অর্থনীতি

আশার আলো অর্থনীতিতে

করোনা ও ওমিক্রন পরিস্থিতির মধ্যে নতুন বছরের অর্থনীতির গতি পর্যালোচনা করে দেখছেন রাষ্ট্রের আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারকরা। সেখানে আর্থিক অবস্থার দুধরনের চিত্র দেখতে পান তারা। একদিকে করোনায় আয়-রোজগার কমা, বেকার ও ছাঁটাই হওয়া মানুষগুলো খরচ করতে হিমশিম খাচ্ছে। এরসঙ্গে চোখ রাঙাচ্ছে বাজারদর।

জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা মূল্যস্ফীতিকে উত্তপ্ত করে তুলছে। রেমিট্যান্স নিয়েও উদ্বেগ বাড়ছে। অন্যদিকে- সরকারের রাজস্ব আয় ভালোই হচ্ছে। বাড়ছে ব্যাংক ঋণের অঙ্ক। রপ্তানি ও আমদানিতে ইতিবাচক ধারা বইছে। সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পুরোদমে শুরু হয়েছে। কৃষি উৎপাদন সন্তোষজনক পর্যায়ে আছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, এটা স্পষ্ট যে অর্থনীতি করোনার ধাক্কা যথেষ্ট মাত্রায় কাটিয়ে উঠছে। গেল সপ্তাহে আর্থিক খাতের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে ‘আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হারসংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল’ সভায় বসেছিলেন অর্থমন্ত্রী নিজেই। ওই বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন-বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সি, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদার এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তারা।

কাউন্সিলের সদস্যরা মনে করছেন, টিকার কারণে অর্থনীতিতে গতি বাড়ছে। নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন অর্থনীতির জন্য হুমকি মনে করছেন না। কারণ বুস্টার ডোজ ইতোমধ্যে চলে আসছে। মার্চ পর্যন্ত দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ টিকার আওতায় চলে আসবেন। করপোরেট খাত অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ও আমদানিতে রের্কড সৃষ্টি হয়েছে। বাড়ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হারও। রাজস্ব আয়ে আশার সঞ্চার তৈরি হয়েছে। এসব কারণে নতুন বছরের অর্থনীতির গতি আরও বাড়বে বলে আশার আলো দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

সবকিছু ঠিক থাকলে গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি সংকোচের তুলনায় চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ অর্জন হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে অর্থ বিভাগ। শুধু তাই নয়, পরের অর্থবছরেও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হবে এমনটি ধরেই হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে।

তবে অর্থনীতির আকাশে কিছু ঘন কালো মেঘও দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, শঙ্কা মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী। রেমিট্যান্স প্রভাব নিুমুখী ও ব্যালেন্স অব পেমেন্টে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। খোলা বাজারে ডলারের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বমুখী ভাবিয়ে তুলছে।

জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, বিশ্বব্যাপী পণ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়েছে। যে কারণে দেশে জ্বালানি তেল ও নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতে হয়েছে। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে পণ্য ও সেবা খাতে। এ বছর মূল্যস্ফীতি বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করছে। যে কোনো মূল্যে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এটি সম্ভব না হলে মুদ্রার বিনিময় হার, আমদানি ও রপ্তানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

তার মতে, বিশ্ব অর্থনীতির সবকিছু খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশেও অন্যান্য সূচক কিছুটা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। রপ্তানি আয় কিছুটা বেড়েছে। রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ও বাজেট বাস্তবায়ন আগের বছরের তুলনায় ভালো হয়েছে। এখন নজর মূল্যস্ফীতির দিকে।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থনীতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে ঋণ ও সঞ্চয় দুটোর পরিমাণই বাড়ছে। আমদানির চাহিদা অনেক বেড়েছে। রপ্তানিও বাড়ছে। তবে রেমিট্যান্স কমছে। আমদানি বেড়ে যাওয়ায় ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি বেড়েছে। এটি কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এটির কারণেই মুদ্রা বিনিময় হারে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ডলারের মূল্য বেড়েছে। তবে খোলা বাজার ও ব্যাংকিং এর মধ্যে ডলারের মূল্য ব্যবধান অনেক বেশি। সেটি আরও কমিয়ে আনতে হবে। না হলে ইনফরমাল চ্যানেলে বেশি টাকা চলে যাবে।

তিনি আরও বলেন, আগীম বছরে পদ্মাসহ আরও কিছু বড় প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। মেট্রোরেল আংশিক হয়ে যাবে। এর প্রভাব ২০২২ সালের অর্থনীতিতে পড়বে। এসব দিক বিবেচনায় নতুন বছরের অর্থনীতি ভালো অবস্থায় যাবে। তবে কিছু পুরোনো চ্যালেঞ্জ আছে। এরমধ্যে রয়েছে করোনাভাইরাসের প্রভাব। সরকারের ব্যয় করার সক্ষমতা কমছে। কারণ রাজস্ব আহরণ সেভাবে বাড়ছে না। সেদিকে নজর দিতে হবে।

এদিকে করোনা ধকল কাটিয়ে দেশের শিল্পকারখানা উৎপাদন শুরু করেছে। ফলে আমদানিতে রের্কড সৃষ্টি হয়েছে। অক্টোবরে ৭১১ কোটি ডলারের আমদানি হয়েছে। আগের বছরের একই মাসের তুলনায় বেশি ২৭৪ কোটি ডলার বা ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ। জুলাই-অক্টোবরে মোট ২ হাজার ৫৮৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ে ছিল এক হাজার ৭০৬ কোটি ডলার। আমদানি বেশি হয়েছে ৮৭৭ কোটি ডলার বা ৫১ দশমিক ৩৯ শতাংশ

এদিকে জুলাই-নভেম্বরে রপ্তানি বাণিজ্য থেকে ১ হাজার ৯৭৯ কোটি ডলার আয় হয়েছে। এ সময় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। গতবছর একই সময়ে আয় হয় ১ হাজার ৫৯২ কোটি ডলার।

অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হয়েছে ৪৪ হাজার ৬১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩৮ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা। পরিকল্পনা বিভাগ মনে করছে করোনার ধাক্কা সামলে গতি ফিরছে উন্নয়ন কার্যক্রমে। এদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফেরায় রাজস্ব খাতেও আদায়ের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। গত পাঁচ মাসে মোট রাজস্ব আয় হয়েছে ১ লাখ ২৩ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টদের মতে, নতুন বছরে অর্থনীতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দ্রুত ব্যালেন্স অব পেমেন্টকে স্থিতিশীল করা। প্রয়োজনে টাকার অবমূল্যায়ন করে হলেও করতে হবে। তা না হলে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি এখন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি বেড়ে গেলে গরিব মানুষের ওপর বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আর ধনী মানুষকে আরও ধনী করবে। মূল্যস্ফীতি বাড়লে সঞ্চয়ের সুদ হার ৬ থেকে ৭ শতাংশ করতে হবে। এতে ব্যাংক ঋণের সুদ হার ৯ শতাংশে রাখা সম্ভব হবে না। ফলে শিল্পসহ উৎপাদনশীল খাত ধ্বংস হয়ে যাবে।

জানা গেছে, চলতি বাজেটে ভর্তুকি ধরা হয়েছে ৪৮ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু অর্থ বিভাগ হিসাব করে দেখছে এর পরিমাণ আরও বাড়বে। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে দেশে জ্বালানি তেল, সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ভর্তুকি বেড়ে ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও আগামীতে দেশের ভেতর এ মূল্য কমানোর সম্ভাবনা নেই। ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে আনতে নতুন করে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বাড়তে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *