অর্থনীতি

অডিটের ফাঁদে এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা

দেশের ব্যাংক খাতের বিশাল অঙ্কের টাকা আটকে আছে অডিটফাঁদে। ঋণ জালিয়াতি, খেলাপিদের বেআইনি সুবিধা, প্রতিবেদনে অসঙ্গতিসহ নানা অনিয়ম চিহ্নিত করে এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার অডিট প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে। টাকার এ অঙ্ক জাতীয় বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশের সমান। রাষ্ট্রায়ত্ত আটটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ১০০টি অডিট রিপোর্টে বিপুল অঙ্কের টাকা দীর্ঘদিন আটকে আছে। অদৃশ্য মহলের চাপে এসব নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এতে ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়েছে ব্যাংক ও আর্থিক খাত। এই সংকট সর্বকালের রেকর্ড অতিক্রম করেছে।

বড় অঙ্কের এ অর্থ আদায়ে ‘বিশেষ ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ কার্যক্রম বাস্তবায়নে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইওদের। ইতোমধ্যে সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি)। পর্যায়ক্রমে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠকের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

সূত্র মতে, অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির মাধ্যমে টাকা আদায়ের একটি ছক করছে এফআইডি। সেখানে অর্থ আদায় ও মনিটরিংয়ের বিষয়টি উল্লেখ আছে। গত এক মাসে এ প্রক্রিয়ায় অডিট রিপোর্ট নিষ্পত্তির মাধ্যমে ৩৪৪ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। এর আগে প্রতি মাসে গড়ে আদায়ের অঙ্ক ছিল ৪০ থেকে ৪৪ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) সচিব নাজমা মোবারেক জানান, অডিট আপত্তিগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। আপত্তিগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে করণীয় এবং কী করলে সমাধান পেতে পারি সে পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এফআইডির সচিব আরও বলেন, পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দীর্ঘদিন বড় অডিট রিপোর্ট থেকে অর্থ আদায়ে ব্যাংকগুলোর কোনো ফলোআপ ছিল না। এ সংক্রান্ত আইনের ঘাটতিও রয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। এসব ঘাটতি চিহ্নিত করে দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে ব্যাংকের এমডিদের।

জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ৪০ হাজারের বেশি অডিট আপত্তি রয়েছে। এর মধ্যে আটটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট শীর্ষ ১০০টি রিপোর্ট নিয়ে বিশেষ ক্র্যাশ প্রোগ্রাম শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর সঙ্গে অর্থ জড়িত প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা।

অডিট রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সহযোগী ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান হলেও নতুন করে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাংক। এ ঋণ এখন অনাদায়ী। গুদামে পাট নেই কিন্তু ঋণ দেওয়া হয়েছে পৌনে ২০০ কোটি টাকা। এছাড়া গ্রাহকের সিসিএ হিসাব থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে দেড়শ কোটি টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছে ব্রোকার হাউজ। এছাড়া রূপালী ব্যাংক নিয়ম ভেঙে আড়াইশ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। সে ঋণ আর ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের শর্ত ভেঙে ঋণ পুনঃতফসিলি করেছে ১২৫ কোটি টাকা। সেটি এখন অনাদায়ী। রিপোর্ট পর্যালোচনায় আরও দেখা গেছে, গ্যারান্টি ছাড়া ঋণ দেওয়া হয় ৮০০ কোটি টাকা। সে টাকা গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে ঋণখেলাপি হওয়া সত্ত্বেও ফের সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয় গ্রাহককে। সেটি এখন অনাদায়ী। একাধিক প্রকল্পে বারবার পুনঃতফসিল সুবিধা দেওয়ায় ৩০০ কোটি টাকার ঋণ আটকে যায়। এক ঋণ নিয়ে অন্য ঋণ পরিশোধ এমন ঘটনায় এক হাজার ৭১ কোটি টাকা অনাদায়ী হয়ে পড়েছে। গ্রাহক ঋণখেলাপি, তাকে পুনরায় ৪০৯ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। ওই টাকা আর ফেরত পায়নি ব্যাংক।

এফআইডির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জনতা ব্যাংকের শীর্ষ ১০টি অডিট রিপোর্টে জড়িত ৫৪ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা । বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের শীর্ষ ১০টি রিপোর্টে জড়িত ৪৪ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা। এছাড়া শীর্ষ ১০টি করে অডিট রিপোর্টে সোনালী ব্যাংকের ৩২ হাজার ২৩ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ১৮ হাজার ৯২২ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ৯ হাজার ২২৭ কোটি টাকা জড়িত। আর বেসিক ব্যাংকের পাঁচ হাজার ১১৪ কোটি টাকা, আইসিবির তিন হাজার ৬০৬ কোটি টাকা এবং বিএসইসির ৬০৬ কোটি টাকা।

ক্র্যাশ প্রোগ্রামের আওতায়, শীর্ষ অডিট রিপোর্ট দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে টাকা আদায়ের জন্য এখন থেকে প্রতি মাসে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করতে ব্যাংকের এমডি ও সিইওদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরপর ওই বৈঠকের অগ্রগতি প্রতিবেদন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠাতে হবে। আবার অগ্রগতি প্রতিবেদন নিয়ে প্রতি তিন মাস অন্তর ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবে এফআইডি। সেখানে এমডি ও সিইওদের কাছে টাকা আদায়ের অগ্রগতি জানতে চাওয়া হবে। তবে পদক্ষেপের অগ্রগতি বৈঠকের তিন দিন আগেই প্রতিবেদন আকারে জমা দিতে হবে এফআইডিতে।

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত এফআইডির অডিট ও আইন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আহসান কবীর জানান, আগে অডিট রিপোর্ট নিষ্পত্তি করতে মন্ত্রণালয়, ব্যাংক এবং অডিট বিভাগ মিলে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হতো। সে পদ্ধতি ছিল খুবই দুর্বল। বৈঠকে রিপোর্ট নিষ্পত্তিসংক্রান্ত কোনো আগাম প্রস্তুতি থাকত না। ফলে ৫০টি আপত্তি উত্থাপনের পর পর্যালোচনায় সময় চলে যেত। সব মিলিয়ে দেখা গেছে মাত্র নিষ্পত্তি হতো তিনটি। এখন ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের আগে একটি প্রি-ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করা হচ্ছে।

সরকারের এ উদ্যোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. কামরুজ্জামান খান জানান, ব্যাংক খাতের কর্তৃপক্ষ হিসাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটি প্রতিপালন করতে বাধ্য। শীর্ষ একশ অডিট রিপোর্ট নিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ যে মনিটরিংয়ের উদ্যোগ নিয়েছে সে বিষয়ে আমি অবহতি হয়েছি। এ বিষয়ে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *