশ মজবুত এক অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর দাঁড়ানো ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের বড় অর্থনীতির দেশ। সমস্যা যে নেই, তা নয়। কোনো কোনো ব্যাংকে মন্দ ঋণের সমস্যা আছে, কোথাও সুশাসনের সমস্যা আছে। তাই বলে আপনার টাকা তুলে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরির প্রশ্নই ওঠে না। উঠলে এত দিনে এ দেশে দু-একটা ব্যাংক ধসে যেত। যায়নি কারণ, সব সমালোচনার পরও ব্যাংকব্যবস্থায় রয়েছে ওই তারল্য ও উদ্বৃত্ত তারল্যের উপস্থিতি; আর রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মিত কড়া চোখ। এ সময়ে কিছু স্বল্পস্থায়ী সমস্যাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে আপনার ব্যাংক হিসাবের টাকা যারা অকারণে ব্যাংক থেকে তুলে নিতে বলছে, তারা আপনার ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই করছে না। সে ক্ষতিটার শিকার যাতে আপনি না হন, তাই উপরের এতগুলো তথ্য-উপাত্ত-অঙ্ক। অঙ্কই কথা বলুক; আর কথা বলুক আমাদের ব্যাংকিংব্যবস্থার ইতিহাস।

মাসরুর আরেফিন : এমডি ও সিইও, দ্য সিটি ব্যাংক; ভাইস প্রেসিডেন্ট, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স ।

অর্থনীতি

বাজেট সহায়তা দেওয়ার আগে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খতিয়ে দেখছে বিশ্বব্যাংক। এর অংশ হিসাবে সোমবার পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলমের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল। এতে নেতৃত্ব দেন সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়ার রিজিওনাল ডিরেক্টর ম্যাথিউ ভারগিস। বৈঠকে উন্নয়ন প্রকল্পের গতি বৃদ্ধি এবং প্রকল্পের কেনাকাটায় স্বচ্ছতা নিশ্চিতের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ই-জিপি (ই-টেন্ডার) সম্প্রসারণের কথা বলা হয়েছে বলে জানান পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে তার সম্মেলন কক্ষে ব্রিফিং করেন তিনি।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী জানান, প্রতিশ্রুত ২৫ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা ছাড় করার আগে তারা বেশ কিছু বিষয় জানতে চেয়েছেন। এর মধ্যে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি, রিজার্ভের অবস্থা, মূল্যস্ফীতি, ভ্যাট আইন সংস্কার, সিপিটিইউকে পাবলিক প্রকিউমেন্ট অথরিটি করার অগ্রগতি এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। উত্তরে প্রতিমন্ত্রী তাদের বলেছেন, আমাদের রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন থেকে কমে গেছে, এটা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু আমাদের রপ্তানি বাড়ছে ২৫ শতাংশ হারে। আমদানি বাড়ছে ২৩ শতাংশ হারে। এক্ষেত্রে আমদানির তুলনায় রপ্তানি বাড়ছে। গত এক মাসে রেমিট্যান্স এসেছে দুই বিলিয়ন ডলার। ফলে আমরা এখন স্বস্তিদায়ক অবস্থায় আছি। ফলে রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে। এত দুর্যোগের মধ্যেও আমাদের বিনিময় মূল্য স্থিতিশীল আছে। কোথাও উৎপাদন ব্যাহত হয়নি। অর্থনীতি আমাদের আয়ত্তে আছে। তবে রিজার্ভ ধরে রাখতে আমাদের বাজেট সহায়তা প্রয়োজন। প্রচুর বৈদেশিক ঋণ এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ দরকার। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের গতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মেগা প্রকল্পসহ দেশের সব প্রকল্পের গতি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। আমরা গ্রিন গ্রোথে (সবুজ প্রবৃদ্ধি) গুরুত্ব দিচ্ছি। তবে ব্যবস্থাপনার অদক্ষতাই প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে উন্নয়ন করা হচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধানে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়েছে।

উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংকের কাছে নতুন করে ১০০ কোটি ডলার এবং আগে প্রতিশ্রুত ২৫ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা দ্রুত ছাড় করতে অনুরোধ জানায় সরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ সফর করছে।

