ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে সর্বকালের অন্যতম জনপ্রিয় এ অভিনেতার জীবনাবসানে পর্দা নামল বর্ণীল এক অধ্যায়ের।
পারিবারিক নাম ইউসুফ খান, জাতিতে পাঠান। ১৯৫০ ও ১৯৬০ এর দশকের বলিউড শাসন করা এ অভিনেতাকে বলা হয় ভারতীয় সিনেমার ‘কিং অব ট্রাজেডি’।
তার জীবনীকার লর্ড মেঘনাধ দেশাইয়ের ভাষায়, একজন চরিত্র অভিনেতা হিসেবে ব্যাপ্তি, গভীরতা আর নিষ্ঠায় দিলীপ কুমারকে তুলনা করা যায় হলিউডের কিংবদন্তি মার্লোন ব্রান্ডো, জাপানি তারকা তোশিরো মিফুনে কিংবা ইতালীয় মায়েস্ত্রো মার্সেলো মাস্ত্রোয়ানির সঙ্গে।
ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্রে কখনও অভিনয় করেননি বলে পশ্চিমা দুনিয়া তাকে হয়ত সেভাবে চেনে না। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের কয়েক প্রজন্মের চলচ্চিত্র দর্শকের কাছে তিনি মহাতারকা। তাকে ‘আইডল’ মেনেই তারকা হয়ে উঠেছেন পরবর্তী সময়ের বহু অভিনেতা।
সেই ১৯৪৪ সালে প্রথম সিনেমা জোয়ার ভাটা থেকে শুরু করে ১৯৯৮ সালে শেষ সিনেমা ‘কিলা’ পর্যন্ত অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে যেসব চরিত্রকে তিনি রুপালি পর্দায় প্রাণ দিয়ে গেছেন, ভারতীয় দর্শকদের কাছে সেগুলো যেন পুরুষোত্তমের নজির।
মেলা, নয়া দৌড়, গঙ্গা যমুনা কিংবা সাগিনা মাহাতোর মত সিনেমায় দিলীপ কুমার অভিনয় করেছেন সাধারণ কৃষক কিংবা গ্রামের যুবকের চরিত্রে। আন্দাজ, ফুটপাত, অমর, পয়গাম, মধুমতি কিংবা লিডার সিনেমার দিলীপ কুমার ছিলেন ঝকঝকে শহুরে তরুণ।
মিলন, দেবদাস আর শিকাস্ত সিনেমার বাঙালি বাবু দিলীপ কুমারই আন, আজাদ, কোহিনূর আর মুঘল-এ-আজমে হয়ে উঠেছে ইতিহাসের পাতার নায়ক।
অনবদ্য অভিনয়ে শুরুর দিকেই ‘ট্র্যাজিক হিরো’ তকমা জুটে গিয়েছিল দিলীপ কুমারের, কিন্তু পরের সিনেমাগুলোতে কমেডিতেও তিনি কম যাননি।
১৯৮৩ সালে ‘শক্তি’ চলচ্চিত্রে একজন সৎ পুলিশ অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করা দিলীপ কুমারের অপরাধী ছেলের ভূমিকায় পর্দায় এসেছিলেন পরবর্তী সময়ের সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চন।
প্রিয় উত্তরসূরীর মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ অমিতাভ বচ্চন এক টুইটে লিখেছেন, “আমার আইডল দিলীপ সাবকে হারালাম। স্বর্ণযুগের পর্দা নামল। সেই যুগ আর কখনোই আসবে না।”
এই মহাতারকার মৃত্যুর খবর প্রচারের পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোক ও সমবেদনার বার্তা আসতে শুরু করে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক টুইটে লিখেছেন, “দিলীপ কুমারজি একজন সিনেমার কিংবদন্তি হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি অতুলনীয় মেধার অধিকারী ছিলেন, যে কারণে প্রজন্মান্তরের দর্শকরাও তার অভিনয়ে শিহরিত হয়েছে। তার এই প্রস্থান আমাদের সাংস্কৃতিক জগতে একটি ক্ষতি। তার পরিবার, বন্ধু ও অসংখ্য ভক্তের প্রতি সমবেদনা। শান্তিতে থাকুন।”
