আইএমএফ-এর শর্ত পূরণে আগামী অর্থবছরের (২০২৪-২৫) বাজেটে খাদ্য সহায়তা ভর্তুকি কমছে। অর্থাৎ খোলাবাজারে স্বল্পমূল্যে খাদ্য বিতরণ কর্মসূচির ভর্তুকি চলতি অর্থবছরের চেয়ে প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি টাকা কমানো হচ্ছে। অপরদিকে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে খাদ্য আমদানি খাতে সরকারি ব্যয়ে বড় উল্লম্ফন ঘটছে। চাল ও গম আমদানিতে আগামী অর্থবছরে পৌনে ১৩শ কোটি টাকা বেশি গুনতে হবে। সবমিলিয়ে ব্যয় পরিচালন করতে আগামী বাজেটে খাদ্য খাতে সম্ভাব্য বরাদ্দ থাকছে ২২ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। এটি চলতি বাজেটের চেয়ে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা বেশি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
ওএমএসসহ বিভিন্ন খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিতে ভর্তুকি কমিয়ে আনাকে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, মূল্যস্ফীতির কশাঘাতে নতুন করে অনেক মানুষ গরিব হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে খাদ্যে ভর্তুকি বাড়ানো দরকার ছিল। ডব্লিউএফপি (ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম বা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি) গত মাসে বাংলাদেশের খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ মানুষ খাদ্যঝুঁকিতে ছিল; যা এর আগের মাসের তুলনায় ২ শতাংশ বেড়েছে। দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। আর ৪৩ শতাংশ মানুষ বাকিতে খাবার কিনছে। ২২ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বাবদ খরচ কমিয়েছে। আর ১৩ শতাংশ মানুষ সঞ্চয় ভাঙছে। খাদ্যঝুঁকিতে থাকা মাত্র ২১ শতাংশ মানুষ বাইরে থেকে সহায়তা পাচ্ছে।
৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এটি তার প্রথম বাজেট। সংকট পরিস্থিতিতে নতুন বাজেটে প্রাধান্য পাচ্ছে মূল্যস্ফীতি। সে হিসাবে খাদ্য সংগ্রহ ও মজুত খাতে বরাদ্দকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন কম হওয়ায় বিদেশ থেকে চাল ও গম আমদানিও প্রাধান্য পাচ্ছে।
প্রতিবছর সরকার ওএমএস কর্মসূচির মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে চাল গরিব মানুষের কাছে বিক্রির মাধ্যমে ভর্তুকি দিয়ে আসছে। চলতি বাজেটে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ছিল ৫ হাজার ৮ কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে ভর্তুকি দেওয়া হয় ৫ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা। মূল্যস্ফীতির হার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি হিসাবে দরিদ্র মানুষের মধ্যে স্বল্পমূল্যে খাদ্য সহায়তা বৃদ্ধি করা হয়। মূল্যস্ফীতি এখন ৯ শতাংশের ওপরে আছে। সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস-এর হিসাবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ১৫ শতাংশের ওপরে। সে হিসাবে আগামী বাজেটে খাদ্য ভর্তুকির অঙ্ক আরও বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। কিন্তু সম্ভাব্য ভর্তুকি বরাদ্দ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের খাদ্য ভর্তুকির চেয়ে ৩২২ কোটি টাকা কমিয়ে আগামী বাজেটে ৫ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছে। মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের যে ঋণ দিয়েছে, তার অনেক শর্তের মধ্যে একটি হলো ভর্তুকি ব্যয় হ্রাস করা। সে শর্ত পালন করতে গিয়ে সরকার খাদ্য ভর্তুকিতে হাত দিয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, খাদ্য ভর্তুকি কমানোর সিদ্ধান্ত সঠিক হচ্ছে না। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ভর্তুকি আরও বাড়ানো দরকার। এ ভর্তুকি গরিব মানুষ পাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির কারণে এ শ্রেণির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। আমি এ উদ্যোগ সমর্থন করি না।
সূত্রমতে, প্রতিবছর চাল ও গমের চাহিদার একটি অংশ সরকার বিদেশ থেকে আমদানি করে। আগামী অর্থবছরে ১১ থেকে ১২ লাখ মেট্রিক টন চাল ও গম আমদানির লক্ষ্য রয়েছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, এ সময়ে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির বড় প্রভাব পড়েছে খাদ্য আমদানি ব্যয়ে। চলতি বাজেট প্রণয়নের সময় প্রতি ডলারের মূল্য ১১০ টাকা ধরে সব ধরনের ব্যয়ের হিসাব করা হয়। এখন সে ডলারের মূল্য ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে চলতি অর্থবছরের সংশোধনী এবং আগামী অর্থবছরের বাজেটে খাদ্য খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় আগামী অর্থবছর চাল ও গম আমদানি খাতে ব্যয় পৌনে ১৩শ কোটি টাকা বেড়ে ৫ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকায় উঠেছে। এর মধ্যে চাল আমদানিতে ২ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা এবং গমে ২ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ২১৫ কোটি টাকা। এছাড়া আসন্ন বোরো মৌসুমে ১৭ লাখ ৫০ হাজার টন ধান, চাল ও গম সংগ্রহ করবে সরকার। এর মধ্যে ৩২ টাকা কেজি দরে ৫ লাখ টন ধান, ৪৫ টাকা কেজি দরে ১১ লাখ টন সিদ্ধ চাল, ৪৪ টাকায় আতপ চাল ১ লাখ টন এবং ৩৪ টাকা কেজি দরে ৫০ হাজার টন গম সংগ্রহ করা হবে। আগামী বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৮ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে চাল খাতে ৮ হাজার ৭০৬ কোটি এবং গম কিনতে ব্যয় হবে ৩৬ কোটি টাকা। যদিও বর্তমানে ধান ও চালের মজুত আছে ১২ লাখ ৪৯ হাজার ১৭১ মেট্রিক টন। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, জুনে সংগ্রহ অভিযান শুরু হলে মজুত আরও বাড়বে।
আগামী বাজেটে অন্যান্য আনুষঙ্গিক, বিশেষ করে চাল বহনে বস্তা ক্রয়, পরিবহণ, খাদ্য খালাসসহ অন্যান্য ব্যয় খাতে ১ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।