আঙিনায় অস্ট্রেলিয়া, অপেক্ষায় পাঁচ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ। তাদের বিপক্ষে আগে চারটি টি-টোয়েন্টি খেলে একবারও জিততে পারেনি বাংলাদেশ। এবার কি পারবে ? আলাপচারিতায় সেটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলেন বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক মুমিনুল হক, জাতীয় নির্বাচক ও সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার এবং আরেক নির্বাচক ও সাবেক স্পিনার আব্দুর রাজ্জাক।
বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া দুই দলই এখন টিম হোটেলে কোয়ারেন্টিনে আছে। কোভিড পরীক্ষায় নেগেটিভ হওয়ার সাপেক্ষে রোববার থেকে অনুশীলন করতে পারবে দুই দলই। সিরিজ শুরু মঙ্গলবার।
মুমিনুল, হাবিবুল ও রাজ্জাক, তিনজনেরই বিশ্বাস, অস্ট্রেলিয়ারকে হারানোর বড় সুযোগ এবার। অক্টোবর-নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপের প্রস্তুতির জন্যও এই সিরিজটিকে গুরুত্বপূর্ণ মানছেন তারা।
মুমিনুল হক
বাংলাদেশ টেস্ট দলের অধিনায়ক
“জিততে হলে আমাদের দেখাতে হবে দলগত পারফরম্যান্স। এটার বিকল্প নেই। তিন ফরম্যাটেই আমাদের জয়ের রেসিপি এটাই।”
“বলতে পারেন, টি-টোয়েন্টিতে দুই-একজনই খেলার ভাগ্য গড়ে দিতে পারে। সেটা বেশির ভাগ দলের ক্ষেত্রে সত্যি। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা ভিন্ন। এই সংস্করণেও তো আমাদের অনেক বড় ম্যাচ উইনার নেই! সাকিব হ্যাঁ, সাকিব ভাইয়ের মতা বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার আছেন, মুস্তাফিজের মতো বোলার আছে। তবু জিততে হলে আমাদের সম্মিলিত অবদানই লাগে। এবার জিম্বাবুয়েতে টি-টোয়েন্টি সিরিজেও এটা দেখা গেছে।”
“ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং, সবকিছুতে ভালো করতে হবে, এটা কমন কথা। তবে এই সিরিজে আমাদের ব্যাটিংটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে। কারণ, ওদের বোলিং শক্তিশালী। কিন্তু আমরা নিজেদের সবাইকে পাচ্ছি না। ওপেনিংয়ে তামিম ভাইয়ের মতো অভিজ্ঞ একজন নাই, লিটন দাসের মতো ফর্মে থাকা ব্যাটসম্যান নাই। মিডল অর্ডারে মুশফিক ভাই তো সম্ভবত গত দুই-তিন বছরে এই সংস্করণে আমাদের সেরা ব্যাটসম্যান। তাকে না পাওয়া অনেক বড় শূন্যতা। অন্যদের তাই বেশি দায়িত্ব নিতে হবে। বিশেষ করে টপ অর্ডারে সৌম্য, পরে সাকিব ভাই, রিয়াদ ভাইদের বড় ভূমিকা রাখতে হবে।”
মিরপুরের উইকেট বরাবরের মতো থাকলে বাংলাদেশ ৪-১ ব্যবধানেও জিততে পারে বলে মনে করেন মুমিনুল।মিরপুরের উইকেট বরাবরের মতো থাকলে বাংলাদেশ ৪-১ ব্যবধানেও জিততে পারে বলে মনে করেন মুমিনুল।“যদি মিরপুরের টিপিক্যাল ধীরগতির উইকেট হয়, আমাদের ম্যাচ পরিকল্পনা সেরকমই হওয়া উচিত। টি-টোয়েন্টিতে বেশির ভাগ সময় হয়তো প্রথম ৬ ওভারে আপনি ৫৫-৬০ রান চাইবেন। কিন্তু মিরপুরের উইকেটে সেটা কঠিন। এখানে উইকেট হাতে রেখে রানটা যতটুকু বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে। ভালো ব্যাটিং উইকেট থাকলে অবশ্য অন্য কথা।”
“বোলিংয়ে আমার মনে হয় সাকিব ভাই ও মুস্তাফিজের পারফরম্যান্স বেশি জরুরি। তারা দুজনই অভিজ্ঞ, অনেক টি-টোয়েন্টি খেলেছেন এবং পরিস্থিতি বুঝে বল করার ব্যাপারটা খুব ভালো বোঝেন। মিরপুরের উইকেটের ব্যবহার তাদের চেয়ে ভালো আর কে করতে পারবে!”
