সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করার পরও দেশ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ পাচার কোনোভাবেই থামছে না। মোট অর্থ পাচারের ৮০ ভাগই হচ্ছে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে। পাচার রোধে দেশে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) রাষ্ট্রীয় সাতটি সংস্থা কাজ করছে। কিন্তু আসছে না কোনো কার্যকর ফল। পাচার বন্ধ না হওয়ার নেপথ্যে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর মধ্যে চরম সমন্বয়হীনতাসহ ১১ কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি সম্পদ পুনরুদ্ধার অর্থাৎ বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে ফেরতের ক্ষেত্রেও ৪টি প্রতিবন্ধকতা শনাক্ত হয়েছে।
দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন (২০২০ ও ২০২১) উঠে এসেছে এসব তথ্য। সম্প্রতি এটি রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করা হয়। ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬ বছরে দেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। প্রতি ডলার ৮৮ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় ৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি। এ হিসাবে গড়ে প্রতি বছর পাচার হচ্ছে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা।
দুদকের প্রতিবেদনে অর্থ পাচারের কারণ ও প্রতিকার এবং পাচারকৃত সম্পদ পুনরুদ্ধারে সীমাবদ্ধতা ও করণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। অর্থ পাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে দুদককে আরও শক্তিশালী ভূমিকা পালনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানতে চাইলে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কার্যক্রমের পরিধি বিস্তৃত। তবে মানি লন্ডারিং কার্যক্রমের সবচেয়ে বড় বাধা হলো সমন্বয়হীনতা। দুদক ছাড়াও আরও ছয়টি সংস্থা এ আইন প্রয়োগের ক্ষমতাপ্রাপ্ত। কিন্তু কোনো সংস্থার সঙ্গেই কোনো রকম সমন্বয় নেই। যখন কোনো দায়িত্ব সবাইকেই দেওয়া হয়, তখন মূলত কোনো দায়িত্বই কাউকে দেওয়া হয় না। যখন সবাই অর্থ পাচার প্রতিরোধে কাজ করে, তখন মূলত কেউই সঠিকভাবে কাজ করে না বা করতে পারে না। বিদ্যমান আইন ও বিধিমালা সংশোধনের জন্য ইতোমধ্যেই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অর্থ পাচার প্রতিরোধ অন্যান্য সংস্থাগুলোও কাজ করবে। তবে অন্যান্য সংস্থার পাশাপাশি দুদককে সমন্বয়কারীর দায়িত্ব দিলে কাজে আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সৃষ্টি হবে। অর্থ পাচার ঠেকানো ও পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত কার্যক্রমে গতি ফিরবে।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই অর্থ পাচারের অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো সংস্থাগুলো করে থাকে। বাংলাদেশেও এক্ষেত্রে (অর্থ পাচার প্রতিরোধ) সফলতা পেতে চাইলে দুদককে ক্ষমতা দিতে হবে। এক্ষেত্রে অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে দুদক কাজ করবে। এছাড়া অর্থ পাচারের কারণগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর সমাধান করতে হবে। একইসঙ্গে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরতের ক্ষেত্রেও যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।
অর্থ পাচার ঠেকাতে ৭ সংস্থা : বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট-সিআইডি), মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কাস্টমস, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পরিবেশ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও দুদক অর্থ পাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। বিদ্যমান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ২৭টি সম্পৃক্ত অপরাধের মধ্যে দুদক শুধু ‘ঘুস ও দুর্নীতি’র মাধ্যমে অপরাধলব্ধ অর্থের মানি লন্ডারিংয়ের অনুসন্ধান ও তদন্ত করছে। বাকি ২৬টি সম্পৃক্ত অপরাধের তদন্তভার সিআইডি ও এনবিআরসহ অন্যান্য সংস্থাগুলোর কাছে ন্যস্ত। দুদকের এ আইনি সমস্যার সমাধানে ১৭ ফেব্রুয়ারি দুদক সচিব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। সেখানে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা-২০১৯ সংশোধনের কথা বলা হয়েছে।
অর্থ পাচারের কারণ ও প্রতিকার : বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় অর্থ পাচার ঠেকানো ও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় প্রতিরোধ না হওয়ার পেছনে অন্তত ১১টি উল্লেখযোগ্য কারণ পাওয়া যায়। দেশে আইন থাকলেও এসব কারণেই মূলত এর সুফল জনগণ পাচ্ছে না। কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অর্থ পাচার প্রতিরোধ না হওয়ার কারণগুলো হলো-১. দুদকসহ অন্য সাতটি সংস্থার বিদ্যমান ব্যবস্থায় অনুসন্ধান বা তদন্তকারী কর্মকর্তার দ্বারা সার্ভিলেন্স পরিচালনা ও আন্ডারকভার অপারেশনের কোনো বিধান বা ব্যবস্থা নেই। এর সমাধানে প্রো-অ্যাক্টিভ অনুসন্ধানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ২. মানি লন্ডারিং ও আর্থিক