অর্থনীতি

দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার থেকে মার্কিন ডলার আয় ক্রমশ কমছে। মূলত বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির প্রভাবে উন্নত বিশ্বের ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে এ শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

এছাড়া শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খুলতে বেশি টাকায় ডলার কিনতে হচ্ছে। কিন্তু রপ্তানি আয় (ডলার) নগদায়নের ক্ষেত্রে মিলছে কম টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমদানি বিল পরিশোধসংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারিকৃত প্রজ্ঞাপন। সম্প্রতি এটা জারি করা হয়।

উল্লিখিত কারণগুলো রপ্তানি আয়ের প্রধান খাতে বড় ধরনের সংকট তৈরি করছে। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমএই এবং বিকেএমইএ। বিদ্যমান সংকট মোকাবিলায় দুটি সংগঠনের পক্ষ থেকে একাধিক প্রস্তাবসহ অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সূত্রমতে, সংকট কাটিয়ে উঠার প্রস্তাবে বলা হয়েছে ডলারের বিনিময় মূল্য নির্ধারণের এখতিয়ার শুধুই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। অন্য কোনো সংগঠনের নয়। ডলারের বিনিময় মূল্য নির্ধারণে বৈষম্যের কারণে লোকসান গুনতে হচ্ছে পোশাক শিল্পকে। সেখানে রপ্তানি আয় (মার্কিন ডলার) নগদায়নের ক্ষেত্রে ডলারের মূল্য রেমিট্যান্স নগদায়নের মূল্যের সমান করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এছাড়া রপ্তানিতে উৎসে কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৫০ শতাংশ করার বিষয়টিও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

জানতে চাইলে বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ১০৫ থেকে ১০৭ টাকায় প্রতি ডলার কিনে এখন পোশাক শিল্পের জন্য কাঁচামাল আমদানির এলসি খুলতে হচ্ছে। আবার রপ্তানি আয় ভাঙানোর ক্ষেত্রে ডলারের বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ৯৯ টাকা।

আবার রেমিট্যান্স ভাঙানোর ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের মূল্য পাওয়া যাচ্ছে ১০৭ টাকা। সঙ্গে ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা মিলে ডলারের মূল্য দাঁড়ায় ১১০ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) কাছে। তারা ডলারের মূল্য নির্ধারণ করে ব্যাংকগুলোকে একটি লুটপাটের রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে। ব্যাংকগুলো তাই করছে। এখন রপ্তানি খাতে ডলারের মূল্য পুনর্নিধারণ করতে হবে।

একটি শীর্ষ রপ্তানিকারক বলেন, ডলার সংকটের কারণে ইতালি থেকে একজন বায়ার তাদের অর্ডারের পণ্য নিতে দেরি হবে এমন বার্তা দিয়েছেন। তার কারখানায় প্রায় সাড়ে ৮ লাখ ডলারের পোশাক পড়ে আছে রপ্তানির অপেক্ষায়।

এ উদ্যোক্তার মতে, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি নির্দেশনা জারি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে নির্ধারিত সময়ে আমদানি বিল পরিশোধে ব্যর্থ হলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা বাণিজ্যের অনুমোদিত ডিলার (এডি) লাইসেন্স বাতিল করবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। এরপর অনেক ব্যাংক ভয়ে এলসি খুলছে না। তিনি (ওই রপ্তানিকারক) বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। ওই কর্মকর্তাও স্বীকার করেছেন এই মুহূর্তে এমন নির্দেশনা দেওয়া সঠিক হয়নি।

এদিকে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক থেকে ডলার আয় কমে যাওয়ার তথ্য উঠে আসছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর প্রতিবেদনে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবরে পোশাক খাতে প্রায় ১২৬ কোটি মার্কিন ডলার আয় হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দশমিক ৭৪ শতাংশ কম। এদিকে বিজিএমইএ’র আগাম পূর্বাভাসে বলা হয়েছে-রপ্তানির গতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যাচ্ছে, আগামী মাসগুলোতে এ ঋণাত্মক ধারা অব্যাহত থাকবে।