“অস্ট্রেলিয়ার বোলিং খুবই ভালো। ব্যাটিংয়ে যদিও কোনো বড় নাম নেই। তবে টি-টোয়েন্টিতে দুই-একজন দাঁড়িয়ে গেলেই খেলা ঘুরিয়ে দিতে পারে।”
“তারপরও অবশ্য আমি মনে করি, এবার আমাদের সুযোগ আছে। অনেক বড় সুযোগ। যদি মিরপুরের টিপিক্যাল উইকেট হয়, তাহলে পাঁচ ম্যাচের চারটি আমরা জিততে পারব বলে আশা করি। তাই বলে ওদেরকে হালকা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। দলে যারাই খেলুক, দলটা অস্ট্রেলিয়া। ওদের পেশাদারীত্ব অন্যরকম।”
হাবিবুল বাশার
জাতীয় নির্বাচক ও সাবেক অধিনায়ক
“অস্ট্রেলিয়াকে আমরা টি-টোয়েন্টিতে কখনও হারাতে পারিনি। এবার হারাতে চাই। শুধু সিরিজ জয়ের জন্যই নয়, জিততে চাই সামনের বিশ্বকাপের দিকে তাকিয়েও। অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে পারলে আমাদের আত্মবিশ্বাসের জন্য দারুণ হবে।”
“অস্ট্রেলিয়াকে কিন্তু আমি মোটেও খর্বশক্তির মনে করছি না। হ্যাঁ, ব্যাটিংয়ে তাদের বেশ কজন নাই। কিন্তু যারা আছে, বিগ ব্যাশে তারা দুর্দান্ত পারফর্ম করেছে। আর বোলিং তো খুবই শক্তিশালী। ম্যাচ জেতায় বোলাররাই। অস্ট্রেলিয়ার আসল জায়গাটা তাই ঠিকই আছে। মনে রাখতে হবে, আমরাও আমাদের শীর্ষ ক্রিকেটারদের কয়েকজনকে পাচ্ছি না।”
“জিততে হলে কন্ডিশন যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হবে আমাদের এবং নিজেদের সেরা ক্রিকেট খেলতে হবে। কন্ডিশন ভালো ব্যবহার বলতে বোঝাচ্ছি, উইকেট ও পারিপার্শ্বিকতা, সব মিলিয়েই। অস্ট্রেলিয়ানরা এমনিতেই এই কন্ডিশনে অভ্যস্ত নয়। তার ওপর এই দলে অনভিজ্ঞ অনেকেই আছে। তাদের জন্য এখানে মানিয়ে নেওয়া সহজ হওয়ার কথা নয়। আমাদের কাজ হবে, ওদের কাজটা আরও কঠিন করে তোলা।”
প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীনের দুই পাশে অন্য দুই নির্বাচক হাবিবুল বাশার ও আব্দুর রাজ্জাক।প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীনের দুই পাশে অন্য দুই নির্বাচক হাবিবুল বাশার ও আব্দুর রাজ্জাক।“ওদের বোলারদের আমরা কীভাবে সামলাব, সেটা হবে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। সিরিজের ক্ষেত্রে তো বটেই, সামগ্রিকভাবেও। স্টার্ক-হেইজেলউড-জ্যাম্পা-অ্যাগার-মার্শ, এই মানের বোলিং আক্রমণ খেলতে পারলে, বিশ্বকাপের জন্য অনেক ভালো হবে। সবসময় তো এই ধরনের বোলার খেলার সুযোগ হয় না আমাদের। বিশ্বকাপে তো এরকম বোলারদেরই খেলতে হবে, বিশেষ করে যদি প্রথম ধাপ উতরাতে পারি। বিশ্বকাপের ড্রেস রিহার্সাল হবে এটা।”
“সেরা বোলারদের খেললে অনেক সময় নিজের সেরাটা বেরিয়ে আসে। আশা করি, এবারও তেমন হবে। যদি ব্যাটিংটা আমরা ভালো করতে পারি, আমার ধারণা আমরা জিততে পারব।”
“সিরিজ নিয়ে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী আমি করব না। টি-টোয়েন্টি নিয়ে আগে থেকে কিছু বলা কঠিন। তবে যেটা বললাম, এবার কিছু ম্যাচ জিততে চাই।”
আব্দুর রাজ্জাক
