বিজ্ঞান শিক্ষাকে সহজ ও বোধগম্য করে তুলতে ‘খুব বেশি’ রক্ষণশীল ‘না হয়ে’ পরিভাষার পরিবর্তে প্রচলিত শব্দ এবং পরিচিত ‘টার্মস’ ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সোমবার দুপুরে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে তিনি এই পরামর্শ দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “উন্নয়নশীল দেশ থেকে আমাদের উন্নত দেশ হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সেটা করতে হলে ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞান চর্চা, বিজ্ঞান গবেষণা, সব বিষয়ে গবেষণা একান্তভাবে দরকার।”
এসব বিষয়ে ‘দৃষ্টি রেখে’ সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে জানিয়ে বিজ্ঞান শিক্ষা, বিজ্ঞান গবেষণা এবং গবেষণালব্ধ জ্ঞান মানুষের কল্যাণে যেন সহজভাবে ব্যবহার হয় তার উপর জোর দেন তিনি।
এক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, “যে শব্দগুলো বহুল প্রচলিত এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত সেগুলো যে ভাষাতেই আসুক, আমাদের সেটাই গ্রহণ করতে হবে।
“সেখানে পরিভাষা ব্যবহার করতে গিয়ে পরে কোনো কিছুই বুঝব না, বলতেও পারব না, সেটা যেন না হয়। কারণ সব জায়গায় প্রতিশব্দ করতে হবে বা পরিভাষা বলতে হবে আমি সেটা বিশ্বাস করি না।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বিজ্ঞানের এই যুগে বিজ্ঞান যেভাবে বিস্তার লাভ করছে, সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভাষাও রয়েছে, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ বা অন্য ভাষাও রয়েছে এর ভেতর যুক্ত হয়ে গেছে। আর আমাদের বাংলা ভাষায় কিন্তু প্রায় আট হাজারের উপর বিদেশি ভাষা আমাদের ভাষার সাথে মিলে গেছে।
“কাজেই সেদিক থেকে আমি মনে করি, আমরা এই ব্যাপারে খুব বেশি রক্ষণশীল না হয়ে প্রচলিত যে শব্দগুলো, প্রচলিত বিজ্ঞানের যে টার্মসগুলো সেগুলো দিয়েই কিন্তু বাংলা ভাষায় সহজভাবে বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থাটা করা যেতে পারে।”
এবিষয়ে ভাষা সংগ্রহ এবং সংরক্ষণসহ প্রয়োজনীয় গবেষণা ও প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে উদ্যোগী হতে বলেন সরকার প্রধান।
“এটা যেহেতু আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, মাতৃভাষা সংগ্রহ করা, মাতৃভাষার উপর গবেষণা করা সেটাও যেমন করবে সাথে সাথে এই ক্ষেত্রটাও দেখতে হবে যে, আমরা এই ভাষাকে কীভাবে মানুষের ব্যবহারের জন্য বা সহজলভ্য করা, সহজবোধ্য করা, সহজভাবে ব্যবহার করার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারি।”
এই বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করা ‘একান্তভাবে প্রয়োজন’ উল্লেখ করে জাতি হিসেবে সামনে এগিয়ে চলার জন্য বিজ্ঞানের বিস্তারের ওপর গুরুত্ব দেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।
কম্পিউটারে বাংলা ‘কনটেন্ট’ তৈরি করা এবং বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য বাংলা কি বোর্ড ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “কিন্তু সেটাকে আরও সহজ করে দেওয়া আর আমাদের যুক্তাক্ষরগুলো এত খটোমটো।
“কারণ আমি নিজেও এক সময় বাংলা টাইপ করা শিখেছিলাম। যেমন শেখাও যায় আবার তাড়াতাড়ি ভুলেও যেতে হয় প্র্যাকটিস না থাকলে। এটাই হচ্ছে বড় কথা। কাজেই এটাকে আরো সহজভাবে আমাদের তৈরি করা দরকার।”
এ বিষয়ে কাজ চলছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এটাকে আরও সহজভাবে তৈরি করার জন্য ইতোমধ্যেই কিন্তু কাজ চলছে। তবে এটা নিয়ে আরও গবেষণা করা এবং মানুষ যেন সহজে ব্যবহার করতে পারেন সেটার ব্যবস্থা নেওয়া।”
মোবাইল ফোনে বাংলা শব্দ ব্যবহার এবং বাংলা বার্তার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমাদের দেশের একবারে সেই গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কিন্তু এটা ব্যবহার হচ্ছে এখন। মানুষ সেভাবে ব্যবহার করছে। কাজেই এটা একটা শুভ লক্ষণ।”
মোবাইল ফোনে বাংলা অক্ষর ব্যবহার করার সুযোগ করে দেওয়ায় দেশের পিছিয়ে পড়া জনপদের মানুষ নিজেদের প্রয়োজনেই অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন হয়ে উঠছেন বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
“এর ফলে আমাদের দেশে যে সাধারণ মানুষ সবাই তো এখন মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, তাতে আমাদের যে নিরক্ষরতা মুক্ত বাংলাদেশ করার যে উদ্দেশ্য সেটাও কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়েছে।
“কারণ অনেকেই এই মোবাইল ফোন ব্যবহার করার স্বার্থে অক্ষরজ্ঞান নিজেরাই শিখে ফেলেছে। সেটা একটা বড় অবদান বলে আমি মনে করি।”
বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “একদিকে যেমন বিজ্ঞান শিক্ষা, পাশাপাশি আমরা, আপনারা লক্ষ্য করবেন আমরা বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় করে দিচ্ছি।
“কারণ একই, শুধু বিশ্ববিদ্যালয় থাকলে তার আকর্ষণ থাকে না। বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় করে সেখানে আমাদের ছেলে মেয়েরা যেন বহুমুখী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে,দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
“কারণ আমরা রক্ত দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছি। আমরা বাঙালি জাতি আর এই ভাষা আন্দোলন থেকে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলতে চাই।”
শেখ হাসিনা বলেন, “আমি বিশ্বাস করি আমাদের ছেলে মেয়েরা অত্যন্ত বিজ্ঞান মনস্ক, অনেক মেধাবী। এই মেধা বিকাশের একটু সুযোগ করে দিলে তারা অসাধ্য সাধন করতে পারে এবং যখন বিজ্ঞান মেলা হয়, প্রতিযোগিতা হয় সেখানে তাদের এই মেধার পরিচয় আমরা পাই। অনেক কিছুই তারা আবিষ্কার করতে পারে।”
শিশু এবং তরুণদের আরও বেশি করে এ ধরনের সুযোগ তৈরির করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এবং এসব বিষয়ে উৎসাহিত করতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন সরকার প্রধান।
অনুষ্ঠানে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার কথা তুলে ধরে দেশের উন্নয়নে সরকারের নেওয়া পরিকল্পনার বিষয়ে জানান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, “আগামীতে বাংলাদেশ কীভাবে চলবে তার কাঠামো তৈরি করে আমরা প্রেক্ষিত পরিকল্পনা দিয়ে যাচ্ছি ২০২১ পর্যন্ত। ২০০৮ এ আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যেই ঘোষণা দিয়েছিলাম- রুপকল্প ২০২১।
“আমরা সেটা বাস্তবায়ন করে আমরা আজকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি। কাজেই উন্নয়নশীল দেশ থেকে আমাদের উন্নত দেশ হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।”
করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে অনুষ্ঠানে স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে না পেরে ডিজিটাল মাধ্যমে সবার সঙ্গে যুক্ত হয়ে কথা বলতে বাধ্য হওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী।
“তবে আমি আশা করি যে করোনার এই প্রাদুর্ভাব থেকে আমরা মুক্তি পাব এবং বাংলাদেশ আবার এগিয়ে যাবে।”
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রান্ত থেকে অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বক্তব্য রাখেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো.আবু বকর সিদ্দিক স্বাগত ভাষণ দেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মো. বেলায়েত হোসেন তালুকদার ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।