জাতীয়

খুনের আগে রুপি আদায়

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ-সদস্য (এমপি) মো. আনোয়ারুল আজিম আনারকে নৃশংসভাবে হত্যার আগে ব্ল্যাকমেইল করার পরিকল্পনা ছিল মাস্টারমাইন্ড শাহীনের। আনারের নগ্ন ছবি তোলার উদ্দেশ্য ছিল। সঙ্গে থাকবে কোনো নারী। এ ধরনের ছবি দেখিয়ে তাকে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায় করা হবে।

দুদিন এভাবে অর্থ আদায়ের পর তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা ছিল। এ উদ্দেশ্যেই এমপি আনারকে সঞ্জীবা ভবনে ডেকে নেওয়া হয়। ফ্ল্যাটে পাওয়া রক্তের ডিএনএ পরীক্ষা হবে। শেষ পর্যন্ত মরদেহ পাওয়া না গেলেও ডিএনএ রিপোর্ট প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করা হতে পারে। এদিকে ডিবির তিন সদস্যের একটি দল ঘটনা তদন্তে আজ ভারত যাচ্ছে।

সঞ্জীবা ভবনের সেই বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স ভবনে প্রবেশের পর আনারের পকেটে থাকা ১০ হাজার রুপি কেড়ে নেয় কিলাররা। তারা এমপি আনারকে দিয়েই তার বন্ধু গোপালের কাছে ফোন দিয়ে ৪ লাখ ২০ হাজার রুপি আনায়। তাদের এমন কর্মকাণ্ড দেখে সন্দেহ হয় আনোয়ারুল আজিম আনারের। সেখানে থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজতে থাকেন।

বিষয়টি আঁচ করতে পেরে বাধা দেয় খুনিরা। এ সময় তাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এর একপর্যায়ে এমপি আনারের মুখে চেতনানাশক প্রয়োগ করে ভাড়াটে খুনিরা। এতে জ্ঞান হারান তিনি। এ অবস্থাতেই তার উলঙ্গ ছবি তোলা হয়।

কিলারদের ভাবনায় ছিল, এমপির জ্ঞান ফেরার পর ওইসব ছবি দেখিয়ে তাকে ব্ল্যাকমেইলিং করবে। কিন্তু দীর্ঘক্ষণেও জ্ঞান না ফেরায় তাকে প্রথমে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর লাশ গুমের চিন্তা শুরু করে। প্রথম পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ায় তারা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় লাশ গুম করার বিষয়ে।

এর অংশ হিসাবে লাশ টুকরো টুকরো করে হাড়, মাংস এবং চামড়া আলাদা করা হয়। এরপর এমপি আনার হত্যার খবর প্রকাশ হলে শুরু হয় তোলপাড়। সন্ধান শুরু হয় মরদেহের। কিন্তু ২৫ মে পর্যন্ত আনোয়ারুল আজিম আনারের লাশের সন্ধান মেলেনি। উদ্ধার হয়নি আনারের ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোন। তবে তদন্তে বেরিয়ে আসছে নতুন নতুন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

ডিবি সূত্র জানায়, জ্ঞান না ফেরার কারণে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে এমপি আনারের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা আদায় করতে পারেনি কিলাররা। এরপরও তারা চার লাখ ৩০ হাজার রুপি আদায় করেছে। আনারকে দিয়েই তারা গোপালের কাছে টাকা চেয়ে ফোন করায়। গোপাল তার ম্যানেজারের মাধ্যমে ওই টাকা পাঠান ঘাতকদের কাছে।

সূত্র আরও জানায়, হত্যা মিশন সম্পন্ন করতে গাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে একটি ভারতীয় সিম নম্বর ব্যবহার করে মূল সমন্বয়ক আক্তারুজ্জামান শাহীন। এই সিমের সূত্র ধরেই দ্রুত সময়ে সব খুনি শনাক্ত করে দুদেশের পুলিশ।

