লাইলাতুল কদর হচ্ছে একটি সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত। এ রাতে মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির প্রতিটি ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। সূর্যাস্তের পরপরই এ রাতে মহান আল্লাহ তাঁর আরশ থেকে প্রথম আকাশে নেমে আসেন। মায়া আর দয়া নিয়ে, প্রেম ও ভালোবাসা দিয়ে মানবজাতিকে ডাকেন আর বলেন, ‘কে আছ পাপী! তুমি ক্ষমা চাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব। কে আছ দুঃখী! আমি তোমার দুঃখ মোচন করব। কে আছ রোগী! আমি তোমাকে সুস্থ করে দেব। কে আছ দায়গ্রস্ত! আমি তোমাকে দায়মুক্ত করে দেব। তোমাদের কার রিজিকের প্রয়োজন-আমার কাছে চাও, আমি তার রিজিক বৃদ্ধি করব।’ মহান আল্লাহ এভাবে ফজর পর্যন্ত ডাকতে থাকেন। যারা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে প্রার্থনায় লিপ্ত হয়, তারা কল্যাণকামী হয়। সৌভাগ্যবান হয়। মহান আল্লাহ এ রাতে বান্দার জীবন, মৃত্যু ও ভাগ্যলিপি চূড়ান্ত করে দেন।
লাইলাতুল কদর সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আমি কোরআন নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে।’ ‘লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।’ ‘এ রাতে ফেরেশতারা ও জিবরাইল তাদের প্রভুর অনুমতিক্রমে সব সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করে। শান্তিময় এ রাত হলো ফজরের সূচনা পর্যন্ত’ (সূরা কদর)। এ রাত কোরআন নাজিলের রাত। মহত্ব ও গুরুত্বসহকারে মহান আল্লাহর ইবাদতের রাত। এ রাত হলো হাজার মাস তথা তিরাশি বছর চার মাসের চেয়ে উত্তম। ওই ব্যক্তির চেয়েও ভাগ্যবান আর কে হতে পারে, যে এ রাতে নির্ঘুম থেকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার সুযোগ পেয়েছে। যে ব্যক্তি এ রাত ইবাদতে মগ্ন থেকে কাটিয়ে দিল, সে যেন তিরাশি বছর চার মাসের বেশি সময় ধরে মহান আল্লাহর ইবাদত করল।
এ রাতটি কেন হাজার মাসের চেয়েও উত্তম? নবিজির একটি গল্পে এ প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। নবিজি (সা.) একদিন সাহাবায়ে কেরামদের সামনে বনি ইসরাইলের এক উপাসকের কথা বলছিলেন। সে ব্যক্তি এক হাজার মাস ধরে আল্লাহর ধ্যান ও সাধনায় লিপ্ত ছিল। এ কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম আফসোস করতে লাগলেন আর বললেন, আমরা এত বছর ইবাদত করব কীভাবে? তাছাড়া আমাদের অনেকে তো এত বছর বেঁচেও থাকি না। আমরা তো সেই উপাসকের মতো শ্রেষ্ঠ হতে পারব না। ঠিক তখনই জিবরাইল (আ.) এ রাতের সুসংবাদসহ সুরা কদর নিয়ে নবিজির কাছে হাজির হলেন এবং এ উম্মতকে শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসাবে প্রমাণ করে দিলেন (তাফসিরে মাজহারি)। নবিজি (সা.) বলেন, ‘তোমরা মাহে রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোয় লাইলাতুল কদর তালাশ করো’ (বুখারি)। এই পবিত্র রাতে ফেরেশতারা পৃথিবীতে আসে মানবজাতির জন্য বরকত, রহমত ও কল্যাণ নিয়ে। এ রাত হলো জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার রাত।
লাইলাতুল কদরকে গোপন রাখা মহান আল্লাহর মহারহস্য। তিনি চান, মূল্যবান কিছু অর্জনে যেমন কষ্ট করতে হয়, তেমনি তার বান্দা লাইলাতুল কদর অন্বেষণেও সাধনা করুক। ওলামায়ে কেরাম বলেন, লাইলাতুল কদর যদি অনির্দিষ্ট রহস্যময় না হতো, তাহলে অনেক অলস ও হতভাগা লোক এ মহান রাতের অমর্যাদা করে আল্লাহর গজবে পতিত হতো। তবে লাইলাতুল কদর সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। এ রাতের ফজিলত শুধু মুমিনদের জন্য। যাদের ইমান আছে, যারা প্রকৃত মুমিন, তারাই শুধু লাইলাতুল কদরের সুফল পাবে। নবিজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে আত্মকল্যাণের উদ্দেশ্যে এ রাতে জেগে থেকে ইবাদত করবে, তার অতীতের সব পাপ মোচন করা হবে’ (বুখারি)। অন্যান্য ফরজ ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গে নফল ইবাদত করে নির্ঘুম রাত অতিবাহিত করা লাইলাতুল কদরের প্রধান সুন্নত।
