রায়ে আদালত বলেছে, সরকারি চাকরি আইনের ওই ধারা ‘সংবিধান পরিপন্থি এবং মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি’।
ফৌজদারি মামলায় সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তারে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার বিধান ‘বেআইনি’ ঘোষণা করে বাতিল করে দিয়েছে হাই কোর্ট।
তিন বছর আগে কার্যকর হওয়া সরকারি চাকরি আইনের ৪১ (১) ধারার বৈধতা প্রশ্নে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের হাই কোর্ট বেঞ্চ রায় দেয়।
রায়ে আদালত বলেছে, ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনের ওই ধারা ‘সংবিধান পরিপন্থি এবং মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি’।
আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অরবিন্দ কুমার রায়। দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান।
রায়ের পর আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, “আদালত বলেছে, সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে আছে, আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান, সেটা সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে। তারপরও ৪১(১) ধারা করে সেখানে সরকারি কর্মচারীদের আলাদাভাবে একটি সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। তা কেনোভাবেই সংবিধান সম্মত নয়, এ আইন একটি মেলাফাইড উদ্দেশে করা হয়েছে।”
সরকারি কর্মচারীদের সুরক্ষা দিতে এ আইনের ৪১(১) ধারা সংযোজন করা হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “এ রায়ের ফলে তাদের গ্রেপ্তারে আর পূর্বানুমতির প্রয়োজন নেই।”
মনজিল মোরসেদ বলেন, “আমরা আদালতকে দেখিয়েছি, এই আইন করার পেছনে একটাই উদ্দেশ্য রয়েছে, সেখানে সরকারি কর্মচারীদেরকে সাধারণ নাগরিক থেকে একটু আলাদা করে তাদেরকে একটি বিশেষ শ্রেণি হিসেবে দেখিয়ে তাদের অনেক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। অপরাধ করলেও যেন তারা অপরাধী হিসেবে শাস্তি না পায়। বিশেষ করে এই আইনের মাধ্যমে দুদকের যে স্বাধীনতা, সেটা খর্ব করা হয়েছিল।”
২০১৮ সালের ১৪ নভেম্বর সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ এর গেজেট জারি হয়। এরপর ২০১৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সরকারের এক গেজেটে ১ অক্টোবর থেকে এ আইন কার্যকর হয়।
আইনের ৪১ (১) ধারায় বলা হয়, “কোনো সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সহিত সম্পর্কিত অভিযোগে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক অভিযোগপত্র গৃহীত হইবার পূর্বে, তাহাকে গ্রেপ্তার করিতে হইলে, সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ করিতে হইবে।”
নানা মহলের সমালোচনার মধ্যে আইনের এ ধারা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর জনস্বার্থে হাই কোর্টে আবেদন করে পরিবেশবাদী ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)।
প্রাথমিক শুনানির পর ওই বছরের ২১ অক্টোবর রুল জারি করে হাই কোর্ট। সরকারি চাকরি আইন- ২০১৮-এর ৪১(১) ধারা কেন বেআইনি ও বাতিল করা হবে না এবং এ ধারা সংবিধানের ২৬(১) ও ২৬(২), ২৭ ও ৩১ অনুচ্ছেদের পরিপন্থি ঘোষণা করা হবে না, জানতে চাওয়া হয় রুলে।
বুধবার সেই রুলের ওপর শুনানিতে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, “২০১৩ সালে দুদক আইনের ৩২(ক) ধারায় এমন বিধান রাখা হয়েছিল। পরে তা চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে রিট করলে আদালত ওই ধারাটি বাতিল করেছিলেন। যদিও সরকার এখনও তা আইন থেকে বাদ দেয়নি। তখন আদালত একে ‘দুঃখজনক’ বলেও মন্তব্য করেন।”
অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অরবিন্দ কুমার রায় আপিল বিভাগের একটি রায় তুলে ধরে বলেন, “আইনটি সরকারি কর্মচারীদের সুরক্ষার জন্য করা হয়েছে। আইনটিতে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে কোনো বৈষম্য করেনি। সব সরকারি কর্মচারীর বেলায় এ বিধান প্রযোজ্য।”
তখন এক বিচারক বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, “আইন করার ক্ষেত্রে সরকার কীভাবে বিশেষ একটি গোষ্ঠীকে দায়মুক্তি দেয়! এতে তো দুর্নীতিতে আরও উৎসাহ জোগাবে।”
সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ এর এ সরকারি কর্মচারী গ্রেপ্তারে পূর্বানুমতি সংক্রান্ত ধারা ৪১(১) ও ৩ চ্যালেঞ্জ করে কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যান আরেকটি রিট আবেদন করেছিলেন। তার প্রাথমিক শুনানির পর গত ২৬ সেপ্টেম্বর রুল দেয় হাই কোর্ট। এটি হাই কোর্টের আরেক বেঞ্চে বিচারাধীন।