‘জামায়াতের সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পরকীয়া প্রেম চলছে কিনা’, এমন বক্তব্যে চাপে পড়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। দলের ভেতরে ও অনুসারীদের মধ্যে ‘জামায়াতের প্রতি দুর্বল অংশ’ ও দলীয়ভাবে জামায়াতের সমন্বিত প্রতিবাদের মুখে পড়েছেন সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী।
বিএনপির অন্যতম একজন শীর্ষ নেতা এই চাপে ইকবাল হাসানের সঙ্গ দিলেও প্রকাশ্যে কোনও নেতাই তার বক্তব্যের বিষয়ে কথা বলছেন না। এ অবস্থায় বিএনপির পরিবর্তিত নতুন নীতিনির্ধারণে অন্যতম ভূমিকা রাখা এই নেতা কিছুটা বেকায়দায় আছেন। ধারণা করা হচ্ছে, দলের স্থায়ী কমিটির পরবর্তী বৈঠকে বিষয়টি আলোচনায় উঠতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দলের মধ্য থেকে কোনও চাপ আছে বলে আমার জানা নেই। কথা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ আমাদের জামায়াত-বিএনপি বলে ব্র্যান্ডিং করে ফেলেছিল। ফলে কাউকে না কাউকে বলতে হবে। এই ব্র্যান্ডিং করা মানে বিএনপিকে পেছনে ফেলে দেওয়া। সে কারণে আমি আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করেছি যে ‘তোমরা সস্তা ব্যবসা করছো’।
‘বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সাহেব বলেছেন—ধর্মের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে, বিএনপি তো ইসলামি দল না’ উল্লেখ করে ইকবাল হাসান বলেন, ‘বিএনপি কি এতই দৈন্য হয়ে গেছে যে জামায়াতের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে? বিএনপি একটি বৃহৎ দল। সেই জায়গা থেকেই আমি ওই বক্তব্য রেখেছি।’
গত ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর হাজারীবাগে অনুষ্ঠিত বিএনপির সমাবেশে সরকারের বিভিন্ন নীতি ও অবস্থান নিয়ে কথা বলেন ইকবাল হাসান মাহমুদ। একপর্যায়ে তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উদ্দেশে প্রশ্ন তোলেন—‘‘আওয়ামী লীগের মুখে প্রায়ই শুনি, যেটা বুলি হয়ে গেছে। তারা প্রায়ই বলে, বিএনপি-জামায়াত, বিএনপি-জামায়াত। আমি বলছি, এখন সময় এসেছে আওয়ামী-জামায়াত, আওয়ামী–জামায়াত বলার। ওরা (আওয়ামী লীগ) জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে, কিন্তু বেআইনি ঘোষণা করে না। তাহলে কি আমি বলবো, উনাদের ‘পরকীয়া প্রেম’ চলছে!’’
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর এই বক্তব্যের পরদিন প্রতিবাদ জানায় জামায়াত। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী এই দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম বিবৃতিতে বলেন, ‘ইকবাল হাসান মাহমুদ জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত যে অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেছেন, তা দেশবাসীকে বিস্মিত করেছে। এটি কোনও রাজনীতিবিদের ভাষা হতে পারে না। তার এ বক্তব্য স্বৈরাচারী শাসনকে প্রলম্বিত করার ক্ষেত্র তৈরি করবে।’ আবদুল হালিম এটাও উল্লেখ করেন, জামায়াতে ইসলামী কখনও কোনও আপস, গোপন ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না এবং করার প্রশ্নই আসে না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, ‘‘ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু যা বলেন, সরাসরিই বলেন। উনি কোনও চাপে পড়েননি। তিনি সরাসরি বক্তব্য দিয়ে দেন, ‘এটা হলে এটা হবে, ওটা হলে ওটা হবে’। আর জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের অ্যালায়েন্সের সুযোগ তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এটা প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে হতে পারে। জামায়াতও রিকগনাইজড হতে পারে, সরকারেরও সুবিধা হবে।’’
স্থায়ী কমিটির আরেক নেতার প্রশ্ন, ‘জামায়াত সরকারের সুবিধা না পেলে বিনা বাধায় বছরব্যাপী মিছিল, প্রতিবাদ, সারা দেশে অবাধে নেতাদের সফর করা সম্ভব হচ্ছে কীভাবে?’
বিএনপি নেতারা বলছেন, ২০১৮ সালের আগস্টে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেন বিএনপির তৃণমূলের নেতারা। এর দুই বছর পর ২০২০ সালে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের আগে-আগে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জোটসঙ্গী জামায়াতকে নিয়ে পর্যালোচনা শুরু করে বিএনপি। ওই পর্যালোচনায় স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্য জানিয়েছেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর গুরুত্ব অনেকাংশেই কম। সে কারণে জামায়াতের সঙ্গে বিদ্যমান জোটগত সম্পর্ককে নতুনভাবে দেখা প্রয়োজন। একজন সদস্য ২২ পৃষ্ঠায় একটি বিস্তারিত পর্যালোচনাও উত্থাপন করে বৈঠকে। স্থায়ী কমিটিতে জামায়াতপন্থি অন্তত একাধিক সদস্যের বিরূপ অবস্থান ও শীর্ষ নেতৃত্বের কৌশলগত অবস্থানের কারণে সেই আলোচনার কোনও রেজাল্ট আসেনি।
চেয়ারপারসন কার্যালয়ের প্রভাবশালী একজন কর্মকর্তা জানান, জামায়াতকে নিয়ে আওয়ামী লীগকে আক্রমণ করায় দলের অভ্যন্তরে চাপ নেই—ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর ওপর। তার বক্তব্যের পর প্রথম দুদিন পক্ষে-বিপক্ষে সমালোচনা ও আলোচনা হয়েছে। অনেকের প্রশ্ন ছিল—তিনি কি বিএনপির নীতিনির্ধারণী অবস্থান ব্যক্ত করেছেন? তাহলে এত আগে কেন, এসব প্রশ্ন তৈরি হয়েছে বিএনপিতে। কিন্তু এখন নতুনভাবে চাপ সৃষ্টি হয়েছে—আমার দেশ অনলাইনের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের একটি লেখায়।
প্রভাবশালী একজন কর্মকর্তার ভাষ্য—মাহমুদুর রহমানের লেখায় স্পষ্টভাবে জামায়াতের পক্ষাবলম্বন করা হয়েছে। এতে স্পষ্ট হয়েছে যে তিনি আদতে বিএনপির ঘাড়ে পা রেখে জামায়াতকেই লালন-পালন করছেন। দক্ষিণপন্থিরা তার লেখার প্রচার করলেও বিএনপির নেতৃত্ব তাকে নিয়ে আরও পরিষ্কার অবস্থানে রয়েছেন।
‘মাহমুদুর রহমানের লেখার পর বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা ক্ষুব্ধভাষায় তার কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছেন যে কেন ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয়েছে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে, এমন তথ্য দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।
বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জামায়াতের চাপে ২০০৮ সালে নির্বাচনে গেছেন খালেদা জিয়া। তাদের চাপে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাননি তিনি। ২০১৪ সালে নির্বাচন বয়কটও করেছেন জামায়াতের চাপে। এসব বিষয়ে পরিলক্ষিত যে জামায়াতের কারণে রাজনৈতিকভাবে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিএনপি তার একক পরিচয় নিয়ে দাঁড়াতে পারেনি।’
দলের দায়িত্বশীল একাধিক ব্যক্তি মনে করছেন, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর সাম্প্রতিক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের কার্যকর কোনও সম্পর্ক যে নেই, তা পরিষ্কার হয়েছে। স্থায়ী কমিটির আলোচনার মধ্য দিয়ে যে বিষয়টি বিএনপির রাজনীতিতে গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল, সেটিও একটি শেষ মাত্রা এনেছে তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। যদিও দলের দক্ষিণপন্থি অংশ ও জামায়াতের অনুসারীরা টুকুর বক্তব্য ‘বর্তমান সরকারকে প্রলম্বিত করার’ কৌশল হিসেবে দেখছেন। তারা মনে করছেন, এতে আসন্ন আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হবে। আর বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা মনে করছেন, জামায়াতকে পাশে রাখলে স্বয়ং বিএনপির একক শক্তি হয়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত হবে।
এ প্রসঙ্গে স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার বক্তব্যে আন্দোলনে বাধা হবে কীসের জন্য। আন্দোলন বিএনপি একা করছে। যুগপৎ আন্দোলন করতে বিএনপি সবার সঙ্গে কথা বলছে। কিছু পয়েন্টের আলোকে আমরা যুগপৎ আন্দোলন করবো। আমাদের মহাসচিব ইতোমধ্যে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন এটা।’
প্রসঙ্গত, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে বিএনপি।