শাহীন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ায় অনেক তথ্যই যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না জানিয়ে গোয়েন্দারা বলেন, শাহীনকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগবে। তারা জানান, সঞ্জীবা গার্ডেনের ওই বাসা থেকে যে রক্ত সংগ্রহ করছে সেগুলোর ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে। এটা হলে লাশ পাওয়া না গেলেও মামলার অভিযোগ প্রমাণ করা যাবে।

এদিকে ঘটনা তদন্তে ডিবির তিন সদস্যের একটি দল আজ রোববার ভারতের উদ্দেশে রওয়ানা হবে। ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সকাল ৮টার ফ্লাইটে দেশ ছাড়ার কথা রয়েছে তদন্ত টিমের।

ডিবির এ টিমের নেতৃত্ব দেবেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। টিমের অন্য দুই সদস্য হলেন ডিবি ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার মো. আ. আহাদ ও অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. শাহিদুর রহমান। এর আগে ভারতীয় পুলিশের চার সদস্যের একটি টিম বাংলাদেশে এসে কয়েক দফায় আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে।

১২ মে ভারতে যান এমপি আনার। কলকাতার ব্যারাকপুরসংলগ্ন মণ্ডলপাড়ায় বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন তিনি। ১৩ মে চিকিৎসার কথা বলে বাসা থেকে বের হন আনার। পরে কলকাতার দমদম বিমানবন্দর লাগোয়া নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে খুন হন এমপি আনার। বাসাটি খুনিরা ভাড়া নেয় ১১ মাসের জন্য।

এমপি খুনের ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে ২২ মে। ওইদিনই রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন (২৪) বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করেন। এছাড়া ভারতে একটি হত্যা মামলা হয়েছে।

হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত আটজনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের পুলিশ। এদের মধ্যে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ।

তারা হলেন, চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ আমান, তার চাচাতো ভাই তানভীর ভূঁইয়া ও শাহীনের গার্লফ্রেন্ড সেলেস্তি রহমান। তারা ডিবিতে রিমান্ডে আছে। শুক্রবার আদালত তাদের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এছাড়া কলকাতা পুলিশের কাছে গ্রেফতার আরেক আসামি জিহাদ হাওলাদার ওরফে কসাই জিহাদকে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে ভারতের পুলিশ। অপর চারজন পলাতক রয়েছে। তাদের মধ্যে সিয়াম নেপালে, শাহীন যুক্তরাষ্ট্রে এবং মোস্তাফিজ ও ফয়সাল বাংলাদেশেই রয়েছে।

ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া পলাতক আসামি মোস্তাফিজ ও ফয়সাল বাংলাদেশেই আছে। এখন তারা চেহারা পরিবর্তন করে বাংলাদেশ থেকে পালানোর চেষ্টা করছে। এমপি আনারের দুটি মোবাইল ফোন এখনো উদ্ধার হয়নি। ডিবির ধারণা, ফোন দুটি মোস্তাফিজ ও ফয়সালের কাছে রয়েছে।

শনিবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ের কনফারেন্স রুমে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা গ্রেফতারকৃত আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করছি। এখন পর্যন্ত জানতে পেরেছি, হত্যাকাণ্ডে দুটি গ্রুপ জড়িত।

একটি মদদদাতা গ্রুপ এবং অপরটি হলো বাস্তবায়ন গ্রুপ। মদদদাতা গ্রুপের মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীন। শাহীন একজন মেয়েসহ তিন সদস্যের একটি টিম নিয়ে ৩০ এপ্রিল কলকাতায় যান। এ টিমে ছিল হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়ন গ্রুপের মূল ব্যক্তি পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শিমুল ভূঁইয়া (আমানুল্লাহ)। সেখানে কে কি কাজ করবে, কে গাড়ি ভাড়া করবে, কে গাড়িতে থাকবে সবকিছু ঠিক করে গলাকাটা বাহিনীর প্রধান শিমুল ভূঁইয়া।