জাতীয় নির্বাচক ও সাবেক স্পিনার
“হারাতে হলে কী করতে হবে, এটার আগে আমার একটা অনুরোধ মিডিয়া, ক্রিকেট অনুসারী সবার কাছে। এই সিরিজে যারা নেই, তাদের নিয়ে আলোচনা যেন আমরা যতটা সম্ভব কম করি।”
“অবশ্যই তারা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার। তাদের অভাব অনুভূত হতেই পারে। কিন্তু ওদেরকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে দলে যারা আছে, তাদের যেন আড়ালে ঠেলে দেওয়া না হয়। যারা দলে আছে, ওরাই সেরা। এই বিশ্বাসটা ওদেরকে দিতে হবে। নইলে ওদের মনোবল কমে যেতে পারে, দায়িত্ব কম অনুভব করতে পারে, নিজেদের নিয়ে সংশয়ে ভুগতে পারে। বাংলাদেশের হয়ে যারা খেলছে, তারাই সেরা দল। এখানে টিম ম্যানেজমেন্ট, অধিনায়কেরও দায়িত্ব আছে। আশা করি, তারা করবে।”
“মাঠের ক্রিকেটের কথা বললে, সবকিছুর আগে জরুরি সঠিক মানসিকতা। ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলতে হবে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে এই মানসিকতার বিকল্প নেই।”
“আরেকটা ব্যাপার হলো, বিশ্বাস। যা কিছুই হোক, অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে পারব আমরা, এই বিশ্বাস রাখতে হবে। ধরুন, প্রথম ম্যাচে যদি আমরা হেরে যাই, বা দুই ম্যাচে হেরে যাই, তারপরও বিশ্বাস রাখতে হবে যে সিরিজ জিতব।”
“মাঠের ক্রিকেটের কথা যদি বলি, প্রথম ৬ ওভার হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেটা ব্যাটিং-বোলিং দুই দিকেই, সর্বোচ্চ ফায়দা নিতে হবে।”
“পাওয়ার প্লে কাজে লাগানোর ব্যাপারটা অনেকটা নির্ভর করবে উইকেটের ওপর। ভালো ব্যাটিং উইকেট হলে ৬ ওভারে তো ৬০-৭০, এমনকি ৮০ রান ছাড়িয়েও যায়। কিন্তু মিরপুরে যে ধরনের উইকেট আমরা দেখি, সেরকম উইকেটই থাকলে প্রথম ৬ ওভারে উইকেট হারানো চলবে না। উইকেট রেখে রান যতটা করা যায়।”
“বোলিংয়ে করতে হবে ঠিক উল্টোটা। দ্রুত ব্রেক থ্রু দিতে হবে, যত বেশি সম্ভব উইকেট নিয়ে ওদের চাপে ফেলা যায়। অন্তত ২-৩ উইকেট নিতে হবে পাওয়ার প্লেতে। তাহলে ওরা চাপে পড়বে। সেখান থেকে বিল্ড আপ করতে হবে। বোলিং আমাদের এমনিতেই ভালো হচ্ছে এখন। সেটা ধরে রাখতে হবে।”
“অনেক ক্যালকুলেটিভ ক্রিকেট খেলতে হবে আমাদের। পরিস্থিতি দ্রুত পড়ে সেই অনুযায়ী সাড়া দিতে হবে। দেশের বাইরে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলা বেশ কজন আছে আমাদের। সাকিব-মুস্তাফিজ-রিয়াদ, এমনকি আফিফ, মোসাদ্দেকরাও টুকটাক খেলেছে। ওদের তাই এসব বুঝতে পারার কথা।”
“অস্ট্রেলিয়ার যদিও অনেকে নাই, কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে সবার থাকা সবসময় জরুরিও না। ওদের বেশ কজন ক্রিকেটার আছেন, যারা বড় বড় টুর্নামেন্ট বা সিরিজে অনেক খেলেছেন। টেম্পারামেন্ট তাই অন্যরকম।”
“তারপরও যদি সব মিলিয়ে হিসাব-নিকাশ করি, আমি মনে করি আমাদের সিরিজ জয় করা উচিত। সেটা ৩-২ ব্যবধান হোক, সমস্যা নেই। সিরিজ জিততে চাই।”