জাতীয়

১৯১১-তে সম্রাট পঞ্চম জর্জ ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতা গোখেলকে প্রশ্ন করেছিলেন, ইংরেজরা ভারতের অনেক উন্নতি করিয়ে দিলেও ভারতীয়রা স্বাধীনতা চায় কেন। গোখেলের ঝটপট উত্তর ছিল, ভারতীয়রা স্বাধীন হয়ে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অর্থাৎ গোখেলের বিবেচনায় স্বাধীনতা আত্মমর্যাদার সমার্থক ছিল। কবি শামসুর রাহমানের পঙক্তি আছে-‘স্বাধীনতা মানে ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।’ বুঝতে অসুবিধা হয় না, এখানে স্বাধীনতা মানে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলা হয়েছে।

খ্যাতকীর্তি মার্কিন ইতিহাসবিদ হানাহ আরেন্ডেটের একটি সাড়া জাগানো প্রবন্ধ আছে, যার শিরোনাম ‘Freedom’। প্রবন্ধটির একটি নজরকাড়া বাক্য হলো, স্বাধীনতা মানে দায়িত্ব (Freedom means responsibility)। স্বাধীন সত্তায় বিকশিত হওয়া দায়িত্বই তো বটে, বিশেষ করে স্বাধীন জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বের জন্য।

স্বাধীনতার তিনটি নির্দেশিত মানে ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতার মানে এবং তার স্থিতিপত্র তৈরি করা যায়। স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন মানে তা শুধু অনুষ্ঠানসর্বস্বতা নয়, বা নয় আবেগে উদ্বেলিত হওয়া; স্বাধীনতার উদ্যাপন মানে মনের গহিনে স্বাধীনতার একটি স্থিতিপত্রও তৈরি করা। উল্লেখ্য, বছর বছর এমন স্থিতিপত্র তৈরি করার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার মানে পরিস্ফুট হবে। অর্থাৎ আমরা বুঝতে পারব স্বাধীনতার মানে অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছি কিনা। অবশ্য আমরা কজন তা করি বা কেউ আদৌ তা করে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। কিন্তু মনে হয় তা করা উচিত। কারণ, তা না হলে স্বাধীনতাকে ঘিরে প্রত্যাশা-প্রাপ্তির সমীকরণ হয় না।

অবশ্য এমন স্বাধীনতার মানে প্রত্যাশী স্থিতিপত্র তৈরি করতে হলে আমাদের হতে হয় কিংবদন্তির রোমক দেবতা জেনাসের মতো। জানা আছে, জেনাসের দুটো মুখ আর চারটি চোখ ছিল। ফলে সে সামনে-পেছনে উভয় দিকেই দেখতে পেত। অবয়বে আমরা জেনাস হতে পারব না; কিন্তু মানসিকভাবে পারি। মনের চোখ সামনে-পেছনে ছড়িয়ে অতীত-বর্তমানের তুলনামূলক পর্যালোচনা করতে পারি; এমনকি ভবিষ্যৎও ভেবে নিতে পারি।

তাহলে এবার আসা যাক স্থিতিপত্রের প্রথম খাতের কথায়; যা হলো আত্মমর্যাদা। বহুশ্রুত কবির পঙ্ক্তি আছে ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় বল’। স্বাধীনতাহীনতায় বাঁচা মানে মর্যাদাহীন বাঁচা। ব্যক্তিগতভাবেই হোক আর সমষ্টিগতভাবেই হোক, স্বাধীন সত্তা তাই পরম কাঙ্ক্ষিত। উভয় পরিপ্রেক্ষিতে এমন প্রত্যাশার রূপায়ণ প্রক্রিয়াকে বলে আত্মঅধিকার (self-determination) প্রতিষ্ঠা। ’৭১-এর ৭ মার্চের ভাষণে যখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাঙালিকে ‘আর দাবায়ে রাখতে পারবা না’, তখন তাতে বাঙালির আত্মঅধিকার প্রতিষ্ঠার বার্তা নিহিত ছিল। আর আত্মঅধিকার প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটি ছিল মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ প্রমাণ করেছিল সাবাস বাংলা দেশ,

এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়,

জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার,

তবুও মাথা নোয়াবার নয়।

আমরা মাথা নোয়াইনি; শত্রুহননের সাফল্যে মাথা তুলে মেরুদণ্ড সোজা করে স্বাধীনতাকে নির্বিঘ্ন করে বিশ্বের বুকে স্থান করে নিয়েছি। উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিতে কবি সুকান্ত বাঙালির চিরদ্রোহী সত্তার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ যে আমাদের দ্রোহী সত্তার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ, তা বলার জন্য কোনো যুক্তি-প্রমাণের প্রয়োজন নেই। বলা বাহুল্য, বাঙালির দ্রোহী সত্তা ভাষিক জাতীয়তাবাদের পাটাতনে স্বাধীন বাংলাদেশ নামে এক রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব নির্মাণ করেছে। এ রাষ্ট্রই বাঙালির আত্মমর্যাদার সূচক। স্বাধীনতা আমাদের অর্জন। স্বাধীনতার সংরক্ষণ আমাদের কৃতিত্ব।

বিগত সাড়ে চার দশকে এ অর্জন ও কৃতিত্বে কি কোনো সংযোজন হয়েছে? একাধিক সূচকের ভিত্তিতে আমাদের নির্দ্বিধ উচ্চারণ হতে পারে যে, আমাদের সংযোজন অনেক। বাহাত্তরের ধ্বংসস্তূপ বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে থাকা দেশের নাম। আমাদের অনেক ব্যর্থতা আছে, আছে বিচ্যুতিও। তবুও বাংলাদেশ এখন নানা কারণে তৃতীয় দুনিয়ার এক মডেল দেশ।

কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় স্বাধীনতার অনেক মানে তুলে ধরা হয়েছে। তবে উদ্ধৃত পঙ্ক্তিতে যে মানে আছে, তা অর্থনৈতিক মুক্তির। স্মর্তব্য, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে মুক্তির প্রসঙ্গ এসেছে একাধিকবার; স্বাধীনতার প্রসঙ্গ মাত্র একবার। তবে স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে মুক্তির সোপান রচিত হয়। আর বঙ্গবন্ধু সার্বিক মুক্তির নির্দেশনা দিয়েছিলেন, যা অর্জিত হবে স্বাধীন বাংলাদেশে। সেই কারণে বলা চলে, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর; আর মুক্তির যুদ্ধ শুরু হয়েছে ’৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর থেকে, যা আজও চলমান। মুক্তির এ যুদ্ধ অনিঃশেষ, চলে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত। অবশ্য চূড়ান্ত মুক্তি অর্জন কোনো দেশে বা ব্যবস্থায় সম্ভব হয়নি; কিন্তু লক্ষ্যে অবিচল থাকাটাই আসল কথা। মুক্তির লক্ষ্যহীন স্বাধীনতা অন্য কথায় স্বাধীনতার প্রহসন বৈ আর কিছু নয়। সুতরাং, বাংলাদেশে সার্বিক মুক্তির যে যুদ্ধ চলমান, তা অব্যাহত থাকবে যতদিন না লক্ষ্য অর্জিত হয়। এ যুদ্ধে আজ পর্যন্ত আমাদের সাফল্য আছে, আছে ব্যর্থতাও। অবশ্য ব্যর্থতার অর্থ হলো, আমরা যা অর্জন করতে পারিনি; কিন্তু যা অর্জন করা উচিত ছিল বা যা অর্জন করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।

