রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৬টি চিনিকলে আখ মাড়াই বন্ধ করার পর এবার আখ চাষিদের জন্য সহায়তাও বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে অনেক চাষিই আখ চাষ শুরু করতে পারেননি।
এ কারণে আগামী মৌসুমে আখ উৎপাদন ৩২ থেকে ৪০ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যার প্রভাব চিনি উৎপাদনেও পড়বে।
হিসাব অনুযায়ী আগামী বছর ১০ থেকে ১৫ হাজার মেট্রিকটন চিনি উৎপাদন কমে যাবে। বর্তমানে ৬০ থেকে ৭০ হাজার মেট্রিকটন চিনি উৎপাদন হয়।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, চিনি উৎপাদন কমে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো আখের উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় চাষিরা নিরুৎসাহী। সময় মতো চাষিদের ঋণ ও কৃষি উপকরণ না দেওয়া। এছাড়া আমাদের উৎপাদিত আখগুলোর জাত ভালো না হওয়ায় চিনি পাওয়া যায় কম। উন্নত জাতের আখ চাষ করে বলে বিদেশে একই পরিমাণ জমিতে কম খরচে বেশি আখ পায় এবং তা থেকে চিনিও বেশি হয়। এখন প্রতি হেক্টর জমিতে আমাদের দেশীয় জাতের আখ উৎপাদন হয় ৮ থেকে ১৫ মেট্রিক টন। উচ্চ ফলনশীল আখ চাষ করে পাওয়া যায় হেক্টরপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টন। চিনি উৎপাদনেও তারতম্য রয়েছে। উচ্চ ফলনশীল ১০০ টন আখ মাড়াই করে চিনি পাওয়া যায় ১২ টন। আর আমরা এখন পাচ্ছে ৫ থেকে ৬ টন।
এছাড়া চিনি বিক্রিতে অনিয়ম, কারখানার আধুনিকায়ন না হওয়াসহ নানা সমস্যায় চিনিশিল্প অনেক পিছিয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে শিল্পসচিব কে এম আলী আজম বলেন, আমাদের যে পরিমাণ আখের চিনি হচ্ছে তা দিয়ে আমরা বিভিন্ন রেশনিং কার্যক্রম চালাচ্ছি। এরপর কিছু ডিলারের মাধ্যমে বিক্রি করি। বর্তমানে আমাদের যেটা আছে সেটা এখন শর্ট পড়ার মতো অবস্থা। নতুন চিনি না এলে আবার সমস্যা হবে।
এবছর আখ চাষিদের সহায়তা না দেওয়ায় আখের উৎপাদন কমে যাবে যা চিনি উৎপাদনে কেমন প্রভাব ফেলবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বছর এখন পর্যন্ত চাষিদের আখ চাষের জন্য সহায়তা দেওয়া হয়নি বলে যে দেওয়া হবে না, তেমন সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। আমরা যতোটা পারি তাদের সহায়তা দেবো।
৬টি চিনিকলে আখ মাড়াই কাজ বন্ধ রয়েছে এতে করে চিনির উৎপাদন কমে যাবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই ৬টি চিনিকলে যে আখ মাড়াই হতো তা পার্শ্ববর্তী চিনিকলগুলোতে দেওয়া হয়েছে। ফলে চিনির উৎপাদন কমবে না। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনায়ও কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে যে লিকেজগুলো ছিলো সেগুলো বন্ধ করা হচ্ছে। তাই খুব একটা কম হবে না। আনুপাতিক হারে ভালো হবে। আমরা চাচ্ছি আগে ১৫টা মিলে যে চিনি উৎপাদন করতো এখন ৯টি মিলেই সে চিনি উৎপাদন করবে। কারণ আগে দুই মাসের বেশি চিনিকল চালানো যেতো না। কিন্তু এ বছর আমরা সাড়ে তিন মাস কলগুলো চালু রাখবো।
উৎপাদন বাড়ানো প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে শিল্পসচিব বলেন, উন্নতজাতের আখের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে, পানিসহনীয় আখের জাত উদ্ভাবন, পণ্যের বহুমুখীকরণ, নতুন মেশিন বা অধুনিকায়ন, আখ ক্রয়ে সচেতন হতে হবে। একই সঙ্গে চিনির পাশাপাশি বিভিন্ন বাই প্রডাক্ট তৈরি করতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের সচিব রফিকুল ইসলাম বলেন, দেশে উৎপাদিত আখের লাল চিনি দিয়ে চাহিদার মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব। বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। লোকসানে জর্জরিত চিনিকলগুলোতে ‘সংস্কার করা হবে’ এমনটা জানিয়ে সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের (বিএসএফআইসি) ছয়টি কলের আখ মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। যদিও সরকার ৬টি কলের সব আখ পার্শ্ববর্তী কলে মাড়াইয়ের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু আখ মাড়াই না হওয়ায় চাষিরা এ বছর আখ উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে।
