ফরাসি পঞ্চম প্রজাতন্ত্রের ১১তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, তা নিয়ে নানারকম জল্পনা-কল্পনা চলছে। অনেকেরই ধারণা যে বর্তমান প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাঁক্রোই শেষ পর্যন্ত জয়ী হবেন। কিন্তু সাম্প্রতিক জনমত যাচাইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে তার সম্ভাবনা নিতান্তই কম।
প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্রো মূলত ক্ষমতায় এসেছিলেন একটা বিশেষ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া হলেন্ডের দুর্বল শাসনামল এবং তিনি তার সময় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করায় ফরাসি ইতিহাসের সবচেয়ে তরুণ এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী এমানুয়েল ম্যাঁক্রো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ গ্রহণ করেন।
কট্টর বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর এ আন্দোলন শেষপর্যন্ত সরকারকে বাধ্য করে তাদের কার্যক্রম থেকে সরে আসতে। তারপর করোনা ক্রাইসিস, দুই বছরের অধিক সময় সরকারকে নানারকম সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, যা সব ক্ষেত্রেই জনপ্রিয় ছিল না। বিশ্বব্যাপী এ মহামারি সমগ্র মানব সমাজকে তার অস্তিত্বের ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত করেছে ভ্যাকসিনের পক্ষে বা বিপক্ষে। সেই সাথে অর্থনৈতিক অচলাবস্থা তো আছেই। তার পরও ফরাসিদের মধ্যে দেশ পরিচালনার অন্য কোনো যোগ্য ব্যক্তিত্ব না থাকায় ম্যাঁক্রোকেই বেছে নিয়েছিল পরবর্তী ৫ বছরের জন্য; অন্তত জনমত যাচাইয়ে তা-ই মনে হচ্ছিল।
প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্রো ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের একচেটিয়া ইউক্রেনকে সমর্থনের ব্যাপারটা তারা গ্রহণ করতে পারেনি। পশ্চিমা বিশ্ব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর ইউক্রেনকে শর্তহীন সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিপরীতে রযেছে ফরাসি জনমত। যদিও ফরাসি মিডিয়াগুলো সর্বক্ষণ রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রচারণায় ব্যস্ত এবং ইউক্রেনকে রাশিয়ার আগ্রাসনের শিকার বলে অভিহিত করছে। প্রকৃত কারণ বা বাস্তবতাকে তারা গুরুত্ব দেয় না।
স্বাধীনচেতা ফরাসিরা ১৯৬৫ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল দ্যু গলের নেতৃত্বে মার্কিন সংগঠন ন্যাটো থেকে বেরিয়ে এসে এক স্বাধীন নিউক্লিয়ার ডিসিশনের কার্যক্রম শুরু করে এবং সামরিক ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল নীতি অবলম্বন করে, কিন্তু প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি ২০০৮ সালে এক অজানা কারণে পুনরায় ন্যাটোতে ফ্রান্সকে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। এরই এক নীরব প্রতিক্রিয়া আজ দৃশ্যমান, যেখানে প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্রো জনমত যাচাইয়ে ৩৫% জনগণের আস্থার পাত্র ছিলেন, অথচ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ৪২ দিন পর তার জনপ্রিয়তা নেমে এসেছে ২৬.৫০ ভাগে। অন্যদিকে কট্টর ডানপন্থী মারিন লোপেনের জনপ্রিয়তা বেড়ে হয়েছে ১৫% থেকে ২৫%।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে মারিন লোপেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছ থেকে নির্বাচনী খরচ বাবদ লোন নিয়েছিলেন ৩০ মিলিয়ন ইউরো। এবারের নির্বাচনী প্রচারণায়ও তিনি রাশিয়ার প্রতি ইউরোপের নানা রকম নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে। ফরাসি গণতন্ত্রের বিশেষত্ব হচ্ছে, নির্বাচনগুলো পরিচালিত হয় দুই রাউন্ডে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থীকে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করতে হলে অবশ্যই ৫০০ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সাক্ষর দেয়া অনুমোদনপত্র জমা দিতে হবে। এটা অবশ্য মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। তারপর একটা নির্দিষ্ট নিয়মের ভিত্তিতে নির্বাচনী প্রচারণা ও খরচ করতে হবে। নির্বাচনী খরচ সর্তসাপেক্ষে সরকার পরিশোধ করে, যাতে টাকার জোরে কেউ নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে না পারে।
শতকরা ৫০ ভাগের অধিক ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থীকে সরাসরি জয়ী বলে ঘোষণা করা হয়। অন্যদিকে তার কম হলে ১৫ দিন পর দ্বিতীয় রাউন্ড মোকাবেলা করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সাধারণত প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকারীদের সঙ্গে অন্য দলগুলো আলোচনা করে কোয়ালিশন করে ক্ষমতায় আসার জন্য।
এবারের নির্বাচনে ১২ জন প্রার্থী, তবে তাদের ডান বা বামপন্থী হিসেবে বিবেচনা করলে দেখা যায়, ৪৫% ডান আর ২৮.৫০% বামপন্থী প্রতিদ্বন্দ্বী। অন্যদিকে মধ্যপন্থী ম্যাঁক্রো পেতে পারেন ২৬.৫০%। জনমত যাচাইয়ে এটাই হচ্ছে আজকের প্রতিচ্ছবি। উল্লেখ করা যায় যে ১৫ বছর ফ্রান্স শাসন করা প্রেসিডেন্ট মিতেরাঁর এবং ৫ বছর শাসন করা প্রেসিডেন্ট হলেন্ডের সোশালিস্ট পার্টির অবস্থা খুবই করুণ! অন্যদিকে ঐতিহাসিক দ্যু গল, সিরাক আর সারকোজির ক্লাসিক ডান দলেরও একই অবস্থা। কথা হচ্ছে- দিতীয় রাউন্ডের কোয়ালিশন আলোচনায় বাম ও ডান কোন পক্ষের শক্তি কী হতে পারে? বিষয়টা আরও নির্ভর করছে কত ভাগ ভোটার এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় আছেন এবং কত ভাগ ভোটার তাদের নাগরিক দায়িত্ব পালন করবেন না।
এবারের নির্বাচন তাই অনেকটাই অনিশ্চিত। কোনো কিছুই বলা যাবে না। যেমন প্রখ্যাত ফরাসি ব্যক্তিত্ব জ্যাক আতালি বলেছেন, “এবারের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো একজন মহিলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন, যিনি কট্টর বর্ণবাদী দলের একজন ঐতিহাসিক নেত্রী।” যদি তা-ই হয়, তাহলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।
তবে যদি বাংলাদেশ বা ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলাদেশিদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপারে বলতে হয়, তাহলে ম্যাঁক্রোই উপযুক্ত ব্যক্তি, যার সঙ্গে আমাদের সরকার ও ব্যবসায়ীদের একটা অব্যাহত সম্পর্ক রয়েছে। আর রাষ্ট্র পরিচালনায়ও উনার অভিজ্ঞতা ও পরিপক্বতা এখন স্বীকৃত।