আর্থসামাজিক অঙ্গনে যে সাফল্যগুলো আমাদের শ্লাঘা ও বিশ্বের বিস্ময়ের কারণ, তার সূচনা হয়েছিল চরম প্রতিকূল পরিবেশে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর ধ্বংসস্তূপ বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে একজন ড. হেনরি কিসিঞ্জারের তির্যক ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, বাংলাদেশ হবে তলাহীন ঝুড়ি। ড. কিসিঞ্জার কাগুজে কূটনীতিক হিসাবে খ্যাতকীর্তি ছিলেন; কিন্তু বাস্তবে নয়। কারণ বাংলাদেশের অভ্যুদয় রুখে দেওয়ার বাস্তব কূটনীতিতে তিনি ব্যর্থ ছিলেন। আর যা হোক, তিনি ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা ছিলেন না। তার প্রমাণ আর্থসামাজিক খাতে শনৈ শনৈ এগিয়ে চলা আজকের বাংলাদেশ। অনস্বীকার্য, শুরুতে বাংলাদেশ তলাহীন ঝুড়ি হিসাবে প্রতীয়মান হয়েছিল; কিন্তু আজ বাংলাদেশ নামের ঝুড়িটির শক্ত তলা হয়েছে। উপরন্তু, ঝুড়িটি কানায় কানায় পূর্ণ না হলেও, তা করার আয়োজন-উদ্যোগের কমতি নেই; এবং যা পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতির মোড়ল বিশ্বব্যাংকেরও নজর কেড়েছে।

অবশ্য উল্লেখ্য, বাংলাদেশকে তলাহীন ঝুড়ি হিসাবে চিরদিন রেখে দেওয়ার লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অভাব ছিল না বা এখনো নেই। কিন্তু তবু বাংলাদেশ তার স্বীয়তানির্ভর (autonomy-based) অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রেখেছে। স্মর্তব্য, স্বাধীনতার পর ষড়যন্ত্রের কারণে বিগত শতকের ষাট-সত্তর দশকে আফ্রিকীয় সমাজতন্ত্র (African Socialism) ব্যর্থ হয়েছিল। আফ্রিকার নিজস্ব ধাঁচের এ সমাজতন্ত্র টিকে থাকলে আফ্রিকার দেশগুলো আজ অনেক এগিয়ে যেতে পারত; কিন্তু বিপরীতে বাংলাদেশকে দমিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। আজ বাংলাদেশ অন্তত আর্থসামাজিক মানদণ্ডে ঘুরে দাঁড়ানো এক বিস্ময়কর দেশ; এবং অনেক ক্ষেত্রে দেশটি ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে।

অবশ্য আর্থসামাজিক প্রবৃদ্ধি ও প্রগতির মানে এ নয়, আমরা মুক্তির চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করেছি। আমাদের প্রত্যাশা-প্রাপ্তির মধ্যে এখনো বিরাজমান দুস্তুর ব্যবধান। আপাতদৃষ্টিতে ধনীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান; আর সেই কারণে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধানও ক্রমবর্ধমান, যা সামাজিক অস্থিরতার কারণ। রয়েছে সামাজিক অপরাধ-সূচকের ঊর্ধ্বগতি। উপরন্তু আছে শহর আর গ্রামের বৈষম্য। আছে কর্মসংস্থানের ঘাটতি ও বেকার সমস্যা। ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তার একটি জায়গায় বলেছিলেন, ‘দেশের মানুষ যদি খেতে না পায়, বেকার যুবক যদি চাকরি না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে।’ দেশের মানুষ এখন খেতে পায়; কারণ বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতির দেশ নয়। গণদারিদ্র্যের হারও কমেছে। কিন্তু বেকারত্ব সমস্যার আশানুরূপ সমাধান এখনো হয়নি। উদ্যোগ আছে, সময়ের ব্যবধানে সাফল্য অনিবার্য।

এবার স্বাধীনতার মানে নিয়ে সবশেষ প্রসঙ্গে আশা যাক। স্বাধীনতার প্রতি আমরা কতটুকু দায়িত্বশীল ছিলাম বা আছি? এতদিনের যা অর্জন, তাতে নিঃসন্দেহে প্রতিফলিত আমাদের দায়িত্বশীলতা। অন্যদিকে যা কিছু অর্জন করতে পারিনি, তা আমাদের দায়িত্বহীনতার প্রতীক। অবশ্য দায়িত্বহীনতা প্রসঙ্গে পরিস্থিতির প্রতিকূলতা একটি বিবেচ্য অনুষঙ্গ। ধরা যাক গণতন্ত্রের কথা। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের আট হাজার আটশত তিরাশি দিনে আমরা গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলাম। আর এ কারণে গণতন্ত্রের প্রতি এক ধরনের কাঠামোগত অঙ্গীকার (structural commitment) নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছিল। বাহাত্তরের সংবিধান গণতান্ত্রিক অঙ্গীকারের প্রতীক। কিন্তু তারপর গণতন্ত্র যেন মরু পথে হারানো নদীর ধারার মতো হয়ে গেল; যা অকল্পনীয় ছিল বা যা ছিল পাকিস্তানি ঐতিহ্য, সেই সামরিক শাসন এবং প্রকারান্তরে সামরিক শাসন বাংলাদেশের ওপর চেপে বসল, থাকল একানব্বই পর্যন্ত। প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মুখে সামরিক স্বৈরাচার পিছু হটেছিল; গণতন্ত্র মুক্তির দরজাও উন্মুক্ত করল; কিন্তু এখন পেছন ফিরে দেখে যদি প্রশ্ন করি, গণতন্ত্র মুক্তি পেয়েছে কি? উত্তরটি মিশ্র হতে বাধ্য। কারণ আমরা গণতন্ত্রের পথে এগিয়েছি, কিন্তু গন্তব্য এখনো বহুদূর। জানা কথা, গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার; গণতন্ত্র স্বল্প সময়ে বা রাতারাতি হয় না। কোথাও তা হয়নি। সুতরাং, গণতন্ত্রের প্রতি দায়িত্ব পালনে আমাদের ভূমিকা আংশিক। ভূমিকার সম্পূর্ণতার লক্ষ্যে উদ্যোগ অব্যাহত আছে। সুতরাং, আছে আশাবাদও। তবে যতদিন চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত না হচ্ছে, ততদিন বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক না বলে গণতন্ত্রায়নের রাষ্ট্র বলা যৌক্তিক।

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল্স (বিইউপি)

জাতীয়

বাঙালি মুক্তি চেয়েছিল। দ্বিজাতিতত্ত্বের অবৈজ্ঞানিক ধারণায় সৃষ্ট পাকিস্তান নামের নরকবাস থেকে বেরিয়ে মাতৃভূমির খোলা আকাশের নিচে নিঃশ্বাস নিতে চেয়েছিল। স্বাধীনতার আশার নেমেছিল রাজপথে। আর পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাঙালিকে দিয়েছিল ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাত। বাঙালির শরীরে রাইফেল ও বেয়োনেটের নৃশংসতায় কেঁপে উঠেছিল পুরো ঢাকা। বর্বরতার ডানায় ভর করে ১৯৭১ সালের সেই রাতে এসেছিল মৃত্যুর ঘনতমসা। পৃথিবীর ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিল আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশে। আজ সেই কালরাত ও গণহত্যা দিবস।

রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরীহ-নিরস্ত্র স্বাধীনতাকামী বাঙালি জনগণের ওপর। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্ণ সামরিক সম্ভার নিয়ে রাত ১০টার পর সারা দেশে পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা শুরু করে তারা। সামরিক ভাষায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচিত ছিল পাক-হানাদারদের এ হত্যা-অভিযান। শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ এড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাঙালি হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের পথেই এগিয়েছিল। অত্যাচার, উৎপীড়ন, পাশবিকতা, নৃশংসতা আর হিংস্রতার কালো থাবায় বিভীষিকা ছড়িয়ে দিয়েছিল পুরো ঢাকা শহরে।

বর্বর হত্যাযজ্ঞের দিনটি ‘গণহত্যা দিবস’ হিসাবে বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে। কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হামলার সেই নৃশংস ঘটনার স্মরণে ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদের চতুর্দশ অধিবেশনে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করা হয়। দিনটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ‘গণহত্যা দিবস’ উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। স্বাধীনতার জন্য প্রাণ উৎসর্গকারীদের প্রতি তারা গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।

১৯৭১ সালে এ বর্বরোচিত হামলায় বিশ্ববাসী হতবাক হয়ে দেখেছিল উš§ত্ত পাকবাহিনীর গণহত্যাকাণ্ড। মধ্যযুগীয় কায়দায় হানাদাররা রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ গোটা ঢাকা শহরে চালায় হত্যাযজ্ঞ, করে অগ্নিসংযোগ। এই রাতেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি দেশকে শত্র“মুক্ত করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে দেশের মানুষের প্রতি আহ্বান জানান।

২৫ মার্চের কালরাতের বেদনাদায়ক ঘটনা সমগ্র জাতিকে শিহরিত করে। নির্বিচারে পাখির মতো গুলি চালিয়ে নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠ স্তব্ধ করা যায়নি। ভয়াবহ সেই কালরাতের হত্যাযজ্ঞ বাঙালিকে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রেরণা জোগায়।

প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের এই দিন সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সরাসরি এয়ারপোর্ট চলে যান। নিরপরাধ বাঙালির ওপর কাপুরুষোচিত সশস্ত্র হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়ে তিনি রাত পৌনে ৮টায় গোপনে বিমানে ঢাকা ত্যাগ করেন। পাক হানাদার বাহিনীর জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে জল্লাদের মতো বাংলার নিরপরাধ জনগণের ওপর মেশিনগান, মর্টার আর ট্যাংক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং শহরে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে।

রাত ১টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনা অনুযায়ী ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের সেনারা পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ চালায়। কেন্দ্রীয় কোয়ার্টারে ১৮ জন বাঙালি গার্ড থাকলেও তারা পালটা আক্রমণের সুযোগ পাননি। পিলখানা আক্রমণের পাশাপাশি রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাঁখারিবাজারসহ ঢাকাজুড়েই শুরু হয় হামলা। বিভিন্ন এলাকায় হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করে বর্বর পাক হানাদার বাহিনী। মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকে ট্যাংক, সঙ্গে সেনা বোঝাই লরি। ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল), জগন্নাথ হলে মধ্যযুগীয় কায়দায় চলে পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতা। শহিদ হন কয়েকশ ছাত্রছাত্রী। ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ নয়জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।

হানাদাররা চলার পথে রাস্তার দুই পাশে গুলি ছুড়ে মেরে ফেলে অসংখ্য নিরীহ, গরিব মানুষকে। মেডিকেল কলেজ ও ছাত্রাবাসে গোলার পর গোলা ছুড়ে হত্যা করা হয় অজস্র মানুষকে। রাজারবাগে পুলিশের বাঙালি সদস্যরা তাদের সামান্য অস্ত্রশস্ত্র দিয়েই প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ট্যাংক আর ভারী মেশিনগানের মুখে এ প্রতিরোধ বেশিক্ষণ টেকেনি। গ্যাসোলিন ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় পুরো সদর দপ্তর।

২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। গোপন ওয়্যারলেস বার্তায় তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ছাত্র-জনতা-পুলিশ-ইপিআর শত্র“র বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়েছে। আমি ঘোষণা করছিÑআজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সর্বস্তরের নাগরিকদের আমি আহ্বান জানাচ্ছিÑআপনারা যে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন, যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সম্মিলিতভাবে শত্র“র মোকাবিলা করুন। এই হয়তো আপনাদের প্রতি আমার শেষ বাণী হতে পারে। আপনারা শেষ শত্র“টি দেশ থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান।’

এর আগে সকালে প্রেসিডেন্ট ভবনে ভুট্টো-ইয়াহিয়া এবং ইয়াহিয়া ও পিপলস পার্টির উপদেষ্টাদের মধ্যে আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের খবর সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে ছিল। রাত ৯টার পর বাসভবনে উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সর্বাÍক চেষ্টা চালিয়েছি। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছেন। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট অখণ্ড পাকিস্তানের সমাপ্তি টানতে চলেছেন।

পিলখানায় ইপিআর ব্যারাক ও অন্যান্য স্থান থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার লিখিত বাণী ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারা দেশে মেসেজ আকারে পাঠানো হয়। এ বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দপ্তরে পৌঁছায়। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশি জাহাজও এ বার্তা গ্রহণ করে। চট্টগ্রামে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী সাইক্লোস্টাইল করে রাতেই শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন। রাত ১টায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের অদূরে শুক্রাবাদে ব্যারিকেডের মুখোমুখি হয়। এখানে প্রতিরোধ ব্যুহ ভেঙে হানাদাররা রাত দেড়টায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে আসে। হানাদার বাহিনী এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রবেশ করে। বঙ্গবন্ধুকে রাত দেড়টায় তার বাসভবন থেকে বন্দি করে শেরেবাংলা নগরের সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুকে সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয়। সকাল পর্যন্ত আদমজী কলেজের একটি কক্ষে বঙ্গবন্ধুকে আটক রাখা হয়।

কর্মসূচি : যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে সোমবার রাত ১১টা থেকে ১১টা ৩১ মিনিট পর্যন্ত সারা দেশে প্রতীকী ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করা হবে। তবে কেপিআই এবং জরুরি স্থাপনা এ কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে। এদিন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গণহত্যা দিবসের ওপর আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

সারা দেশে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গীতিনাট্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে ২৫ মার্চ গণহত্যার স্মৃতিচারণা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশনে গণহত্যার ওপর দুর্লভ আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করা হবে। এছাড়া ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিহতদের আÍার মাগফিরাত কামনা করে এদিন বাদ জোহর বা সুবিধাজনক সময় দেশের সব মসজিদে বিশেষ মোনাজাত এবং অন্য সব উপাসনালয়ে প্রার্থনা করা হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে একই কর্মসূচি পালন করা হবে।

আওয়ামী লীগের কর্মসূচি : গণহত্যা দিবস উপলক্ষ্যে সোমবার বিকালে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যৌথ উদ্যোগে সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

জাতীয়

রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসের তালিকা প্রণয়ন এক রকম অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টদের অনেকে জানিয়েছেন, কমিটির সদস্যদের নানামুখী বক্তব্য সার্বিক কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো এক ধরনের ‘তামাশা’ চলছে বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেন। প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের বক্তব্য এবং বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে এমন চিত্রই বেরিয়ে এসেছে।

রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের তালিকা প্রণয়ন উপকমিটির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান জানিয়েছেন, আমরা একটি তালিকা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। যাচাই-বাছাই শেষে তা প্রকাশ করা হবে।

কমিটির আরেক সদস্য সাবেক সংসদ-সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদও বলেছেন, একটা তালিকা তৈরি করে তারা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন।

তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, তার কাছে কোনো তালিকা আসেনি। আলাপ-আলোচনা হলেও শাজাহান খানের কমিটি এখনও কোনো তালিকা দিতে পারেনি। অপরদিকে কমিটির আরেক সদস্য সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম বলেছেন, তিনি কমিটিতে থাকতেই চাননি। তার নাম জোর করে ঢোকানো হয়েছে।

রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসের তালিকা প্রণয়ন নিয়ে এই যখন অবস্থা তখন বিশ্লেষকদের অনেকে বিষয়টি নিয়ে কাছে তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, আমি বলব রাজাকারের তালিকা কেউ করতে চায় না। ৭২ সালের তালিকা তো আছেই। এছাড়া নতুন করতে গেলে সমস্যা হবে। অনেকে এগুলো আদালতে চ্যালেঞ্জ করে বসবেন। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে এবং ৩ বছর সে মামলা আমাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। সুতরাং বাস্তবে কেউ এ তালিকা করায় আন্তরিক নন বলে তিনি মনে করেন।

পাকিস্তান সরকারের তালিকা নিয়ে মন্ত্রীর দৃঢ় অবস্থান : রোববার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রণীত রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসের তালিকাই প্রকৃত তালিকা। কারণ রাজাকারদের তালিকা তো তৎকালীন সরকার প্রণয়ন করেছে এবং রাজাকারদের তারা বেতন-ভাতা দিত। নতুন করে তালিকা করতে গেলে সেই তালিকায় ভেজাল ঢুকতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে পাকিস্তান সরকারের তৈরি করা তালিকাকে প্রকৃত ও নির্ভুল তালিকা মনে করি।

তিনি বলেন, সেই তালিকাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জেলা প্রশাসক (ডিসি) অফিসে সংরক্ষিত। সেই তালিকার একটি কপি আমার সংগ্রহে আছে। দরকার হলে তা আপনাদের দেখাতে পারি। মন্ত্রী আরও বলেন, আমরা ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ১০ হাজার ৭৮৯ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেছি। যা পাকিস্তান সরকারের সময় প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু সেই তালিকার বিরুদ্ধে সাংবাদিকরাই সোচ্চার প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে শাজাহান খানকে প্রধান করে ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। সেই কমিটি এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত তালিকা আমাকে দেয়নি।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আরও বলেন, ১৯৭১ সালে অনেকে বাধ্য হয়ে রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে, সেই মন্ত্রিসভায় কি সবাই স্বেচ্ছায় শপথ নিয়েছে? বরং বন্দুকের নলের মুখে অনেকে শপথ নিতে বাধ্য হয়েছে। সুতরাং ১৯৭১ সালেও অনেকে রাজাকারের খাতায় নাম লেখাতে বাধ্য হয়েছে। সে ক্ষেত্রে যারা বাধ্য হয়ে রাজাকার হয়েছে তাদের সংজ্ঞা কি হবে? আর যারা প্রকৃত রাজাকার ছিল, তারা তো পাকিস্তানিদের তালিকায় ভাতাভোগী। বিষয়গুলো নিয়ে নানা ধরনের সমস্যা আছে। তাহলে কি রাজাকারের তালিকা হচ্ছে না-এমন প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, ‘হবে। হবে না কেন? বলতে পারেন কাজ চলছে।’

আংশিক তালিকা প্রকাশ থেকে পিছু হটল কমিটি : রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসের তালিকা প্রণয়ন উপকমিটির সভাপতি এবং সাবেক নৌপরিবহণমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, দেশের ৪৯৫ উপজেলার মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৫০টি উপজেলার রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসের তালিকা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। আরও যাচাই-বাছাই হচ্ছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে আংশিক তালিকা প্রকাশ না করে একসঙ্গে সব রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করতে। কারণ আংশিক তালিকা প্রকাশ করলে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমরা পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন কাজের মধ্যে আছি।

রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের তালিকা প্রণয়ন কমিটির সদস্য এবং সাবেক সংসদ-সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, যতটা সম্ভব কাজ করে আমরা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। সব উপজেলার তথ্য পাওয়া যায়নি। ৫৩ বছর হয়ে গেছে। অনেকে অনেক কিছু ভুলে গেছেন। অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। যাদের নাম এসেছে তাদের সময়কার সাক্ষ্য লাগবে। এখন সাক্ষ্য পাওয়া যাচ্ছে না। যাচাই- বাছাই করে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে রাজাকারের তালিকা তৈরি করতে হবে। কাজটি বেশ জটিল। তবে মনে রাখতে হবে, এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া।

রাজাকারদের সাহায্য করার বয়ান : কমিটির আরেক সদস্য সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এবি তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কমিটিতে থাকতেই চাইনি। শাজাহান খান আমার নাম দিয়েছেন। জেলায় জেলায় আনসারের উপপরিচালকের (ডিডি) কাছে রাজাকারের তালিকা আছে। জেলা থেকে যে তালিকাগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো তো ইতোমধ্যে জামুকায় জমা দেওয়া হয়েছে। অনেক রাজাকার মারা গেছে। মনে রাখতে হবে, এটা একটা জনযুদ্ধ ছিল। অন্য দশটি কাজের সঙ্গে রাজাকাররা ব্রিজ পাহারা দিত। আমি যখন কাওরানের ব্রিজ ভাঙতে যাই, তখন রাজাকাররা আমাদের অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে। রাজাকাররা আমাদের বলেছে, পাকিস্তান আর্মির গাড়ি দেখলে আমরা রেললাইনে লোহা দিয়ে ৫টি আঘাত করব। তখন আপনারা লুকিয়ে থাকবেন। আবার যখন পাকিস্তান আর্মির গাড়ি চলে যাবে, তখন আমরা রেললাইনে লোহা দিয়ে ৩টি আঘাত করব। তখন আপনারা বেরিয়ে আসবেন। এভাবে রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে। তিনি আরও বলেন, বর্ডারের স্মাগলাররা মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তান আর্মির গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা দিয়ে, তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে। দেশে কোনো কাজ নেই, অভাবে পড়ে অনেকে রাজাকারের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। অনেকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজাকারে যোগ দিতে হয়েছে। তাদের আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন।’

তিনি আরও বলেন, নির্ভুল তালিকা করতে হলে অনেক বছর সময় লাগবে। এলাকায় এলাকায় গিয়ে ইন্টারভিউ নিয়ে নিশ্চিত হয়ে তালিকা করতে হবে। কেউ একজন তালিকা করে এনে আমাকে দেবে আর আমি সেই তালিকায় স্বাক্ষর করব, তা আমি করব না। কাজটা বেশ কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। নিজে ইন্টারভিউ নিয়ে যতক্ষণ না আমি সন্তুষ্ট হব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি কেন দায়িত্ব নেব? কাজটা ইবাদতের ন্যায় করতে হবে। একজন রাজাকারের নাম বাদ যাক এটা যেমন চাচ্ছি না, তেমনি আরেকটা ভালো লোকের নাম রাজাকারের তালিকায় আসুক সেটাও চাই না। আমি সময় দিতে পারিনি এবং পারব না। তারপরও কমিটিতে আমার নাম রাখা হয়েছে। আর সময় না দিয়ে কারও তৈরি করা তালিকায় আমি স্বাক্ষরও করতে পারব না। তিনি আরও জানান, তালিকা প্রণয়নের বিষয়ে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন শাজাহান খান।

সব উপজেলার রাজাকারের নাম না পাওয়া এবং অনেক রাজাকার বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকায় বা আত্মীয়স্বজনরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের সম্পর্কে অনেকে তথ্য দিতেও অপারগতা প্রকাশ করছে। ফলে তালিকা তৈরির কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এমনটিই জানিয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ৯ মাস দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা ব্যক্তিদের রাজাকার বলা হয়। পাকিস্তানিদের সহযোগী আরও দুটি সংস্থার নাম ছিল আলবদর ও আলশামস। পাকিস্তানিদের নানা অপকর্ম যেমন-হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে তারা।

২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করেছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তবে ওই তালিকায় অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর ও ভাষাসৈনিক সদ্যপ্রয়াত গোলাম আরিফ টিপুসহ আরও অনেকের নাম আসে ওই তালিকায়। অথচ তারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ছিলেন বলে প্রমাণ রয়েছে। এ নিয়ে সারা দেশে সমালোচনা শুরু হলে বিতর্কের মুখে রাজাকারের তালিকা স্থগিত করেছিল মন্ত্রণালয়। ওয়েবসাইট থেকে তালিকাটি সরিয়ে ফেলা হয়। পরবর্তী সময়ে যাচাই-বাছাই করে তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইন-২০২২ সংশোধিত আকারে পাশ হওয়ার পর তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয় ২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। এতে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীর মধ্যে রাজাকারের তালিকা তৈরি ও প্রকাশের দায়িত্ব দেওয়া হয় জামুকাকে।

আইনে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্য হিসাবে কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন বা আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসাবে কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন বা আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসাবে সশস্ত্র যুদ্ধে নিয়োজিত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন বা খুন, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের অপরাধমূলক ঘৃণ্য কার্যকলাপ দ্বারা নিরীহ মানুষকে হত্যার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছেন অথবা একক বা যৌথ বা দলীয় সিদ্ধান্তক্রমে প্রত্যক্ষভাবে, সক্রিয়ভাবে বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন তাদের তালিকা প্রণয়ন ও গেজেট প্রকাশের জন্য জামুকা সরকারের কাছে সুপারিশ প্রেরণ করবে।

মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাজাকারের তালিকা চেয়ে জেলা প্রশাসকদের কাছে চিঠি পাঠানো হলে অনেকে জানিয়েছেন তাদের জেলার রেকর্ড রুমে রাজাকারদের নামের কোনো তালিকা নেই। কমিটির সদস্যরা জেলা ও উপজেলায় গিয়েও সঠিক তথ্য পাচ্ছেন না। অনেকে শত্রুতা করে কারও নাম দিতে পারে সে বিষয়টিও মাথায় রাখতে হচ্ছে তাদের। আবার অনেক রাজাকার বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকায় বা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের সম্পর্কে অনেকে তথ্য দিতেও অপারগতা প্রকাশ করছে। ফলে তালিকা তৈরির কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে।

জাতীয়

রমজান মাসে সারাদিন রোজা রেখে ইফতারিতে পুষ্টিকর খাবার খুবই জরুরি। তাই ইফতারির মেন্যুতে রাখতে পারেন পুদিনা পাতা। যার আছে মহা ঔষধি গুণ। পৃথিবীতে অনেক ধরনের ঔষধি গাছ রয়েছে। পুদিনা পাতা তার মধ্যে অন্যতম।

যেসব উপকার মিলবে পুদিনা পাতায়:

পেট ফাঁপায়: সহজ কথায় পেটে বাতাস জমে যাওয়া। এ অবস্থা সৃষ্টি হলে নানা রোগ হতে পারে। বদ হজমের ফলে পেটে বাতাস জমে এবং পেট ফাঁপে। এ ক্ষেত্রে পুদিনার শরবত সারাদিন ২-৩ বার করে কয়দিন খেলে পেটে বাতাস জমা বন্ধ হবে। খাদ্যে রুচিও ফিরে আসবে।

শিশুদের অতিসারে: পাতলা দাস্ত, সেই সঙ্গে পেট মোচড় দিয়ে ব্যথা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অল্প আম সংযুক্ত দাস্ত, সেসঙ্গে পেট ফাঁপা, হিক্কা বমি বমি ভাব, প্রস্রাবও সরলি হচ্ছে না, শিশু কিছুই খেতে চাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে পুদিনা পাতার রস ৮/১০ ফোঁটা অল্প একটু চিনি ও লবণ সহযোগে এক ঘণ্টা অন্তর কয়েকবার খাওয়াতে হবে। কখন কিভাবে কতবার খাওয়াতে হবে সেটা নির্ভর করবে রোগীর সুস্থতার ক্রমের দিকে লক্ষ্য রেখে। বয়স আনুপাতে মাত্রাটা ঠিক করে নিতে হবে।

অরুচিতে: রোগে ভোগার পর, পেটে বাতাস জমে ও কোষ্ঠ বদ্ধতায় অরুচি আসে। একই রকম খাদ্য দীর্ঘদিন খেলে অরুচি আসে। এসব ক্ষেত্রে পুদিনার শরবত (পুদিনার রস ২ চা চামচ, সামান্য লবণ, কাগজী লেবুর রস ৮/১০ ফোঁটা, হাল্কা গরম পানি পোয়া খানিক একত্রে মিশিয়ে) সকাল বিকাল দিনে দুই বার ৫/৭ দিন খেলে অরুচি চলে যায়। পুদিনা পাতা বেটে পানিতে গুলে শরবত করা যায়। সে ক্ষেত্রে কাঁচা পাতা ৮/১০ গ্রাম নিতে হবে।

মূত্রাল্পতায়: অনেক রোগে প্রস্রাব কম হয়। কিন্তু যে ক্ষেত্রে ঠাণ্ডা গরমের ফলে সাময়িকভাবে অল্প অল্প প্রস্রাব হতে থাকে কোনো কোনো সময় দাহ হতে থাকে, সে ক্ষেত্রে পুদিনা পাতা ৮/১০ গ্রাম বেটে তাতে সামান্য লবণ ও কাগজি লেবুর রস ঠাণ্ডা পানি মিশিয়ে শরবত করে দিনে ২/৩ বার খেতে হবে। অন্য কোনো রোগে মূত্রাল্পতা হলে সে ক্ষেত্রে এটা ব্যবহার করা যাবে কিনা সেটা নির্ভর করবে রোগের ধরনের ওপর এবং চিকিৎসকের বিচার ধারার ওপর।

অ্যান্টিক্যান্সার: পুদিনায় আছে মনোটারপিন নামক উপাদান। যা স্তন, লিভার এবং প্যানক্রিয়াসের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। নিয়মিত খেলে ফুসফুস, কোলন এবং ত্বকের ক্যান্সার থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

বমিতে: পিত্তে শ্লেষ্মার জ্বর, অম্লপিত্ত, আমাশয়, অজীর্ণ, উদরশূল প্রভৃতিতে বমি হতে পারে। আবার রোদে ঘোরাফিরা করে ঠাণ্ডা পানি খেলে, খালি পেটে থেকে পরিশ্রম করলে বমি হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে পুদিনার শরবতের সঙ্গে এক চা চামচ তেঁতুল মাড় ও চিনি মিশিয়ে ২/৩ বার করে কয়দিন খেতে হবে।

ঘাম নিয়ন্ত্রণে: যাদের শরীরে বেশি ঘাম হয় তারা পুদিনা পাতা ও গোলাপের পাপড়ি একসঙ্গে মিশিয়ে পানিতে ফুটিয়ে নিন। ঠাণ্ডা হলে সেই পানির সঙ্গে পাতিলেবুর রস মিশিয়ে ছেঁকে নিয়ে বোতলে করে ফ্রিজে রেখে দিন। গোসলের পর সারা শরীরে লাগান।

অ্যাজমা: পুদিনায় রোজমেরিক এসিড নামের এক ধরনের উপাদান থাকে। এটি প্রাকপ্রদাহী পদার্থ তৈরিতে বাধা দেয়। ফলে অ্যাজমা হয় না। এছাড়াও এ ঔষধি প্রোস্টসাইক্লিন তৈরিতে বাধা দেয়। তাতে শাসনালী পরিষ্কার থাকে।

জাতীয়

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত অনুযায়ী কর অব্যাহতি-প্রণোদনা কমিয়ে আনতে কাজ শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এরই ধারাবাহিকতায় এবং বেসরকারি চাকরিজীবীদের সঙ্গে বৈষম্য কমিয়ে আনতে সরকারি চাকরিজীবীদের বাড়িভাড়া ও অন্য ভাতায় করারোপের চিন্তা করছে সংস্থাটি। এছাড়া শিল্প খাতে কর অবকাশ সুবিধার মেয়াদ নির্দিষ্ট করাসহ আয়কর আইন সংস্কারে একগুচ্ছ পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা আগামী বাজেটে অর্থবিলের মাধ্যমে আয়কর আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

জানা গেছে, কর অব্যাহতি-প্রণোদনা যৌক্তিক করতে কর আপিল ও অব্যাহতি অণুবিভাগের সদস্য ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল কাজ করছে। ২০ মার্চ সেই টিম এনবিআর চেয়ারম্যানকে কর প্রণোদনার প্রেক্ষাপট, বিদ্যমান ব্যবস্থার বিস্তারিত তুলে ধরে একটি উপস্থাপনা দেয়।

উপস্থাপনায় কর অব্যাহতি-প্রণোদনার বিদ্যমান ব্যবস্থা ও পদ্ধতি, নেতিবাচক দিক, প্রয়োজনীয়তা, অপব্যবহার, আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা তুলে ধরা হয়। একইসঙ্গে আয়কর আইন সংস্কারের মাধ্যমে কর প্রণোদনা যৌক্তিকীকরণে একগুচ্ছ সুপারিশ করা হয়।

উপস্থাপনায় বলা হয়, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, দেশীয় বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ, রপ্তানিমুখী সেবা ও শিল্পকে উৎসাহ দেওয়া, সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সহযোগিতা দেওয়া, গবেষণা ও শিক্ষা কার্যক্রমকে উৎসাহ দেওয়া এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে শ্রমঘন প্রতিষ্ঠানকে বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে কর প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। মোট ৩১৮টি প্রজ্ঞাপন ও বিশেষ আদেশের মাধ্যমে ১৫টি শিল্প খাত ও ব্যক্তি খাতে কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া আছে। এর মধ্যে ৪৫টি প্রজ্ঞাপন সময় দ্বারা সীমাবদ্ধ হলেও প্রায় ২৭৩টি প্রজ্ঞাপনের সময়ের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। তবে কর প্রণোদনার ফলে সরকারের রাজস্ব আয় কমে যায়। ফলে সরকার অন্য প্রয়োজনীয় খাত যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করতে পারে না।

এতে আরও বলা হয়, কর প্রণোদনার অপব্যবহারও হয়ে থাকে। কর ফাঁকি দিতে একই ব্যক্তি বা গ্রুপর করযোগ্য সত্তার আয় কম দেখিয়ে কর প্রণোদনার সত্তার আয় বাড়িয়ে দেখানো হয়ে থাকে। কর প্রণোদনা পরিপালন ব্যয় বৃদ্ধি করে, দুর্নীতি ও অনিয়ম বেড়ে যায়। অপরিকল্পিত কর প্রণোদনার ক্ষেত্রে প্রকৃত কর ব্যয় এবং কর ব্যয়ের সফলতা বা সুবিধা সুনির্দিষ্টভাবে পরিমাপযোগ্য হয় না। তাছাড়া অনিয়ন্ত্রিত প্রণোদনা ব্যবসার অসম প্রতিযোগিতাকে বাড়িয়ে দিয়ে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, কর প্রণোদনা যৌক্তিক করতে এবং অপব্যবহার রোধে আয়কর কর্মকর্তাদের একটি টিম বিদ্যমান কাঠামো পর্যালোচনা করছে। কর প্রণোদনায় শৃঙ্খলা আনতে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। ভবিষ্যতে সেই নীতিমালার আলোকে কর অব্যাহতি, প্রণোদনা বা ছাড় দেওয়া হবে। আগামী বাজেটে নীতিমালাটি আয়কর আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

বৈঠক সূত্র জানায়, কর অব্যাহতির পরিমাণ যৌক্তিক করতে এবং বেসরকারি চাকরিজীবীদের সঙ্গে বৈষম্য দূর করতে সরকারি চাকরিজীবীদের ভাতায় কর আরোপের পরিকল্পনা আছে। বর্তমানে বেসরকারি চাকরিজীবীদের মূল বেতন, বোনাস, বাড়িভাড়া, যাতায়াত ভাতাসহ মোট আয়ের দুই-তৃতীয়াংশের ওপর (এক-তৃতীয়াংশ বা সাড়ে ৪ লাখ টাকার নিচে যেই অঙ্ক কম, সেই অঙ্কে করছাড় রয়েছে। অর্থাৎ করমুক্ত) নির্ধারিত হারে আয়কর দিতে হয়। পক্ষান্তরে সরকারি চাকরিজীবীরা শুধু মূল বেতন ও বোনাসের ওপর আয়কর দেন।

এছাড়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানিক করদাতারা বিভিন্ন খাতে দানের পরিপ্রেক্ষিতে যেই পরিমাণ করছাড় পেয়ে থাকেন, সেগুলোও পুনর্বিন্যাস করার উদ্যোগ থাকছে। যেমন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট, শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনুমোদিত বালিকা বিদ্যালয় বা মহিলা কলেজ, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং কৃষি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিক্ষা উন্নয়নের জন্য গবেষণা ও উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে দান করতে করছাড় পাওয়া যায়। এসব ক্ষেত্রে করছাড় যৌক্তিক করার পাশাপাশি প্রণোদনার সম্ভাব্য অপব্যবহার রোধে দাতব্য এবং জনকল্যাণমূলক ট্রাস্টের কর্মপরিধি সুনির্দিষ্ট করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

সূত্র আরও জানায়, আগামীতে শিল্প খাতকে অনির্দিষ্টকাল বা অসীম সময়ের জন্য কর অব্যাহতি বা প্রণোদনা দেওয়া হবে না। শিল্পকে উৎসাহিত করতে কর প্রণোদনা বহাল থাকবে। তবে সেটি সময়াবদ্ধ হবে, সর্বোচ্চ ৫ বছর করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। যেসব প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে কর অব্যাহতি বা প্রণোদনা পেয়েছে, সেগুলো নতুন করে সুবিধা দেওয়া হবে না। ব্যবসা ক্ষেত্রে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করে, এমন সব প্রণোদনা বাতিল করা হতে পারে।

এছাড়া স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, সেনাবাহিনী বা যেসব প্রতিষ্ঠানের আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা নেই, কিন্তু করযোগ্য আয় রয়েছে, তাদের গ্রসপ্রাপ্তির সংবলিত একটি বার্ষিক রিপোর্ট দালিল এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর কর পরিশোধের বিষয় আয়কর আইনে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। একইভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের করযোগ্য প্রাপ্তির ওপর করারোপের সুস্পষ্ট বিধান করার পরিকল্পনা আছে।

এ বিষয়ে সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফল পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আয়কর আইনে বেশকিছু বৈষম্য আছে। এর মধ্যে একটি হলো সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন-ভাতা করমুক্ত রাখা এবং বেসরকারি চাকরিজীবীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের ওপর করারোপ করা। একই আইনে চাকরিজীবীদের ওপর দ্বৈতনীতি কাম্য হতে পারে না। সরকারি কর্মকর্তারা নিজেরা আইন করেছেন বলে নিজেরা সুবিধা নিয়ে নেবেন, আর বেসরকারি চাকরিজীবীদের ওপর বোঝা চাপিয়ে দেবেন, সেটি যৌক্তিক হতে পারে না। সব শ্রেণি-পেশার চাকরিজীবীর সমান সুবিধা দেওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, কর অবকাশ সুবিধা যৌক্তিকীকরণ করা উচিত। কোনো সুবিধাই আজীবনের জন্য দেওয়া উচিত নয়। এতে শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় না, বরং অপব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। যেমন আইটিইএস সার্ভিস ১৫ বছর ধরে কর অবকাশ সুবিধা ভোগ করছে; কিন্তু নতুন অনেক শিল্পোদ্যোগের কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া দরকার, তারা সুবিধা পাচ্ছে না। আয়কর আইনে যেসব শিল্পকে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া আছে, সেগুলো পুনর্বিন্যাস ও যৌক্তিক করা জরুরি। মোদ্দা কথা, বাংলাদেশের কর ব্যয় আরও স্বচ্ছতার মধ্যে নিয়ে আসা উচিত।

৫-১৩ মার্চ আইএমএফের ৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের ‘কর ব্যয়’ ওপর ওয়ার্কশপে অংশ নেয়। তারা কর অব্যাহতি কমিয়ে আনতে ২০২৪ সাল অর্থ আইনের মাধ্যমে আয়কর আইনে কী পরিবর্তন আনতে হবে, ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ পরবর্তী ব্যবসায় সক্ষমতা ধরে রাখতে মধ্য মেয়াদে ২০২৫ সালে এবং দীর্ঘমেয়াদে ২০২৬ ও ২০২৭ সালে আইনে কী ধরনের সংস্কার আনতে হবে তার সুপারিশ করেছে। আইএমএফের সুপারিশের মধ্যে আছে-সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন এবং বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ সব ধরনের ভাতা করের আওতায় আনা, ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের অব্যাহতি সুবিধা বাতিল (বর্তমানে মোট আয়ের এক-তৃতীয়াংশ অথবা সাড়ে ৪ লাখ টাকার মধ্যে যেটি কম সেই অঙ্কের করছাড় পায় করদাতারা), করমুক্ত আয়সীমা ও ন্যূনতম করহার বৃদ্ধি এবং শিল্প খাতে প্রদত্ত কর অব্যাহতি পুনর্মূল্যায়নের সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।

কোন খাতে কত কর ব্যয় : এনবিআরের তথ্যমতে, ক্ষুদ্রঋণ খাতে সবচেয়ে বেশি কর ব্যয় হয়, ১৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। এরপরের অবস্থানে আয়ে যথাক্রমে বৈদেশিক আয় খাতে ১১ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৮ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা, অর্থনৈতিক অঞ্চল বা হাইটেক পার্কে ৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা, তৈরি পোশাক/টেক্সটাইল মিল/এক্সেসরিজ শিল্পে ৩ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা, আইটি/সফটওয়্যার খাতে এক হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা, শেয়ার মূলধনী মুনাফা ৯৬৫ কোটি টাকা এবং মৎস্য চাষ ও হাস-মুরগির খামারে ১৪৩ কোটি টাকা কর ব্যয় হয়।

প্রত্যক্ষ কর ব্যয় বলতে কর রেয়াত, ছাড়, প্রণোদনা, অব্যাহতি, হ্রাসকৃত হারে করারোপ এবং মোট করযোগ্য আয় পরিগণনা হতে আয় বাদ দেওয়াকে বোঝায়। এটি এক ধরনের ভর্তুকি। এই ভর্তুকি যদি কর হিসাবে আয়দায় হতো তা হলে মোট আদায়কৃত করের সঙ্গে এটি যুক্ত হতো এবং করের পরিমাণ বৃদ্ধি পেত। প্রত্যক্ষ কর ব্যয়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রণোদনা, সামাজিক সাম্যাবস্থা ও শিল্প সহায়তার সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। চলতি বছরের বাজেটে প্রত্যক্ষ কর ব্যয়ের একটি ধারণা দেয় এনবিআর, যা অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করা হয়।

এনবিআরের হিসাবে, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ কর ছাড়ের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে করপোরেট পর্যায়ে ৮৫ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা ও ব্যক্তিপর্যায়ে ৪০ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হয়। সামগ্রিকভাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ কর ব্যয় ছিল জিডিপির ৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপির আকার বিবেচনায় প্রত্যক্ষ কর ব্যয় হবে এক লাখ ৭৮ হাজার ২৪১ কোটি টাকা।

জাতীয়

সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. জিল্লুর রহমানের ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।

১৯২৯ সালের ৯ মার্চ বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলার ভৈরবপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জিল্লুর রহমান। মহান ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। সে সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের জিএস ছিলেন। দেশের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম ও ক্রান্তিলগ্নে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। দল-মত নির্বিশেষে তিনি সবার কাছে সমভাবে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। কিশোরগঞ্জের ভৈরব-কুলিয়ারচর আসন থেকে তিনি ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

জিল্লুর রহমান দেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ২০১৩ সালের ২০ মার্চ সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। এর আগে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ দলীয় সরকার গঠন হলে তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং সংসদের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এ ছাড়া স্বাধীনতার পর তিনি তিনবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী বেগম আইভি রহমান মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভানেত্রী ছিলেন এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট দলীয় জনসভায় গ্রেনেড হামলায় আহত হয়ে পরে ২৪ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। তাদের একমাত্র ছেলে নাজমুল হাসান পাপন বর্তমানে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি।

জাতীয়

আগের বছর দেশ হিসেবে বায়ুদূষণে বাংলাদেশ ছিল শীর্ষে। মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ‘বৈশ্বিক বায়ু মান প্রতিবেদন ২০২৩’–এ এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

বায়ুদূষণের অন্যতম উপাদান পিএম ২.৫ বা অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপাদান ধরেই বায়ুর মান নির্ণয় করা হয়েছে এ প্রতিবেদনে। সেখানে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ২.৫) উপস্থিতি ছিল ৭৯ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বেঁধে দেওয়া মানদণ্ডের চেয়ে অন্তত ১৫ গুণ বেশি।

বৈশ্বিক বায়ু মানের ষষ্ঠ বার্ষিক এ প্রতিবেদনে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশ, অঞ্চল এবং অঞ্চলগুলোর সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটি তৈরিতে ১৩৪টি দেশ, অঞ্চলের সাত হাজার ৮১২টি স্থানের ৩০ হাজারেরও বেশি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা।

বায়ুদূষণে বাংলাদেশের পরই ছিল পাকিস্তানের অবস্থান। দেশটিতে প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ২.৫) উপস্থিতি ছিল ৭৩ দশমিক ৭ মাইক্রোগ্রাম, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বেঁধে দেওয়া মানদণ্ডের চেয়ে অন্তত ১৪ গুণ বেশি। এরপর যথাক্রমে তাজিকিস্তান ও বুরকিনা ফাসোর অবস্থান।

২০২৩ সালে সবচেয়ে দূষিত আঞ্চলিক রাজধানী শহরের তালিকায় শীর্ষে ছিল নয়াদিল্লি। সেখানে প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ২.৫) উপস্থিতি ছিল ৯২ দশমিক ৭ মাইক্রোগ্রাম। এরপরই ঢাকার অবস্থান। ঢাকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ২.৫) উপস্থিতি ছিল ৮০ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম।

১২৪টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে মোট ১২৪টিই (৯২ দশমিক ৫) ডব্লিউএইচওর বেঁধে দেওয়া মানদণ্ড অতিক্রম করেছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে উত্তর ভারতের বিহার রাজ্যের পাঁচ লাখ লোকের শহর বেগুসরাই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর। এ শহরে প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ২.৫) উপস্থিতি ছিল ১১৮ দশমিক ৯ শতাংশ, ডব্লিউএইচও) বেঁধে দেওয়া মানদণ্ডের চেয়ে অন্তত ২৩ গুণ বেশি। এরপর রয়েছে আসামের গুয়াহাটি, দিল্লি ও পাঞ্জাবের মুল্লানপুর।

২০২২ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের দূষিত বাতাসের দেশের তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে ছিল। আর বাতাসে পিএম ২.৫–এর উপস্থিতি ছিল ৬৫ দশমিক ৮।

জাতীয়

সড়ক-মহাসড়কে লক্কর-ঝক্কর বাস, পণ্যবাহি গাড়িতে যাত্রী চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ থাকবে। এ ধরনের যানবাহন রাস্তায় দেখামাত্র কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সতর্ক করেছেন হাইওয়ে পুলিশ প্রধান শাহাবুদ্দিন খান।

মঙ্গলবার রাজধানীর রাজারবাগে ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে পরিবহণ মালিক শ্রমিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ হুঁশিয়ার দেন। হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি (অপারেশনস) শ্যামল কুমার মুখার্জীর সঞ্চালনায় এতে সড়ক পরিবহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা অংশ নেয়।

সভায় গুরুত্বপূর্ণ ৫টি মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কে কোথায়, কেমন যানজট ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে, তা তুলে ধরেন যাত্রী কল্যাণ সংশ্লিষ্টরা। নিরাপদ সড়ক চাইয়ের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘ছোট গাড়িগুলো হাইওয়েতে চলে আসা একটা বড় সমস্যা। এটাই যানজট ও দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।’ এদিকে ঈদ যাত্রায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি যাতে চলতে না পারে, সে বিষয়ে আশ্বস্ত করেছে পরিবহণ মালিক সমিতি। তারা জানায়, নেওয়া হবে না বাড়তি ভাড়া। পরিবহণ মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান রাঙা বলেন, ‘আমি জানি। আমি একেবারেই ওয়াকিবহাল। কোনো কোনো জায়গায় নেওয়া হয়। যাতে না নেওয়া হয় সে ব্যবস্থাই আমরা করব এবার।’

হাইওয়ে পুলিশপ্রধান বলেন, বডি ওর্ন ক্যামেরা ছাড়া হাইওয়ে পুলিশের কোনো সদস্য মহাসড়কে ডিউটি করতে পারবে না। তিনি বলেন, পণ্য পরিবহণে মালিক-শ্রমিক পক্ষ যেন কোনোভাবেই হয়রানির শিকার না হয়, এ বিষয়ে সবাইকে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

সভায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের সহ-সভাপতি মো. তাজুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী, বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির পরিচালক এফবিসিসিআই কার্যকরী সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ বখতিয়ার যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

জাতীয়

ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা, পেঁয়াজ ও রসুনসহ ১০ পণ্যের দাম কমেছে। এক মাসের ব্যবধানে পণ্যমূল্য হ্রাসে ভোক্তারা কিছুটা স্বস্তিও পাচ্ছেন। তবে রমজানে অধিক ব্যবহৃত ছোলা, বেসন, খেজুর, সব ধরনের মাংস ও ফল এখনো বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছু পণ্যের দাম কমলেও একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী দুই মাস আগে থেকে এসব পণ্য বাড়তি দামে বিক্রি করে আসছিল। এখন দাম কমিয়ে সরকারসংশ্লিষ্টরা ক্রেডিট নিচ্ছে। মঙ্গলবার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

রাজধানীর খুচরা বাজার ঘুরে জানা যায়, এদিন প্রতিকেজি প্যাকেট আটা ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা এক মাস আগে ৬৫ টাকা ছিল। খোলা ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা, যা আগে ৭০ টাকা ছিল। প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৬৩-১৬৫ টাকায়। যা আগে ১৭৩-১৭৫ টাকা ছিল। প্রতিকেজি মুগডাল বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকায়। যা আগে ১৮০ টাকা ছিল। প্রতিকেজি দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৫০-১৮০ টাকায়, যা এক মাস আগে ২৫০ টাকা ছিল। প্রতিকেজি হলুদ ২৫০-২৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা আগে ৩০০-৩৫০ টাকা ছিল। প্রতিকেজি জিরা বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকায়। যা আগে ৯৫০-১০০০ টাকা ছিল। রুই মাছের কেজি ৩৫০ টাকা, যা ৪৫০ টাকা ছিল।

এদিকে ভারত থেকে আমদানির খবরে অবৈধভাবে মজুত পেঁয়াজ বাজারে ছাড়তে শুরু করেছে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা। খুচরা বাজারে প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৭০ টাকায়। যা এক মাস আগে ১২০ টাকা ছিল।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরকারের একাধিক তদারকি সংস্থা বাজারে কাজ করছে। এতে করে কিছু পণ্যের দাম রোজায় কমাতে শুরু করেছে। তবে দেখা গেছে, যেসব পণ্যের দাম কমছে-তা রোজার আগেই দাম বাড়ানো হয়েছিল। তখন বেশি দামে বিক্রি করে বাড়তি মুনাফা করে এখন দাম কমানো হচ্ছে। এছাড়া বাজারে এখনো অনেক পণ্য অযৌক্তিক দামে বিক্রি হচ্ছে। তদারকির মাধ্যমে সেগুলোর দামও নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এতে ক্রেতার স্বস্তি ফিরবে।

খুচরা বাজারের বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারে মান ও দামভেদে সাদা মুড়ি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। যা রোজার আগে ৭০ টাকা ছিল। মান ও বাজারভেদে প্রতিকেজি বেসন বিক্রি হচ্ছে ৭০-১০০ টাকায়। যা আগে ৬০-৮০ টাকায় বিক্রি হতো। এছাড়া ইফতারে শরবত তৈরিতে ব্যবহৃত ইসবগুলের ভুসি, ট্যাং, রুহ-আফজা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিকেজি ইসবগুলের ভুসি রোজার আগে ১ হাজার ৬০০ টাকা বিক্রি হলেও এখন ২ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিকেজি প্যাকেটজাত ট্যাং বিক্রি হয়েছে ৮৫০ টাকা, যা আগে ছিল ৮০০ টাকা। বড় সাইজের রুহ-আফজা বিক্রি হচ্ছে ৫০০-৫৫০ টাকায়। যা আগে ৩৫০ টাকা ছিল। ছোট সাইজের রুহ-আফজা বিক্রি হচ্ছে ২৮০-৩০০ টাকায়। যা আগে ২০০ টাকা ছিল। সোমবার প্রতিলিটার খোলা সরিষার তেল বিক্রি হয়েছে ২৬০-২৭০ টাকায়। যা আগে ২৫০-২৬০ টাকা ছিল।

খুচরা বাজারে প্রতিকেজি লাল আপেল ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা আগে ২৬০-২৭০ টাকা ছিল। কমলা বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকা কেজি। যা আগে ২৮০-৩০০ টাকা ছিল। প্রতিকেজি আনার বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ টাকা। যা আগে ৩১০ টাকা ছিল। প্রতিকেজি বরই বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা। যা আগে ৭০-৮০ টাকা ছিল। পেয়ারার কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা। যা আগে ৬০-৭০ টাকা ছিল।

এদিকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের নতুন নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী খুচরা পর্যায়ে গরুর মাংস কেজিতে সর্বোচ্চ ৬৬৪ টাকা ৩৯ পয়সা এবং খাসির মাংস ১০০৩ টাকা ৫৬ পয়সায় বিক্রি করতে হবে। কিন্তু খুচরা বাজারে প্রতিকেজি গরুর মাংস ৭৫০-৭৮০ ও খাসির মাংস ১১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে রাজধানীর দু-একটি দোকানে ৫৯৫ টাকা কেজিদরে গরুর মাংস বিক্রি করা হচ্ছে। তবে গরুর সব স্থানের হাড় ও মাংস মিলিয়ে বিক্রেতারা বিক্রি করছেন। তাই ক্রেতার লাভের তুলনায় লোকসানই গুনতে হচ্ছে। এছাড়া ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৭৫ টাকা ৩০ পয়সা ও সোনালি মুরগি ২৬২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৩০ ও ৩৫০ টাকা। দেশি মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৫০-৬০০ টাকা।

জাতীয়

পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা ইহসানুল করিম হেলালের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। আজ বাদ জোহর বনানী কবরস্থানে তৃতীয় নামাজে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়।

এর আগে সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা ইহসানুল করিমকে রাষ্ট্রীয় সম্মান গার্ড অব অনার জানানো হয়। পরে সেখানে নামাজে জানাজা শেষে তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী সাংবাদিকরা ফুল দিয়ে তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান। এ সময় জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতিসহ বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং পরিবারের সদস্যরা সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন।

রোববার সন্ধ্যা ৮টার দিকে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন।

ইহসানুল করিম বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক এবং রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। তিনি ১৯৪৯ সালে কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি স্ত্রী, এক মেয়ে ও এক ছেলেসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

শিক্ষাজীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সাংবাদিকতায় ¯œাতকোত্তর ডিপ্লোমা ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তি বাহিনীর হয়ে পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধে অংশ নেন।

ইহসানুল করিম ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি সংবাদ সংস্থার বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৭ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের নয়া দিল্লিতে বাসস’র ব্যুরো প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। বাসসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক হিসেবে চার বছর দায়িত্ব পালনের পর তিনি ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অবসর গ্রহণ করেন।

তিনি বাসস থেকে অবসর গ্রহণের পর, একই বছরের ২০ মে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের প্রেস সচিব হিসেবে নিয়োগ পান এবং ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ সালের ১৫ জুন তাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সচিব হিসেবে প্রথমে এক বছরের জন্য নিয়োগ প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে তার চুক্তির মেয়াদ দুই বার-তিন বছর করে বৃদ্ধি করা হয়।