অবিভক্ত ভারতের পেশোয়ারে ১৯২২ সালে জন্ম নেওয়া দিলীপ কুমার ছয় দশক ধরে বলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম আইকন হয়ে ছিলেন। ৯৮ বছরের জীবনে অভিনয় করেছেন ৬৫টিরও বেশি চলচ্চিত্রে।
সিরিয়াস চরিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি হাস্যরসাত্মক অভিনয়েও অসাধারণ দক্ষতা দেখানো এই অভিনেতার অভিনয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। চলচ্চিত্রে আসার আগে কখনো মঞ্চে অভিনয় করেননি। স্কুল বা কলেজ জীবনে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও খুব আগ্রহী ছিলেন না দিলীপ কুমার।
যেখানে তার জন্ম, সেই জায়গা এখন পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনওয়ালার অন্তর্ভুক্ত। পাঠানদের অন্যতম গোত্র আওয়ান পরিবারের সন্তান তিনি।
তারা ছিলেন ১২ ভাইবোন। বাবার নাম লালা গুলাম সরোয়ার। তিনি ছিলেন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। ফলের জমজমাট ব্যবসা ছিল তার। পেশোয়ার ও মহারাষ্ট্রের দেওলালিতে ছিল নিজস্ব বাগান।
দিলীপ কুমার লেখাপড়া করেন দেওলালির বিখ্যাত বার্নস স্কুলে। ত্রিশ দশকের শেষ দিকে ইউসুফ খানের পরিবার স্থায়ীভাবে মুম্বাইয়ে বসবাস শুরু করে। চল্লিশের দশকের শুরুতে দিলীপ কুমার পুনেতে নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেন। তিনি একটি ক্যান্টিন চালাতেন এবং স্থানীয় বাজারে শুকনো ফল সরবরাহ করতেন।
১৯৪৩ সালে আওধ মিলিটারি ক্যান্টিনে সে সময়ের প্রখ্যাত নায়িকা এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা দেবিকা রানির সঙ্গে পরিচয় তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
দেবিকা রানির ভীষণ ভালো লেগে যায় এই সুদর্শন তরুণকে। তিনি ছিলেন বোম্বে টকিজের অন্যতম মালিক। বোম্বে টকিজের পরবর্তী সিনেমা ‘জোয়ার ভাটা’ মুক্তি পায় ১৯৪৪ সালে। আর সেই সিনেমাতেই রুপালি পর্দায় আবির্ভাব ঘটে দিলীপ কুমারের।
কিন্তু চলচ্চিত্র তারকা ওঠার জন্য বলিউডের শুরুর দিকের অনেক অভিনেতার মত তাকেও নিজের নাম বদলাতে হয়েছে। ইউসুফ খান থেকে তিনি হয়ে উঠেছেন দিলীপ কুমার।
কেন এই নামবদল? রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান ইউসুফ বাবাকে যমের মতো ভয় পেতেন। ছেলে সিনেমায় নেমেছে জানতে পারলে বাবা আস্ত রাখবেন না। ইউসুফ চাইছিলেন আগে চলচ্চিত্রে শক্ত অবস্থান গড়ে তারপর সাহস করে বাবাকে কথাটি জানাবেন।
‘জোয়ার ভাটা’ সিনেমায় যাত্রা শুরু হলেও দিলীপ কুমার দর্শকপ্রিয় হয়ে ওঠেন ১৯৪৯ সালের হিট সিনেমা ‘আন্দাজ’ এর সাফল্যে। ওই চলচ্চিত্রে তার সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন দুই বলিউড তারকা রাজ কাপুর এবং নার্গিস।
‘আন্দাজ’ সিনেমার সাফল্যে ট্র্যাজেডি কিংয়ের পরিচয় আরও দৃঢ় হয় পঞ্চাশের দশকে। একের পর এক মুক্তি পায় ‘জোগান’ (১৯৫০), ‘দাগ’ (১৯৫২), ‘দেবদাস’ (১৯৫৫), ‘ইয়াহুদি’ (১৯৫৮), ‘মধুমতী’ (১৯৫৮)। বিশেষ করে দেবদাসের ভূমিকায় তিনি ছিলেন অনবদ্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস ‘নৌকাডুবি’র হিন্দি চিত্ররূপ ‘মিলন’-এর পর ‘উড়ান খাটোলা’, ‘দিদার’, ‘ফুটপাত’, ‘নয়া ডোর’, ‘মুসাফির’ আর ‘পয়গাম’ দিলীপ কুমারকে খ্যাতির শিখরে রিয়ে যায়। ‘দাগ’ সিনেমা তাকে ফিল্ম ফেয়ারের প্রথম আসরে এনে দেয় সেরা অভিনেতার পুরস্কার।
