আসন্ন রোজা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েই চলছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোজ্যতেল, চিনি ও ছোলার ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এলসি মার্জিন প্রত্যাহার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব পণ্য আমদানির বিপরীতে এলসি কমিশন ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতকিছুর পরও বাজার লাগামহীন।
নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্যে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জীবনযাত্রার অন্যান্য সেবা, খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ব্যয়ও। প্রায় সব খাতেই বাড়তি ব্যয় সামাল দেওয়ার মতো আয় বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কমাতে হচ্ছে খাদ্য, বিনোদন ও অন্যান্য চাহিদা।
সূত্র জানায়, করোনার সংক্রমণ কমার পর হঠাৎ করে চাহিদা বৃদ্ধি ও সরবরাহ সংকটের কারণে আন্তর্জাতিকসহ দেশীয় বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। আসন্ন রমজান ঘিরে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার প্রবণতায় পণ্যের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।
গত এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে সাড়ে ৪ শতাংশ, চিকন চালের দাম সোয়া ৩ শতাংশ, আটার দাম ৯ শতাংশ, মসুর ডালের দাম ৯ শতাংশ, পেঁয়াজের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।
ভোজ্যতেলে দাম লিটারে সর্বোচ্চ বেড়েছে ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। প্রতিকেজি আদা ১৫ শতাংশ ও রসুন ১৪ শতাংশ, গরু ও খাসির মাংসের দাম প্রায় ৬ শতাংশ বেড়েছে। পাশাপাশি প্রতিকেজি চিনির দাম ৩ দশমিক ২৭ শতাংশ বেড়েছে।
প্রতিহালি ডিমের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ৭৮। এছাড়া জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে পরিবহণ খরচ ও সেচ খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় সবজির দাম বেড়েছে গড়ে ৪ শতাংশ।
এভাবে সব পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে। গত এক মাসের ব্যবধানে তো আয় বাড়েইনি। গত এক বছরের ব্যবধানেও বাড়েনি। উলটো অনেকের আয় কমেছে। ফলে ভোক্তাদের জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে আপস করে খাদ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ছাড় দিতে হয়েছে।
এর মধ্যে খাদ্যে বাজেট কমছে। একই সঙ্গে শিক্ষা ও চিকিৎসা ও যাতায়াত ভাড়া খাতে ব্যয় কমছে। ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভালো শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একই সঙ্গে খাদ্য বাজেটে কাটছাঁট করায় পুষ্টি গ্রহণের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ার শঙ্কা আছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপেও পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে অপুষ্টিতে ভোগার তথ্য উঠে এসেছে। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মানুষ যে কতটা অসহায় তা একজন ভোক্তার বক্তব্য থেকে পষ্ট হয়ে ওঠে।
রাজধানীর কাওরান বাজারে কথা হয় একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা মো. শফিউদ্দিনের (ছদ্মনাম) সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, দুই ছেলে, স্ত্রী ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে আমার পরিবার।
সেগুনবাগিচা এলাকায় থাকি। চাকরি করে বেতন পাই ৫৫ হাজার টাকা। এই বেতন দিয়ে গত দুই বছর আগেও পরিবার নিয়ে বেশ ভালো ছিলাম। কিন্তু এখন ভালো নেই।
এখন সংসারের চাহিদা মেটাতে পারছি না। অভাব কাটছে না। এই আয় দিয়ে ব্যয় সামলাতে পারছি না। প্রতিমাসেই ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। তিনি বলেন, যে বাসায় থাকি তার ভাড়া ২০ হাজার টাকা।