নবিজির আমলে অনেক সাহাবি রমজানের ২৭ তারিখকে লাইলাতুল কদর হিসাবে স্বপ্নে দেখেছেন। সাহাবিরা নবিজিকে স্বপ্নের কথা জানালে নবিজি বলেন, আমিও এমনটা স্বপ্নে দেখেছি। হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন, ‘মহান আল্লাহর শপথ করে বলছি, নবিজি (সা.) রমজানের ২৭ তারিখের রাতকে লাইলাতুল কদরের রাত বলেছেন।’ অন্য হাদিসে রয়েছে, নবিজি (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যদি দুর্বল অথবা কোনো কারণে অক্ষম হয়ে থাকে, সে যেন রমজানের ২৭ তারিখ রাতে ইবাদত করে’ (মুসলিম)। আরেক হাদিসে এসেছে নবিজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর পেতে চায়, সে যেন তা রমজানের সাতাশতম রাতে অনুসন্ধান করে (মুসনাদে আহমদ)। অনেক বিজ্ঞজনের মতে, লাইলাতুল কদর হচ্ছে রমজানের ২৭ তারিখে। তারা বলেন, আরবিতে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দ দুটিতে ৯টি বর্ণ রয়েছে; আর সুরা কদরে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দ দুটি তিনবার রয়েছে; নয়কে তিন দিয়ে গুণ করলে ফলাফল হয় সাতাশ। তাই ছাব্বিশতম রোজার দিবাগত রাত সাতাশ রমজানের রাতই হলো লাইলাতুল কদর রাত (তাফসিরে মাজহারি)। আবার অনেকের মতে, বছর ঘুরে লাইলাতুল কদরের তারিখ পরিবর্তন হয়। কোনো বছর একুশ, কোনো বছর তেইশ, কোনো বছর পঁচিশ, কোনো বছর সাতাশ, আবার কোনো বছর উনত্রিশ তারিখের রাতে লাইলাতুল কদর হয়। তবে সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে অনেক মহামনীষী রমজানের সাতাশ তারিখের রাতকে লাইলাতুল কদর হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।
লাইলাতুল কদরের নিদর্শন : বিজ্ঞজনের মতে, লাইলাতুল কদরের রাতের বিশেষ কিছু নিদর্শন রয়েছে। এ রাতে অন্ধকার গভীর হবে না। আলো-আঁধারি ছেয়ে থাকবে। অধিক গরম হবে না। শীতের তীব্রতাও থাকবে না। মৃদু বাতাস প্রবাহিত হবে। মহান আল্লাহর উপাসনায় মানুষ তৃপ্তি লাভ করবে। এ রাতে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। লাইলাতুল কদর শেষে সূর্য উদয় হবে হালকা আলো নিয়ে পূর্ণিমার চাঁদের মতো করে। কিন্তু মুমিন বান্দার সঠিক কাজ হবে, রমজানের শেষ দশকের প্রত্যেক বিজোড় রাতেই লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করে মহান আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকা। তার ধ্যানে নিজেকে মগ্ন রাখা।
লাইলাতুল কদরের ইবাদত : এ রাতে মুমিন বান্দা কিছু নফল ইবাদত করবে। ধীরগতিতে নফল নামাজ পড়বে। তাকওয়া ও স্থিরতার সঙ্গে রুকু-সিজদা করবে। বারবার মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে। এ রাতে যে মুমিন বান্দা অনেক কিছু পেল কিন্তু ক্ষমা পেল না; তাহলে তার চাওয়া-পাওয়া সবই ব্যর্থ। তার জীবন পুরোটাই অনর্থ। এ রাতে একনিষ্ঠ চিত্তে মহান আল্লাহর কাছে তওবা করবে। মুমিন এ মর্মে আল্লাহর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে যে, সে জীবনে সব পাপ ছেড়ে দেবে। সে অন্যায় করেছে বলে মহান আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত হবে। কোনো বান্দার অধিকার বিনষ্ট করলে তার অধিকার আদায়ের প্রতিশ্রুতি দেবে। একজন মুমিনের কাজ হবে এই পবিত্র রাতে মহান আল্লাহর কাছে নিজের দুঃখ-কষ্টগুলো তুলে ধরা। নিজের ভুলগুলো স্বীকার করে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। তাঁর ধ্যানে মগ্ন হয়ে নির্ঘুম রাত অতিবাহিত করা। হজরত আয়েশা (রা.) একবার রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জানতে পারি, তাহলে আমি ওই রাতে কী দোয়া করব? তখন নবিজি (সা.) তাকে একটি দোয়া শিখিয়ে দিলেন এবং বললেন, তুমি লাইলাতুল কদরে আল্লাহর কাছে এই দোয়াটি করবে-‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফউন; তুহিব্বুল আফওয়া, ফা’ফু আন্নি’, অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি তো ক্ষমাশীল! ক্ষমাকে তুমি ভালোবাসো। অতএব, আমাকে তুমি ক্ষমা করো।
মুহসিন আল জাবির : ইসলামি গবেষক ও বিশ্লেষক