১৯৬০ সালে মুক্তি পায় ‘মুঘল-ই-আজম’। কে আসিফের এই ইতিহাস নির্ভর সিনেমায় শাহজাদা সেলিম ছিলেন দিলীপ কুমার, মধুবালা ছিলেন আনারকলি এবং সম্রাট আকবরের ভূমিকায় ছিলেন পৃত্থিরাজ কাপুর (রাজ কাপুরের বাবা)। বলিউডের একশ বছরের ইতিহাসে অন্যতম সেরা সিনেমা বলা হয় একে।
সিনেমার নায়কোচিত রঙিন জীবনের মাঝে ১৯৬৬ সালে দিলীপ কুমার সংসার শুরু করেন বলিউডের অভিনেত্রী সায়রা বানুর সঙ্গে। দিলীপের ১০ বছরের ছোট সায়রা বানু নিজেও হিন্দি ভাষার সিনেমার এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী। কোনো সন্তান নেই এ দম্পতির।
অভিনয়ের পাশপাশি চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনাতেও হাতেখড়ি হয়েছিলো দিলীপ কুমারের। ১৯৬১ সালে তিনি ‘গঙ্গা যমুনা’ প্রযোজনা করেন। এছাড়া ১৯৬৬ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দিল দিয়া দর্দ লিয়া’ সিনেমাটি আবদুল রশিদ কারদারের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালনা করেন। সেখানে ওয়াহিদা রেহমানের বিপরীতে অভিনয়ও করেছিলেন তিনি।
দিলীপ কুমার বাংলাদেশে এসেছিলেন নব্বইয়ের দশকে। সে সময় এদেশের ভক্তদের ভালোবাসায় প্লাবিত হন তিনি। তার ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হন এদেশের ভক্তরা।
দীর্ঘ অভিনয় জীবনে দিলীপ কুমার ফিল্ম ফেয়ারে আটবার পেয়েছেন সেরা অভিনেতার পুরস্কার। মনোনীত হয়েছেন ১৯ বার। ফিল্মফেয়ার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন ১৯৯৩ সালে। ১৯৮০ সালে মুম্বাই শহরের সাম্মানিক শেরিফ পদটি অলংকৃত করেন তিনি।
১৯৯১ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব পদ্মভূষণ এবং ভারতীয় চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য ১৯৯৪ সালে দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন দিলীপ কুমার।
ব্যক্তিগত জীবনে দিলীপ কুমার ছিলেন ভীষণ খেয়ালি, কিছুটা নিভৃতচারীও। মাতৃভাষা হিন্দকো ছাড়াও ফার্সি, হিন্দি, উর্দু, পশতু এবং ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারতেন তিনি।
ভারত-পাকিস্তানের বৈরিতা কমিয়ে দুদেশের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের জন্য দীর্ঘদিন কাজ করছেন এই অভিনেতা। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে মিলে কাজ করেছেন সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সেবায়।
১৯৯৭ সালে পাকিস্তান সরকার দিলীপ কুমারকে নিশান-ই-ইমতিয়াজ খেতাব দেওয়ার পর তা নিয়ে ভারতে বিতর্ক দেখা দেয়। কিন্তু দিলীপের পক্ষে অবস্থান নেন বর্তমান ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) তৎকালীন প্রধান অটল বিহারী বাজপেয়ী।
বিবিসি লিখেছে, তিনি শুধু একজন মহান অভিনেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন মুক্ত ভারতের একজন অনুসরণীয় নাগরিক।