তিনি বলেন, আখের বীজ বপনের সময় আমরা চাষিদের ঋণ দিয়ে থাকি। পাশাপাশি বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে সহায়তা করে থাকি। কিন্তু এ বছর বাকি ৯টি কলের চাষিদের এটা দেওয়া হয়নি। এখন চাষিরা ব্যক্তি উদ্যোগে যতোটুকু পারে আখ চাষ করছে। প্রাতিষ্ঠানিক কোন সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না। এর ফলে উৎপাদন অবশ্যই কমে যাবে। এর ফলে ৩২ থেকে ৪০ শতাংশ আখের উৎপাদন কমে যাবে। যার প্রভাব চিনি উৎপাদনেও পড়বে। আমাদের ধারণা আগামী বছর আমাদের ১০ থেকে ১৫ হাজার মেট্রিকটন চিনি উৎপাদন কমে যাবে।
রফিকুল ইসলাম বলেন, এখানে সরকারের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না, যা হচ্ছে চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের। ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত বর্তমানে আমাদের ট্রেডগ্যাপ আছে ৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আর ব্যাংকের কাছে ঋণ রয়েছে হাজার কোটি টাকার বেশি। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকার যদি ব্যাংক ঋণ, ট্রেডগ্যাপের টাকা দেয় তাহলে আমরা নিজেরাই চলতে পারবো। একই সঙ্গে আর আমাদের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন জাতীয় রাজস্ব থেকে করার ব্যবস্থাসহ শিল্পগুলোকে আধুনিকায় করলে এই শিল্প টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
বিএসএফআইসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ১৫টি চিনিকল রয়েছে। বিগত ১৯৩৩ সাল হতে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এসব চিনিকল প্রতিষ্ঠিত হয়। মিলগুলোর প্রতিষ্ঠাকালীন মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২ লাখ ১০ হাজার ৪৪০ মেট্রিকটন। কিন্তু মিলগুলো পুরাতন হয়ে পড়ায় ও আখ হতে চিনি আহরণের হার কমে যাওয়ায় এবং মিলে আখের পর্যাপ্ত যোগান না থাকায় কারণে বর্তমানে বার্ষিক চিনি উৎপাদন গড়ে ৬৭ হাজার ৫৭৭ মেট্রিক টন।
বর্তমানে মিলভেদে উৎপাদিত চিনির কেজি প্রতি খরচ ৯৩ টাকা থেকে ১৮৬ টাকা। মিলের বিপরীতে গৃহীত ঋণের সুদসহ বিবেচনা করলে তা ১৩১ থেকে ৩১১ টাকা ও গড় হিসেবে কেজি প্রতি উৎপাদিত চিনির খরচ ২২৫ টাকা ৬০ পয়সা। অথচ বর্তমানে চিনির বাজারমূল্য ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। বিএসএফআইসি বর্তমানে তার উৎপাদিত চিনি লুজ কেজি প্রতি ৬০ ও প্যাকেটজাত ৬৫ টাকা দরে বাজারে বিক্রয় করছে। উৎপাদন খরচও বিক্রয়মূল্যের এ বিরাট ব্যবধানের কারণে শুধু গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে মিলগুলো ৯৩৭ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে।
এছাড়া ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত মিলগুলোর দায় দেনার পরিমাণ ৮ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। মিলগুলোর লোকসান কমিয়ে আনার জন্য ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ৯টি চিনিকলের উৎপাদন পরিচালনা করা হচ্ছে। বাকি ৬টি মিলে সাময়িকভাবে আখ মাড়াই বন্ধ করেছে সরকার।
উল্লেখ্য, আমাদের দেশে বার্ষিক চাহিদা ১৮ লাখ মেট্রিকটন। তারমধ্যে আমরা উৎপাদন করি ৬০ থেকে ৭০ লাখ মেট্রিকটন। আমাদের মজুদ আছে ৪০ হাজার মেট্র্রিক টন। দেশে উৎপাদিত আখের লাল চিনি দিয়ে চাহিদার মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব। বাকিটা আমদানি করে মেটাতে হচ্ছে।
বর্তমানে দেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চিনিকলগুলোতে উৎপাদিত দেশী আখের চিনির মজুদ রয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার মেট্রিকটন।