অপরাধ উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে ফরেনসিক অ্যাকাউন্টিং টেকনিক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংস্থাগুলোতে ফরেনসিক অ্যাকাউন্টিং টেকনিক অবশ্যকীয়ভাবে ব্যবহার করতে হবে। ৩. দুদকসহ অন্যান্য সংস্থাগুলোতে মূলত রিঅ্যাক্টিভ অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনা করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আন্ডারকভার অপারেশন পরিচালনার নীতিমালা প্রণয়ন ও বিশেষায়িত লোকবল নিযুক্ত করতে হবে। ৪. ক্রস-বর্ডার অপরাধের ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য দুদকসহ অন্যান্য সংস্থা শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউর ওপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে তথ্য-প্রমাণ পেতে গ্লোব নেটওয়ার্ক বা এন্টি করাপশন এজেন্সিগুলো নিয়ে গঠিত আঞ্চলিত প্লাটফরমে বাংলাদেশকে অবশ্যই সংযুক্ত হতে হবে। ৫. মানি লন্ডারিং প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফোরামে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন এবং সরকার কর্তৃক প্রণীত জাতীয় কৌশলপত্রের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পলিসি ও গাইডলাইন প্রণয়ন করতে হবে। ৬. মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) প্রণয়ন ও প্রেরণ, বিদেশি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় সাধন, এপিজির সঙ্গে যোগাযোগ, মিউচ্যুয়াল ইভ্যালুয়েশনের জন্য ডকুমেন্ট তৈরি, প্রস্তুতি গ্রহণ ইত্যাদি কাজের জন্য বিদ্যমান অর্গানোগ্রামে নেই ডেডিকেটেট শাখা বা ডেস্ক নেই। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ লোকবল নিয়োগ করে মানি লন্ডারিং অনুবিভাগে পৃথক ডেস্ক স্থাপন করতে হবে। ৭. বাংলাদেশ থেকে যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়ে থাকে, সেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি না থাকায় শুধু ইউনাইটেড ন্যাশন কনভেনশন এগেইনস্ট করাপশনের (আনকাক) আওতায় তথ্য বা সাক্ষ্য-প্রমাণ কিংবা সম্পদ পুনরুদ্ধারে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক আইনি সহযোগিতা চুক্তি করতে হবে। ৮. বিদ্যমান অনুসন্ধান ও তদন্তের সংখ্যার বিপরীতে কর্মরত তদন্তকারী কর্মকর্তার সংখ্যা অপ্রতুল। এক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং, ব্যাংক ও বিমা সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধান ও তদন্ত, ফরেনসিক অ্যাকাউন্টিং, ডিজিটাল ফরেনসিক, সার্ভিলেন্স ও আন্ডারকভার বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও স্টাডি ট্যুরের আয়োজন করতে হবে। ৯. এমএলএআর প্রেরণ পরবর্তী কার্যক্রমের কোনো আপডেট তথ্য থাকে না। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে পাঠানো এমএলএআরের সর্বশেষ অবস্থা পর্যালোচনা করা এবং গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য দুদক, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে সমন্বয় সভা করতে হবে। ১০. অনুসন্ধান/তদন্তকারী কর্মকর্তার নামে ডোমেইন সংবলিত ইমেইল (অফিসিয়াল) না থাকায় বিদেশি এজেন্সি বা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগে সমস্যা। এক্ষেত্রে সব অনুসন্ধান ও তদন্তকারী কর্মকর্তাদের স্ব স্ব নামে ডোমেইন সংবলিত অফিসিয়াল ইমেইল অ্যাকাউন্ট তৈরি করতে হবে। ১১. তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহে সর্বোপরি দুর্নীতি প্রতিরোধসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কে যোগদান করতে হবে।
সম্পদ পুনরুদ্ধারে বাধা ও করণীয় : কমিশনের কর্মপরিকল্পনার মধ্যে সম্পদ পুনরুদ্ধার কার্যক্রমকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কমিশনের সম্পদ পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে বড় ৪টি বাধা রয়েছে। এগুলো হলো-১. বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে দুদকের আইনি সীমাবদ্ধতা। অর্থ পাচার রোধ ও বিদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার ক্ষেত্রে দুদকের অগ্রণী ভূমিকা দেখতে চাইলে দুদককে পর্যাপ্ত আইনি ক্ষমতা দিতে হবে। ২. বিদেশ থেকে অর্থ ফেরতের সার্বিক প্রক্রিয়া জটিল ও সময় সাপেক্ষ। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের দুর্নীতি দমন সংস্থার সঙ্গে দুদকের এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা চুক্তি করতে হবে। ৩. বিদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরতে আনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সংশ্লিষ্ট দেশের আইনি সহায়তা। এজন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করার জন্য দুদক এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ডেডিকেটিড লোকবল নিয়োগ করে দেশ-বিদেশে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ৪. অর্থ পাচারের অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি এবং আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের যথেষ্ট জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার ও আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।