বড় ছেলে অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। প্রতি সেমিস্টারে (৪ মাস) তার পড়ার খরচ ৩৫ হাজার টাকা। সেমিস্টারে ফি’র জন্য প্রতিমাসে সাড়ে ৮ হাজার টাকা করে রাখতে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতসহ ছেলেকে হাতখরচ দিতে হয় মাসে সাড়ে ৪ হাজার টাকা। ছোট ছেলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। মাসে যাতায়াত খরচসহ স্কুল ফি ৬ হাজার টাকা।
এর পর পরিবারের ৫ সদস্যের জন্য মাসে চাল দরকার ৩৫-৪০ কেজি। ৬৫ টাকা কেজি ধরলেও প্রায় ২৬০০ টাকা হয়। মাসের শুকনা বাজারসহ মাছ-সবজিসহ অন্যান্য পণ্য কিনতে যায় ১০ হাজার টাকা।
গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল চার হাজার টাকা। এতেই বেতনের টাকা শেষ। এরপর আছে আমার নিজের অফিসে যাতায়াত খরচ, চিকিৎসা, ছেলেদের বইখাতা-কলমসহ অন্যান্য ব্যয়।
এক সময় ভালো খাওয়ার অভ্যাস ছিল। এখন সব ভুলে গেছি। বাজারে সবকিছুর দাম বাড়তি। চাল থেকে শুরু করে ডাল এমনকি চিনি-লবণ পর্যন্ত বাড়তি দরে কিনতে হয়। পেঁয়াজ ও তেলের দাম আকাশচুম্বী। মাংস তো কেনাই যায় না। সবজির দামও অনেক। তাই যা জুটছে তা কিনে খেয়েপরে বাঁচতে হচ্ছে। এসব দেখার কেউ নেই।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, পণ্যের বেসামাল দামে মধ্যবিত্ত অসহায়। তার চেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পড়েছে নিুআয়ের মানুষ। সব মিলে এই দুই শ্রেণির
মানুষের আয়ের সঙ্গে পরিবারের সব ব্যয় সামলাতে
পারছে না। প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছে। অনেকেই ব্যয় সামলাতে খাবার কেনার বাজেট কাটছাঁট করছেন।
কম করে পণ্য কিনছেন। এতে পুষ্টির অভাব হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে মানুষকে বের করে আনতে হবে। পণ্যের দাম কমাতে সঠিক উদ্যোগ নিতে হবে।
কঠোর বাজার তদারকির পাশাপাশি যেসব পণ্য আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয়, সেসব পণ্যের সব ধরনের ভ্যাট/শুল্ক প্রত্যাহার করতে হবে। মজুত বাড়াতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বেশি করে পণ্য ভর্তুকি মূল্যে খোলাবাজারে ছাড়তে হবে।
ব্যবসায়ীদের একটি নিয়মের মধ্যে আসতে হবে। এসবের পাশাপাশি যেসব পণ্য উৎপাদন করা হয়, কৃষি খাত থেকে বাজার পর্যন্ত সার্বিক তদারকির আওতায় আনতে হবে।
এছাড়া জীবনমান ভালো রাখতে জ্বালানি, পানি ও গ্যাসের দাম কমাতে হবে। তিনি আরও বলেন, মধ্যবিত্ত মানুষের এখন আর স্বাদ আহ্লাদ বলতে কিছু নেই। পরিবার নিয়ে আয়ের সঙ্গে ব্যয় সামলিয়ে চলাই দায় হয়ে গেছে। এখন এসব বিষয়ে ভাবার সময় এসেছে। কারণ দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, জ্বালানি তেলকে অর্থনীতির লাইফ লাইন হিসাবে অভিহিত করা হয়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ও মানুষের জীবনযাপনে সবকিছুতেই জ্বালানি তেলের ভূমিকা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম হু-হু করে বাড়ছে।
গত আগস্টে ছিল প্রতি ব্যারেল ৬০ ডলার। এখন তা বেড়ে ১১২ ডলারে উঠেছে। জ্বালানি তেলের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য পরিবহণ ব্যয় ৬০ শতাংশ বেড়েছে। ফলে সব ধরনের পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়েছে।
দেশে ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ৯ শতাংশ। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি তো আছেই। বিশ্ববাজারে এক মাস আগে প্রতিটন গমের দাম ছিল ২৩৫ ডলার। এখন তা বেড়ে হয়েছে ২৭৮ ডলার।
ফলে দেশের বাজারেও মনপ্রতি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বেড়েছে। খুচরা বাজারে কেজিতে ৩৫ থেকে বেড়ে ৪৫ টাকা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম প্রতিটন ছিল ১ হাজার ১০০ ডলার। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৮৩০ ডলার। দাম আরও বাড়ছে। এদিকে বাজারে সয়াবিনের লিটার বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকার বেশি দামে।
বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের দাম বাড়লেও দেশে এখনই এর প্রভাব পড়ার কথা নয়। কারণ এখন যেসব পণ্য বাজারে আছে সেগুলো আমদানি হয়েছে ৪ থেকে ৫ মাস আগে। যেসব পণ্য আসছে সেগুলোর এলসি খোলা হয়েছে কমপক্ষে ২ মাস আগে।
ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লেও দেশের বাজারে এখনই এসব পণ্যের দাম বাড়ার কথা নয়। বাড়তি দামে যেসব এলসি খোলা হয়েছে সেগুলো দেশে আসতে আরও দুই মাস সময় লাগবে। এগুলো পরিশোধন করে বাজারে আসতে লাগবে কমপক্ষে এক মাস।
ফলে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দাম বৃদ্ধির কথা নয়। কিন্তু ব্যবসায়ী এখনই দাম বাড়ানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। সরকার দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব নাকচ করে দিলে সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট করে দাম বাড়ানো হয়েছে।
বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, রমজানসহ ধর্মীয় উৎসবে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়িয়ে অতিমুনাফা করার চেষ্টা চালায়।
এবারও একই ঘটনা ঘটানোর পাঁয়তারা চলছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে বেশকিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধকে হাতিয়ার করে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। এতে ক্রেতার নাভিশ্বাস বাড়ছে।
তবে ভোক্তার স্বস্তি ফেরাতে আমরা বসে নেই। বিশেষ তদারকি টিম করে বড়-ছোট সব স্থানে অভিযান পরিচালনা করছি। যেখানে অনিয়ম সেখানেই পৌঁছে গিয়ে আইনের আওতায় আনছি। গত কয়েকদিনের তুলনায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। আশা করি পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
সূত্র জানায়, চালের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে সামান্য বেড়েছে। আমদানি করা চালের চেয়ে বাজারে দেশি চালই বেশি। দেশে ধানের বাম্পার ফলন হচ্ছে। মজুত ও সরবরাহও বেশি। তারপরও এর দাম কেজিতে ৪ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম কমতে শুরু করেছে। যুদ্ধ শুরুর পর প্রতিটন চিনি ৪০৯ ডলারে উঠেছিল। এখন তা কমে ৩৯৬ ডলারে নেমেছে। আগে ছিল ৩৫০ ডলার। আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম কমলেও খুচরা বাজারে কমেনি। প্রতিকেজি ৮৫ টাকা দরেই বিক্রি হচ্ছে।
ফার্মের মুরগি ও ডিমের দাম শীতে কম থাকে। কারণ এ সময়ে উৎপাদন বেশি হয় এবং মুরগির আয়ুষ্কাল কম থাকে বলে ব্যবসায়ীরা তা বাজারে দ্রুত বিক্রি করে দেন।
গত বছর এই সময়ে প্রতিকেজি ফার্মের মুরগি ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এখন বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা কেজি। ডিসেম্বরে এক ডজন ডিম ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে ১১৫ টাকা হয়েছে। এছাড়া ডাল, ছোলা, মসলা, মাছ, মাংসের দামও বেড়েছে।
এদিকে বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার হিসাবে দেখা যায়, করোনার কারণে গত দুই বছরে মানুষের আয় কমেছে। এতে আড়াই কোটি লোক নতুন করে দারিদ্র্যের আওতায় নাম লিখিয়েছিল।
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের ফলে কিছু মানুষের আয় বাড়ায় নতুন দারিদ্র্যের আওতা থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখনো ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়ে গেছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ভোগ্যপণ্যের মধ্যে বিশেষ করে চালের দাম বাড়লে স্বল্প আয়ের প্রায় ১ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। এ কারণে চালসহ ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে দারিদ্র্য বিমোচন প্রক্রিয়াটি টেকসই হবে না।