হেনরি কিসিঞ্জার। মার্কিন কূটনীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র। বড় বড় সফলতা আর ‘অগণিত’ বিতর্কিত রেকর্ডসহ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে ঢেলে সাজিয়েছেন তিনি। ভালোবাসা যেমন পেয়েছেন দেশে, দুর্নামও তেমন জুটেছে বিদেশে। পুরস্কার-তিরস্কার দুইই আছে তার স্বর্ণোজ্জ্বল রাজনীতিক জীবনে। ঘৃণা-প্রশংসার দ্বৈরথে আজ (শনিবার) শতবর্ষে পা রাখছেন যুক্তরাষ্ট্রের সদাহাস্য চেহারার এই কূটনীতিক।
যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭তম প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন (১৯৬৯-১৭৭৪) আর ৩৮তম প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের (১৯৭৪-১৯৭৭) জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময় তার ঝুলিতে রয়েছে কমিউনিস্ট চীনে কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তার থেকে শুরু করে ভিয়েতনাম যুদ্ধে ষড়যন্ত্র আর সোভিয়েত বিরোধী স্বৈরশাসকদের ক্ষমাহীনভাবে সমর্থনের মতো কিছু দুঃসাহসিক পদক্ষেপ। তার কঠোর সমালোচকেরাও অনেক সময় তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, একঘেয়েমি আর বুদ্ধিবৃত্তিক উপহারগুলোর প্রশংসা না করে পারেননি। অনেকের মতে, সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো শতবর্ষী এই ‘নির্মম’ স্নায়ু যোদ্ধাকে কখনো জবাবদিহিতারও মুখোমুখি হতে হয়নি।
কিসিঞ্জারের কিছু উল্লেখযোগ্য ভূমিকা
চীন: ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে কমিউনিস্ট চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের একটি মিশনে গোপনে বেইজিংয়ে যান কিসিঞ্জার। যাওয়ার পর তিনি সেখানে নিক্সনের একটি যুগান্তকারী সফরের মঞ্চ তৈরি করেন। তৎকালীন বিচ্ছিন্ন বেইজিং আর উৎপাদন শক্তি আর যুক্তরাষ্ট্রের পর বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিতে চীনের উত্থানে অবদান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। চীন ছাড়ার সময় কিসিঞ্জার চীনকে ব্যবসায়িক পরামর্শসহ মার্কিন নীতির বিষয়ে কটূক্তিতে সতর্ক করেছিলেন।
ভিয়েতনাম: ভিয়েতনামে মার্কিন যুদ্ধকে ‘সম্মানের সঙ্গে’ শেষ করতে নিক্সনের প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। লাওস-হ্যানয়ের সরবরাহ লাইন বন্ধ করতে গোপনে প্রতিবেশী কম্বোডিয়ায় বোমা হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন কিসিঞ্জার। সে সময় কয়েক হাজার বেসামরিক নাগরিক মারা গিয়েছিল বলে অনুমান করেন কিছু ইতিহাসবিদ। কিসিঞ্জার প্যারিসে আলোচনার মাধ্যমে ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে ভিয়েতনামে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছেন। আর বিতর্কিতভাবে নোবেলে শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। যদিও হ্যানয়ের লে ডুক থো তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। প্যারিস চুক্তির দুই বছরেরও বেশি সময় পর সাইগনে মার্কিন-মিত্র সরকারের পতনে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি কমাতে কিসিঞ্জার একটি ‘শান্তিপূর্ণ সমাধান’ চেয়েছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়।
অভ্যুত্থান
সোভিয়েত ইউনিয়নের মুখোমুখি দাঁড়ানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হওয়ায় চিলি আর আর্জেন্টিনার মতো বাম সরকারগুলোকে উৎখাতের পক্ষে ছিলেন কিসিঞ্জার। একটি স্মারকলিপিতে দেখা যায়, চিলির সমাজতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দের মতো একটি বামপন্থি নির্বাচিত সরকার কাজ করতে পারে তা দেখিয়ে একটি ‘প্রতারণাপূর্ণ’ মডেলের প্রস্তাব করেছিলেন কিসিঞ্জার। সিআইএ-সমর্থিত অভুত্থ্যানে সৈন্যরা দায়িত্ব নেওয়ার পর আলেন্দে আত্মহত্যা করেন।
আক্রমণ: যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে কিসিঞ্জার কখনো কোনো আক্রমণের সমর্থনে অনিচ্ছা দেখাননি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) হত্যা ও গণধর্ষণ চালানোর পরও পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের বিশিষ্ট অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘কিসিঞ্জার বাংলাদেশের গণহত্যাকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছিলেন। তাই আমি কিসিঞ্জারের প্রশংসা করার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। ভিয়েতনামসহ অন্য অনেক দেশে একই মতামত বিশ্বাস করা হয় বলেও জানান তিনি। কিসিঞ্জার ২৪ বছরের নিষ্ঠুর দখলদারিত্ব শুরু করে পূর্ব তিমুর দখল করার সাথে সাথে শীতল যুদ্ধের মিত্র ইন্দোনেশিয়াকে বন্ধ করতে সমর্থন দিয়েছিলেন। আর এর মাধ্যমে শুরু হয় ২৪ বছরের নিষ্ঠুর দখলদারিত্ব। কিসিঞ্জারও তুরস্কের সঙ্গে কৌশলগত দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপনে সাইপ্রাসের এক-তৃতীয়াংশ দখলের পরও দেশটিকে সমর্থন দিয়েছিলেন। আর তাতে সহকর্মী ন্যাটো সদস্য গ্রিসের সাথে তার প্রতিদ্বন্বিতায় ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানও বজায় ছিল। কিসিঞ্জার সোভিয়েত ও কিউবা মিত্রদের মোকাবিলায় অ্যাঙ্গোলার গৃহযুদ্ধে গোপনে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার নেতৃত্ব দেন।
মধ্যপ্রাচ্য: কূটনীতিতে কিসিঞ্জার তার বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেছেন মধ্যপ্রাচ্যে। ১৯৭৩ সালে আরব রাষ্ট্রগুলোর আকস্মিক আক্রমণ শুরুর পর মিত্র ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহে বড় ধরনের একটি কৌশলগত এয়ারলিফট পরিচালনা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। মস্কোকে দমাতে কিসিঞ্জার সবচেয়ে জনবহুল আরব দেশ মিসরের সাথেও সম্পর্ক পরিবর্তন করেছিলেন।