সূত্রমতে, সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে তৈরি পোশাক শিল্পের সার্বিক সংকট তুলে ধরে সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দিয়েছেন বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট ফারুক হাসান। সেখানে তিনি বলেছেন, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মূল্যস্ফীতির চরম আকার ধারণ করেছে। যার প্রভাবে শিল্পের কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে অস্বাভাবিক হারে। এছাড়া জ্বালানি সংকটের কারণে ব্যয় বৃদ্ধিসহ উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বিদেশি ক্রেতারা রপ্তানি আদেশ কমিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া ইতঃপূর্বের দেওয়া রপ্তানি আদেশ ধীরগতিতে শিপমেন্ট করতে বলা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বাতিল করছে রপ্তানির আদেশও।

ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, এর বিরূপ প্রভাব কিছু সংখ্যক রপ্তানিমুখী শিল্প তাদের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সময়মতো পরিশোধ করতে পারছে না। এতে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে। বর্তমান এই সংকটকালীন দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে আর্থিক সহায়তা প্রদান একান্ত প্রয়োজন। বিশেষ করে চলতি বাজেটে উৎসে কর দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। সেটি পুনরায় কমিয়ে দশমিক ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে অর্থমন্ত্রীকে। এ প্রস্তাব আগামী ৫ বছর পর্যন্ত কার্যকর করার কথা বলা হয়।

এদিকে ডলার বিনিময় হার জটিলতা তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারকে চিঠি দিয়েছে বিকেমএই। সেখানে বলা হয়, আমদানির দেনা পরিশোধের জন্য ১০৮.৫০ টাকা ডলারের মূল্য নির্ধারণ করা হলেও ব্যাক টু ব্যাক এলসি বা অন্য যে কোনো আমদানির দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ১০৫ থেকে ১০৬ টাকা দিয়ে ডলার কিনতে হয়।

অন্যদিকে রপ্তানি আয় নগদায়নের ক্ষেত্রে প্রতি ডলারে ৯৯ টাকা দেওয়া হচ্ছে। ডলার বিনিময় হারে এ নীতির কারণে বিশাল অঙ্কের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে পোশাক রপ্তানিকারকরা। এক্ষেত্রে পূর্বের ন্যায় ইডিএফ’র মাধ্যমে ব্যাক টু ব্যাক এলসির দেনা পরিশোধ সমন্বয় করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

অর্থনীতি

সাতটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এগুলো বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৯৮১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে তিন হাজার ৩৯২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, বৈদেশিক ঋণ সহায়তা থেকে ৩২২ কোটি ২১ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থা থেকে ২৬৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে।

মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত একনেক বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ, ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) সত্যজিত কর্মকার, আইএমইডির সচিব আবু হেনা মোর্শেদ জামান এবং তথ্য ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন।

পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, সন্দ্বীপসহ উপকূলীয় অনেক স্থানে জেটি নির্মাণ করা হলে স্থানীয়সহ পর্যটকদের সুবিধা হবে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের যেসব এলাকায় অবকাঠামো ঘাটতি আছে, অনুমোদিত প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সেই ঘাটতির অনেকটাই পূরণ হবে।

একনেকে অনুমোদিত প্রকল্পগুলো হচ্ছে— চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপ ও টেকনাফ অংশের জেটিসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনাদি নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৯১৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় অঞ্চল-২ ও অঞ্চল ৪-এর ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক অবকাঠামোসহ অঞ্চল-২, অঞ্চল ৫-এর সার্ভিস প্যাসেজগুলোর উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৬৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার বৈদ্যুতিক-যান্ত্রিক ও নিরাপত্তাব্যবস্থাসহ অন্যান্য উন্নয়ন কাজের ব্যয় ধরা হয়েছে ৯২ কোটি ১৭ লাখ টাকা। বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৬১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। নবীনগর-আশুগঞ্জ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা। দিনাজপুর অঞ্চলে টেকসই কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০২ কোটি ৪১ লাখ টাকা।

এ ছাড়া ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া চতুর্থবার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে দুটি প্রকল্পের, সেগুলো হলো— খুলনা শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন প্রকল্প। বরিশাল মেট্রোপলিটন ও খুলনা পুলিশ লাইন নির্মাণ প্রকল্প।

অর্থনীতি

গেল আগস্টে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি সরকারের ভর্তুকি কমাতে সাহায্য করবে। অপরদিকে আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে কমতে পারে বিনিয়োগ। অর্থ বিভাগের কাছে এমন মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, আগামী দিনে রাজস্ব আহরণ আরও হ্রাস পাবে। ক্রমাগত মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি অর্থনীতিতে মারাত্মক আঘাত হানছে। সব মিলিয়ে বৈশ্বিক সংকটের একাধিক ধাক্কায় দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি গভীর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাটি সম্প্রতি অর্থ বিভাগকে এসব তথ্য লিখিত আকারে জানিয়েছে।

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, আইএমএফ সামষ্টিক অর্থনীতির বিষয়ে নানা দিক জানতে চেয়েছে। অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে। ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তার প্রক্রিয়া হিসাবে ঢাকা সফর করছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। মিশনটি বুধবার ঢাকা ত্যাগ করার কথা। এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয়; জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়; বাংলাদেশ ব্যাংক; জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে।

সূত্র জানায়, দেশের অর্থনীতির সার্বিক বিষয় নিয়ে সম্প্রতি অর্থ সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের সঙ্গে সংস্থাটির প্রতিনিধিরা বৈঠক করেছেন। আইএমএফ-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯-এর প্রভাব কাটিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গতি ফিরে আসে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ফের আঘাত করে। এই যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বেড়েছে। পণ্যের সরবরাহ চেইনে বাধা সৃষ্টি এবং বৈশ্বিক চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। এর প্রভাবে চলতি হিসাবে ঘাটতি আরও বেড়েছে। পাশাপাশি টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। এছাড়া ক্রমাগত কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে অর্থনীতিতে আঘাত হেনেছে। আমদানি করতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে।

সংস্থাটি মনে করছে, এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন জিডিপির প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বলা হয়, গত এপ্রিলে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রতিবেদনে আইএমএফ-এর পর্যবেক্ষণ ছিল ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ অর্জন করতে পারে। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি এ প্রবৃদ্ধির হার আরও কমবে। আইএমএফ মনে করছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ৬ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।

সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২০০২ থেকে ২০০৬ অর্থবছর পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল। কিন্তু ২০০৯ থেকে ২০২২ অর্থবছর পর্যন্ত এ প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এটি ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ অর্জন হবে।

আইএমএফ মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে বলেছে, ঊর্ধ্বমুখীর কারণে অভ্যন্তরীণ খাদ্যপণ্যের দাম বেশি। সংস্থাটি মনে করছে, চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়াবে ৯ দশমিক ১ শতাংশ। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী থাকবে। ওই বছর মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৮ শতাংশে বিরাজ করতে পারে। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এটা কমতে পারে বলে ধারণা দিয়েছে। তবে অর্থ বিভাগ থেকে জানানো হয়, ২০০৮ সালে মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এটি জুনে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ ওঠে। তবে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ১ শতাংশ।

আইএমএফ বাজেট ঘাটতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাদের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বাজেট ঘাটতি চলতি অর্থবছরে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হবে। আর আগামী অর্থবছরে এটি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া চলতি ও আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায় কমবে। রাজস্ব আহরণ জিডিপির ১১ শতাংশ হবে এবং আগামী অর্থবছরে সেটি ১০ দশমিক ৯ শতাংশ হবে। এটি জিডিপির ৯ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে। তবে আগস্টে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করেছে সরকার। এতে সরকারের ভর্তুকি কিছুটা কমবে, যা স্বস্তিদায়ক। সরকারের পরিচালন ব্যয়ও কমবে।

জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আইএমএফ ৪৫০ কোটি ডলারের মধ্যে ১৩০ কোটি ডলার দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। এজন্য বৈঠক শেষে আইএমএফ-এর একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে আসছে। এই ঋণের বিপরীতে ভ্যাট যৌক্তিককরণ, প্রশাসনিক অটোমেশন, ভর্তুকি টার্গেটসহ নানা ধরনের শর্ত দেওয়া হয়েছে। তবে খুব বেশি কিছু করতে হবে না। মোটা দাগে দুই থেকে তিনটি সংস্কার করলে এই ঋণ পাওয়া যাবে। তিনি আরও বলেন, এ মুহূর্তে আইএমএফ-এর ঋণ পেলে অনেক ভালো হবে। কারণ রিজার্ভ এখনো সংকটে আছে।

অর্থনীতি

তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, দেশ ও জনগণের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ অবিচল। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ গণমানুষের দল। সমস্ত রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ জন্মলগ্ন থেকে অকুতোভয়ে কাজ করে আসছে। আমরা আপোষ করি না, আপোষ জানি না। দেশের প্রশ্নে, জনগণের প্রশ্নে, রাষ্ট্রের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সবসময় অবিচল।’ মন্ত্রী আজ দুপুরে রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির নাট্যশালা মিলনায়তনে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) নতুন কমিটির অভিষেক ও গুণীজন সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন।

বিএনপি নেতাদের মন্তব্য ‘আওয়ামী লীগ পালিয়ে যাবে’ এর জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘পালানোর ইতিহাস তো বিএনপির। তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া এই বলে মুচলেকা দিয়ে বিদেশ চলে গেছেন যে, তিনি আর রাজনীতি করবেন না এবং তার সাথে আরো অনেকেই পালিয়ে গেছেন।’ হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আজ শুধু সরকারে নয়, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষকসহ দেশের সবপেশার মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আগের তুলনায় অনেক গভীরে  প্রোথিত হয়েছে। সে কারণেই বিএনপির  গাত্রদাহ, কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না। যে দলের মহাসচিব বলে পাকিস্তান আমলই ভালো ছিল, তারা কোন চেতনায় বিশ্বাস করে, তা সহজেই অনুমেয়। তারা আসলে পাকিস্তানের পক্ষে।’ বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ নিয়ে প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, সরকার ও জনগণের সম্পত্তি ধ্বংস করা থেকে বিএনপি যদি বিরত থাকে, তাহলে তাদের সভা-সমাবেশ নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই।

সরকার এক্ষেত্রে তাদেরকে সহযোগিতা করছে এবং সেই কারণেই তারা সমাবেশ করতে পারছে। ‘আর আমরা যখন বিরোধী দলে  ছিলাম, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে  তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় বৃষ্টির মতো গ্রেনেড ছুঁড়ে হামলা করা হয়েছিল, ২৪ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল’ উল্লেখ করেন মন্ত্রী হাছান। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন বিরোধী দলে ছিলাম, তখন আওয়ামী লীগ অফিসের দু’পাশে কাঁটাতারের স্থায়ী বেড়া ছিল, তার বাইরে আমাদের যেতে দেওয়া হতো না। তখন শেখ হেলাল এমপিকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার জনসভায় হামলা করে কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছিল। সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের জনসভায় হামলা করা হয়েছিল, এস এম কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টারের জনসভায় হামলা করে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছিল।’ ‘এভাবে আমরা বিরোধী দলে থাকতে আমাদের শতশত নেতকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু বিএনপির সমাবেশে তো বোমা বা গ্রেনেড দূরে থাক, একটি পটকাও তো ফোটে নি’ দৃষ্টান্ত দেন হাছান।

এর আগে বক্তৃতায় বাচসাসের নতুন কমিটিকে অভিনন্দন জানিয়ে তারা তাদের লেখনী ও চিত্রের মাধ্যমে দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে এগিয়ে নিতে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাবেন বলে আশা ব্যক্ত করেন মন্ত্রী। ড. হাছান বলেন, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ। বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রায় ২০০ সিনেমা হল আবার চালু হয়েছে শুনে তিনি অত্যন্ত উৎসাহিত হয়েছেন ও আমাকে বলেছেন সবাইকে আরও সিনেমা হল নির্মাণের জন্য বলতে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে নতুন সিনেপ্লেক্স, সিনেমা হল নির্মাণ ও পুরনো হল সংস্কারের জন্য ১ হাজার কোটি টাকার সহজ ঋণ তহবিল গঠিত হয়েছে। কেউ যদি মার্কেটে সিনেপ্লেক্স নির্মাণ করতে চায়, তাহলে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ পাবে। ব্যাংকগুলোকেও আমরা ঋণ দিতে উদ্বুদ্ধ করবো। আমাদের সিনেমা শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, খুব সহসাই বিশ্ব অংগনে আরো ভালো জায়গা করে নেবে, আশাপ্রকাশ করেন তথ্যমন্ত্রী।
বাচসাস সভাপতি রাজু আলীমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান, বিএফইউজের সাবেক সভাপতি মোল্লা জালাল, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনা পরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান, একুশে পদকপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী পাভেল রহমান, চিত্রনায়ক ওমর সানী ও বাচসাস সাধারণ সম্পাদক রিমন মাহফুজ।

এ দিন বাচসাস সম্মাননা-২০২২ প্রাপ্ত হন- সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য রাবেয়া খাতুন (মরণোত্তর), সাহিত্য নির্ভর ্র চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক (মরণোত্তর), একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার (মরণোত্তর), বরেণ্য সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী (মরণোত্তর), সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ, সাংস্কৃতিক জাগরণে অনবদ্য অবদানের জন্য লিয়াকত আলী লাকী, সাহিত্য নির্ভর চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য আনিসুল হক, নাটক ও চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য মাসুম রেজা, একুশে পদকপ্রাপ্ত ফটো সাংবাদিক ও বাচসাস সদস্য পাভেল রহমান, চলচ্চিত্র শিল্প ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের জন্য চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন, টিভি সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য মোজাম্মেল বাবু, চলচ্চিত্র প্রযোজনায় বিশেষ অবদানে হাবিবুর রহমান খান, হাসিনা- এ ডটার’স টেল চলচ্চিত্রের জন্য পিপলু আর খান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, বরেণ্য সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক শেখ সাদী খান, চারুশিল্পী, অভিনয় ও নির্দেশনায় আফজাল হোসেন, চলচ্চিত্র শিল্পে অবদান রাখার জন্য চিত্রনায়ক শাকিব খান ও সঙ্গীতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত কণ্ঠশিল্পী কোনাল ও ইমরান মাহমুদুল।

এদিকে নবনির্বাচিত কার্যনির্বাহী পরিষদের অভিষেক অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান, হল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সাবেক সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার, নির্মাতা সাজ্জাদ হোসেন দোদুল,পরিচালক এস এ হক অলিক, অপূর্ব রানা, শাহ মোহাম্মদ সংগ্রাম, গাজী মাহবুব, খিজির হায়াত, চিত্রনায়িকা অরুনা বিশ্বাস,অঞ্জনা রহমান, শাহ হুমায়রা সুবহা, চিত্রনায়ক ওমর সানী, সঙ্গীতশিল্পী দিঠি চৌধুরী, অভিনেতা শাহেদ শরীফ খান, চিত্রনায়ক তানভীর তনু, অভিনেতা রাশেদ সীমান্ত ,অভিনয় শিল্পী সংঘের নেতৃবৃন্দের মধ্যে প্রাণ রায়, ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর প্রমুখ।

অর্থনীতি

ব্যাংক ঋণের বিদ্যমান সুদহার বাড়ালে দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই)’র সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। তিনি বলেছেন, দেশে বিনিয়োগ সম্প্রসারণ এবং শিল্প সচল রাখতে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানো যাবে না। সুদহার ৯ শতাংশ তুলে দিলে শিল্প তার সক্ষমতা হারাবে।

শনিবার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ইআরএফ সংলাপে তিনি এসব কথা বলেন। রাজধানীর পুরানা পল্টন ইআরএফ কার্যলয়ে সংলাপের আয়োজন করা হয়।

জসিম উদ্দিন সুদহার না বাড়িয়ে ব্যাংকের সক্ষমতা বাড়ানোর পক্ষে জোরালো মত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সুদহার বাড়ানো হলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমনটা ঠিক নয়।

তিনি বলেন, যখন সুদহার কমানো হয়েছে, তখন দেশে অনেক বিনিয়োগ বেড়েছে। ঋণের সুদহার বাড়ানোর বিষয়ে একেক ধরনের এজেন্ডা থাকে, গবেষণা সংস্থাগুলোর। তারা একেক জনের প্রতিনিধিত্ব করে এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায় বলে তিনি মন্তব্য করেন। জসিম উদ্দিন বলেন, বাস্তব হচ্ছে-এর ফলে শিল্প টিকে থাকবে কিনা? বর্তমান অবস্থায় সুদহার বাড়ালে শিল্প কোথায় যাবে। তিনি বলেন, বাড়তি ব্যয় কমিয়ে ব্যাংকের সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। ব্যয়বহুল শাখাসহ ব্যাংকের অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যয় কমাতে হবে।

এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই সভাপতি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব মুদ্রা ডলার শক্তিশালী করতে সুদহার বাড়িয়েছে। তাদের ফর্মুলা আমাদের দেশে বাস্তবায়ন করলে চলবে না। দেশের শিল্পের কথা বিবেচনা করেই নীতি গ্রহণ করতে হবে।

জ্বালানি স্বল্পতা মোকাবিলায় তিনি বলেন, আমাদের কয়লা ভিত্তিক জ¦ালানিতে যেতে হবে। নিজস্ব কয়লা ব্যবহার করতে হবে। দেশের উন্নয়নে শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব জ¦ালানি সহযোগিতা লাগবে। বাংলাদেশ বিশে^র নবম ভোক্তা বাজার হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই বাজার ঘিরে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। বিদ্যমান বিনিয়োগের সঙ্গে আরও নতুন বিনিয়োগ আসলে তাদের ধরে রাখতে জ¦ালানি সহযোগিতা বাড়াতে হবে।

জ্বালানি স্বল্পতার বিষয়ে অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, গ্যাস ও বিদ্যুৎ এখন বড় ইস্যু। কোভিডের সময় সিদ্ধান্ত ছিল কারখানা বন্ধ করা যাবে না। এটা সাহসী সিদ্ধান্ত। চলমান সংকটেও তেমন সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। কারণ গত বছর ৫২ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি হয়েছে। তখন ৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বলা হলেও বাস্তবে এতটা ছিল না। জসিম উদ্দিন আরও বলেন, এখন গ্যাস-বিদ্যুৎ না পেলে বিদেশি ক্রেতার অর্ডার অনুযায়ী পণ্য দিতে ব্যর্থ হবো আমরা। এর ফলে ক্রেতারা একবার ফিরে গেলে আর পাওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বন্ধ করাসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নিয়ে শিল্পে গ্যাস চালু রাখতে হবে।

জ্বালানি সরবরাহের বিষয়ে তিনি একটি প্রস্তাব তুলে ধরে বলেন, বিশ^বাজারে জ¦ালানির দাম বেড়েছে. তাই গ্যাস বেশি দামে আমদানি করতে হবে। সেক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা শিল্প কারখানায় নিরবিচ্ছন্ন গ্যাস নিশ্চিত করার জন্য বেশি দাম দিতে রাজি আছে।

অর্থপাচার বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু বলেছে, আমদানির আড়ালে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত মূল্য দেখানোর প্রমাণ পেয়েছে তারা। আন্ডার ইন ভয়েস ও ওভার ইন ভয়েসের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে। তাদের উচিত জড়িতদের আইনের আওতায় আনা।

এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, যেসব পণ্য আমদানির প্রয়োজন বেশি তা দেশে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হলে আমদানিতে ডলারের ব্যয় কমে যাবে। তাতে ডলার ঘাটতি কিছুটা লাঘব হবে। এ দিকে এখন নজর দেওয়ার প্রয়োজন।

তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি শুধু শহর কেন্দ্রিক নয়। এখন গ্রামেরও উন্নয়ন হয়েছে। এ কারণে শুধু কর ব্যবস্থা শহরে সীমাবদ্ধ না রেখে উপজেলা পর্যায়ে কার্যক্রম বাড়ানো দরকার। ২১০০ সালের এজেন্ডা (ডেল্টা প্লান) এক দিনে হবে না। এটি ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এ জন্য দেশের শিল্পের উন্নয়ন বাড়াতে হবে। পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন অব্যহত রাখতে হবে।

ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সংলাপে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সহসভাপতি এম শফিকুল আলম। অনুষ্ঠানে ইআরএফের শতাধিক সদস্য উপস্থিত ছিলেন।