গোয়েন্দা কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, বাসায় যাওয়ার পর প্ল্যান ছিল প্রথমেই তারা হত্যা করবে না। শুরুতে তাকে হানি ট্রাপের মতোই ভয় দেখাবে, নুড ছবি তুলবে, এই ছবি দিয়ে তাকে দুদিন ব্ল্যাকমেইল করবে। এমপির ভারতের ও বাংলাদেশের বন্ধুদের কাছ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে যত টাকা পারে আদায় করবে। টাকা আদায় শেষ হলে হত্যা করা হবে।

হাতিয়ে নেওয়া ওই টাকার একটি অংশ যারা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করবে তাদের দেবে। কিন্তু সঞ্জীবা গার্ডেনের ওই ফ্ল্যাটে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে এমপির মুখে ক্লোরোফর্ম (চেতনানাশক) দেওয়া হয়। এতে অচেতন হয়ে পড়লে তখন তারা এমপির নুড ছবি তোলে। কিন্তু পরে আর এমপি আনারের জ্ঞান ফেরে না। তখন তাদের প্রথম প্ল্যানটি ভেস্তে যায়। তখন তারা প্ল্যান করে হত্যা করে এমনভাবে গুম করতে হবে, যাতে বোঝা না যায় এই জায়গাতে হত্যা করা হয়েছে।

এজন্য তারা এমপির মোবাইল ফোনগুলো বেনাপোল সীমান্তের কাছে নিয়ে এমপি আনারের বিরোধী পক্ষের লোকজনকে ফোন করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ফোন করে বলবে ‘শেষ’। যাতে যাদের ফোন করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের পেছনে ঘুরবে।

হারুন অর রশীদ বলেন, গ্রেফতার শিমুল ভূঁইয়া আমাদের কাছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। তার প্রেক্ষিতে আমরা একটি টিম নিয়ে ভারত যাব। সেখানে গ্রেফতার জিহাদের কাছে আমরা বিভিন্ন বিষয় জানতে চাইব। বাসা বাড়ি সবকিছু মেলাব। আমরা অনেক বিষয় নিয়ে কাজ করব।

তিনি বলেন, সংসদ-সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে এর আগেও দুবার হত্যার চেষ্টা করে তারা ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমবার তাদের প্ল্যান ছিল গত নির্বাচনের আগে বাংলাদেশেই হত্যা করবে। দ্বিতীয়বার তাদের প্ল্যান হয় গত জানুয়ারির ১৭-১৮ তারিখে। ওই সময় এমপি আনার ও এই চক্র উভয়ই কলকাতায় ছিল। কিন্তু এমপি হোটেলে থাকায় সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি। তৃতীয় ধাপে এসে প্ল্যান বাস্তবায়ন হয়েছে।

কি কারণে এমপিকে হত্যা করা হয়েছে এমন প্রশ্নের উত্তরে হারুন বলেন, এই হত্যার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। পূর্বশত্রুতা থাকতে পারে, আর্থিক বিষয় থাকতে পারে, রাজনৈতিক বিষয় থাকতে পারে। হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নকারীদের ৪-৫ জন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা।

তারা হলেন, জাহিদ, সিয়াম, মোস্তাফিজ, আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া। শিমুল ভূঁইয়া এর আগে পাঁচ থেকে ছয়টি গলা কেটে মার্ডার করেছে। কি কারণে হত্যা সেটি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। হত্যার মূল কারণ উদ্ঘাটনে তদন্ত শেষে বলা যাবে।

চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডে স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের কোনো সম্পৃক্ততা আছে কিনা জানতে চাইলে ঢাকার ডিবিপ্রধান বলেন, নির্দিষ্ট কোনো কিছুই বলা যাবে না। তবে অনেক বিষয় আছে। তদন্ত শেষ করে আমরা আপনাদের জানাতে পারব। আমরা অনেক তথ্য-প্রমাণ পেয়েছি। তদন্তের স্বার্থে এখনই প্রকাশ করছি না। প্রমাণ পেয়েছি বলেই কলকাতায় হত্যা মামলা হয়েছে। আমাদের দেশে একটি মামলা হয়েছে। কলকাতায় মামলাটি সিআইডি তদন্ত করছে। নিশ্চয়ই তারা আলামত পেয়েছে। কলকাতায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলার তদন্তে আমরাও যাব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *